সাক্ষাৎকার: মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীর বিক্রম
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকরা নেতৃত্ব দিয়েছেন। এ যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছেন অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপ-অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমান। তার স্বাধীনতার ঘোষণা জাতিকে অনুপ্রাণীত করেছে, উজ্জীবিত করেছে। এমন একটি ঘোষণা দিয়ে আওয়ামী লীগের ঈর্ষাভাজন হয়েছেন; এই ঘোষণা দেওয়ার পরিকল্পনা আওয়ামী লীগের ছিল না। জিয়াউর রহমানকে নানান ধরনের মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হয়। এই মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ইপিআরের বাঙালি সৈনিকেরা।
৫৪তম মহান স্বাধীনতা দিবসে বাংলা আউটলুককে দেওয়া এক একান্ত সাক্ষাৎকারে রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীর বিক্রম এসব কথা বলেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বাংলা আউটলুকের ঢাকা প্রতিনিধি।
হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, পড়াশোনা শেষ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ১৯৬৮ সালে কমিশন পান। প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে অফিসার হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭১ সালের মার্চে হাফিজ উদ্দিন তার ইউনিটের সঙ্গে যশোরের প্রত্যন্ত এলাকা জগদীশপুরে শীতকালীন প্রশিক্ষণে ছিলেন। ২৫ মার্চের পর তাদের ডেকে পাঠানো হয় এবং ২৯ মার্চ তারা সেনানিবাসে ফেরেন। পরে যশোর ক্যান্টনমেন্টে প্রথম অফিসার হিসেবে বিদ্রোহ করে যোগ দেন যুদ্ধে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধ শেষ করে ভারতে যান। যুদ্ধকালে তিনি কামালপুর, ধলই বিওপি, কানাইঘাট ও সিলেটের এমসি কলেজের যুদ্ধে বেশ ভূমিকা রাখেন। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বের জন্য তিনি বীর বিক্রম উপাধিতে ভূষিত হন।
বাংলা আউটলুক: প্রথম কারা অস্ত্র হাতে ধরেছিলেন?
মেজর হাফিজ: ১৯৭১ সাল জাতির জন্য গর্ব। অদ্ভূত এক সময়, একাত্তর সালে এই জাতিকে যারা দেখেনি, তারা এই জাতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অন্ধকারে থাকবে। পাকিস্তানিরা আমাদেরকে ঘৃণা করতো। তারা বলতো, ‘এরাতো মাছ খায়, নন মার্শল রেস্, এটা কোনো জাতিই না’। কিন্ত একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ প্রমাণ করেছে আমরা সাহসী জাতি। প্রথমে আমি প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ২০০ সৈনিক নিয়ে যশোর ক্যন্টনমেন্টে বিদ্রোহ করি। আমিই একমাত্র বিদ্রোহী অফিসার ছিলাম। ক্যান্টনমেন্ট থেকে বাইরে আসার পর দেখি হাজার হাজার ছাত্র-যুবক দৌঁড়ে আসছে আমাদের কাছে, এদের অধিকাংশই স্কুল কলেজের সাধারণ ছাত্ররা, সাধারণ মানুষ। এরা কেউই রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল না। আমাদের কাছে এসে বলছে, ‘স্যার আমাদেরকে অস্ত্র দেন, আমরা যুদ্ধ করব’।
বাংলা আউটলুক: মূলত কারা এই যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন?
মেজর হাফিজ: মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকেরা। যার সূচনা করেছিলেন অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপ-অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমান। তার স্বাধীনতার ঘোষণা জাতিকে অনুপ্রাণীত করেছে, উজ্জীবিত করেছে। আওয়ামী লীগের জন্য ঈর্ষার কারণ হয়েছেন তিনি। তারা ঘোষণা দিতে পারেননি। ঘোষণা দেওয়ার পরিকল্পনা তাদের ছিল না। সৈনিকদের পক্ষ থেকে মেজর জিয়া এ ধরনের একটি ঘোষণা দিয়ে তাদের (আওয়ামী লীগের) ঈর্ষাভাজন হয়েছেন। নানান ধরনের মিথ্যা অপবাদ তাকে দেওয়া হয়। মূলত যুদ্ধ শুরু করেছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ইপিআরের বাঙালি সৈনিকেরা। এদের সাথে যোগ দিয়েছে হাজার হাজার ছাত্র, যুবক। সুতরাং এই স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা কেউ আলাদাভাবে দেখতে পারবে না।
বাংলা আউটলুক: কোন প্রেক্ষাপটে মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন?
মেজর হাফিজ: মুক্তিযুদ্ধের অনেকগুলো ফেইস বা ধাপ ছিল। এর প্রথম উন্মেষ ঘটে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। তার পর দীর্ঘ দিন পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে ছাত্ররা। অবশেষে এসেছে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ। ৭০ সালের ভোটে যিনি জিতেছিলেন, শেখ মুজিবুর রহমান, তিনি অবশ্যই বড় মাপের নেতা। কিন্তু তার সংগ্রাম ছিল পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ত্বশাসনের আন্দোলন। বেলুচিস্তান, পাঞ্জাব, ফর্টিয়ার প্রভিঞ্জ, সিন্ধু এদের সমান ভাগ তিনি চেয়েছিলেন পাকিস্তানি কাঠামোয়। পূর্ব পাকিস্তানকে যেন বঞ্চিত করা না হয়, এটিই ছিল ২৪ বছরের আওয়ামী লীগের আন্দোলন। কিন্তু ২৫ মার্চ ভয়াবহ গণহত্যার পর বাঙালিরা তখন নামে এক দফার আন্দোলনে এবং এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর’র সৈনিকেরা, হাজার হাজার ছাত্র যুবকেরা, গ্রাম-গঞ্জের সাধারণ মানুষ এসে এই যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। রাজনৈতিক নেতৃত্ব পাকিস্তানের ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। সাধারণ মানুষ তাদেরকে ভোট দিয়েছিলেন, এতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু তারা স্বাধীনতার কথা কখনো চিন্তা করেনি। ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের পর বাঙালিদের স্বাধীনতার কথা ভাবতে বাধ্য করা হয়েছে। একটি ঘুমন্ত জাতি জেগে উঠেছিল। আমরা যদি সৈনিকেরা সশস্ত্র নেতৃত্ব না দিতাম, এ দেশ আজও স্বাধীন হতো না, আজও পাকিস্তান থাকতো। আমরা সামরিক বাহিনীর সদস্যরা অপেক্ষায় ছিলাম, শেখ মুজিব হয়তো স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন, সেটি যখন তিনি দেননি এবং তার কাছে স্বাধীনতার ঘোষণার জন্য যখন তাজউদ্দিন আহম্মেদ টেপ রেকর্ডার নিয়ে গিয়েছিলেন ২৫ মার্চ রাত সাড়ে ৯টার দিকে, তখন তিনি (শেখ মুজিব) বলেছিলেন, ‘আমি কোনো স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে পারব না, তাহলে আমি বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত হব’। সুতরাং পাকিস্তান ভাঙার দায়িত্ব তিনি নিতে চাননি। কিন্তু জনতা তখন পাগল-পাড়া, পাক বাহিনীর এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যই প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল বাঙালি সৈনিকেরা। ১৯৭১ সালের এই যুদ্ধ ছিল জনতার যুদ্ধ, সাধারণ মানুষের যুদ্ধ। এটি কোনো রাজনৈতিক দলের যুদ্ধ নয়।
বাংলা আউটলুক: কোন ধরনের মানুষ সেদিন সাথে পেয়েছিলেন যুদ্ধে?
মেজর হাফিজ: বিভিন্ন পেশার লোক ছিল। আমি বেনাপোল অঞ্চলে যুদ্ধ করেছি। সেখানে বাসের ড্রাইভার, হেলপার, কৃষক, মুদি দোকানদার এমনকি ওই এলাকায় যারা স্মাগলার ছিল, সেই সমস্ত যুবকরাও এসে আমাদের সাথে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। কারণ জাতির তখন মহা দুর্দিন। এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে নিজেদের অস্তিত্বের প্রমাণ দিতে হয়েছে।
বাংলা আউটলুক: স্বাধীনতার এত বছর পরও কে ঘোষণা দিয়েছে, কে দেয়নি- এই বিতর্ক করে মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করা হচ্ছে কি-না?
মেজর হাফিজ: অবশ্যই অপমান করা হচ্ছে। এটি হচ্ছে বর্তমান শাসক দল যে ইতিহাস বিকৃত করেছে তারই একটি প্রমাণ। সবাই জানে মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু তারা প্রচার করে, শেখ মুজিবুর রহমান রাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই একটি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন, টেলিফোনে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন ইপিআর’র সিগনাল সেন্টারে। ইপিআর’র সিগনাল সেন্টার থেকে বর্হিঃবিশ্বে এটি ইথারের মাধ্যমে ছড়িয়ে গেছে। এই মেসেজটি ধরেছে চট্টগ্রামের বহিঃনোঙ্গরে নোঙ্গর করা একটি বিদেশি জাহাজ। সেই জাহাজ থেকে ফোন করে নাকি জানিয়েছে চট্টগ্রামের কোন এক নেতাকে। প্রকৃতপক্ষে ২৩ মার্চ থেকেই পিলখানায় বাঙালি অফিসারদেরকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেখানে পাকিস্তানিরা নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল। ২৫ মার্চ রাতে প্রথমেই ইপিআরের শত শত সৈনিককে হত্যা করা হয়েছিল। কিন্তু এই মেসেজ পাঠানো, রিসিভ করা এসব মিথ্যাচারের কোনো প্রয়োজন নেইতো। এমনিতেই শেখ মুজিব অনেক বড় নেতা। তার ডাকে অসহযোগ আন্দোলন হয়েছিল। আমরাতো স্বীকার করি, এমনকি জিয়াউর রহমান সাহেবও তো সেটা স্বীকার করেন। কিন্তু যেহেতু তারা স্বাধীনতা নিয়ে চিন্তা করেনি, স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদের অংশগ্রহণ ছিল না, সে জন্যই সাধারণ সৈনিকদের, সাধারণ মানুষের কৃতিত্বকে ম্লান করে দেবার জন্যই এই কল্প কাহিনীর অবতারণা করেছেন তারা।
বাংলা আউটলুক: আওয়ামী লীগ কেন এই বিষয়টি নিয়ে এমন করে, আপনার কী মনে হয়?
মেজর হাফিজ: আওয়ামী লীগ ঘটনাচক্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছে। মুক্তিযুদ্ধতো সাধারণ মানুষ করেছে। তার পর উদার হৃদয়ে দেশের মানুষ তাদেরকেই ক্ষমতায় মেনে নিয়েছে। প্রথম দিন থেকেই মানে ১৯৭২ সাল থেকেই তারা গণতন্ত্র হত্যার চেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। ১৯৭২ সালে ডাকসুর ব্যালট পেপার তারা হাইজ্যাক করেছে। ১৯৭৩ সালে যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছিল, সেটি ছিল কারচুপিতে ভরপুর। প্রার্থী হাইজ্যাক, ব্যলটবাক্স ছিনতাই এসব দিয়েই তাদের আসল চরিত্র প্রকাশিত হয়েছে। তাদের চূড়ান্ত রূপ প্রকাশ পেয়েছে ৭৫ সালে, বাকশাল ঘোষণার মধ্য দিয়ে। সুতরাং, গণতন্ত্রে যে তারা বিশ্বাস করে না, সেটি আমরা আগেই দেখতে পেয়েছি। বর্তমানে এই যে ১৬ বছর ধরে দেশ শাসন করছে, দুর্নীতিতে তারা সিদ্ধহস্ত। সাধারণ মানুষের কোনো অধিকার নেই। যেই গণতন্ত্রের জন্য ৭১ সালে লড়াই হয়েছে, সেই গণতন্ত্রকেই তারা নির্বাসনে পাঠিয়ে দিয়েছে। মানুষের ভোটাধিকার নেই, বাক স্বাধীনতা নেই, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নেই। একটি পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র শাসনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে না। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানই স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়েছেন এবং তার দল বিএনপি সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের দল, তারাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন করে আসছে।
বাংলা আউটলুক: এমন পরিস্থিতিতে এই স্বাধীনতা দিবসে সাধারণ মানুষের প্রতি কী আহ্বান?
মেজর হাফিজ: আমরা বয়সে যখন তরুণ ছিলাম, আরো যারা শহীদ হয়ে গেছেন তাদের রক্তের বিনিময়ে, অনেক ত্যাগের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা ও একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মোটেই বাস্তবায়িত হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান চেতনা ছিল- গণতন্ত্র। আজ সেই গণতন্ত্রই দেশ থেকে নির্বাসিত। সুতরাং, জনগণের প্রতি আমাদের উদাত্ত্ব আহ্বান, রাজপথে নেমে এসে কঠিন আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আবারো বাস্তবায়িত করে গণতন্ত্রকে আবারো দেখতে চাই। রাষ্ট্র শাসনের মধ্যেই মানুষের মতামত এবং অধিকার প্রতিফলিত হচ্ছে এটি দেখতে চাই। মহান মুক্তিযুদ্ধের যে লক্ষ্য ছিল, সাম্য-মানবিক মর্যাদা-গণতন্ত্র এই লক্ষ্যগুলো প্রতিষ্ঠিত করার লড়াইয়ে সাধারণ মানুষকে আহ্বান জানাই। বর্তমান দুঃশাসনের অবসান ঘটাতে রাজপথে নেমে আসুন।
বাংলা আউটলুক: আপনারা যারা মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন, তারা কী পারবেন এই দুঃশাসনের বিরুদ্ধে লড়ে জনগণের অধিকার ফিরিয়ে আনতে?
মেজর হাফিজ: আমার বিশ্বাস আছে। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান যে উদাহরণ সৃষ্টি করে গেছেন সততা এবং দেশপ্রেমের, সেটি অবলম্বন করে বিএনপি দেশে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। এই সংগ্রামে অবশ্যই আমরা বিজয়ী হবো। মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যসমূহ বিএনপির নেতৃত্বেই একদিন বাস্তবায়িত হবে। এই দেশের লড়াকু জনগণ নিশ্চয়ই তাদের অধিকার ফিরে পাবে।
- ২৬ মার্চ, ২০২৪
No comments:
Post a Comment