শাহাদত হোসেন বাচ্চু
এক
উন্নয়নের সবচেয়ে বড় মাপকাঠি ‘মানব-সম্পদ উন্নয়ন’। প্রশ্নপত্র ফাঁস আর ‘গায়েবী’ নির্দেশে পরীক্ষা পাশের হার বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় মানব-সম্পদ ‘ধুঁকছে’; মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিপর্যস্ত শিক্ষকদের দলাদলিতে। স্কুল শিক্ষকদের পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে, পিপার-স্প্রে দিয়ে শাসন করা হয়। একজন সংসদ সদস্য শিক্ষকদের উদোম করে রাস্তা প্রদক্ষিণ করিয়েছেন, প্রকাশ্যে কান ধরে ওঠ-বস করিয়েছেন আরেক সংসদ সদস্য। এর ফলে শিক্ষকরা উদোম বা কান ধরে ওঠ-বস করেছেন, না গোটা জাতি করেছে- এ নিয়ে ভাবার সময় নেই। আর শিক্ষক নেতাদের মুখে তো কুলুপ!
প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি শিক্ষামন্ত্রী প্রথমে কানেই তোলেননি। ‘গুজব’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি নীতি পাল্টেছেন। সবশেষে বলেছেন, অত্যাধুনিক প্রযুক্তির যুগে প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকানো পুরোপুরি সম্ভব নয়। এর আগে বলেছিলেন, “কিছুসংখ্যক ‘কুলাঙ্গার’ শিক্ষক প্রশ্ন ফাঁস করে দিচ্ছে। কিভাবে প্রশ্ন ফাঁস সামলাবো”? তারপরে বলেছিলেন, “আমাদের ভাল শিক্ষক নেই”। এইসব কথামালা একটি বিষয়কেই ইঙ্গিত করে- হয় প্রশ্ন ফাঁসকারীরা সরকারের চেয়ে শক্তিশালী, অথবা সরকারের প্রভাবশালীরা প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত।
ভুলে ভরা বিকৃত পাঠ্যবই পৌঁছাচ্ছে আর মৌখিক নির্দেশনা দিয়ে পাশের হার বাড়াচ্ছে। শিক্ষায় শনৈ: শনৈ: উন্নতির গল্প শুনছে মানুষ। এর মধ্য দিয়ে কি মনোজগত তৈরী হচ্ছে শিক্ষার্থীদের? সারাদেশে কিশোর অপরাধ বাড়ার কারন কি এই ভুল-বিকৃত শিক্ষার মনোজমিন। এর মধ্য দিয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে যে মৌলিক ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে- সেই তুলনায় সময়মত বই পৌঁছানো কি সত্যিই সাফল্য? কি ফলাও করেই না এই সাফল্য প্রচার করা হয়!
সত্যটা কি উপলব্দিতে আছে? দেশ থেকে লাখ লাখ কোটি টাকা পাচার-আত্মসাত হলেও ক্ষতি পোষানো যায়! চাইলে চলমান হত্যাকান্ড থামিয়ে আইন-শৃঙ্খলার উন্নয়নও করা সম্ভব; ধ্বসে যাওয়া নির্বাচন ব্যবস্থা মেরামত সম্ভব। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের চুরিও বন্ধ করা যায়। কিন্তু শিক্ষা ক্ষেত্রে অন্তর্গত ক্ষতি-ধ্বস কি ইচ্ছে করলেই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব? এর জন্য কত সময় লাগবে, কত মূল্য দিতে হবে জানা নেই। অন্তত: একটি প্রজন্ম তো বটেই।
প্রশ্ন ফাঁস, নম্বর বাড়িয়ে দেয়ার নির্দেশের মত অশিক্ষা নিয়ে যারা পাশ করে বের হচ্ছে, আগামী এক-দেড় দশক পরে তারাই নেতৃত্বে থাকবে। এই শিক্ষা ও মেধা নিয়ে তারা কেমন নেতৃত্ব দেবেন? মেধাবী-যোগ্য মানুষ কি পাওয়া যাবে? ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্নের সুযোগে যারা ডাক্তার হয়ে বেরিয়ে আসবেন, তারা কি চিকিৎসা সেবা দেবে? ভয়াবহতা-ধ্বস কতটা ঘটেছে, আপাত: আমোদে মত্ত আমরা কি তা অনুমান করতে পারছি!
এটি স্বীকৃত সত্য যে, দেশে মানুষকে মেধার ভিত্তিতে শিক্ষিত করা গেলে মানব সম্পদের উন্নয়ন ঘটে। শ্রীলঙ্কা এর সবচেয়ে বড় উদাহরন। সেখানে মানবসম্পদ উন্নয়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ায় উন্নয়ন তার আপন গতি পেয়েছে। রাস্তা-ফ্লাইওভার, সেতু নির্মান উন্নয়ন নয়, উন্নয়ন সহায়ক কাজ। প্রযুক্তি তখনই গুরুত্বপূর্ণ যখন শিক্ষা-মেধা দিয়ে সেগুলি তৈরী করে মানুষ ব্যবহার করে উপকৃত হয়। এখানে অমূল্য একটি প্রশ্ন হচ্ছে- এই ব্যবস্থার কি শিক্ষা-মেধা কোনটি নিশ্চিত করছে, কি নিশ্চিত করবে?
আমরা কি তাহলে পুরো ব্যবস্থাই ধ্বংস করে দিলাম? ৯৫ শতাংশ মানুষের সন্তান যে শিক্ষা ব্যবস্থার অংশ তার কথাই বলা হচ্ছে – ৫ শতাংশের সন্তানরা ইংরেজী মাধ্যমে পড়ালেখা করে। ‘ও’ লেভেল পাশ করে উন্নত দেশের নামী-দামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যায়, সেটির আরও উন্নতি হচ্ছে। এই যে বৈষম্য তা থাকবে না- মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তো ছিল সেটিই। সুতরাং ৯৫ শতাংশের ব্যবস্থা ধ্বসিয়ে দিয়ে কিভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠিত হবে?
দুই
এক দলদাস শিক্ষকের কথা বলি। এমত শিক্ষক এখন ছড়ানো-ছিটানো সর্বত্র। শিক্ষার ধ্বস, অবনমন ও নজিরবিহীন অনাচারের বিরুদ্ধে এরা কথা বলেন না কখনও। এরকম এক দলদাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের প্রফেসর আব্দুল আজিজ ২০১৪ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকীতে ছাত্রলীগের আলোচনা সভায় যা বলেছিলেন তা মনে করিয়ে দেব। ঐ সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নুর।
“ছাত্রলীগের সব নেতা-কর্মীদের চাকরী দিতে হবে। খেয়াল রাখতে হক্ষে, কোন কর্মী যেন বেকার না থাকে। ছাত্রলীগ নেতাদের রেজাল্টের প্রয়োজন নেই। তাদের গায়ের ক্ষতচিহ্নই তাদের বড় যোগ্যতা…। বর্তমান সরকারের আমলে কেবল ছাত্রলীগ কর্মীদের চাকরী দিতে সরকারকে আহবান জানাই”। প্রফেসর আজিজের এই মৌলিক প্রস্তাবনার প্রতিধ্বনি ছিল প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের কথায়। তিনিও বলেছিলেন, ছাত্রলীগ কর্মীদের শুধু লিখিত পরীক্ষায় পাশ করলেই হবে, বাকিটুকু তারা দেখবেন।
জাতির সবচেয়ে উজ্বল সময়ে ন্যায্য রাষ্ট্র চিন্তায় শিক্ষকরা ভূমিকা রেখেছিলেন। চিন্তায়, মননে ছিলেন নির্মোহ, নির্লোভ, পক্ষপাতহীন। তারা জাতিকে সঠিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন। কিন্তু দলদাস শিক্ষকরা তাদের উত্তরাধিকার নন। এই শ্রেনীটি সবসময় সব ক্ষমতাসীনদের সাথেই আছেন। ক্রমাগত মূল্যবোধ-হ্রাসপ্রাপ্ত গত চার দশকে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে তাদের ভূমিকা হয়ে পড়েছে নতজানু। শিক্ষক-শিক্ষকতার এই অবনমন সবকিছুতেই গা সহা সমাজকে আর আলোড়িত করে না, আন্দোলিতও করে না।
শুরুর দিকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা স্কুল-কলেজ পর্যায়ে শিক্ষার ধ্বস নিয়ে প্রতিবাদী হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। শিক্ষামন্ত্রীর গোল্ডেন জিপিএ পাওয়া শিক্ষার্থীদের ১০ শতাংশের বেশি ভর্তি পরীক্ষায় টিকছে না- গণমাধ্যমে এমত সমালোচনার পর শিক্ষামন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া ছিল দেখার মত। খোদ প্রধানমন্ত্রী যখন বললেন, “আমাদের ছেলে-মেয়েরা বেশি সংখ্যায় পাশ করবে তাও অনেকে চায় না”। ব্যাস, শিক্ষক নেতৃবৃন্দ ভোল পাল্টে ফেললেন, গলা মেলামেল প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর সাথে। তারা বিবেচনা করেননি, এই দলদাস ভূমিকা শিক্ষার সর্বনাশের পাশাপাশি তাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে!
তিন
শিক্ষার সংকট কোথায়? এ আলোচনায় পরস্পর বিরোধিতা রয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলে শিক্ষা ব্যবস্থার অধ:পতন ঘটেছে। কিছুকাল আগেও নকল ছিল বিচ্ছিন্ন ঘটনা; এখন সেখানে সব ধরনের প্রশ্নপত্র ফাঁস রেওয়াজে পরিনত হয়েছে। স্কুলকেন্দ্রিক পড়াশুনার বদলে কোচিং সেন্টার বা প্রাইভেট শিক্ষক নির্ভর হয়ে পড়েছে শিক্ষার্থীরা। পরীক্ষার আগেই প্রশ্ন মিলছে। শিক্ষার্থীদের অনুশীলন যাচাইয়ের জন্য পরীক্ষা পদ্ধতি এখন কার্যত: অকার্যকর। এরসাথে যুক্ত হয়েছে শিক্ষার হার বাড়ানোর উচ্চাভিলাষ।
শিক্ষাবিদ প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, “শিক্ষার প্রধান সমস্যা তিনটি। প্রথমত: বাণিজ্যিকীকরণ। শিক্ষা পণ্যে পরিনত হয়েছে। পূঁজিবাদী সমাজে মুনাফাই যেহেতু লক্ষ্য, তাই পণ্যে ভেজাল হওয়া খুবই স্বাভাবিক। শিক্ষা নামক পণ্যটিতেও ওই ভেজালটা ঢুকে গেছে। দ্বিতীয়ত: রাষ্ট্রের গুরুত্বহীনতা; রাষ্ট্র যে শিক্ষাকে গুরুত্ব দেয় না, শিক্ষাই যে জাতির ভবিষ্যতের ভিত্তি, এটি রাষ্ট্র আমলে নেয় না। তৃতীয়ত: তিনধারার শিক্ষা; এটা রাষ্ট্র বাড়াচ্ছে। এরকম তিন ধারার শিক্ষা যত বাড়বে বৈষম্য তত বাড়বে”।
জাতিসংঘ ঘোষিত সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অন্যতম বিষয় ছিল শিক্ষার হার বৃদ্ধি। এই লক্ষ্যপূরণে মরিয়া সরকার পাশের হার বাড়াতে, পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে নম্বর বাড়িয়ে, মৌখিক নির্দেশনা দিয়ে রেখেছে। জেনুইন নম্বর দিতে গিয়ে অনেক শিক্ষক হেনস্তার শিকার হয়েছেন। এই সর্বগ্রাসী সরকারী চাহিদা মেটাতে মেধা মূল্যায়নে পরীক্ষা গ্রহণ পদ্ধতি কাজে আসছে না। প্রশ্ন ফাঁস, পরীক্ষা পদ্ধতির সংকট, খাতা মূল্যায়নে সরকারী নির্দেশনা কেবল নয়, পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা এখন সমস্যাজর্জর। সরকারী, বেসরকারী, মাদ্রাসা ও ইংরেজী মাধ্যমে শিক্ষা কাঠামো এই বহুমুখী সংকটকে সর্বগ্রাসী করে তুলছে।
চার
শিক্ষার বিদ্যমান স্তরে প্রাথমিক শিক্ষা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীর সবদেশেই প্রাথমিক শিক্ষা গুরুত্ব পায়। বাংলাদেশেও তাই ছিল। এখন পয়তাাল্লিশ বয়সী এই দেশে ভাঙাচোরা প্রাথমিক স্কুল এখন দালানে পরিনত। ভাঙা ঘরে নিবেদিত প্রাণ শিক্ষক ছিলেন, স্কুল ছিল শিশুর দ্বিতীয় বাড়ি। শিক্ষক ছিলেন মা- বাবার পরের অভিভাবক। বঞ্চনা-কষ্টকে মেনে নিয়ে তারা শিশুকে একাডেমিক ও নৈতিক শিক্ষা দিতেন। কারো মধ্যে মেধার খোঁজ পেলে পরিচর্যা করতেন বিশেষভাবে।
ইট সিমেন্টের দালানে এখন “অন্যকিছু করতে না পারা” মেধাহীনরা প্রাথমিক শিক্ষায় নিয়োজিত। যিনি এইচএসসি পাশ করেছেন টেনেটুনে। চাকরি নিয়েছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য বা কোন ক্ষমতাধরকে অনৈতিক সুবিধা দিয়ে। এলাকায় তিনি ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হন। চাষ-বাস বা ব্যবসা করেন। মাঝে মধ্যে স্কুলে যান আড্ডার মেজাজে।
শিক্ষার এই সংকট মূলত: সমাজের দৈন্য চেহারা এবং পাশাপাশি এটি সংঘবদ্ধ অপরাধী সমাজ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছে। অগণতান্ত্রিক ও চরম বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থা নৈতিক বিপর্যয় ডেকে নিয়ে আসছে সমাজের সব স্তরে। মানুষ ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে এবং জড়িয়ে পড়ছে দখলদারিত্ব আর অনৈতিক প্রতিযোগিতায়। উগ্রপন্থা, সহিষ্ণুতার বিস্তার ঘটছে।
এই অবস্থা প্রমান করছে, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের মানবিক, প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক চেতনার নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারছে না। সংস্কৃতি বিনির্মানেও শিক্ষাব্যবস্থা অক্ষম। সামাজিক বৈষম্য দুর করা ও নানামতের প্রয়োজনীয়তা বোঝার বদলে শিক্ষার্থীরা হয়ে উঠছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক।
এর মূল কারন নিহিত রয়েছে রাষ্ট্রের উপরিকাঠামোয়। রাষ্ট্র যেমন গণতান্ত্রিক চেহারা বিসর্জন দিচ্ছে, কঠোর কর্তৃত্ববাদীতায় ঢেকে দিচ্ছে সবকিছু, শিক্ষাঙ্গনেও পড়েছে এর কড়ালগ্রাস। এই কঠোর, কর্তৃত্ববাদী শাসনে সরকার হয়ে উঠেছে আমলা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও অদৃশ্য শক্তি নির্ভর। শিক্ষা ব্যবস্থাকে আজকের অবস্থায় নিয়ে আসা এবং শিক্ষাঙ্গণে গণতন্ত্র চর্চা, প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতি নিপুন কৌশলে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে- শুধুমাত্র ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার বাসনায়।
এজন্যই প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, “সমাধানের প্রশ্নে গেলে বলব, সংস্কারের সময় শেষ হয়ে গেছে। এই শিক্ষাব্যবস্থাকে সংস্কারের আর কোন সুযোগ নেই। এখন সমাজের আমুল রূপান্তর দরকার। শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও সংশ্লিষ্টদের এখন আমুল পরিবর্তন ছাড়া যে কিছু সঠিক হবে না এই সত্যটি মানুষের কাছে নিয়ে যেতে হবে”।