Search

Sunday, November 3, 2024

তরুন প্রজস্ম এবং ৭ই নভেম্বরের বিপ্লব


বাংলাদেশে ১৫ থেকে ২৫ বয়সী কিশোর-কিশোরী এবং তরুন-তরুনীর সংখ্যা  তিন কোটির ঘরে, যা জনসংখ্যার ২০ শতাংশ। ছাত্র-জনতার জুলাই ‘২৪ বিপ্লবের মাধ্যদিয়ে এরা আমাদের সকলের শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা অর্জন করছে। অকুতোভয় আন্দোলনকারীরা বন্দুকের নলের সামনে বুক পেতে দিয়েছে; হুমকি-ধামকি, ভয়-ভীতি, নির্যাতন-গুম তাদেরকে লক্ষ্যথেকে বিচ্যুত করতে পরেনি। পকেটে নাম-ঠিকানা, পিতা-মাতার নাম লেখা কাগজ নিয়ে রাস্তায় নেমেছে - এদের  অনেকে ঘরে ফিরে আসেনি। তদের সংকল্প এবং আত্নত্যাগ সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছে এবং ছাত্র-জনতার যৌথ আন্দোলন শেখ হাসিনার রাষ্ট্র ধ্বংসকারী ফ্যাসিস্ট সরকারকে উৎখাত করেছে। 

স্বাধীন বাংলাদেশে তিনটি দিন ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে এবং বাংলাদেশকে একটি বৈষম্যহীন, গনতান্ত্রিক, সার্বভৌম এবং আত্মমর্যাদাশীল রাষ্ট্র গঠনের ধারায় ফিরিয়ে এনেছে। দিবস তিনটি হলো ৭ই নভেম্বর ১৯৭৫, ৬ই ডিসেম্বর ১৯৯০ এবং ৫ই আগষ্ট ২০২৪। ৭ই নভেম্বরের তাৎপর্য  আমরা প্রবীনরা যেভাবে উপলব্ধি করতে পরি, আজকের তরুন প্রজন্মের জন্য তা সহজ নয়। তাদের জন্ম ২০০০ থেকে ২০১০ এর মধ্যে এবং ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর দূর অতীতের কথা।  আশার কথা আমাদের কিশোর এবং তরুনেরা অনেক তথ্য, উপাত্ত নিজ উদ্যোগে সংগ্রহ করে এবং পর্যালোচনার মাধ্যমে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিচারের চেষ্টা করে।  তা না হলে মুজিবময় পাঠ্যপুস্তক, শপথ বাক্য আর আওয়ামী লীগ সরকারের মুজিব বন্দনার বিপরীতে ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠত না। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার সুবাদে প্রতিনিয়ত তারুন্যে সংস্পর্শে আসতে হয়।  তাদের সচেতনতা, চিন্তার গভীরতা এবং নতুন কিছু গড়ার আকাক্ষা প্রতিনিয়ত চমকিত করে।  এদের মাঝেই বেঁচে থাকবে আমাদের ইতিহাস, অর্জন এবং গৌরব। তাদের কথা বিবেচনায় ৭ই নভেম্বরের বিপ্লবের ঘটনাপ্রবাহ এবং বাংলাদেশের ইতিহাসে এর অপরিহার্যতা নিয়ে আমার আজকের উপস্থাপনা।  আমার আশা এ লোখাটি তরুনদের ৭ই নভেম্বরের বিপ্লব নিয়ে আরও জানার আগ্রহ তৈরি করবে এবং তাদের মাঝে এই বিপ্লবের ভাবাদর্শ জীবিত থাকবে। 

৭ই নভেম্বরের পটভূমি রচিত হয় আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা লগ্নে।  ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী যখন নিরস্ত্র বাঙালীদের ওপর বর্বরের মতো ঘৃণ্য হামলা চালায়। সে রাতে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ চলে যান আত্মগোপনে। জনগণ তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। এই ক্রান্তিকালে ২৬শে মার্চ বিহ্বল জাতী মেজর জিয়াউর রহমানের চট্রগ্রাম রেডিও ষ্টেশন থেকে স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধের ঘোষনায় সম্বিত খুজে পায়।  অথচ ফ্যাসিন্ট শেখ হাসিনার সরকার যেকোনো ছুতায় জিয়াউর রহমানের মর্যাদাহানিতে কুণ্ঠা বোধ করেনি, চক্ষু লজ্জারও ধার ধারেনি। স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে আদালতের রায়ের আড়ালে মেজর জিয়াউর রহমানের প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করেছে।

অথচ ২৫ মার্চ রাতে তাজউদ্দীন আহমদ ও কর্নেল ওসমানী পীড়াপীড়ি করেও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা আদায় করতে পারেননি। সে সময়কার যে কেউ এক বাক্যে স্বীকার করবেন তারা জিয়াউর রহমানের ঘোষণা শুনেছেন এবং সেটাই তাদের অনুপ্রাণিত করেছে। আমরা  স্বাধীনতার ঘোষণা রেডিওতে প্রথম কে কখন পাঠ করেছে, তার বিতর্কে যদি না-ও যাই, আমাদের মানতে হবে জিয়াউর রহমানের বলিষ্ঠ ও আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠের ঘোষণার ব্যাপক প্রভাব ছিল। এটা কেবল আহ্বান নয়, ইতোমধ্যে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করে দেওয়া বিদ্রোহী সামরিক কর্মকর্তার ঘোষণা। জনগণ নিশ্চিত হয় প্রতিরোধ যুদ্ধের সূচনায়। আর জিয়াউর রহমান ২৫ থেকে ২৬ মাঝরাতে বিদ্রোহ করে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের পশ্চিম পাকিস্তানি কমান্ডিং অফিসার ও সেনা কর্মকর্তাদের গ্রেফতার না করলে ভাষণ দেওয়ার জন্য রেডিও স্টেশন থাকত না।

জিয়াউর রহমানের এই ভাষণের গুরুত্ব সুদূরপ্রসারী। একজন অপরিচিত সামরিক কর্মকর্তা থেকে তিনি হয়ে ওঠেন সবার পরিচিত ও সম্মানিত। মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে তিনি ছিলেন ব্যাপক জনপ্রিয় এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের কাছে ঈর্ষণীয়। ঠিক একই কারণে এবং কাছাকাছি পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের জিয়ার ভাষণ দেশকে গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরিয়ে আনে।

শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগের সরকার এমন কী করেছিল যে স্বাধীতার চার বছরের মাথায় দেশে গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি হয়? স্বল্প পরিসরে স্বাধীনতা-উত্তর ৭২ থেকে ৭৫ সালের আওয়ামী দুঃশাসন বর্ণনা করা কষ্টসাধ্য কাজ। এর কদর্যতা ব্যাপক বিস্তৃত ও ভয়ংকর। শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেওয়া হলেও তিনি ছিলেন প্রথমত তার পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের রক্ষক এবং দলের প্রতিপালক ও প্রশ্রয়দাতা। তিনি জনগণের বন্ধু হতে পারেননি অথবা হতে চাননি। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং বিভিন্ন দেশ থেকে ব্যাপক পরিমাণে খাদ্যশস্য ও আর্থিক সাহায্য এসেছিল, ৭২ থেকে ৭৫ সালের আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার এতটাই দুর্নীতিগ্রস্ত ছিল যে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন হওয়া দেশের অসহায়-অনাহারক্লিষ্ট মানুষের জন্য বিদেশ থেকে আসা ত্রাণ আত্মসাৎ করতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। দলীয় ছত্রচ্ছায়ায় চোরাকারবারি, কালোবাজারি ও মজুতকারীতে দেশ ছেয়ে যায়। চালের সংকট এতটাই প্রকট হয়ে ওঠে যে দুবেলা ভাত খাওয়া বিলাসিতায় পরিণত হয়। ’৭২ থেকে ৭৪ সালের খরা ও বন্যা আমলে নিলেও আমাদের দুবেলা খাওয়ার মতো পর্যাপ্ত খাদ্য ছিল, তবু ১৯৭৪ সালের শেষ দিকে সারা দেশে দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ, অনাহারে মারা যায় এক লাখের বেশি মানুষ। যারা এখনও ওই দুর্ভিক্ষের জন্য শেখ মুজিবের ব্যর্থতা মানতে চান না, তাদের নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য সেনের গবেষণা পড়ে দেখতে অনুরোধ করছি। তিনি তথ্য-প্রমাণ দিয়ে উপসংহার টেনেছেন যথেষ্ট খাদ্য সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল।

দেশের আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমান আইনশৃঙ্খলা উন্নয়নে সেনাবাহিনীকে তিনবার মাঠে নামান। তারা দৃঢ়তার সঙ্গে অপরাধীদের ধরলেও আওয়ামী নেতা এবং সর্বোপরি শেখ মুজিবের সুপারিশে চিহ্নিত অপরাধীরাও ছাড়া পেয়ে যায়। খুনের মামলার আসামিরাও প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াতো। পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করার বদলে তিনি তৈরি করেন লাল বাহিনী ও রক্ষীবাহিনীর মতো মিলিশিয়া বাহিনী, যাদের কাজ ছিল প্রতিবাদী, সমালোচক ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের নির্যাতন ও গুম-খুনের মাধ্যমে নিস্তব্ধ করা। রক্ষীবাহিনী ছিল মুজিব বাহিনীর উত্তরসূরি এবং তৈরি করা হয়েছিল ভারতীয় গোয়েন্দাদের তত্ত্বাবধানে। বিতর্কিত মুজিব বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের গোয়েন্দা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে তৈরি করা হয়, যা বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার ও মুক্তিবাহিনীর কমান্ডের বাইরে ছিল।

মুজিব বাহিনী গঠনের উদ্দেশ্য ছিল শেখ মুজিবের নিরঙ্কুশ একচ্ছত্র ক্ষমতা নিশ্চিত করা। রক্ষীবাহিনীর অফিসাররা ভারতের দেরাদুন থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আবার দেশে সাভারের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে মেজর রেড্ডি নামক একজন ভারতীয়র তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ পেত। ভারত বাংলাদেশে বারবার একই ভুল করেছে, দেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষা আমলে না নিয়ে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে। রক্ষীবাহিনী ছিল জনমনে আতঙ্কের প্রতীক এবং সেনাবাহিনীর অসন্তোষের কারণ। রক্ষীবাহিনীর অপকর্ম এত ব্যাপক হয়েছিল যে তাদের দায়মুক্তি দিয়ে শেখ মুজিব ১৯৭৪ সালে আইন পাস করেন। ৩৪ বছর পর শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা একই পন্থা অবলম্বন করেছিলেন র‌্যাব দিয়ে। আমাদের দুর্ভাগ্য পুলিশ ও সেনাবাহিনীর মতো গৌরবজনক ও ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের কিছু সুবিধাভোগী কর্মকর্তাও শপথ ভঙ্গ করে শেখ হাসিনার জনবিরোধী কাজে শরিক হয়েছিলেন।

ভারত আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে সর্বোত সাহায্য করেছে, এটি অনস্বীকার্য। ১২ হজারের মতো ভারতীয় সেনাসদস্য আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন। ১৯৭২ সালে বিধ্বস্ত বাংলাদেশ মূলত ভারতের খাদ্য সহায়তায় বেঁচে ছিল। এ সত্ত্বেও ভারতের অভিপ্রায় ও আচরণ দেখে প্রবাসী সরকার ও মুক্তি বাহিনীর মাঝে অস্বস্তি শুরু হয় ১৯৭১ সাল থেকেই, যা দূর হওয়ার বদলে আরও ঘনীভূত হয়। তখন মওলানা ভাসানী এক বিখ্যাত উক্তি বলেছিলেন, ‘পিন্ডির গোলামির জিঞ্জির ছিন্ন করেছি দিল্লির দাসত্ব করার জন্য নয়’। ১৬ ডিসেম্বর পকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে মুক্তিবাহিনী ও প্রবাসী সরকারকে দূরে রাখা হয়। আত্মসমর্পণকারি পাকিস্তানি বাহিনীর সব অস্ত্র ও গোলাবারুদ ভারতীয় সেনাবাহিনী নিয়ে যায়। কিছু লুটতরাজেরও অভিযোগ পাওয়া যায়। ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে ভারত একতরফা পানি প্রত্যাহার করে। শেখ মুজিব ও ইন্দিরা গান্ধীর স্বাক্ষরিত ২৫ বছরের মৈত্রী চুক্তিকে জনগণ সন্দেহের চোখে দেখে। এই চুক্তির একটি ধারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ গোলোযোগে ভারতকে হস্তক্ষেপের অধিকার দেওয়া হয়েছিল। সর্বোপরি শেখ মুজিবের দুঃশাসন যত দীর্ঘায়িত হতে থাকে, জনগণের মধ্যে ভারতবিদ্বেষ তত দানা বাঁধতে থাকে।

শেখ মুজিবুর রহমান দেশের সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে এবং চারটি ছাড়া সব সংবাদপত্র বন্ধ করে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে বাকশাল গঠনের মাধ্যমে একদলীয় শাসন কায়েম করেন। জনগণকে সংসদীয় গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখানো শেখ মুজিবুর রহমান আজীবন ক্ষমতায় থাকার বন্দোবস্ত করেন। সব সমালোচনা ঝেড়ে ফেলে পুরোদস্তুর ফ্যাসিস্ট শাসক বনে যান। প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ তাজউদ্দীন আহমদ আক্ষেপ করে শেখ মুজিবুর রহমানকে বলেছিলেন, ‘মুজিব ভাই, এরপর বুলেট ছাড়া আপনাকে সরানোর কোনো উপায় থাকল না।’

মুজিব শাসনের ব্যর্থতা এতটা প্রকট হতে থাকে যে দেশের মানুষের স্বাধীনতার আনন্দ ফিকে হতে হতে বিলীন হয়ে যায়। অভাব, দুঃশাসন, দুর্নীতি, অরাজকতা ও জুলুমে জর্জরিত জনগণ মুক্তির উপায় খুঁজতে থাকে। এমন পটভূমিতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর কতিপয় ক্ষুব্ধ মেজর শেখ মুজিবকে হত্যার মাধ্যমে স্বৈরাচারী সরকারকে উৎখাত করে। শেখ মুজিবকে হত্যা ছিল একটি coup d’état (ক্যু দেঁতা), যার কাছাকাছি পরিশব্দ অভ্যুত্থান। এর অর্থ হঠাৎ বল প্রয়োগের মাধ্যমে একটি ছোট গোষ্ঠী দ্বারা কোনো সরকারপ্রধানকে উৎখাত করা। বিপ্লব হয় তখন, যখন আপামর জনসাধারণ আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার উৎখাত করে এবং রাষ্ট্র পরিচালনার ধরনে পরিবর্তন আনে। যেমন ছাত্র-জনতার জুলাই ২০২৪ আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতন একটা সফল বিপ্লব। একইভাবে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতা দেশকে অরাজকতার হাত থেকে উদ্ধার করা সফল বিপ্লব।

শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর দেশে একটা অস্বাভাবিক সরকার প্রতিষ্ঠা হয়। সংবিধান অনুযায়ী উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম রাষ্ট্রপতি হওয়ার বিধান থাকলেও অভ্যুত্থানে জড়িত মেজররা খন্দকার মোশতাকের হাতে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব অর্পণ করে। সব বাহিনীর প্রধানরা খন্দকার মোশতাকের আনুগত্য স্বীকার করেন, সংসদ বলবৎ থাকে এবং নতুন মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণ করে। নতুন মন্ত্রীদের অধিকাংশই শেখ মুজিবুর রহমানের মন্ত্রিসভার সদস্য। খন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রপতি হলেও বঙ্গভবনে অবস্থান নিয়ে অভ্যুত্থানের মাস্টারমাইন্ড মেজর ফারুক ও মেজর রশীদ সব সিদ্ধান্ত দিতেন। বঙ্গভবন পাহারায় ফারুকের ট্যাংক বাহিনী নিয়োজিত থাকে। শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারকে হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের দায়মুক্তি দিয়ে অধ্যাদেশ জারি করা হয়। আগস্টের শেষে জাতীয় চার নেতাকে কারান্তরীণ করা হয়। 

সেনাবাহিনীর উচ্চপর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ রদবদল করা হয়। উপ-সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বীর উত্তমকে তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কাজী মোহাম্মদ সফিউল্লাহ বীর উত্তমের স্থলাভিষিক্ত করা হয়। সফিউল্লাহ কোনো দিনই যোগ্য অথবা বলিষ্ঠ সেনাপ্রধান ছিলেন না। জিয়াউর রহমানের জুনিয়র হওয়া সত্ত্বেও শুধু শেখ মুজিবের আনুগত্যের কারণে এবং জেনারেল ওসমানীর প্রিয়ভাজন হওয়ায় সফিউল্লাহ সেনাপ্রধান হন। একটি বিতর্কিত পদায়ন হয়, নিয়মবহির্ভূতভাবে দিল্লিতে প্রশিক্ষণরত ব্রিগেডিয়ার হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে তিন জন সিনিয়র অফিসার ডিঙিয়ে উপ-সেনাপ্রধান নিযুক্ত করা হয় এবং মেজর জেনারেলে উন্নীত করা হয়। মাত্র এক বছর আগেই সেনাপ্রধান সফিউল্লাহ তাকে এভাবেই প্রশিক্ষণে থাকা আবস্থায় কর্নেল থেকে ব্রিগেডিয়ার জেনারেলে পদোন্নতি দেন। ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানে জড়িত মেজরদের সঙ্গে এরশাদের সক্ষ্য এবং তাদের প্রতি আসকারা সেনাবাহিনীতে সর্বজনবিদিত।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশারফ বীর উত্তমের পদপদবি অপরিবর্তিত থাকে। সফিউল্লাহ ও খালেদ মোশারফের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের যোগাযোগ সর্বাধিক ছিল। সফিউল্লাহর পরবর্তীতে সেনাপ্রধান হওয়ার স্বপ্ন লালন করছিলেন খালেদ মোশাররফ। শেখ মুজিব জিয়াকে সেনাবাহিনী থেকে অপসারণের ব্যবস্থা প্রায় পাকা করে ফেলেছিলেন। ১৫ আগস্ট-পরবর্তী পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবে খালেদ মোশাররফ মনক্ষুণ্ন ছিলেন।

সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে জিয়াউর রহমানের মতো যোগ্য অফিসার সে মুহূর্তে দ্বিতীয় কেউ ছিলেন না। কিন্তু তার যোগ্যতা, স্বাধীনচেতা মনোভাব ও জনপ্রিয়তা অভ্যুত্থানে জড়িত মেজরদের উদ্বেগের বিষয় ছিল। এ দুটি বিষয় মাথায় রেখে সেনাপ্রধানের ওপর চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ পদ তৈরি করা হয় এবং মেজর জেনারেল এম খলিলুর রহমানকে নিয়োগ দেওয়া হয় এবং তারও ওপরে জেনারেল ওসমানীকে প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা করা হয়। জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা সীমিত করে দেওয়া হয়। প্রকারান্তরে অভ্যুত্থানে জড়িত ওসমানী ও খলিলুর রহমান গং সামরিক বাহিনী পরিচালনা করতে থাকে।

ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সরকার জিয়াউর রহমানের সম্মানহানি এবং তার বিরুদ্ধে কুৎসা রটাতে এতটাই মনোযোগী ছিল যে অনেক সত্য ঘটনা জনগণের কাছে অজানা থেকে গেছে। ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের মাস্টারমাইন্ড মেজর ফারুক সম্পর্কে খালেদ মোশাররফের ভাগ্নে এবং তার ছত্রচ্ছায়ায় ঢাকা সেনানিবাসে দম্ভের সঙ্গে ঘুরে বেড়াত। তার চেয়েও ভয়ংকর কথা হলো, ১৯৭৩ সালে তিনি অভ্যুত্থানচেষ্টা করে ব্যর্থ হন, যা সেনাবাহিনী জ্ঞাত ছিল। তবু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং মিসর থেকে উপহার পাওয়া নতুন ৩২টি ট্যাংক তার হাতেই ন্যাস্ত করা হয়। মেজর ফারুকের ট্যাংক বাহিনী সরাসরি সেনাপ্রধানের কমান্ডে ছিল। অপরদিকে অভ্যুত্থানে মেজর ফারুকের প্রধান সহযোগী মেজর রশীদ সম্পর্কে ফারুকের ভায়রা ভাই। প্রশিক্ষণ শেষে তার পোস্টিং নিয়মিতভাবে যশোরে হয়েছিল। কিন্তু ফারুক খালেদ মোশাররফকে ধরে রশীদের পোস্টিং বাতিল করে ঢাকায় রাখার বন্দোবস্ত করেন। 

শেখ মুজিব নিহত হওয়ার ঘটনা জনগণ একরকম মেনে নেয়। একমাত্র কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম ছাড়া আর কেউ প্রতিবাদ অথবা প্রতিরোধ করতে বের হননি। মজলুমের ওপর জুলুমবাজ রক্ষীবাহিনী, লাল বাহিনী, যুবলীগ, ছাত্রলীগ–এদের কাউকে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি, ভোজবাজির মতো উধাও হয়েছিল। অথচ তখনো আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায়। অত্যাচারী-জালেমদের হম্বীতম্বী সব সময়  অসহায়, দুর্বল মানুষের সঙ্গে হয়। শক্ত প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হলে পলায়নপরতা তাদের একমাত্র গত্যন্তর। গত ৫ আগস্ট আমরা একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখলাম। স্বাধীন বাংলাদেশে এমন গণপলায়ন দুবারই হয়েছে, শেখ মুজিব নিহত হওয়ার পর এবং তার কন্যা শেখ হাসিনা ছাত্র-জনতার আন্দোলনে উৎপাটিত হওয়ার পর। শেখ মুজিব নিহত হওয়ার পর অবস্থা এতটাই স্বাভাবিক ছিল যে পরবর্তী দিনগুলোতে ১৪৪ ধারা জারি করারও প্রয়োজনীয়তা দেখা যায়নি। উল্টো জনগণের মাঝে উৎসবের আমেজ দেখা যায়। এক দিনের ব্যবধানে চাল কেজিপ্রতি ৭ টাকা থেকে ৪ টাকায় নেমে আসে। অধিকাংশ চোরাকারবারি, মজুতদার ও অপরাধীরা গা ঢাকা দেয়। কিন্তু সেনাবাহিনীতে চলতে থাকে চাপা অস্বস্তি।

জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে একমাত্র ব্রিগেডিয়ার শাফায়াত জামিল বীর বিক্রম প্রকাশ্যে খন্দকার মোশতাক সরকারের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ এবং অভ্যুত্থানে জড়িত মেজরদের বঙ্গভবনে অবস্থানের বিরোধিতা করেন। তিনি শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনতে সোচ্চার ছিলেন। শাফায়াত জামিল শেখ মুজিবের অত্যন্ত আস্থাভাজন ছিলেন এবং তার অধীনে মেজর রশীদের অভ্যুত্থানে জড়িত হওয়া তার জন্য গ্লানিকর ছিল। শাফায়াত জামিল বেশ কয়েকবার জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য অভ্যুত্থানে জড়িত মেজরদের বঙ্গভবন থেকে সেনানিবাসে ফিরিয়ে আনতে উদ্বুদ্ধ করেন। জিয়াউর রহমান এ বিষয়ে তাড়াহুড়োর পক্ষপাতী ছিলেন না। উপরন্তু জিয়াউর রহমানের ওপর দুটি পদ তৈরি করে তাকে অকার্যকর করে রাখা হয়েছিল। জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীতে অবশিষ্ট শৃঙ্খলা ধরে রাখতে সচেষ্ট ছিলেন। এখানে মনে রাখতে হবে, সেনাবাহিনীতে কেউই চেইন অব কমান্ডের বাইরে নয়, স্বয়ং সেনাপ্রধানসহ। সেনাপ্রধানকেও দেশের গঠন ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিয়ম অনুযায়ী হয় রাষ্ট্রপতি অথবা প্রধানমন্ত্রী অথবা প্রতিরক্ষামন্ত্রীর আদেশ মানতে হয়। স্বউদ্যোগে কোনো কিছু করার স্বাধীনতা থাকে না। খন্দকার মোশতাকের সময়কালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ খলিলুর রহমানের নির্দেশ মেনে চলতে হতো। জিয়ারউর রহমান শৃঙ্খলাবিরোধী কাজে নিজেকে জড়াবেন না বুঝতে পেরে শাফায়াত জামিল খালেদ মোশাররফের মতামত জানার চেষ্টা করেন। খালেদ মোশাররফ তার সম্মতি জানিয়ে দেন।

২ অথবা ৩ নভেম্বর মাঝরাতে শাফায়াত জামিল তার অধীনে পদাতিক বাহিনী নিয়ে বিদ্রোহের সূচনা করেন। প্রথমেই সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে তার ঘরে অন্তরীণ করা হয়। রেডিও-টিভি স্টেশন দখল করা হয়, টেলিফোন এক্সচেঞ্জে বাংলাদেশের সঙ্গে বহির্বিশ্বের যোগাযোগ বিছিন্ন করা হয়। বঙ্গভবন পাহারায় নিয়োজিত ইউনিটকে সেনানিবাসে ফেরত আনা হয়। এরপর খালেদ মোশাররফ বিদ্রোহের নিয়ন্ত্রণ নেন। রাষ্ট্রপতি ও অভ্যুত্থানে জড়িত মেজরদের ভীতি প্রদর্শনের জন্য সারা দিন যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার সশব্দে বঙ্গভবনের ওপর চক্কর দিতে থাকে। খালেদ মোশাররফ মেজরদের সেনানিবাসে ফেরত আসার নির্দেশ দেন। সারা দিনের উত্তপ্ত বাদানুবাদ শেষে মেজর মহিউদ্দিন ছাড়া বাকি ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকারীরা ৩ নভেম্বর সন্ধ্যায় পরিবারসহ থাইল্যান্ডে চলে যায়। ইতোমধ্যে জিয়াউর রহমানের কাছ থেকে পদত্যাগপত্র সংগ্রহ করা হয়। 

৪ নভেম্বর সকালে একটি মর্মান্তিক খবর খালেদ মোশাররফ ও শাফায়াত জামিল জানতে পারেন; ২ বা ৩ নভেম্বর ভোর রাতে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক ও মেজর রশীদের অনুমতিক্রমে চার নেতাকে হত্যা করা হয়। খালেদ মোশাররফ ও শাফায়াত জামিল উভয়ে খন্দকার মোশতাক ও অভ্যুত্থানে জড়িত মেজরদের ওপর ক্ষিপ্ত হন। কিন্তু ততক্ষণে মেজররা থাইল্যান্ড পৌঁছে গেছে। পরে জানা যায়, অভ্যুত্থানে জড়িতরা আগেই ঠিক করে রেখেছিল সেনাবাহিনী থেকে পাল্টা অভ্যুত্থান হলে স্বংক্রীয়ভাবে চার নেতাকে হত্যা করা হবে। তাদের ভয় ছিল চার নেতার যেকোনো একজনের আহ্বানে ভারত বাংলাদেশে হস্তক্ষেপ করতে পারে। বেলা বাড়তে খালেদ মোশাররফ বঙ্গভবনে তার দাবি নিয়ে উপস্থিত হন। জিয়াউর রহমানের পরিবর্তে নিজে সেনাপ্রধান হতে অভিপ্রায় প্রকাশ করেন এবং খন্দকার মোশতাককে রাষ্ট্রপতি রেখে মন্ত্রিপরিষদ ভেঙে দেওয়ার দাবি জানান। আলোচনা সারা দিন ধরে চলতে থাকে। এর মাঝে শাফায়াত জামিল টের পাওয়া শুরু করেন জিয়াউর রহমানকে অন্তরীণ রেখে খালেদ মোশাররফের সেনাপ্রধান হওয়ার চেষ্টা সাধারণ সিপাহীরা ভলো চোখে দেখেছে না এবং তাদের মাঝে অসন্তোষ দানা বাঁধছে। শাফায়াত জামিল অধৈর্য হয়ে সেনানিবাস থেকে বঙ্গভবনে গমন করেন এবং মন্ত্রিপরিষদের মিটিংয়ে সশস্ত্র প্রবেশ করেন। ভীত খন্দকার মোশতাক জিয়াউর রহমানের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন এবং খালেদ মোশাররফকে মেজর জেনারেলে পদোন্নতি দেন এবং সেনাপ্রধান নিযুক্ত করেন। খন্দকার মোশতাক পদত্যাগ করেন। মন্ত্রিপরিষদের মিটিং থেকেই চার মন্ত্রীকে আটক করা হয়। ৬ নভেম্বর প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন এবং রাতে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। তিনি সংসদ ভেঙে দেন।

এত কিছুর পরও খালেদ মোশারফ ও শাফায়াত জামিল তাদের অভ্যুত্থান টিকিয়ে রাখতে পারেননি। এর কারণ বিশ্লেষণ করতে হলে যে আলোচনা আসে, তা তাদের জন্য অসম্মানজনক। তারা দুজনেই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের দেশপ্রেম নিয়ে সন্দেহ পোষণ করা অনুচিত। রক্তপাত এড়ানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা তাদের মাঝে দেখা যায়। তাদের অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার পারিপার্শ্বিক কারণগুলো আলোচনা করা উচিত, তাদের ব্যক্তিত্বে কালিমা লেপন না করে।

৩ নভেম্বর থেকে রেডিও-টিভিতে কোনো সংবাদ প্রচারিত হচ্ছিল না। সেনানিবাস ও বঙ্গভবনে ঘটে চলা ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে সাধারণ জনগণ এমনকি সেনাবাহিনী অন্ধকারে ছিল। অনিশ্চয়তা ও ভারতীয় আগ্রাসনের ভীতির মাঝে জনতার দিন কাটছিল। তার ওপর সেনাবাহিনীর মধ্যে ধারণা তৈরি হয় খালেদ মোশাররফ ভারতপন্থি এবং তিনি ভারতের সহযোগিতায় আওয়ামী লীগ সরকারকে পুনর্বাসিত করবেন। এমন ধারণা তৈরি হওয়ার কারণ হিসেবে কর্নেল আবু তাহেরের নেতৃত্বে জাসদের গণবাহিনী ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ব্যাপক প্রচারণাকে দায়ী করা হয়। কাকতালীয় অথবা নিয়তির পরিহাস হলেও এ সময় কিছু ঘটনা ঘটে, যা খালেদ মোশাররফের উদ্দেশ্য নিয়ে সিপাহী-জনতার মাঝে সন্দেহ তৈরি হয়। কুখ্যাত রক্ষীবাহিনীর অফিসারদের বিদ্রোহে অংশগ্রহণ সিপাহীদের নজরে পড়ে। তার ওপর ৪ নভেম্বর আওয়ামী লীগের একটি মিছিল বের হয় শেখ মুজিব ও চার নেতা হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে। মিছিলটি পলাশী থেকে শুরু হয়ে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেষ হয়। তারা এই দাবিতে পরের দিন হরতাল ডাকে। এ মিছিলের সম্মুখে ছিলেন খালেদ মোশাররফের মা ও বড় ভাই রাশেদ মোশাররফ, তিনি আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য। এমন নাজুক অবস্থায় আওয়ামী লীগের মিছিল ও নেতৃত্বে খালেদ মোশাররফের পরিবারের সদস্য, এই ছবি ৫ নভেম্বর প্রতিটা পত্রিকার প্রথম পাতায় খালেদ মোশাররফের র‌্যাংক পরিধানের ছবির নিচে ছাপা হয়েছিল। আজকের পরিপ্রেক্ষিতে সেনাপ্রধানের পরিবারের সদস্যরা যদি পলাতক শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরানোর দাবিতে মিছিল করে, তাহলে জনমনে কী ধারণা তৈরি হবে?

আরেকটি ঘটনা ঘটে সেনানিবাসের প্রধান প্রবেশপথে। ৪ নভেম্বর ভারতীয় দুতাবাসের সামরিক অ্যাটাশে ব্রিগেডিয়ার ভোরা এসে উপস্থিত হন এবং খালেদ মোশাররফের সঙ্গে দেখা করতে চান। খালেদ মোশারফ সেনানিবাসে অনুপস্থিত থাকায় ব্রিগেডিয়ার ভোরা খালেদ মোশারফের জন্য একটি উপহার বাক্স রেখে যান। এমনিতেই সেনাবাহিনীতে খালেদ মোশাররফ ও শাফায়াত জামিল শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তার ওপর এসব ঘটনা সিপাহী-জনতার মনে সন্দেহ ঘনীভূত করে। আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা এমন একটা সময়ের আলোচনা করছি, যখন জনগণ ফ্যাসিস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের উৎখাতে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছে এবং ভারতবিদ্বেষ স্মরণকলের মধ্যে তীব্র।

খালেদ মোশাররফ ও শাফায়াত জামিল দুজনেই সেনাবাহিনীতে তাদের প্রভাব ও কর্তৃত্ব নিয়ে ভ্রান্ত ধারণার মধ্যে ছিলেন। শাফায়াত জামিলের ঢাকা সেনানিবাসের ৪৬ বিগ্রেডের মাত্র তিনটি ইউনিট তাদের সমর্থন করছিল। এর থেকেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তারা জনগণকে সম্পৃক্ত করতে পারেননি। খালেদ মোশাররফ ও শাফায়াত জামিল পরস্পরের মাঝে অবিশ্বাস দেখা দেয়। শাফায়াত জামিলকে না জানিয়ে খালেদ মোশাররফ ১০ম বেঙ্গলকে রংপুর থেকে ঢাকা আনেন এবং নিয়তির টানে আরও দুজন খালেদ মোশাররফের আস্থাভাজন সেনা কর্মকর্তা কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা বীর বিক্রম এবং লে. কর্নেল এ টি এম হায়দার বীর উত্তম ঢাকায় এসে তার পাশে অবস্থান নেন।

জিয়াউর রহমান গৃহ-অন্তরীণ হওয়ার পর থেকে সেনানিবাসে গোপনে সিপাহীদের মাঝে বিদ্রোহ তৈরিতে উদ্যোগী হন জাসদ নেতা অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তম। জিয়াউর রহমান গৃহঅন্তরীণ অবস্থায় তাহেরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে সফল হয়েছিলেন। তিনি উদ্ধারে সাহায্য চেয়েছিলেন কি না, তা নিয়ে নিশ্চিত তথ্য নেই, তবে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেছিলেন। তাহের তার নিজস্ব পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন এবং নিজ অভিলাষ পূর্ণ করার একটি সুবর্ণ সুযোগ দেখতে পান। আবু তাহের যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তার এক পা অস্ত্রোপচার করে অপসারণ করা হয়েছিল। তিনি সামরিক বাহিনী থেকে অবসর নিয়ে বেসামরিক পদে যোগ দিয়েছিলেন। তার রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল। তিনি গণচীনের মতো একটি সমাজতান্ত্রিক দেশের স্বপ্ন দেখতেন। তার আদর্শের সঙ্গে জাসদের মিল দেখতে পান। তাহের জাসদের উগ্র রাজনীতিতে জড়িয়ে যান। তিনি জাসদের সশস্ত্র ইউনিট গণবাহিনীর প্রশিক্ষকের দায়িত্ব নেন। ’৭২ থেকে ৭৫ সালে শেখ মুজিবের ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে পরাক্রমশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল জাসদ। জাসদের অসংখ্য তরুণ নেতা-কর্মী রক্ষীবাহিনী ও পুলিশের হাতে নিহত হন অথবা কারাগারে নির্যাতিত হন। তবু উগ্রবাদিতা এবং অসহিষ্ণু হিংসাত্মক আচরণের কারণে জাসদ জনসমর্থনে পিছিয়ে ছিল। পরবর্তীকালে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা জাসদ ও সর্বহারা পার্টিকে মেধা এবং তারুণ্যের অপচয় বলে মতামত দিয়েছেন।

আবু তাহের সেনাবাহিনীকে ভেঙ্গে গণবাহিনীতে পরিণত করতে চেয়েছিলেন যেখানে শুধু সৈনিক নিয়োগ হবে এবং সুবেদার পর্যন্ত সর্বোচ্চ পদ থাকবে। নিয়মিত সামরিক বাহিনীর পরিবর্তে তারা দেশের বিভিন্ন কাজে অংশ নিবে। রাশিয়া এবং চীনের বিপ্লবের পটভূমি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী চিন্তাধারা সে সময় অনেক দেশে উদ্ভব হয়, সারা পৃথিবীতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের হুজুগ দেখা দেয়। দুঃখজনক ভাবে এসব স্বপ্নবিলাসের সাথে বাস্তবতার ব্যাপক ফারাক থাকায় অধিকাংশই ব্যর্থ হয় এবং মাঝখানে অনেক মানুষ প্রাণ হারায়।

বাংলাদেশেও তাহেরের পরিকল্পনা মুখ থুবড়ে পড়ে এবং ফলশ্রুতিতে জাসদ বিস্মৃতির গহ্বরে হারিয়ে যায়। আবু তাহেরের পরিবার এবং কতিপয় বুদ্ধিজীবী তাকে মহিমান্বিত করার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত। বিশেষ করে ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ায় তার পক্ষে জনগণের সহানুভূতি গড়ে তোলা সহজ। এর পরিপ্রেক্ষিতে জিয়উর রহমানকে খলনায়কের ভূমিকায় দেখানো হয়। আওয়ামী লীগ সবসময় একাজে উৎসাহ দিয়েছে। অথচ জিয়াউর রহমান সিপাহীদের ন্যায্য দাবি মেনে নিয়েছিলেন এবং তার ফলে সিপাহীদের মর্যাদা এবং জীবনমানের উন্নয়ন হয়। ৭ই নভেম্বরের ছুটিও সিপাহীদের দাবি ছিল যা ২০০৯ সালের আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বাতিল করা পর্যন্ত বলবৎ ছিল। আবু তাহের সেনা বাহিনীতে যে অসন্তোষের বীজ বুনেছিলেন। তার রেশ ধরে ৭৫ থেকে ৭৭ তিন বছর সামরিক বাহিনীতে অসংখ্য সিপাহি এবং অফিসারের রক্ত ঝরেছে। তাহেরের বিপ্লবী সিপাহীরা ৭ই নভেম্বর খালেদ মোশারফ, নাজমুল হুদা এবং কর্নেল এ টি এম হায়দারকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মত স্বাধীন বাংলাদেশে সামরিক বাহিনীতে ভাতৃহত্যার সূচনা হয়। সামরিক বাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পরবর্তীতে জিয়াউর রহমানকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। 

৩রা নভেম্বর খালেদ মোশারফ এবং শাফায়াত জামিল বিদ্রোহ করলে আবু তাহের তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মোক্ষম সুযোগ পেয়ে যান। এমনকি জাসদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মতামত উপেক্ষা করে জিয়াউর রহমানের কাঁধে বন্দুক রেখে তিনি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ছক কষেন। তাহেরের অনুগত বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ঢাকা সেনানিবাসে ৪ঠা নভেম্বর থেকে ১২ দফা দাবি সম্বলিত লিফলেট বিতরণ শুরু করে। সিপাহীদের ন্যায্য কিছু দাবির সাথে সুকৌশলে তার সমাজতান্ত্রীক দাবি ঢুকিয়ে দেন। সাথে রং চড়িয়ে খালেদ মোশারফ এবং শাফায়াত জামিলের আওয়ামী লীগ এবং ভারত প্রীতির গুজব ছড়ানো হয়। সিপাহিরা উত্তেজিত হতে থাকে। তারা প্রথম থেকেই জিয়াউর রহমানের আটক এবং পদত্যাগ ভালোভাবে নেয়নি। ৬/৭ ই নভেম্বর মাঝরাতে ঢাকা সেনানিবাসের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সিপাহীরা ফাঁকা গুলি করে বিদ্রোহ জানান দেয়। এর পর ঘটনা দ্রুত ঘটতে শুরু করে। ৪৬ ব্রিগেডের যে তিনটি পদাতিক ইউনিট খালেদ মোশারফ এবং শাফায়াত জামিল পরিচালিত অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করেছিল তরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। মেজর মহিউদ্দিন (১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানে জড়িত-দেশে থেকে যাওয়া একমাত্র অফিসার) এবং সুবেদার মেজর আনিসুল হক তাদের অনুগত কিছু সৈনিক সহ জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী থেকে উদ্ধার করে তাদের সেকেন্ড ফিল্ড রেজিমেন্টের অফিসে নিয়ে আসেন। অনেকে প্রচার করেন তাহেরের সৈনিকরা জিয়াউর রহমনকে উদ্ধার করে–যা সত্য নয়। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার বিদ্রোহ অনুঘটন হিসাবে কাজ করলেও, জিয়াউর রহমানকে উদ্ধার করেন এই দুই জন সেনা কর্মকর্তা। সেকেন্ড ফিল্ড রেজিমেন্টের অফিসে অবস্থানকালে এই রেজিমেন্ট এবং চতুর্থ বেঙ্গলের অফিসার, নন কমিশন্ড অফিসার এবং সিপাহীরা জিয়াকে আগলে রাখে। এখানে উল্লেখ্য ১৫ই আগস্ট অভ্যুত্থানে ফারুকের ট্যাংক ইউনিটের সাথে রশীদের সেকেন্ড ফিল্ড রেজিমেন্ট অংশগ্রহণ করেছিল। এবং চতুর্থ বেঙ্গল শাফায়াত জমিলের সাথে বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিল। ৭ই নভেম্বর তারা সকলে জিয়ার চারিদিকে প্রতিরক্ষা তৈরি করে।


সেকেন্ড ফিল্ড রেজিমেন্টের অফিসে নিজের অবস্থান সংহত করার পর জিয়াউর রহমান সেনানিবাসে অবস্থানরত সকল সিনিয়র অফিসারদের তার কাছে হাজির করার আদেশ দেন। সৈনিকরা নিজ উদ্যোগে সেনানিবাসের সকল অফিসারকে খুঁজে জিয়ার সামনে হাজির করে। এদের মাঝে সবচেয়ে সিনিয়র ছিলেন ব্রিগেডিয়ার মীর শওকত আলী বীর উত্তম। তিনি সেসময় যশোর সেনানিবাসের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন এবং ৬ই নভেম্বর ঢাকার মিটিংয়ে যোগ দিতে এসেছিলেন। এ সকল অফিসার এবং অনুগত সৈনিকরা জিয়ার চারিদিকে নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে এবং তাকে সুরক্ষিত রাখে উচ্ছৃঙ্খল সিপাহি এবং সেনানিবাসে অনুপ্রবেশকারী তাহেরের সন্ত্রাসীদের থেকে।

জিয়াউর রহমান খালেদ মোশারফ এবং শাফায়াত জামিলের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। তিনি শাফায়াত জামিলের সাথে বঙ্গভবনে যোগাযোগ করতে সমর্থ হন এবং তাকে নিশ্চিন্তে সেনানিবাসে ফেরার আহ্বান জানান। শাফায়াত জামিলের বিপ্লবের মাত্রা এবং ব্যাপকতা নিয়ে পরিষ্কার ধারণা ছিল না। তিনি জিয়াউর রহমানের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেন। যখন উপলব্ধি করেন তার পদাতিক বাহিনী বঙ্গভবন অরক্ষিত রেখে পালিয়ে গেছে এবং বিপ্লবী সিপাহিরা বঙ্গভবনে প্রবেশের চেষ্টা করছে তখন তিনি দেয়াল টপকে পালাতে গিয়ে পা ভেঙ্গে ফেলেন এবং শেষপর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ বন্দর থানায় আশ্রয় নেন। মির শওকত আলী কর্নেল আমিনুল হককে পাঠিয়ে সেখান থেকে উদ্ধার করে তাকে চিকিৎসার জন্য সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করান। দুঃখজনক পরিণতি হয় খালেদ মোশারফ, নাজমুল হুদা এবং এম হায়দারের। তারা বঙ্গভবন ছেড়ে শেরেবাংলা নগরে অবস্থানরত রংপুর থেকে আগত ১০ বেঙ্গল রেজিমেন্টের ছাওনিতে আশ্রয় নেন। এটা তাদের অনুগত বাহিনী হওয়ায় তারা সেখানে নিরাপদ বোধ করেছিলেন। এ ইউনিটের কমান্ডে তখন ছিলেন মেজর নওয়াজিশ। তিনি জিয়াউর রহমানকে ফোন করে খালেদ মোশারফ, নাজমুল হুদা এবং এম হায়দারের উপস্থিতির কথা জানান। জিয়াউর রহমান তাদের সর্বত নিরাপত্তা দিতে নির্দেশ দেন। কিন্তু এর কিছুক্ষণ পর তাহেরের বিপ্লবী সৈনিক সংঘের সিপাহীরা এসে ১০ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সিপাহীদের উত্তেজিত করে তুলে এবং এই তিন বীর মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের হত্যা করে। 

তাহের ৭ই নভেম্বর ভোর রাতে সেনানিবাসে এসে জিয়াউর রহমানকে রেডিও স্টেশনে উপস্থিত হয়ে ভাষণ দিতে আহ্বান করেন এবং সাথে করে নিয়ে যেতে চান। তাহেরের অভিসন্ধি উপলব্ধি করে এবং জিয়াউর রহমানের প্রাণহানির আশঙ্কায় উপস্থিত সেনাকর্মকর্তারা জিয়াউর রহমানকে সেনানিবাসের বাইরে যেতে বাধা দেন এবং রেকর্ডকৃত ভাষণ প্রচারের সিদ্ধান্ত নেন। তাহেরের পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও জিয়াউর রহমান সেনানিবাসে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। তাহের বিফল হয়ে ফেরত যান। তৎকালীন সেনাবাহিনীতে কর্মরত সকল জেষ্ঠ্য অফিসার পরবর্তীতে সর্বসম্মতভাবে মত দিয়েছেন তাহেরের সাথে জিয়াউর রহমানের সেনানিবাস থেকে বের না হওয়া সঠিক ছিল, এর ফলে দেশ গৃহযুদ্ধ থেকে বেঁচে যায়। জিয়াউর রহমান তাহেরের আয়ত্তে চলে গেলে তাকে জিম্মি করে নিজের মতন ভাষণ আদায় করে নিতেন এবং জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তায় সওয়ার হয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ডাক দিতেন। এমন ধারণা অবাস্তব শোনালেও সমাজতন্ত্রীরা যেকোনো উপায়ে তাদের লক্ষ্য অর্জনকে বৈধ মনে করে। উপরন্তু তাহের উগ্রপন্থি রাজনীতিতে ইতোমধ্যে জড়িত ছিলেন। জিয়াউর রহমান হাত ছাড়া হয়ে যাওয়ার পর তাহের তার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করেন অফিসার হত্যায় সিপাহীদের উৎসাহ দিয়ে যার ফলাফল ছিল মর্মান্তিক।

১৯৭১ সালে জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণায় জনতা যেমন সম্বিত ফিরে পেয়েছিল তেমনি ৭ই নভেম্বর ১৯৭৫ সালে জিয়ার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার ভাষণ শুনে জনগণ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে, চলমান অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তিপায়। একজন জনপ্রিয়, দৃঢ়চেতা মুক্তিযোদ্ধার দেশ শাসনের দায়িত্ব নেওয়ায় জনগণের দুশ্চিন্তা লাঘব হয়। সাধারণ সিপাহীরা ট্রাক নিয়ে, ট্যাংক নিয়ে জনতার সাথে আনন্দ মিছিলে যোগ দিতে ৭ই নভেম্বর সকালেই সেনানিবাস থেকে বের হয়ে আসে। এর পর জনতা সামরিক ট্রাক এবং ট্যাংকের উপর উঠে আনন্দ করতে থাকে। এই আনন্দ লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা রক্ষার আনন্দ- মর্যাদা নিয়ে বেচে থাকার আনন্দ-অপশক্তি প্রতিরোধের আনন্দ। এ আনন্দ উচ্ছ্বসিত হয়েছিল রাজপথে। এই সফল বিপ্লব সিপাহি-জনতার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অর্জিত হয়েছিল যার ফলাফল ছিল সুদূর প্রসারী, যা আমরা আজও অনুভব করি। 


৭ই নভেম্বর না হলে বাংলাদেশ উদার গণতন্ত্র এবং সুশাসনের ধারায় ফিরত না। অভাব, দারিদ্র, দুর্নীতি এবং অরাজকতায় জর্জরিত হয়ে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হতো। সিপাহি-জনতার বিপ্লবের আদর্শ ধারণ করে আমাদের তরুণদের ৫ই আগস্ট ’২৪ বিপ্লবের ফসল ঘরে তুলতে হবে। কাজ মাত্র শুরু। হাজার শহীদের রক্ত বৃথা যাবে যদি আমরা সফল হতে না পারি। আমরা সবাই বিপ্লব সফল করতে বদ্ধপরিকর।


  • লেখক: প্রফেসর ড: মোর্শেদ হাসান খান, মহাসচিব, ইউনিভার্সিটি টিচার্স এসোসিয়েশন বাংলাদেশ-ইউট্যাব

জাতীয়তাবাদের আরাধ্য অবয়বের নাম ‘শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান’




কখনো কখনো বহমান সময় ব্যক্তিকে নির্মাণ করে, আবার কখনো ব্যক্তিই তৈরি করে ইতিহাস। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর উত্তম যেমন সময়ের নির্মাণ, তেমনি শহীদ জিয়া তৈরি করে গেছেন ইতিহাস। আজকের বাংলাদেশ সেই ইতিহাসের ধারাবাহিকতা মাত্র, যেখানে সময়ের সাথে গড়ে উঠেছে ব্যক্তির এক অনস্বীকার্য মিথোজীবীতা।

সেনাবাহিনীর একজন মেজর যখন দ্ব্যর্থহীনভাবে নিঃশঙ্ক চিত্তে নিজের এবং পরিবারের জীবনকে বিপদাপন্ন করে ঘোষণা করেন, “উই রিভোল্ট” তখন ব্যক্তি হয়ে ওঠেন কালোত্তীর্ণ। যখন একজন দেশপ্রেমিক মহান স্বাধীনতার ঘোষণা করেন, তখন স্বাধীনতা ও ব্যক্তি হয়ে ওঠেন একে অপরের পরিপূরক। কালের স্রোতে, সময়ের প্রবহমানতায় যিনি তাঁর সত্তাকে বিলীন করে দেন জনগোষ্ঠীর বৃহত্তর স্বার্থে, তখন তিনি হয়ে ওঠেন জাতিসত্তার এক মূর্ত প্রতীক। জাতির সেই আরাধ্য অবয়বের নাম ‘শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান’।

মেজর জিয়াকে নিয়ে সম্পূর্ণ পাঠ এখনো হয়ে ওঠেনি কিংবা বলা যায়- প্রচারবিমুখ বীরমুক্তিযোদ্ধা জিয়ার পাঠোদ্ধার দুরূহ এবং অনতিক্রম্য তার ভাবনার পরিধি। তবুও যেটুকু আমরা জেনে যায় পরম্পরায়, আমরা এমন একজন সামরিক কর্মকর্তাকে দেখি। যিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত থেকেও ক্রমশ হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ধারক এবং স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তিনি হয়ে উঠেন জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা ও বাহক।

১৯৭২ সালের এপ্রিলে জেনারেল এমেজি ওসমানীর পদত্যাগের পর সেনাবাহিনীর প্রচলিত মান ও প্রথা ভেঙ্গে সর্বোচ্চ পেশাদারি, সৎ, ন্যায়পরায়ণ, বিচক্ষণ, সামরিক নেতৃত্বের সকল গুণাবলিতে মহিমান্বিত, প্রশ্নাতীত দেশপ্রেমিক ব্রিগেডিয়ার জিয়াউর রহমানকে বঞ্চিত করে, ব্রিগেডিয়ার কে এম শফিউল্লাহকে সেনাপ্রধান মনোনীত করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান সশস্ত্র বাহিনীতে রাজনীতিকরণ প্রথা চালু করেন। সেই বেদনা জারিত করে শতসহস্র সৈনিক ও অফিসারের হৃদয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মজিবুর রহমান রাজনৈতিক নেতা থেকে ক্রমশ হয়ে ওঠেন স্বৈরশাসক, যার বিপরীতে জেনারেল জিয়াউর রহমান সেনা কর্মকর্তা হতে উত্তীর্ণ হন এক মহান নেতায়। যেন বহমান সময় এই বীরমুক্তিযোদ্ধাকে জায়গা করে দিতে উদ্ধত হয়। 

১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না বরং এটি ছিল ঘটনার পরম্পরা ও পরিণতি। এই পরিণতি হলো একটি তিমির রাত্রির বিনাশ ঘটিয়ে একটি সদ্যোজাত রাষ্ট্রের জীবনে আরেকটি সম্ভাবনাময় ঊষার উন্মেষ।

১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এর বিপ্লবের পর ভারতীয় পৃষ্ঠপোষকতায় যে প্রতিবিপ্লবের সূচনা হয়, তার ধারাবাহিকতায় ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ কারান্তরীণ হন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। ৩ নভেম্বর শুধু জিয়াউর রহমান কারান্তরীণ হননি, শৃঙ্খলিত হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব।

৩ নভেম্বর থেকে ৭ নভেম্বর ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের এক বাক বদলের উপাখ্যান। কেননা ৩ নভেম্বর যেমন ছিল স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হরনের দিন। তেমনি ৭ নভেম্বর ছিল শৃঙ্খল মুক্তির এক মাহেন্দ্রক্ষণ। এই মহান দিনে আধুনিক ও জাতীয়তাবাদী বাংলাদেশের জনক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মুক্তির ভেতর দিয়ে মুক্ত হয় বাংলাদেশ। আর এই মুক্তির নেপথ্য কারিগর ছিল বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের অন্তর্গত স্পৃহা ও বীর সেনানীদের এক অভূতপূর্ব মিথস্ক্রিয়া। যার দরুন ৭ নভেম্বরের বিপ্লব ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে দেদীপ্যমান হয়ে আছে সিপাহি-জনতার বিপ্লব নামে।

সূচনাতেই বলেছি, ইতিহাস হলো এক পরম্পরা। সেই পরম্পরায় ৭ নভেম্বর যুগস্রষ্টা জিয়াউর রহমানের শুরু করে যাওয়া কর্মযজ্ঞের পরম্পরা হলেন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। যদিও এই পরম্পরায় যতি চিহ্ন ছিলেন জেনারেল এরশাদ, সেমিকোলন ছিল পলাতক স্বৈরাচারী হাসিনা। তবুও গণতন্ত্রকামী মানুষের প্রবল সংঘবদ্ধ প্রয়াস ১৯৯১ সালে ম্যান্ডেট দেয় আপোষহীন নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে। বেগম খালেদা জিয়া দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে নিয়ে যান ৭ নভেম্বরের স্পৃহার এক জাতীয়তাবাদী বাংলাদেশ।

সময়ের প্রবহমানতায় পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, সুরমা, কুশিয়ার প্রবাহ করেছে বাঁক বদল। বাংলাদেশের রাজনীতি ঘোর অমানিশায় আবর্তিত হয়েছে ১/১১-এর ভেতর দিয়ে। 

তবুও গণতন্ত্রকামী মানুষের আকাঙ্খা নির্বাপিত হয়নি কখনো। কারান্তরীণ দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া মুক্তির মশাল তুলে দিয়েছেন তাঁর সুযোগ্য উত্তরসূরি সেনা সন্তান তারেক রহমানের কাছে। একদা নির্যাতিত ও কারান্তরীণ পরবর্তীতে নির্বাসিত তারেক রহমান নিজেকে উৎসর্গ করেছেন জনগণ, দেশ ও গণতন্ত্রের মুক্তির কাণ্ডারি হয়ে।

চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার গণআন্দোলন চলাকালে গত ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালিয়েছে স্বৈরাচারী হাসিনা। কিন্ত তারেক রহমানের যাত্রা চলমান। বন্ধুর পথে তিমির রাত্রিতে যে যাত্রা তিনি চলমান রেখেছেন, সেই যাত্রার কোন যতিচিহ্ন নেই। ৭ নভেম্বরের সিপাহি-জনতার যে বিপ্লবী স্পৃহা ধারণ করেছিলেন তাঁর প্রয়াত পিতা, যা লালন করেছেন তাঁর বর্ষীয়ান মাতা, সেই অদম্য স্পৃহা লেলিহান অগ্নিশিখা হয়ে দেদীপ্যমান হয়ে দীপ্তি ছড়াচ্ছে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এক বাংলাদেশে। যে বাংলা দুর্ভেদ্য, অজেয় ও অদৃষ্টপূর্ব।


  • ▪️ লেখক : ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ড. একেএম শামসুল ইসলাম, পিএসসি, জি (অবঃ); সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।