Search

Sunday, March 19, 2017

অপপ্রচার আর কত?


শওকত মাহমুদ

কানাডীয় সরকার বিএনপিকে সন্ত্রাসী দল মনে করে না – এই চাঞ্চল্যকর তথ্যটি জানিয়েছেন কানাডা প্রবাসী অনুসন্ধানী সাংবাদিক মোহাম্মদ আল বোখারী। শনিবার, মার্চ ১১, বাংলাদেশের দৈনিক ‘আমাদের অর্থনীতি’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক রিপোর্টে ফ্যাসিবাদী সরকারের অপপ্রচারে দারুণ এক চোট দিলেন তিনি। 

গত ২৫ জানুয়ারি কানাডার একটি ফেডারেল কোর্ট এক রায়ে বাংলাদেশের এক নাগরিকের শরণার্থীর আবেদন প্রত্যাখ্যান করে এবং সেখানে বিএনপি ও আওয়ামীলীগকে সন্ত্রাসী দল হিসেবে উল্লেখ করে বলে খবরে প্রকাশ হয়। আবেদনকারী নিজেকে জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের কর্মী হিসেবে উল্লেখ করে এবং বিএনপি সন্ত্রাসী তৎপরতা চালায় এই কথাও তার আবেদনে ছিল। ঐ রায়টি ছিল একজন শরণার্থীর আবেদন মঞ্জুর সংক্রান্ত যেখানে বিচারক নন বরং শরণার্থী অবিশ্বাস্যজনক ও আত্মঘাতী প্রক্রিয়ায় নিজের দলকে একটি সন্ত্রাসী দল বানিয়েছে। এই আবেদনকারী কোনও ভাবেই বিএনপির সাথে যুক্ত নয় বা ছিলও না। যা হোক এরপর আওয়ামী-মিডিয়া প্রচারে নেমে পড়ে যে বিএনপি যে সন্ত্রাসী দল কানাডার আদালতের রায়ে প্রমাণিত হয়ে গেছে। নিজেদের কথাটি চেপে যায়। আসলেই বিএনপিকে কানাডীয়রা সন্ত্রাসী দল মনে করে কি না তা নিশ্চিত হতে  মোহাম্মদ আল বোখারী গত কয়েক দিন ধরে কানাডার প্রধানমন্ত্রী, এটর্নি জেনারেল, জননিরাপত্তা মন্ত্রণালয়, অভিবাসন মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশের কানাডিয়ান রাষ্ট্রদূতের কার্যালয়, কানাডার ফেডারেল কোর্টের প্রধান বিচারপতির প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও মিডিয়া বিষয়ক লিগ্যাল কাউন্সিলের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এতে জননিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রীর মুখপাত্র বোখারীকে পরামর্শ দেন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে ৫৩টি সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকা দেখার জন্য। তাতে বিএনপির কোনও নাম নেই। তাছাড়া ঐ কেইসে বিএনপি কোনও পক্ষই ছিল না।

আগেও দেখা গেছে, পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই বেলুচিস্থান ন্যাশনালিস্ট পার্টি ( বিএনপি)-কে নির্বাচনের সময় টাকা দিয়েছে মর্মে খবর প্রকাশ হলে দিল্লিতে কর্মরত দুই বাংলাদেশী সাংবাদিক অপপ্রচার শুরু করে যে, আইএসআই বিএনপি ( বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি )-কে টাকা দিয়েছে। বাংলাদেশী সরকারি সংস্থা বাসসও এই মিথ্যা খবরটি বিএনপির বিরুদ্ধে প্রচার করেছিল। পরে তা থিতিয়ে যায়। বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলকে ভুয়া তথ্য দিয়ে একবার রেড এলার্ট জারি করা হয়েছিল, কিন্তু অনুসন্ধানের পর ইন্টারপোল সে রেড এলার্ট প্রত্যাহার করে নেয়।

আর কত? বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাতে চালাতে আওয়ামীলীগ নিজেই অভিশপ্ত হয়ে পড়েছে। আর অত্যাচারের অভিশাপ তো আছেই।

সুরা হুজুরাত আয়াত ৬-এ সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ বলেছেন, “হে বিশ্বাসীগণ! যদি কোন ফাসেক তোমাদের কাছে কোনও খবর আনে তোমরা তা পরীক্ষা করে দেখবে, যাতে অজান্তে তোমরা কোনও সম্প্রদায়কে আঘাত না করে বসো এবং পরে তোমাদের কাজের জন্য তোমরা লজ্জা না পাও।” 
  • লেখক সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ।

‘পানির কথা বলতে ভুলে যাবার গল্প’ কোথায় পেলেন?

মারুফ কামাল খান সোহেল

দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার অভিযোগের অন্ত নেই। সম্প্রতি এক বক্তৃতায় শেখ হাসিনা একগাদা অভিযোগ করেছেন। তার মধ্যে একটা অভিযোগ হলো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভারত সফরে গিয়ে বেগম জিয়া নাকি পানির কথা বলতে ভুলেই গিয়েছিলেন।
 
প্রধানমন্ত্রী হিশেবে বেগম খালেদা জিয়ার ভারত সফর শেষে দু’দেশের পক্ষ থেকে ২৮ মে, ১৯৯২ তারিখে প্রকাশিত যৌথ ইশতেহার নিচে দেয়া হলো। এতে দেখা যায় পানি বন্টন, স্থল ও নৌসীমা বিরোধ, তালপট্টি, চাকমা বিদ্রোহী শরণার্থী ও তিন বিঘা করিডোর হস্তান্তর সহ গুরুত্বপূর্ণ সকল বিষয় নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়েছিল।

তাহলে পানির কথা বলতে ভুলে যাবার গল্প শেখ হাসিনা কোথায় পেলেন? তিনি কি সব ব্যাপারে এমন সত্য(!) তথ্যই তুলে ধরেন?

Joint communiqué issued at the end of the visit of the Bangladesh  Prime Minister Begum Khaleda Zia to India.

New Delhi, May 28, 1992.

At the invitation of His Excellency Mr. P.V. Narasimha Rao, Prime Minister of the Republic of India, Her Excellency Begum Khaleda Zia, Prime Minister of the People’s Republic of Bangladesh paid a State visit to India from May 26-28, 1992.

During her visit, the Prime Minister of Bangladesh called on His Excellency Shri R. Venkataraman, President of India, and His Excellency Dr. S.D. Sharma, Vice-President.

The Prime Ministers held comprehensive and wide-ranging discussions covering international, regional and bilateral issues in an atmosphere of friendship, harmony and cordiality.

Reviewing the recent momentous and unprecedented changes in the international situation, they expressed satisfaction at the more positive developments and expressed the hope that these would be built upon in the interest of the international community as a whole. The end of the cold war, dissolution of sharp ideological clevages and renewed emphasis on resolution of differences through peaceful means, would hopefully result in a world order based on equity, justice and cooperation. They called for a simultaneous democratisation of international relations and a greater thrust on alleviation of poverty. The decision making organs of the U.N. which were sought to be invested with greater active responsibility, must enjoy wider representation and reflect the collective opinion of its membership.

The Non-aligned Movement based on its abiding principles of independence of judgement and freedom of action, and its emphasis on equitable international economic development, has come to acquire a renewed relevance in the light of these developments.

The two Prime Ministers reiterated their belief that SAARC represents the faith and aspiration of the countries of South Asia to enhance regional cooperation in the interest of greater understanding and well-being of the peoples of the region. Towards this end, they felt that a further momentum should be given to SAARC activities in the core areas of economic cooperation. The two leaders felt that the Seventh SAARC Summit to be held in Dhaka at the end of this year assumes special significance as the beginning of the second cycle of SAARC Summits and expressed the hope that it would not only lead to the consolidation of the past achievements and would also identify new meaningful avenues to achieve its objectives.

The two leaders expressed their determination to further consolidate the friendly, harmonious and good neighbourly relations between Bangladesh and India, in the larger interest of the peoples of the two countries and of peace and stability in the region. A significant opportunity was now available for the purpose based on the mandate of the people.

Both sides noted with satisfaction the recent Exchange of Letters regarding the modalities for implementation of the terms providing for right of passage for Bangladesh citizens through Tin Bigha area which will become effective from June, 26, 1992.

Based on this understanding, it was agreed that efforts should be intensified to resolve the other outstanding issues emanating from the India-Bangladesh Land Boundary Agreement of 1974. It was also agreed that discussions on delimitation of the Maritime Boundary would be resumed at an early date. Moreover, they I noted the need for discussions in due course concerning the question of New Moore/South Talpatty Island for an in-depth examination on the basis of all relevant facts and principles.
THE TWO PRIME MINISTERS NOTED THAT DUE TO GROWING NEED FOR WATERS, THE FLOWS AVAILABLE IN THE GANGA/GANGES AND TEESTA WOULD FALL SHORT OF THE REQUIREMENTS OF THE TWO COUNTRIES PARTICULARLY DURING THE LEAN SEASON. THEY AGREED THAT AN EQUITABLE, LONG-TERM AND COMPREHENSIVE ARRANGEMENT FOR SHARING THE FLOWS OF THESE AND OTHER MAJOR RIVERS EVOLVED THROUGH MUTUAL DISCUSSIONS WOULD SERVE THE BEST INTEREST OF THE PEOPLES OF THE TWO COUNTRIES. THEY DIRECTED THEIR MINISTERS CONCERNED TO MAKE RENEWED ENDEAVOURS FOR ACHIEVING AN ACCEPTABLE SETTLEMENT INCLUDING THE INTERIM ARRANGEMENTS FOR SHARING THE DRY SEASON FLOWS ON THE GANGA/GANGES IN THE MEANWHILE. THE PRIME MINISTER OF INDIA ASSURED THAT EVERY POSSIBLE EFFORT WILL BE MADE TO AVOID UNDUE HARDSHIP TO BANGLADESH BY SHARING THE FLOWS IN GANGA/GANGES AT FARAKKA ON AN EQUITABLE BASIS. THE CONCERNED MINISTERS OF THE TWO SIDES WILL MEET FOR THIS PURPOSE ON AN URGENT BASIS.

In the meanwhile, joint monitoring of releases at Farakka and the Teesta barrage, and observations on the flows of the major rivers into Bangladesh will be revived and undertaken immediately.

Taking into account the problems being caused due to large-scale illegal immigration of people across their borders, they expressed their determination to stop illegal movement of people across the border by all possible means including the strengthening of existing arrangements and mutual co-operation in this regard.
 
Both sides resolved to take effective measures in order to maintain peace and tranquility all along the border and to refrain from unfriendly activity.

The two Prime Ministers agreed to arrange speedy repatriation of all Chakma refugees to Bangladesh in full safety and security. In this context, the Bangladesh side agreed to set up a representative political-level Committee that would encourage the refugees to return. The Indian side assured that its authorities would cooperate fully in the process of repatriation.

The two Prime Ministers directed that special focus should be placed on increasing and diversifying trade and economic cooperation between the two countries. They agreed that the authorities concerned would meet at an early date, preferably August/September 1992, to hold Trade Review Talks with a view to renewing the existing Trade Agreement. They agreed that the Joint Economic Commission between the two countries should meet in October 1992. Existing cooperation in the fields of Culture, Education, Information and Defence could also be expanded.

The Prime Minister of Bangladesh expressed her appreciation to the Prime Minister, the Government and the people of India for the warm welcome and hospitality extended to her and the members of her delegation during their stay in India.

The Prime Minister of Bangladesh extended an invitation to the Prime Minister of India to visit Bangladesh. The invitation was accepted with pleasure.

লেখক: সাংবাদিক ও বিএনপি চেয়ারপার্সন’র প্রেস সচিব। 

উৎসঃ বিএনপি বাংলাদেশ  

Wednesday, March 15, 2017

A wish list from the bizzaro world


By Habibul Islam



It definitely looks like law enforcement in Bangladesh is going through a phase that maybe described as mid-life crisis. That’s the time when people—especially men, we’re told, but lots of women too though theirs are somewhat different—say, do, think, whatever, bizarre stuff. 

According to one expert (needless to elaborate, there are innumerable of them around the world) there are 14 signs of this often-hyped crisis, and here they are:
1.Buying a Sports Car. 2. Drastic Changes in Habits, Mood Swings, and Impulsive Decision-Making. 3. Shifts in Sleeping Habits.4. Obsession with Appearances. 5. Disconnecting from Old Friends, and Replacing Them with Younger Friends. 6. Feeling Tied Down, with No Chance for Change. 7. Thoughts of Death or Dying. 8. Changing Careers. 9. Leaving a Spouse or Having an Affair. 10. Bouts of Depression. 11. Increased Consumption of Alcohol or Drugs. 12. Listless and Bored.13. Assigning Blame. 14. Recent Traumas.

While an ordinary mortal’s crisis may not coincide or even seem similar to those of the law enforcement entities, the critical point to note is the strangeness of the desires or wishes. As a footnote it can be added that at least a few of the signs appear creepily close to those experienced by those who maybe described as leading a “civilian life” of a mere citizen.

Anyhow, as it may be. Not too long back some from law enforcement expressed the plea—and that too right to the prime minister of the country—that they should be relieved from all strictures related to torturing/tormenting persons arrested by them and in their control. We shall leave the prime minister’s reaction to speak for itself since no clarification is required.

The latest demand of the law enforcing leadership relates to becoming a Facebooker. (Just a point of personal disclosure: This commenter has never been registered with the aforementioned Facebook and most certainly has no intention whatsoever to do so anytime in the future. One particular reason: With so much prying into an individual’s life, why bother?) Simply stated this is what law officials desire: Intending Bangladeshis should disclose their National Identification while signing up with Facebook.

It has been noted in various forums and publications that this country’s law enforcement mechanism and general guidelines, apart from upgraded training, need urgent reconsideration—even if the top brass could be feeling that since they’re functioning to help, assist and abet the political power, nothing else but only preserving the powers that be in a pleasant frame of mind matters; and apparently there’s ample evidence to bolster that conclusion.

More than clearly as events have shown, law enforcement units seem to be in need of being sensitized to the realities of the world—and that holds true for numerous other such organizations in numerous other countries too—including a modicum about the rights of citizens and the duties of law enforcement toward them, the state of the world since the time the Brits left these shores, and that professionalism will serve a lifetime but not pseudo-political pronouncements.

These, among other necessary measures, may ultimately succeed in instilling in the relevant persons that asking for a total and comprehensive control of people’s life would appear to make things easier for the law enforcers (au contraire, if no acquiescence comes then it’ll provide them with materials to explain away any inadequacy) but it could very well lead to a contrary impact; and it certainly would not go down well with the citizens whom, it perhaps might be added, the law is supposed to protect, serve and defend.
ENDS

Sunday, March 12, 2017

গ্যাসের দাম বৃদ্ধি, চরম বিপর্যস্ত হবে অর্থনীতি

জি কে সাদিক 

গত ২৩ ফেব্রুয়ারি হঠাৎ করেই কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়াই গ্যাসের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। অনেকটা স্বেচ্ছাচারিতার মতো কাজ। সুবিধাভোগী গুটি কয়েক লোক ছাড়া সুশীল সমাজ এটার সম্পূর্ণ বিরোধিতা করে আসছে শুরু থেকেই। দেশ পরিচালনা করতে হবে দেশপ্রেম ও  জনস্বার্থের উপকারের জন্য বা জনকল্যাণের উদ্দেশ্যে। গ্যাসের ব্যাপারে এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত ঠিক কী কারণে নেয়া হয়েছে তার কোন যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আর সরকার পক্ষ থেকে কোন যৌক্তিক কারণও দর্শানো হয়নি। যুক্তিগত কোন কারণ ছাড়া গ্যাসের দাম বৃদ্ধি দেশ বা জাতির জন্য কোন ধরণের কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসবে? কল্যাণ হবে না অকল্যাণ হবে তার মোটামুটি এখন সবার জানা। তবে এটা বুঝি দেশ পরিচালকদের বুঝা হচ্ছে না। নাকি তারা বুঝেও কোন কারণে না বুঝার ভান করছে তা বুঝা বড় দায় হয়ে পড়েছে। গ্যাসের এমন অপরিকল্পিত ভাবে দাম বৃদ্ধি যে দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে তা আর ব্যাখ্যা করে বলার দরকার নেই। এখন কথা হলো কী এমন বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে যার জন্য সুশীল সমাজসহ সব ধরণের রাজনৈতিক সংগঠন সমূহ এর বিরুদ্ধে জোর প্রচারণা চালাচ্ছে।

গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ফলে আমাদের অর্থনীতিতে ও দেশে এক চরম অরাজকতার সৃষ্টি হবে। গ্যাসের দাম বাড়ার ফলে শিল্প-কারখানাগুলোর উৎপাদনে নানা বিধি সমস্যার সৃষ্টি করবে এবং কর্মসংস্থান বন্ধ হওয়ার এক মহা হিড়িক পড়বে। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই বলা যায় যে, দেশে বেকারত্ব বৃদ্ধি পাবে এবং নানাবিধ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হবে। পরিবহনে যে নৈরাজ্য চলছে সে নৈরাজ্য বৃদ্ধির এক নতুন ইন্ধন যোগাবে এই গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি। গ্যাস শহরে রান্নার একমাত্র উপকরণ বলা চলে। ৬০ শতাংশ দাম বাড়ার ফলে সিঙ্গেল চুলা ৬০০ টাকার পরিবর্তে ৯০০ টাকা হবে আর ডাবল হবে ৬৫০ এর স্থলে ৯৫০ যা স্বাভাবিক জীবন যাত্রার ব্যয় বাড়াবে ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে আয়-ব্যয়ের বৈষম্য বাড়াবে। নিত্য প্রয়োজনীয় শিল্প পণ্যগুলোর দাম বাড়বে অন্যদিকে সমান। সাধারণ মানুষকে বেশি দামে কিনতে হবে নিত্য প্রয়োজনীয় এইসব পণ্য যার ফলে ব্যয় বাড়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু তার সাথে তাল মিলিয়ে বাড়বে না আয়। তাহলে আয়-ব্যয়ের বৈষম্যের ফলে সাধারণ মানুষের জীবনের উপর অর্থনৈতিক চাপের সৃষ্টি হবে।

গত ২২ জানুয়ারি দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকার ১ম পৃষ্ঠায় “মহা বেকারত্বের পদধ্বনি” শিরোনামে একটা প্রতিবেদন ছাপা হয়। সেখানে বলা হয় যে,  গত দু বছরে শ্রমিক মজুরি বেড়েছে ৩২ শতাংশ, বিদ্যুৎ খরচ বেড়েছে ১৫ শতাংশ, গ্যাসের দাম বেড়েছে ১০ শতাংশ এবং একই সময়ে ৩০ শতাংশ বেড়েছে পরিবহন খরচ। সব মিলিয়ে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যয় বেড়েছে ১৭ দশমিক ১১ শতাংশ। ব্যাংকগুলো থেকে সুবিধামতো ঋণ পাচ্ছে না এবং নানা প্রতিকূলতার কারণে প্রতিযোগীতায় টিকে থাকা সম্ভব হচ্ছে না বলে ব্যবসায়ে লাভের স্থানে হচ্ছে ক্ষতি। নিজের ক্ষতি করে কেউ শিল্পপ্রতিষ্ঠান চালাবে না ফলে শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থান সংকট ফলে বাড়বে বেকারত্বের হার। দেশের মানুষকে বেকার রেখে অর্থনৈতিক মুক্তি কতটা হবে বা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কতটা বাড়বে তা সহজেই অনুমেয়।

১ মার্চ এবং আগামী ১ জুন থেকে দু দফায় গ্যাসের দাম বাড়বে ২৩ শতাংশ। স্বল্প সময়ে গ্যাসের আকাশচুম্বি দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ব্যবসা-বাণিজ্যে নানামুখী নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ব্যবসার ব্যয় বাড়বে এবং রফতানি বাধাগ্রস্ত হবে। গ্যাসের দাম বাড়ার কারণে মূল্যস্ফীতি ডাবল ডিজিটে উন্নিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে ও অর্থনীতির নানামুখী কর্মকান্ড মেটানোর জন্য শিল্প-কারখানাগুলোতে পর্যাপ্ত পরিমাণে গ্যাস সরবরাহ করা যায়নি। এর ওপর সার্বিক ভাবে এ মূল্য বৃদ্ধির ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যে নীরব ধস নামবে। ৬০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস ব্যবহার করা হয়। গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির ফলে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করার ঘোষণা করা হয়েছে ইতোমধ্যে। শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো তাদের উৎপাদনে ক্ষেত্রে সম্পূর্ণটাই গ্যাস এবং বিদ্যুতের উপর নির্ভরশীল। তাহলে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির ফলে বিদ্যুতের দাম বাড়বে। গ্যাস এবং বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ফলে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। অন্যদিকে বিশ্ববাজারে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়ার ফলে ক্রেতারা পণ্যের দাম কমানোর চাপ দিচ্ছেন। একদিকে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি অন্যদিকে রফতানি মূল্য হ্রাস। উভয় সংকটের মধ্যে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাটাই হয়ে পড়েছে বড় দায়। ব্যবসায় ক্ষতি করে শিল্পপ্রতিষ্ঠান চালাতে চাইবে না বা পারবে না ফলে বিনিয়োগ গুটিয়ে নিবে ক্ষুদ্র ও মাঝারী ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো ফলে কর্মসংস্থান কমে যাবে। কর্মসংস্থান কমে গেলে তার পরিণতি কী হবে তা বুঝতে আর বাকী নেই। ক্যাপটিভ গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির ফলে এরই মধ্যে প্রায় ৩ হাজার শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।

উন্নয়নের বা কোন কাজের পিছনে পরিকল্পনা গ্রহন করা ও তার যথাযথ বাস্তবায়ন পূর্বশর্ত। বারবার হঠাৎ করে গ্যাসের দাম বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ফলে দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা এবং সে অনুযায়ী কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নিতে পারছে না যথাযথ পদক্ষেপ। ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করতে চাচ্ছে না এবং বিনিয়োগ গুটিয়ে নিচ্ছে। যার ফলে শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হচ্ছে। এভাবে ক্রমাগত চলতে থাকলে দেশের চলমান অর্থনীতির চাকা অচল হয়ে দেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য হবে।

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির ধারাকে গতিশীল রাখতে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ(এফবিআই) আকর্ষন করার ক্ষেত্রে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং ভবিষ্যতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের এ দেশে বিনেয়োগে নিরুৎসাহিত করবে। ফলে বিশ্ববাজারে আমাদের যে প্রভাব রয়েছে তা অল্পদিনে গুটিয়ে যাবে। শিল্পোদ্যোক্তাদের অভিযোগ, এমনিতেই নানা মুখী প্রতিকূল পরিবেশের কারণে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুতের সংযোগ না পাওয়ায় তাদের উৎপাদনে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি এই বাধাকে আরো শক্তিশালী করবে।

অন্যদিকে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি বস্ত্রখাতকে ব্যাপক ভাবে প্রভাবিত করবে। সস্তা শ্রম ও গ্যাস ছাড়া বাংলাদেশের নিজস্ব কোন সম্পদ নেই। শিল্পের কাঁচামাল ও মেশিনারিজসহ সবই আমদানি করতে হয়। অন্যদিকে প্রতিযোগী দেশ ভারতের তুলা থেকে শুরু করে মেশিনারিজ সবই আছে। গত কয়েক মাস আগে ভারত নতুন বস্ত্রনীতিতে সাড়ে ৬ হাজার কোটি রুপি প্রণোদনা অনুমোদন দিয়েছে। আগামী ৩ বছরে পোশাক শিল্পে বাংলাদেশকে টপকানোর ঘোষণা করেছে দেশেটি। তুলা, সুতাসহ সব ধরণের কাঁচামাল এবং মূলধনী যন্ত্রপাতি ভারতের নিজস্ব। একারণে এ ধরণের প্রতিযোগীতার মুখে এবার আর টিকতে পারবে না আমাদের বস্ত্রখাত। অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে বস্ত্র শিল্প প্রধান হিসেবে ভূমিকা পালন করছে। ইউরোপসহ অন্যান্য দেশগুলোতে আমাদের দেশের বস্ত্রখাতে যে বিচরণ ছিলো সেটা ক্রমাগত ভাবে ভারতের দখলে চলে যাচ্ছে। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি এই দখলে যাওয়ার কাজকে বেশ গতি যোগাবে।

গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি দেশের কৃষি খাতকেও চরম বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিবে। উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে এই অজুহাতে গ্যাসের দাম বাড়ার আগেই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সারের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। চলতি বছরের প্রথম ভাগেই শিল্প মন্ত্রণালয় প্রতি টন ইউরিয়া ১৪ হাজার টাকার স্থলে ১৮ হাজার টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছে। এতে প্রতি টনের দাম বাড়বে ৪ হাজার টাকা এবং প্রতি ৫০ কেজি বস্তাপ্রতি দাম বাড়বে ২০০ টাকা। গ্যাস সংকটে বছরের ৭ মাস সার কারখানাগুলো বন্ধ থাকে। একদিকে দাম বৃদ্ধি অন্যদিকে কারখানা বন্ধ থাকার ফলে সারের সংকট দুয়ে মিলে দেশের কৃষি ব্যবস্থাকে চরম বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। এখনো বাংলাদেশের প্রায় ৮০ শতাংশ লোক কৃষির উপর নির্ভরশীল কৃষি খাতে বিপর্যয় এই মানুষগুলোর জীবন মানে বড় ধরণের দূর্ভোগ ডেকে আনবে। দেশের গ্রামীন পরিবারগুলো প্রায় সম্পূর্ণটাই কৃষি নির্ভর। সারের যোগানের সমস্যা হওয়া মানে কৃষি খাতে বিরূপ প্রক্রিয়া সৃষ্টি হওয়া আর এর মানে গ্রামীন পরিবারে দারিদ্রতাকে বাড়িয়ে দেয়া।

গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি পরিবহন খাতে যে নৈরাজ্য চলছে তাতে নতুন ভাবে ইন্ধন যোগাবে। সিএনজি   (রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস) এর দাম ১ মার্চ থেকে বাড়ানো হয়েছে ৩৫ টাকা(পূর্ব মূল্য) থেকে ৩৮ টাকা প্রতি ঘনমিটার। ২০০০ সালে পরিবেশ দূষণ থেকে নগরীকে বাঁচাতে সরকারি উৎসাহে পরিবহন খাতে রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহার শুরু হয়। বর্তমানে সিএনজিতে রূপান্তরিত গাড়ির সংখ্যা ৩ লাখেরও বেশি। প্রথমে প্রতি ঘনমিটার সিএনাজির দাম ছিলো ৭ টাকা ৪৫ পয়সা। কিন্তু গত ১৬ বছরে এর দাম বেড়েছে ৫৩৭ শতাংশ। সিএনজি (রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস)-র  এমন দাম বাড়ার ফলে পরিবহন খাতে ভাড়া নিয়ে বেশ নৈরাজ্য পরিবেশের সৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায় ঢাকা শহরের ৮৭ শতাংশ সিএনজি চালিত অটোরিকশা চালক মিটারে নির্ধারিত ভাড়ায় কোন গন্তব্যে যেতে চান না। চালকদের ৩৫ শতাংশ যাত্রীদের পছন্দের জায়গায় যেতে অস্বীকার করে। বাধ্য হয়ে বেশি বাড়ায় যেতে হয়। ৮৫ শতাংশ ক্ষেত্রে মিটারের চেয়ে ২০ থেকে ৪০ টাকা বেশি ভাড়া পরিশোধ করতে হয়। পরিবহন খাতের চলমান এই অরাজক পরিস্থিতির জন্য কোন ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টা গ্যাসের দাম বাড়ানোর ফলে অরাজকতা আরো বাড়বে।

এখন কথা হলো এতো সমস্যা সৃষ্টির স্পষ্ট ইঙ্গিত থাকার পরেও কেনো সরকার গ্যাসে দাম বৃদ্ধি করছে? গ্যাসের মওজুদ ফুরিয়ে যাওয়ার যে অজুহাত সরকার দেখাচ্ছে তা ধোপে টিকে না। কারণ সরকার গ্যাসের অনুসন্ধান না চালিয়ে গ্যাসের দাম বাড়িয়ে এর স্থায়ী কোন সমাধান দিতে পারবে না। ২০১২ সালে সমুদ্র সীমা নিষ্পত্তির পর থেকে মিয়ানমার অসংখ্য অনুসন্ধান চালিয়ে ৫টি গ্যাসক্ষেত্রে খুঁজে পেয়েছে। সেখানে বাংলাদেশ কোন অনুসন্ধান চালায়নি এবং কোন উদ্যোগও গ্রহণ করেনি। দেশে যখন বিদ্যুতের ভয়াবহ সংকট চলছিল, সে সময় সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুত কেন্দ্র এনেছে যা আজ অবধি অব্যাহত রয়েছে। জনস্বার্থ বিবেচনায় অনুরূপ ভাবে গ্যাসের দাম না বাড়িয়ে এই খাতে অন্তত ৫ বছর ভর্তুকি বহাল রাখা উচিত। কারণ গ্যাসের দাম বাড়ার ফলে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি থেকে শুরু করে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উৎপাদন ব্যয়, সাধারণ মানুষের জীবন জীবিকার ব্যয় বাড়বে। সব মিলিয়ে দেশের চলমান উন্নয়নের গতি স্থবির হয়ে পড়বে এবং দেশে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।

তাই উন্নয়নের গতিধারা নিরবচ্ছিন্ন রাখতে গ্যাস উত্তোলন করে ও সরবরাহ ব্যবস্থা ত্রুটিহীন রেখে এর দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখা প্রয়োজন।

Saturday, March 11, 2017

শিক্ষার সর্বগ্রাসী সংকট : মেধাহীন প্রজন্ম সৃষ্টির কূটকৌশল

শাহাদত হোসেন বাচ্চু


 

এক

উন্নয়নের সবচেয়ে বড় মাপকাঠি ‘মানব-সম্পদ উন্নয়ন’। প্রশ্নপত্র ফাঁস আর ‘গায়েবী’ নির্দেশে পরীক্ষা পাশের হার বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় মানব-সম্পদ ‘ধুঁকছে’;  মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিপর্যস্ত শিক্ষকদের দলাদলিতে। স্কুল শিক্ষকদের পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে, পিপার-স্প্রে দিয়ে শাসন করা হয়। একজন সংসদ সদস্য শিক্ষকদের উদোম করে রাস্তা প্রদক্ষিণ করিয়েছেন, প্রকাশ্যে কান ধরে ওঠ-বস করিয়েছেন আরেক সংসদ সদস্য।  এর ফলে শিক্ষকরা উদোম বা কান ধরে ওঠ-বস করেছেন, না গোটা জাতি করেছে- এ নিয়ে ভাবার সময় নেই। আর শিক্ষক নেতাদের মুখে তো কুলুপ!

প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি শিক্ষামন্ত্রী প্রথমে কানেই তোলেননি। ‘গুজব’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি নীতি পাল্টেছেন। সবশেষে বলেছেন, অত্যাধুনিক প্রযুক্তির যুগে প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকানো পুরোপুরি সম্ভব নয়। এর আগে বলেছিলেন, “কিছুসংখ্যক ‘কুলাঙ্গার’ শিক্ষক প্রশ্ন ফাঁস করে দিচ্ছে। কিভাবে প্রশ্ন ফাঁস সামলাবো”? তারপরে বলেছিলেন, “আমাদের ভাল শিক্ষক নেই”। এইসব কথামালা একটি বিষয়কেই ইঙ্গিত করে- হয় প্রশ্ন ফাঁসকারীরা সরকারের চেয়ে শক্তিশালী, অথবা সরকারের প্রভাবশালীরা প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত।

ভুলে ভরা বিকৃত পাঠ্যবই পৌঁছাচ্ছে আর মৌখিক নির্দেশনা দিয়ে পাশের হার বাড়াচ্ছে। শিক্ষায় শনৈ: শনৈ: উন্নতির গল্প শুনছে মানুষ। এর মধ্য দিয়ে কি মনোজগত তৈরী হচ্ছে শিক্ষার্থীদের? সারাদেশে কিশোর অপরাধ বাড়ার কারন কি এই ভুল-বিকৃত শিক্ষার মনোজমিন। এর মধ্য দিয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে যে মৌলিক ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে- সেই তুলনায় সময়মত বই পৌঁছানো কি সত্যিই সাফল্য? কি ফলাও করেই না এই সাফল্য প্রচার করা হয়!

সত্যটা কি উপলব্দিতে আছে? দেশ থেকে লাখ লাখ কোটি টাকা পাচার-আত্মসাত হলেও ক্ষতি পোষানো যায়! চাইলে চলমান হত্যাকান্ড থামিয়ে আইন-শৃঙ্খলার উন্নয়নও করা সম্ভব; ধ্বসে যাওয়া নির্বাচন ব্যবস্থা মেরামত সম্ভব। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের চুরিও বন্ধ করা যায়। কিন্তু শিক্ষা ক্ষেত্রে অন্তর্গত ক্ষতি-ধ্বস কি ইচ্ছে করলেই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব? এর জন্য কত সময় লাগবে, কত মূল্য দিতে হবে জানা নেই। অন্তত: একটি প্রজন্ম তো বটেই।

প্রশ্ন ফাঁস, নম্বর বাড়িয়ে দেয়ার নির্দেশের মত অশিক্ষা নিয়ে যারা পাশ করে বের হচ্ছে, আগামী এক-দেড় দশক পরে তারাই নেতৃত্বে থাকবে। এই শিক্ষা ও মেধা নিয়ে তারা কেমন নেতৃত্ব দেবেন? মেধাবী-যোগ্য মানুষ কি পাওয়া যাবে? ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্নের সুযোগে যারা ডাক্তার হয়ে বেরিয়ে আসবেন, তারা কি চিকিৎসা সেবা দেবে? ভয়াবহতা-ধ্বস কতটা ঘটেছে, আপাত: আমোদে মত্ত আমরা কি তা অনুমান করতে পারছি!

এটি স্বীকৃত সত্য যে, দেশে মানুষকে মেধার ভিত্তিতে শিক্ষিত করা গেলে মানব সম্পদের উন্নয়ন ঘটে। শ্রীলঙ্কা এর সবচেয়ে বড় উদাহরন। সেখানে মানবসম্পদ উন্নয়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ায় উন্নয়ন তার আপন গতি পেয়েছে। রাস্তা-ফ্লাইওভার, সেতু নির্মান উন্নয়ন নয়, উন্নয়ন সহায়ক কাজ। প্রযুক্তি তখনই গুরুত্বপূর্ণ যখন শিক্ষা-মেধা দিয়ে সেগুলি তৈরী করে মানুষ ব্যবহার করে উপকৃত হয়। এখানে অমূল্য একটি প্রশ্ন হচ্ছে- এই ব্যবস্থার কি শিক্ষা-মেধা কোনটি নিশ্চিত করছে, কি নিশ্চিত করবে?

আমরা কি তাহলে পুরো ব্যবস্থাই ধ্বংস করে দিলাম? ৯৫ শতাংশ মানুষের সন্তান যে শিক্ষা ব্যবস্থার অংশ তার কথাই বলা হচ্ছে – ৫ শতাংশের সন্তানরা ইংরেজী মাধ্যমে পড়ালেখা করে। ‘ও’ লেভেল পাশ করে উন্নত দেশের নামী-দামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যায়, সেটির আরও উন্নতি হচ্ছে। এই যে বৈষম্য তা থাকবে না- মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তো ছিল সেটিই। সুতরাং ৯৫ শতাংশের ব্যবস্থা ধ্বসিয়ে দিয়ে কিভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠিত হবে?

দুই

এক দলদাস শিক্ষকের কথা বলি। এমত শিক্ষক এখন ছড়ানো-ছিটানো সর্বত্র। শিক্ষার ধ্বস, অবনমন ও নজিরবিহীন অনাচারের বিরুদ্ধে এরা কথা বলেন না কখনও। এরকম এক দলদাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের প্রফেসর আব্দুল আজিজ ২০১৪ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকীতে ছাত্রলীগের আলোচনা সভায় যা বলেছিলেন তা মনে করিয়ে দেব। ঐ সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী  আসাদুজ্জামান নুর।

“ছাত্রলীগের সব নেতা-কর্মীদের চাকরী দিতে হবে। খেয়াল রাখতে হক্ষে, কোন কর্মী যেন বেকার না থাকে। ছাত্রলীগ নেতাদের রেজাল্টের প্রয়োজন নেই। তাদের গায়ের ক্ষতচিহ্নই তাদের বড় যোগ্যতা…। বর্তমান সরকারের আমলে কেবল ছাত্রলীগ কর্মীদের চাকরী দিতে সরকারকে আহবান জানাই”। প্রফেসর আজিজের এই মৌলিক প্রস্তাবনার প্রতিধ্বনি ছিল প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের কথায়। তিনিও বলেছিলেন, ছাত্রলীগ কর্মীদের শুধু লিখিত পরীক্ষায় পাশ করলেই হবে, বাকিটুকু তারা দেখবেন।

জাতির সবচেয়ে উজ্বল সময়ে ন্যায্য রাষ্ট্র চিন্তায় শিক্ষকরা ভূমিকা রেখেছিলেন। চিন্তায়, মননে  ছিলেন নির্মোহ, নির্লোভ, পক্ষপাতহীন। তারা জাতিকে সঠিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন। কিন্তু দলদাস শিক্ষকরা তাদের উত্তরাধিকার নন। এই শ্রেনীটি সবসময় সব ক্ষমতাসীনদের সাথেই আছেন। ক্রমাগত মূল্যবোধ-হ্রাসপ্রাপ্ত গত চার দশকে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে তাদের ভূমিকা হয়ে পড়েছে নতজানু। শিক্ষক-শিক্ষকতার এই অবনমন সবকিছুতেই গা সহা সমাজকে আর আলোড়িত করে না, আন্দোলিতও করে না।

শুরুর দিকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা স্কুল-কলেজ পর্যায়ে শিক্ষার ধ্বস নিয়ে প্রতিবাদী হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। শিক্ষামন্ত্রীর গোল্ডেন জিপিএ পাওয়া শিক্ষার্থীদের ১০ শতাংশের বেশি ভর্তি পরীক্ষায় টিকছে না- গণমাধ্যমে এমত সমালোচনার পর শিক্ষামন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া ছিল দেখার মত। খোদ প্রধানমন্ত্রী যখন বললেন, “আমাদের ছেলে-মেয়েরা বেশি সংখ্যায় পাশ করবে তাও অনেকে চায় না”। ব্যাস, শিক্ষক নেতৃবৃন্দ ভোল পাল্টে ফেললেন, গলা মেলামেল প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর সাথে। তারা বিবেচনা করেননি, এই দলদাস ভূমিকা শিক্ষার সর্বনাশের পাশাপাশি তাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে!

তিন

শিক্ষার সংকট কোথায়? এ আলোচনায় পরস্পর বিরোধিতা রয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলে শিক্ষা ব্যবস্থার অধ:পতন ঘটেছে। কিছুকাল আগেও নকল ছিল বিচ্ছিন্ন ঘটনা; এখন সেখানে সব ধরনের প্রশ্নপত্র ফাঁস রেওয়াজে পরিনত হয়েছে। স্কুলকেন্দ্রিক পড়াশুনার বদলে কোচিং সেন্টার বা প্রাইভেট শিক্ষক নির্ভর হয়ে পড়েছে শিক্ষার্থীরা। পরীক্ষার আগেই প্রশ্ন মিলছে। শিক্ষার্থীদের অনুশীলন যাচাইয়ের জন্য পরীক্ষা পদ্ধতি এখন কার্যত: অকার্যকর। এরসাথে যুক্ত হয়েছে শিক্ষার হার বাড়ানোর উচ্চাভিলাষ।

শিক্ষাবিদ প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, “শিক্ষার প্রধান সমস্যা তিনটি। প্রথমত: বাণিজ্যিকীকরণ। শিক্ষা পণ্যে পরিনত হয়েছে। পূঁজিবাদী সমাজে মুনাফাই যেহেতু লক্ষ্য, তাই পণ্যে ভেজাল হওয়া খুবই স্বাভাবিক। শিক্ষা নামক পণ্যটিতেও ওই ভেজালটা ঢুকে গেছে। দ্বিতীয়ত: রাষ্ট্রের গুরুত্বহীনতা; রাষ্ট্র যে শিক্ষাকে গুরুত্ব দেয় না, শিক্ষাই যে জাতির ভবিষ্যতের ভিত্তি, এটি রাষ্ট্র আমলে নেয় না। তৃতীয়ত: তিনধারার শিক্ষা; এটা রাষ্ট্র বাড়াচ্ছে। এরকম তিন ধারার শিক্ষা যত বাড়বে বৈষম্য তত বাড়বে”।

জাতিসংঘ ঘোষিত সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অন্যতম বিষয় ছিল শিক্ষার হার বৃদ্ধি। এই লক্ষ্যপূরণে মরিয়া সরকার পাশের হার বাড়াতে, পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে নম্বর বাড়িয়ে, মৌখিক নির্দেশনা দিয়ে রেখেছে। জেনুইন নম্বর দিতে গিয়ে অনেক শিক্ষক হেনস্তার শিকার হয়েছেন। এই সর্বগ্রাসী সরকারী চাহিদা মেটাতে মেধা মূল্যায়নে পরীক্ষা গ্রহণ পদ্ধতি কাজে আসছে না। প্রশ্ন ফাঁস, পরীক্ষা পদ্ধতির সংকট, খাতা মূল্যায়নে সরকারী নির্দেশনা কেবল নয়, পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা এখন সমস্যাজর্জর। সরকারী, বেসরকারী, মাদ্রাসা ও ইংরেজী  মাধ্যমে শিক্ষা কাঠামো এই বহুমুখী সংকটকে সর্বগ্রাসী করে তুলছে।

চার


শিক্ষার বিদ্যমান স্তরে প্রাথমিক শিক্ষা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীর সবদেশেই প্রাথমিক শিক্ষা গুরুত্ব পায়। বাংলাদেশেও তাই ছিল। এখন পয়তাাল্লিশ বয়সী এই দেশে ভাঙাচোরা প্রাথমিক স্কুল এখন দালানে পরিনত। ভাঙা ঘরে নিবেদিত প্রাণ শিক্ষক ছিলেন, স্কুল ছিল শিশুর দ্বিতীয় বাড়ি। শিক্ষক ছিলেন মা- বাবার পরের অভিভাবক। বঞ্চনা-কষ্টকে মেনে নিয়ে তারা শিশুকে একাডেমিক ও নৈতিক শিক্ষা দিতেন। কারো মধ্যে মেধার খোঁজ পেলে পরিচর্যা করতেন বিশেষভাবে।

ইট সিমেন্টের দালানে এখন “অন্যকিছু করতে না পারা” মেধাহীনরা প্রাথমিক শিক্ষায় নিয়োজিত। যিনি এইচএসসি পাশ করেছেন টেনেটুনে। চাকরি নিয়েছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য বা কোন ক্ষমতাধরকে অনৈতিক সুবিধা দিয়ে। এলাকায় তিনি ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হন। চাষ-বাস বা ব্যবসা করেন। মাঝে মধ্যে স্কুলে যান আড্ডার মেজাজে।

শিক্ষার এই সংকট মূলত: সমাজের দৈন্য চেহারা এবং পাশাপাশি এটি সংঘবদ্ধ অপরাধী সমাজ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছে। অগণতান্ত্রিক ও চরম বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থা নৈতিক বিপর্যয় ডেকে নিয়ে আসছে সমাজের সব স্তরে। মানুষ ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে এবং জড়িয়ে পড়ছে দখলদারিত্ব আর অনৈতিক প্রতিযোগিতায়। উগ্রপন্থা, সহিষ্ণুতার বিস্তার ঘটছে।

এই অবস্থা প্রমান করছে, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের মানবিক, প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক চেতনার নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারছে না। সংস্কৃতি বিনির্মানেও শিক্ষাব্যবস্থা অক্ষম। সামাজিক বৈষম্য দুর করা ও নানামতের প্রয়োজনীয়তা বোঝার বদলে শিক্ষার্থীরা হয়ে উঠছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক।

এর মূল কারন নিহিত রয়েছে রাষ্ট্রের উপরিকাঠামোয়। রাষ্ট্র যেমন গণতান্ত্রিক চেহারা বিসর্জন দিচ্ছে, কঠোর কর্তৃত্ববাদীতায় ঢেকে দিচ্ছে সবকিছু, শিক্ষাঙ্গনেও পড়েছে এর কড়ালগ্রাস। এই কঠোর, কর্তৃত্ববাদী শাসনে সরকার হয়ে উঠেছে আমলা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও অদৃশ্য শক্তি নির্ভর। শিক্ষা ব্যবস্থাকে আজকের অবস্থায় নিয়ে আসা এবং শিক্ষাঙ্গণে গণতন্ত্র চর্চা, প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতি নিপুন কৌশলে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে- শুধুমাত্র ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার বাসনায়।

এজন্যই প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, “সমাধানের প্রশ্নে গেলে বলব, সংস্কারের সময় শেষ হয়ে গেছে। এই শিক্ষাব্যবস্থাকে সংস্কারের আর কোন সুযোগ নেই। এখন সমাজের আমুল রূপান্তর দরকার। শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও সংশ্লিষ্টদের এখন আমুল পরিবর্তন ছাড়া যে কিছু সঠিক হবে না এই সত্যটি মানুষের কাছে নিয়ে যেতে হবে”।
  • উৎসঃ amaderbudhbar.com

কানাডার প্রধানমন্ত্রী থেকে রাষ্ট্রদূত কেউ জানাননি বিএনপি ‘সন্ত্রাসী দল’

মোহাম্মদ আলী বোখারী, টরন্টো থেকে

কানাডার প্রধানমন্ত্রী
জাস্টিন ট্রুডোর সাথে লেখক।

এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে পরিচালিত লাগাতার অনুসন্ধানে কানাডার প্রধানমন্ত্রী, বিচারমন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেল, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, জননিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রী, নাগরিকত্ব ও অভিবাসনমন্ত্রী এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত কানাডার রাষ্ট্রদূত, তারা কেউ জানাননি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল তথা বিএনপি একটি ‘সন্ত্রাসী দল’। একইসঙ্গে পুনর্বিবেচনার রায়ে প্রত্যাখ্যাত শরণার্থীর আবেদন ও পর্যবেক্ষণটিতেই বক্তব্য সীমাবদ্ধ রেখেছেন যথাক্রমে ফেডারেল কোর্টের প্রধান বিচারপতির প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও মিডিয়াবিষয়ক আইনি পরামর্শক। পাশাপাশি কানাডার জননিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একমাত্র মুখপাত্র তাদের ওয়েবসাইটে উল্লেখিত তালিকা খতিয়ে দেখার পরামর্শ দিলে তাতেও ‘সন্ত্রাসী দল’ হিসেবে বিএনপিকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। অথচ একজন শরণার্থীর আশ্রয় প্রার্থনার আবেদনের ভিত্তিতে অভিবাসন কর্মকর্তার পর্যবেক্ষণভিত্তিক ফলাফল এবং পুনর্বিবেচনার শুনানিতে একই কারণে খারিজ হওয়া রায়ের আদেশে নয়, বরং পর্যবেক্ষণে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধীদলীয় বিএনপি ‘অনুরূপ কৌশলে’ যুক্ত থাকার বিষয়টি বিশ্লেষিত হলেও বিএনপি একটি ‘সন্ত্রাসী দল’ হিসেবে চাউর হয়েছে। বলাবাহুল্য, ওই রায়টি ছিল একজন শরণার্থীর কানাডায় আশ্রয় মঞ্জুর সংক্রান্ত, যেখানে বিচারক নন বরং শরণার্থীই আবেদনে ‘অবিশ্বাস্যজনক ও আত্মঘাতী প্রক্রিয়ায়’ নিজের দল বিএনপিকে একটি ‘সন্ত্রাসী দল’ বানিয়েছে।

গত ২৫ জানুয়ারি কানাডার ফেডারেল কোর্ট প্রদত্ত ৩৩ পৃষ্ঠার রায়ে প্রকাশ, বাংলাদেশের জনৈক নাগরিক মোহাম্মদ জুয়েল হোসেন গাজী ২০১৩ সালের ১৮ জানুয়ারি কানাডায় এসে সেদিনই শরণার্থী হিসেবে আশ্রয়ের আবেদন করেন। তাতে ২৬ সেপ্টেম্বর তাকে আইনগতভাবে শরণার্থী করা হয়। পরবর্তীতে ২০১৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি স্থায়ী অভিবাসনের আবেদন করেন। পরের বছর ২৮ এপ্রিল প্রথম ধাপের অনুমোদন পান। দ্বিতীয় ধাপে নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তার আবেদন দীর্ঘায়িত ও পর্যায়ক্রমিক আইনগতভাবে ‘অগ্রহণযোগ্য’ হয়। আবেদনকারী কয়েক দফায় বিএনপির সদস্যপদের উল্লেখ করেন। তার ‘বিওসি’ বা বেসিস অব ক্লেইম বা দাবিগত ভিত্তির বর্ণনায় রয়েছে,  ১৯৯৭ সালের মাঝামাঝি ঢাকায় একটি কলেজে পড়াকালীন বিক্ষোভ, সেমিনার ও সভা জাতীয় রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশ নেন। ২০০৪ সালে পড়াশোনা করতে কোরিয়া যান এবং বাংলাদেশের উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ফিরে আসেন। ২০০৫ সালে তিনি জাপানে যান এবং দেশের ‘পরিস্থিতি অবলোকন’ করতে থাকেন। তার ভিসার মেয়াদ ফুরিয়ে গেলে গ্রেফতারপূর্বক ২০০৮ সালে বাংলাদেশে বিতাড়িত হন। ওই বছরের শেষে মিরপুর বিএনপির অধীন স্বেচ্ছাসেবক দলে যোগ দিয়ে পরবর্তী কয়েকটি নির্বাচনি প্রচারণা চালান। তিনি রাজনৈতিক দলেরও সদস্য ছিলেন। তার ভাষায়, ‘আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ অপরাপর বৃহৎ রাজনৈতিক দলের স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা তাকে বিএনপির আত্মনিবেদিত কর্মী হিসেবে চিনতেন এবং দলের সঙ্গে তার সৎ, হৃদয়সোপিত ও নিবেদিত সংশ্লিষ্টতা ছিল’। একইসঙ্গে স্বীকার করেন বিএনপির সদস্যপদ গ্রহণের ক্ষেত্রে তা ছিল মনস্থিরপূর্ণ, সেক্ষেত্রে বিএনপিতে কোনো ইস্যুই সৃষ্টি হয়নি, বরং তা প্রদান করা হয়েছে। ফলশ্রুতিতে ২০১৫ সালের ২৭ অক্টোবর অভিবাসনের অগ্রহণযোগ্যতার ৩৪(১) ধারায় ‘কানাডা বর্ডার সিকিউরিটি এজেন্সির জাতীয় নিরাপত্তা বাছাই বিভাগ বিএনপির কার্যক্রমের উপর তার বর্ণিত মতামতের ভিত্তিতে মূল্যায়ন সম্পন্ন করে, যেখানে বর্ণিত হয়েছে, বিএনপি ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পরিপূরণে সশস্ত্র সংগ্রাম ও সহিংসতা করে থাকে’। এছাড়া আবেদনকারীর বক্তব্যানুযায়ী বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি ‘অস্ত্রেশস্ত্রে যুদ্ধংদেহী হয়। তারা হাতবোমা, পিস্তল ও বড় তরবারি ব্যবহার করে। তারা হরতাল বা মিছিল চলাকালীন সরকার পক্ষের লোকদের উপর আক্রমণ করে। হরতাল চলাকালীন বাড়ি-ঘর থেকে কেউ বের হয়নি, অফিসপাড়া বন্ধ ছিল, কোনো যানবাহন চলেনি এবং রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা ছিল। এগুলোই বিরোধী দলের কর্মকা- ছিল’। এ কথাগুলোই তার অভিবাসন আবেদন ‘আইএমএম ৫৬৬৯’-এ বর্ণিত রয়েছে।

ফলশ্রুতিতে অভিবাসন কর্মকর্তা ফৌজদারি ধারা মতে, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের সংজ্ঞায় সন্ত্রাসী দল ব্যাখ্যায় অভিমত রাখেন, যদিও বিএনপির জন্য আবেদনকারীর ব্যক্তিগত সন্ত্রাসী ভূমিকা ছিল যৎসামান্য; তথাপি সরকারকে বাধ্য করতে বিএনপির লাগাতার হরতাল নির্ভরশীলতা অর্থনীতি ব্যাহত করার পাশাপাশি হরতালের ফলে সৃষ্ট সহিংসতা বিএনপির সন্ত্রাসী কান্ড হিসেবে বিবেচিত হয়। এক্ষেত্রে আবেদনকারীর জন্য অভিবাসন কর্মকর্তার ইস্যু হয়ে দাঁড়ায় সন্দেহাতীতভাবে বিএনপির কর্মকান্ড সন্ত্রাসমূলক কিনা। সেক্ষেত্রে মানসম্মত বিবেচনায় সুপ্রিম কোর্ট অব কানাডায় ২০০৮ সালে পরিচালিত ‘ডানসম্যুর বনাম নিউ ব্রন্সউইক’ মামলা এবং ‘গুতিয়ারেজ বনাম কানাডা’ মামলাসহ অপরাপর আইনি ব্যাখ্যায় বিচারক সদাশয় বিবেচনায় অভিবাসন কর্মকর্তার অভিমতের ভিত্তিতে রায়টিতে মতামত রাখেন, সন্ত্রাসে ‘বিএনপি যুক্ত ছিল, রয়েছে ও হবে’, যা কানাডার আইনে বিশদভাবে বিবৃত। তারপরও ওই রায়ে বিচারক হেনরি এস ব্রাউন অভিবাসন কর্মকর্তার উদঘাটিত তথ্য এবং অনলাইনে ‘বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি টেরোরিস্ট অ্যাক্টস’ শিরোনামে আবিষ্কৃত সংবাদ ও তথ্যের ভিত্তিতে মতামত দেন যে, বিএনপি ও আওয়ামী লীগ হচ্ছে বাংলাদেশে দুটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল। আবেদনকারীর একজন কৌঁসুলীর মতে বাংলাদেশের রাজনীতি সহিংস। আর সেই বিবেচনায় উভয় দলই অনুরূপ কৌশলে যুক্ত। অর্থাৎ ‘ইন দ্যাট রেসপেক্ট বোদ পার্টিজ হ্যাভ এঙ্গেজড ইন সিমিলার টেকটিকস’। তবে রায়ের মাত্র দুই লাইনের আদেশে বিচারক লিখেন, ‘দিস কোর্টস জাজমেন্ট ইজ দ্যাট দ্য অ্যাপ্লিকেশন ফর জুডিশিয়াল রিভিউ ইজ ডিস্মিসড্, নো কোয়েশ্চেন ইজ সার্টিফাইড অ্যান্ড দেয়ার ইজ নো অর্ডার অ্যাজ টু কস্টস’। অর্থাৎ এই কোর্টের রায়টি হচ্ছে আবেদনকারীর আইনি পুনর্বিবেচনাটি বাতিল করা হলো, কোনো প্রশ্ন সত্যায়ন করা হয়নি এবং খরচ প্রদানেরও কোনো আদেশ দেওয়া হয়নি’।

তবে ওই শরণার্থীর পক্ষে তার কৌঁসুলী বিচারকের কাছে পুনর্বিবেচনার শুনানিতে উত্থাপিত প্রশ্নের সত্যায়ন কেন করেননি, সেটি একটি দুর্বোধ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা সে প্রশ্নগুলো সত্যায়ন করা হলে, শরণার্থীর জন্য আপিলের সুযোগটি থাকত। এক্ষেত্রে টরন্টোয় বসবাসরত নেতৃস্থানীয় বিএনপির দুই নেতা যথাক্রমে মাহবুব রব চৌধুরী ও আবদুল আহাদ খন্দকার পৃথকভাবে এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘ওই শরণার্থী অবিশ্বাস্যজনক ও আত্মঘাতী প্রক্রিয়ায় আবেদনটি অভিবাসন কর্তৃপক্ষের কাছে করেছে। তাকে কানাডা বিএনপির কোনো কার্যক্রমে কখনোই দেখা যায়নি কিংবা তার সম্পর্কে কেউ কিছু জানেন না। আমরা সভা আয়োজন করে পুরো ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছি। তাছাড়া বিএনপি যে সন্ত্রাসী দল নয়, সে কথা বাংলাদেশের মানুষ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় জানেন। আমাদের দল বিএনপি অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় একটি অনির্বাচিত সরকারের কাছে অবর্ণনীয় নিষ্পেষণের শিকার। শুধু বিএনপি নয়, দেশের জনসাধারণেরও বাক-স্বাধীনতা বর্তমান সরকার হরণ করেছে; কেউ প্রতিবাদ জানাতে পারেন না’।

তথাপি বাংলাদেশে চাউর হওয়া সংবাদে বিএনপি আদৌ ‘সন্ত্রাসী দল’ কিনা, তা সুনিশ্চিত হতে এই প্রতিবেদক প্রায় ১০ দিন ধরে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, বিচারমন্ত্রী ও এটর্নি জেনারেল জোডি উইলসন-রেবল্ড, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড, জননিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রী রাল্ফ গোদেল, নাগরিকত্ব ও অভিবাসনমন্ত্রী আহমেদ হোসেন, বাংলাদেশে নিযুক্ত কানাডার রাষ্ট্রদূত বেনওয়া-পিয়ের লাহামিসহ তাদের মিডিয়া কর্মকর্তা এবং ফেডারেল কোর্টের প্রধান বিচারপতির প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও মিডিয়া বিষয়ক লিগ্যাল কাউন্সিলকে ওই শরণার্থীর ৩৩ পৃষ্ঠার প্রত্যাখ্যাত রায়ের কপিসহ ই-মেইল ও টেলিফোনে যোগাযোগ করেন।

এতে জননিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রীর স্পোকপার্সন বা মুখপাত্র এন্ড্রু গোউইং লিখিতভাবে মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে তালিকাভুক্ত ৫৩টি ‘টেরোরিস্ট এনটিটিজ’ বা ‘সন্ত্রাসী সংগঠনসমূহ’ খতিয়ে দেখার পরামর্শ দেন, যাতে বিএনপি বা বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টির নামটি অনুপস্থিত। এছাড়া বাংলাদেশে নিযুক্ত কানাডার রাষ্ট্রদূতের পক্ষে পররাষ্ট্রনীতি ও কূটনীতি বিভাগের সিনিয়র পাবলিক অ্যাফেয়ার্স উপদেষ্টা শাহীন ইসলাম প্রতিবেদকের মূল ই-মেইলে উল্লেখিত ‘কানাডা থেকে মিডিয়া অনুসন্ধান: বিএনপি সন্ত্রাসী দল কিনা’ শিরোনামের প্রত্যুত্তরে শুধুই ‘কানাডা থেকে মিডিয়া অনুসন্ধান’ শিরোনামটি ও লিখিত অনুসন্ধানী বিষয়বস্তু অবিকৃত রেখে কানাডার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ‘গ্লোবাল অ্যাফিয়ার্সের’ গণসংযোগ বিভাগে যোগাযোগের পরামর্শ দেন, যদিও তিনি ফোনে আগেই একটি উত্তর দেওয়া হবে বলে জানান। এদিকে গ্লোবাল অ্যাফিয়ার্সের দায়িত্বশীল মিডিয়া কর্মকর্তা জোসলিন সুইট জানিয়েছেন বিষয়টি সম্পর্কে সম্যক তথ্য দিতে পারেন একমাত্র জননিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রণালয়, যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে প্রেরিত ই-মেইলের পরিপ্রেক্ষিতে ফোনে ফেডারেল কোর্টের প্রধান বিচারপতির প্রশাসনিক কর্মকর্তা লিজ লাফ্রিনিয়ার হেনরি জানান, ‘ওই মামলাটি ছিল গাজী বনাম কানাডা পক্ষের মাঝে এবং সে কথা রায়ের প্রথম অনুচ্ছেদেই বিবৃত। সে কারণে মামলায় রাজনৈতিক দল বিএনপি কোনো পক্ষই ছিল না, গাজী কানাডায় তার শরণার্থী আবেদন মঞ্জুরের জন্য পুনর্বিবেচনার আবেদনটি করেন’। আর লিজ হেনরির সে কথাটিই ফেডারেল কোর্টের মিডিয়া বিষয়ক আইনি পরামর্শক এন্ড্রু বৌমবার্গ ই-মেইলে ভিন্নভাবে জানান, ‘ওই মামলার সিদ্ধান্ত সংবলিত প্রথম অনুচ্ছেদেই শুনানির গুরুত্বপূর্ণ ধরনটি রয়েছে, যেখানে ষোল অনুচ্ছেদে কোর্ট ইস্যুটি বেছে নিয়েছে। একইভাবে সতের থেকে বাইশ অনুচ্ছেদে কোর্ট বিচারিক পুনর্বিবেচনার সীমাবদ্ধতাটি তুলে ধরেছে, যা একান্ন অনুচ্ছেদে সারাংশ হিসেবে দাঁড়িয়েছে’। অপরদিকে বারংবার ফোনে যোগাযোগ সত্ত্বেও কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, বিচারমন্ত্রী ও এটর্নি জেনারেল জোডি উইলসন-রেবল্ড, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড এবং নাগরিকত্ব ও অভিবাসনমন্ত্রী আহমেদ হোসেনের মন্ত্রণালয় থেকে কোনো প্রত্যুত্তর না আসায় কানাডার জননিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে বিএনপি ‘সন্ত্রাসী তালিকাভুক্ত সংগঠন’ নয় সেটিই কারণ হিসেবে দৃশ্যমান।

Thursday, March 9, 2017

নাগরিকত্ব আইন : মানুষ যেন শৃঙ্খলিত না হয়





হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ


বর্তমান সরকার বাংলাদেশ নাগরিকত্ব আইন-২০১৬ নামে একটি আইন পাস করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এ হিসেবে গত ১ ফেব্রুয়ারি-২০১৬ খ্রিস্টাব্দ সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে বাংলাদেশ নাগরিকত্ব আইন-২০১৬ এর অনুমোদন দেওয়া হয়। ১৯৫১ সালের সিটিজেনশিপ অ্যাক্ট, বাংলাদেশ নাগরিকত্ব অধ্যাদেশ-১৯৭২ এবং আইন কমিশনের ২০০৫ ও ২০১২ সালের সুপারিশের আলোকে নাগিরকত্বের খসড়া আইনটি চূড়ান্ত করা হয়েছে।   সংসদে যে কোনো অধিবেশনে এটা বিল আকারে উত্থাপিত হবে এবং পরবর্তীতে পাস হলে এটা আইন আকারে প্রতিষ্ঠা পাবে। আইনটিতে নাগরিকত্ব অর্জনের বিভিন্ন পদ্ধতি, নাগরিকত্বের অযোগ্যতা, পরিত্যাগ, অবসান এবং অপরাধ বিচার ও দণ্ড ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আইনটির উৎকর্ষ ও অপকর্ষের বিষয়ে আলোচনার আগে আমরা নাগরিকত্ব বলতে কী বুঝি সেটা একটু আলোকপাত করা প্রয়োজন। 

বস্তুত সেই ব্যক্তি নাগরিক যিনি কোনো রাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন, রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য পোষণ করেন, রাষ্ট্র প্রদত্ত সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার উপভোগ করেন এবং রাষ্ট্রের প্রতি কর্তব্য পালন করেন। এই বৈশিষ্ট্যগুলো যার মধ্যে বিদ্যমান তিনিই একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃত। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ নাগরিকত্ব আইন-২০১৬ এর বিভিন্ন ধারায় যে অসঙ্গতি বা ত্রুটিগুলো সমাজের আইনজ্ঞসহ বিশিষ্টজনদের চোখে অনুমিত হয়েছে তা থেকে বলা যায় যে, প্রস্তাবিত আইনের ৩ ধারা অনুযায়ী আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইন, আইনগত দলিল, রায়, ডিক্রি ইত্যাদিতে যা কিছুই থাকুক না কেন তার ওপর প্রাধান্য পাবে। উক্ত ৩ ধারাটি সংবিধানের ৭(২) অনুচ্ছেদের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। ৭(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোনো আইন যদি এই সংবিধানের সঙ্গে অসামঞ্জস্য হয় তাহলে সে আইনে যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ ততখানি বাতিল হবে। তাছাড়া আমরা জানি যে কোনো আইনের ব্যাখ্যাকর্তা ও সংবিধানের অভিভাবক হিসেবে বিচার বিভাগের প্রাধান্য স্বীকৃত। তবে এ আইনের ক্ষেত্রে সে বিষয়টির কোনো ব্যত্যয় হবে কিনা তা সবার ভেবে দেখা প্রয়োজন। 

আইনের ৪ ধারায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী প্রত্যেক ব্যক্তি জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক হবেন যদি তার পিতা-মাতা এ আইন বলবৎ হওয়ার তারিখে বা উহার পরে অথবা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ হতে এই আইন বলবৎ হওয়ার অব্যবহিত পূর্ব পর্যন্ত সময়ের মধ্যে জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক হন বা থাকেন। কিন্তু অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছেন যারা ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় বিদেশে চলে গিয়ে লন্ডন, আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাস করছেন। যদি এ আইন পাস হয় তাহলে তাদের এবং তাদের ছেলেমেয়েদের নাগরিকত্ব পাওয়ার ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি হতে পারে। আবার ৪ এর (২) উপধারা (খ) পিতা বা মাতা বিদেশি শত্রু হন তাহলে তিনি বাংলাদেশের নাগরিক বলে গণ্য হবেন না। এক্ষেত্রে পিতা-মাতার অপরাধের কারণে তার দায় সন্তানের ওপর আসা ন্যায়সঙ্গত নয় বলে বিবেচিত হবে।  

এই আইনের ৫ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের বাইরে জন্মগ্রহণ করলেও বাংলাদেশের নাগরিক হবেন, যদি তার বাবা-মা এই আইন কার্যকর হওয়ার আগে বাংলাদেশের নাগরিক হন। এ জন্য সন্তান জন্মানোর দুই বছরের মধ্যে ওই দূতাবাস বা মিশনের কার্যালয়ে নাম নিবন্ধন করতে হবে। তা না হলে ওই সন্তান জন্মগ্রহণ সূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক বলে বিবেচ্য হবেন না। এই আইন প্রবর্তনের পর কোনো প্রবাসী বাংলাদেশের নাগরিকত্ব লাভ করলে এবং প্রবাসে তার কোনো সন্তান জন্মগ্রহণ করলে উক্ত সন্তান জন্মগ্রহণের দুই বছরের মধ্যে দূতাবাস বা হাইকমিশন অফিসে নাম নিবন্ধন না করলে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব লাভের যোগ্য হবে না। কিন্তু এ আইনের মধ্যে কোনো সুস্পষ্টতা না থাকায় প্রবাসে বসবাসরত তৃতীয় এবং চতুর্থ প্রজন্মের সন্তানদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব লাভের ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি হবে। এ আইনের ৬ ধারায় প্রবাসীদের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, বিদেশে বাস করলে তার আবেদনের ভিত্তিতে তিনি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব লাভ করতে পারবেন। যদি তার বাবা-মা, দাদা বা নানা বিদেশি নাগরিকত্ব গ্রহণের আগে বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে থাকেন। তবে অনুরূপ প্রবাসী নাগরিকদের সীমাবদ্ধতা বিষয়ে ৭ এর (২) উপধারায় বলা হয়েছে যে, (৬) ধারা অনুযায়ী নাগরিকত্ব প্রাপ্ত ব্যক্তিরা বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ বা স্থানীয় সরকারের কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। এছাড়া রাষ্ট্রপতি পদে, বিচারক পদে বা প্রজাতন্ত্রের কোনো চাকরিতে নিয়োগ পাবেন না। এমনকি রাজনৈতিক সংগঠন করতে পারবেন না। বাংলাদেশের কেউ যদি এখন বিদেশে যান এবং তার সন্তান জন্ম হয় তাহলে সেই সন্তান বাংলাদেশের নাগরিক হবেন অথচ নির্বাচন করতে ও রাজনৈতিক সংগঠন করতে পারবেন না আবার প্রজাতন্ত্রের চাকরিতে নিয়োগ পাবেন না যা সংবিধানের ২৯ (সরকারি নিয়োগ লাভে সুযোগের সমতা) ৩৮ অনুচ্ছেদের (সংগঠনের স্বাধীনতা) পরিপন্থী। তাছাড়া দেশের অনেক মেধাবী তরুণ প্রবাসে থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশে এসে সব পর্যায়ে সেবা করতে চায়। কিন্তু এ আইনের কঠিন শর্তের বেড়াজালে পড়ে তাদের অনেকের সেবা থেকে জাতি বঞ্চিত হবে। আইনের ৮ ধারায় দ্বৈত নাগরিকত্ব বিষয়ে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের কোনো নাগরিক সার্কভুক্ত দেশ, মিয়ানমার বা সরকার কর্তৃক গেজেট প্রজ্ঞাপন দ্বারা নাগরিকত্ব গ্রহণের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষিত রাষ্ট্র ব্যতীত বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে এমন যে কোনো রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ করতে পারবে। এই আইনে এটা নতুনভাবে সংযোজিত হয়েছে। তবে ৮ এর ২(১) ধারায় আছে, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক জাতীয় সংসদ সদস্য বা সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিত বা শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য বা প্রজাতন্ত্রের অসামরিক কর্মে নিয়োজিত থাকার সময়ে দ্বৈত নাগরিকত্ব গ্রহণ করা যাবে না। এক্ষেত্রে অনেক সংসদ সদস্যের সদস্যপদ নিয়ে প্রশ্ন উঠবে, কেননা তাদের অনেকের দ্বৈত নাগরিকত্ব রয়েছে। তবে বাংলাদেশে দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে যারা বসবাস করছে তাদের একটা তালিকা সরকারের করা উচিত বলে অনেকে মনে করেন। 

প্রস্তাবিত আইনের ১১ ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশের কোনো নাগরিক বিদেশি কোনো নাগরিকের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলে উক্ত বিদেশি নাগরিককে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব লাভের শর্ত হিসেবে কমপক্ষে পাঁচ বছর বাংলাদেশে বসবাস করতে হবে। এক্ষেত্রে নাগরিকত্ব লাভের কঠিন শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এতে বরং ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশ। কেননা এখানে শর্ত শিথিল করা হলে বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকত। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ আর্থিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে। 
আবার আইনের ১২ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ভূখণ্ড বাংলাদেশের অংশ হিসেবে সংযোজিত হলে বা অন্তর্ভুক্ত হলে সেখানকার অধিবাসীরা নাগরিক হতে পারবেন। তবে কারা নাগরিক হবেন সেই তালিকা সরকার গেজেট প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রকাশ করবে এবং এই তালিকার লোকজনই নাগরিক হতে পারবেন। এখানে তালিকা করার সময় স্বজনপ্রীতি, সংগঠনপ্রীতি ও আদর্শপ্রীতি দেখে তালিকা করলে অনেকে নাগরিকত্ব প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হবে। ইদানীং বাংলাদেশের ছিটমহলগুলোতে এমন প্রশ্ন উঠেছে। প্রস্তাবিত আইনের ১৩ তে নাগরিক অধিকারের ওপর কতিপয় বাধা নিষেধ ধারা ৫, , , ১০ ও ১১ এর অধীনে যথাক্রমে বংশসূত্রে নাগরিকত্ব, দ্বৈত নাগরিকত্ব, সম্মানসূচক নাগরিকত্ব, দেশীয়করণ সূত্রে নাগরিকত্ব ও বৈবাহিক সূত্রে নাগরিকত্ব প্রাপ্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে সরকারি কোনো চাকরি অথবা কর্মে এবং সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হিসেবে নিয়োগ লাভের যোগ্য হবেন না। অধিকন্তু রাষ্ট্রপতি পদে অথবা জাতীয় সংসদ সদস্য পদে অথবা স্থানীয় সরকারের যে কোনো পদে নির্বাচনে অংশগ্রহণ বা রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত হতে পারবেন না। এটাও যেমন নাগরিকত্বের সাংবিধানিক মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী তেমনি মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণার সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। 

এই আইনের ১৮ ধারায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কেউ যুদ্ধ করে থাকলে তার নাগরিকত্ব থাকবে না। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে যারা আন্দোলনের নামে বাংলাদেশ থেকে বিছিন্ন হতে চায় তাদের নাগরিকত্ব কীভাবে নির্ধারিত হবে এবং আইনের ২০ ধারায় আছে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রত্যাহার করেছেন এমন তথ্য পেলেই একজনের নাগরিকত্ব চলে যাবে। কিন্তু তিনি কীভাবে বাংলাদেশবিরোধী বা আনুগত্যহীন তা পরিমাপের ক্ষেত্রগুলোকে কি সেটার বিস্তারিত ব্যাখ্যা এই আইনে নেই। এমনকি বাংলাদেশে বসবাসরত বিহারি সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ বিভিন্ন সময়ে উচ্চ আদালতের রায়ের ভিত্তিতে তাদের নাগরিক অধিকার লাভ করলেও এই আইনের ফলে তাদের নাগরিক অধিকার খর্ব হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন। প্রবাসে বসবাসরত বাংলাদেশিরাও এই নাগরিকত্ব আইনের কথা জেনে নাগরিক ও সাংবিধানিক অধিকার নিয়ে উদ্বেগে আছেন। কারণ এ ধরনের বৈষম্যমূলক নাগরিকত্ব আইন কারও জন্য মঙ্গলজনক নয়। বিদেশে ননরেসিডেন্স বাংলাদেশি এবং দ্বৈত নাগরিকরা বাংলাদেশে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা বিনিয়োগ করেন এবং প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে প্রেরণ করেন। এই আইনে তাদের নাগরিক অধিকার সঙ্কুচিত করার ফলে সর্বোপরি বাংলাদেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করবে। এমনকি ননরেসিডেন্স বাংলাদেশিদের মধ্যে অনেকের সহায়-সম্পদ বাংলাদেশে আছে। সেক্ষেত্রে তাদের সহায়-সম্পদ রক্ষা ও বণ্টনের ক্ষেত্রে যাতে নাগরিক সুবিধা ভোগ করতে পারে সে বিষয়টি ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে বলে অনেক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। 

অধিকন্তু গত ৯ ফেব্রুয়ারি সেন্টার ফর এনআরবি আয়োজিত নাগরিকত্ব আইন-২০১৬শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিকবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী বলেন, দ্বৈত নাগরিকত্ব বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন, যাতে মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা দায়িত্ববোধ ভেঙে না যায়। তিনি আইনটির খসড়া আরও যাচাই-বাছাই হবে বলে মতামত দেন। অন্যদিকে একই সভায় সংসদবিষয়ক সচিব শহিদুল হক বলেন, প্রস্তাবিত নাগরিকত্ব আইনের ৭ এর (২) এর (গ) এবং (ঙ) ধারায় বর্ণিত রাজনীতি ও নির্বাচন করার নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি বাতিল করা হবে মর্মে সভায় উপস্থিত সবাইকে অবহিত করেন এবং উক্ত সভার প্রধান অতিথি আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও সচিবের বক্তব্য সমর্থন করে বাংলাদেশি নাগরিক ও প্রবাসী নাগরিকের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে না বলে মতামত দেন। 
      
পরিশেষে বলা যায়, কোনো আইন প্রণয়নের আগে জনস্বার্থ ও সর্বজনীন বিষয়টি চিন্তা করা প্রয়োজন। এই আইনের দ্বারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে কোনো বিশেষ শ্রেণির মানুষের সুবিধা তৈরি করে অন্য কারও অধিকার সঙ্কুচিত করলে তাতে সার্বিক জনকল্যাণ নিশ্চিত হবে না। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড, মানবাধিকার ও প্রচলিত সংবিধানের মৌলিক অধিকারের বিষয়গুলো বিবেচনা নিয়ে নাগরিকত্ব আইনটি হওয়া উচিত বলে বিশিষ্টজনরা মনে করেন। বর্তমান পৃথিবীতে প্রায় এক কোটি মানুষ আছে যাদের কোনো রাষ্ট্র নেই। এর একটা বড় কারণ বিভিন্ন দেশের নাগরিকত্ব আইন। তাই এই আইনের ফলে আমাদের দেশের মানুষ তার নিজের জন্মভূমি থেকে যেন নাগিরকত্ব হারিয়ে রাষ্ট্রহীন অবস্থায় পড়ে না যায়। একই সঙ্গে পিতা-মাতার দায় যেন সন্তানের ওপর না আসে সেই গুরুত্বপূর্ণ দিকটি বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন। আবার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এর অপব্যবহার ও অপ্রয়োগ না হয় সেদিকে সবার দৃষ্টি দেওয়া আবশ্যক। এ ছাড়া আইনটি কার্যকরের আগে এর খসড়া অংশটিও ওয়েভসাইটে প্রকাশ করে সুশীল সমাজসহ দেশে-বিদেশের ব্যাপক মানুষের মতামত গ্রহণ করা যেতে পারে।   এর ফলে স্বচ্ছতার সঙ্গে ও সার্বিক মানবাধিকার সন্নিবেশিত সাপেক্ষে নাগরিকত্ব আইন-২০১৬ কার্যকর হতে পারে।   তখন আর এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন তোলার সুযোগ তৈরি হবে না। মানুষ আর শৃঙ্খলিত হবে না।


  • লেখক : চেয়ারম্যান, ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি। ই-মেইল: kirondebate@gmail.com