Search

Saturday, March 11, 2017

কানাডার প্রধানমন্ত্রী থেকে রাষ্ট্রদূত কেউ জানাননি বিএনপি ‘সন্ত্রাসী দল’

মোহাম্মদ আলী বোখারী, টরন্টো থেকে

কানাডার প্রধানমন্ত্রী
জাস্টিন ট্রুডোর সাথে লেখক।

এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে পরিচালিত লাগাতার অনুসন্ধানে কানাডার প্রধানমন্ত্রী, বিচারমন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেল, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, জননিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রী, নাগরিকত্ব ও অভিবাসনমন্ত্রী এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত কানাডার রাষ্ট্রদূত, তারা কেউ জানাননি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল তথা বিএনপি একটি ‘সন্ত্রাসী দল’। একইসঙ্গে পুনর্বিবেচনার রায়ে প্রত্যাখ্যাত শরণার্থীর আবেদন ও পর্যবেক্ষণটিতেই বক্তব্য সীমাবদ্ধ রেখেছেন যথাক্রমে ফেডারেল কোর্টের প্রধান বিচারপতির প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও মিডিয়াবিষয়ক আইনি পরামর্শক। পাশাপাশি কানাডার জননিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একমাত্র মুখপাত্র তাদের ওয়েবসাইটে উল্লেখিত তালিকা খতিয়ে দেখার পরামর্শ দিলে তাতেও ‘সন্ত্রাসী দল’ হিসেবে বিএনপিকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। অথচ একজন শরণার্থীর আশ্রয় প্রার্থনার আবেদনের ভিত্তিতে অভিবাসন কর্মকর্তার পর্যবেক্ষণভিত্তিক ফলাফল এবং পুনর্বিবেচনার শুনানিতে একই কারণে খারিজ হওয়া রায়ের আদেশে নয়, বরং পর্যবেক্ষণে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধীদলীয় বিএনপি ‘অনুরূপ কৌশলে’ যুক্ত থাকার বিষয়টি বিশ্লেষিত হলেও বিএনপি একটি ‘সন্ত্রাসী দল’ হিসেবে চাউর হয়েছে। বলাবাহুল্য, ওই রায়টি ছিল একজন শরণার্থীর কানাডায় আশ্রয় মঞ্জুর সংক্রান্ত, যেখানে বিচারক নন বরং শরণার্থীই আবেদনে ‘অবিশ্বাস্যজনক ও আত্মঘাতী প্রক্রিয়ায়’ নিজের দল বিএনপিকে একটি ‘সন্ত্রাসী দল’ বানিয়েছে।

গত ২৫ জানুয়ারি কানাডার ফেডারেল কোর্ট প্রদত্ত ৩৩ পৃষ্ঠার রায়ে প্রকাশ, বাংলাদেশের জনৈক নাগরিক মোহাম্মদ জুয়েল হোসেন গাজী ২০১৩ সালের ১৮ জানুয়ারি কানাডায় এসে সেদিনই শরণার্থী হিসেবে আশ্রয়ের আবেদন করেন। তাতে ২৬ সেপ্টেম্বর তাকে আইনগতভাবে শরণার্থী করা হয়। পরবর্তীতে ২০১৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি স্থায়ী অভিবাসনের আবেদন করেন। পরের বছর ২৮ এপ্রিল প্রথম ধাপের অনুমোদন পান। দ্বিতীয় ধাপে নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তার আবেদন দীর্ঘায়িত ও পর্যায়ক্রমিক আইনগতভাবে ‘অগ্রহণযোগ্য’ হয়। আবেদনকারী কয়েক দফায় বিএনপির সদস্যপদের উল্লেখ করেন। তার ‘বিওসি’ বা বেসিস অব ক্লেইম বা দাবিগত ভিত্তির বর্ণনায় রয়েছে,  ১৯৯৭ সালের মাঝামাঝি ঢাকায় একটি কলেজে পড়াকালীন বিক্ষোভ, সেমিনার ও সভা জাতীয় রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশ নেন। ২০০৪ সালে পড়াশোনা করতে কোরিয়া যান এবং বাংলাদেশের উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ফিরে আসেন। ২০০৫ সালে তিনি জাপানে যান এবং দেশের ‘পরিস্থিতি অবলোকন’ করতে থাকেন। তার ভিসার মেয়াদ ফুরিয়ে গেলে গ্রেফতারপূর্বক ২০০৮ সালে বাংলাদেশে বিতাড়িত হন। ওই বছরের শেষে মিরপুর বিএনপির অধীন স্বেচ্ছাসেবক দলে যোগ দিয়ে পরবর্তী কয়েকটি নির্বাচনি প্রচারণা চালান। তিনি রাজনৈতিক দলেরও সদস্য ছিলেন। তার ভাষায়, ‘আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ অপরাপর বৃহৎ রাজনৈতিক দলের স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা তাকে বিএনপির আত্মনিবেদিত কর্মী হিসেবে চিনতেন এবং দলের সঙ্গে তার সৎ, হৃদয়সোপিত ও নিবেদিত সংশ্লিষ্টতা ছিল’। একইসঙ্গে স্বীকার করেন বিএনপির সদস্যপদ গ্রহণের ক্ষেত্রে তা ছিল মনস্থিরপূর্ণ, সেক্ষেত্রে বিএনপিতে কোনো ইস্যুই সৃষ্টি হয়নি, বরং তা প্রদান করা হয়েছে। ফলশ্রুতিতে ২০১৫ সালের ২৭ অক্টোবর অভিবাসনের অগ্রহণযোগ্যতার ৩৪(১) ধারায় ‘কানাডা বর্ডার সিকিউরিটি এজেন্সির জাতীয় নিরাপত্তা বাছাই বিভাগ বিএনপির কার্যক্রমের উপর তার বর্ণিত মতামতের ভিত্তিতে মূল্যায়ন সম্পন্ন করে, যেখানে বর্ণিত হয়েছে, বিএনপি ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পরিপূরণে সশস্ত্র সংগ্রাম ও সহিংসতা করে থাকে’। এছাড়া আবেদনকারীর বক্তব্যানুযায়ী বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি ‘অস্ত্রেশস্ত্রে যুদ্ধংদেহী হয়। তারা হাতবোমা, পিস্তল ও বড় তরবারি ব্যবহার করে। তারা হরতাল বা মিছিল চলাকালীন সরকার পক্ষের লোকদের উপর আক্রমণ করে। হরতাল চলাকালীন বাড়ি-ঘর থেকে কেউ বের হয়নি, অফিসপাড়া বন্ধ ছিল, কোনো যানবাহন চলেনি এবং রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা ছিল। এগুলোই বিরোধী দলের কর্মকা- ছিল’। এ কথাগুলোই তার অভিবাসন আবেদন ‘আইএমএম ৫৬৬৯’-এ বর্ণিত রয়েছে।

ফলশ্রুতিতে অভিবাসন কর্মকর্তা ফৌজদারি ধারা মতে, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের সংজ্ঞায় সন্ত্রাসী দল ব্যাখ্যায় অভিমত রাখেন, যদিও বিএনপির জন্য আবেদনকারীর ব্যক্তিগত সন্ত্রাসী ভূমিকা ছিল যৎসামান্য; তথাপি সরকারকে বাধ্য করতে বিএনপির লাগাতার হরতাল নির্ভরশীলতা অর্থনীতি ব্যাহত করার পাশাপাশি হরতালের ফলে সৃষ্ট সহিংসতা বিএনপির সন্ত্রাসী কান্ড হিসেবে বিবেচিত হয়। এক্ষেত্রে আবেদনকারীর জন্য অভিবাসন কর্মকর্তার ইস্যু হয়ে দাঁড়ায় সন্দেহাতীতভাবে বিএনপির কর্মকান্ড সন্ত্রাসমূলক কিনা। সেক্ষেত্রে মানসম্মত বিবেচনায় সুপ্রিম কোর্ট অব কানাডায় ২০০৮ সালে পরিচালিত ‘ডানসম্যুর বনাম নিউ ব্রন্সউইক’ মামলা এবং ‘গুতিয়ারেজ বনাম কানাডা’ মামলাসহ অপরাপর আইনি ব্যাখ্যায় বিচারক সদাশয় বিবেচনায় অভিবাসন কর্মকর্তার অভিমতের ভিত্তিতে রায়টিতে মতামত রাখেন, সন্ত্রাসে ‘বিএনপি যুক্ত ছিল, রয়েছে ও হবে’, যা কানাডার আইনে বিশদভাবে বিবৃত। তারপরও ওই রায়ে বিচারক হেনরি এস ব্রাউন অভিবাসন কর্মকর্তার উদঘাটিত তথ্য এবং অনলাইনে ‘বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি টেরোরিস্ট অ্যাক্টস’ শিরোনামে আবিষ্কৃত সংবাদ ও তথ্যের ভিত্তিতে মতামত দেন যে, বিএনপি ও আওয়ামী লীগ হচ্ছে বাংলাদেশে দুটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল। আবেদনকারীর একজন কৌঁসুলীর মতে বাংলাদেশের রাজনীতি সহিংস। আর সেই বিবেচনায় উভয় দলই অনুরূপ কৌশলে যুক্ত। অর্থাৎ ‘ইন দ্যাট রেসপেক্ট বোদ পার্টিজ হ্যাভ এঙ্গেজড ইন সিমিলার টেকটিকস’। তবে রায়ের মাত্র দুই লাইনের আদেশে বিচারক লিখেন, ‘দিস কোর্টস জাজমেন্ট ইজ দ্যাট দ্য অ্যাপ্লিকেশন ফর জুডিশিয়াল রিভিউ ইজ ডিস্মিসড্, নো কোয়েশ্চেন ইজ সার্টিফাইড অ্যান্ড দেয়ার ইজ নো অর্ডার অ্যাজ টু কস্টস’। অর্থাৎ এই কোর্টের রায়টি হচ্ছে আবেদনকারীর আইনি পুনর্বিবেচনাটি বাতিল করা হলো, কোনো প্রশ্ন সত্যায়ন করা হয়নি এবং খরচ প্রদানেরও কোনো আদেশ দেওয়া হয়নি’।

তবে ওই শরণার্থীর পক্ষে তার কৌঁসুলী বিচারকের কাছে পুনর্বিবেচনার শুনানিতে উত্থাপিত প্রশ্নের সত্যায়ন কেন করেননি, সেটি একটি দুর্বোধ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা সে প্রশ্নগুলো সত্যায়ন করা হলে, শরণার্থীর জন্য আপিলের সুযোগটি থাকত। এক্ষেত্রে টরন্টোয় বসবাসরত নেতৃস্থানীয় বিএনপির দুই নেতা যথাক্রমে মাহবুব রব চৌধুরী ও আবদুল আহাদ খন্দকার পৃথকভাবে এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘ওই শরণার্থী অবিশ্বাস্যজনক ও আত্মঘাতী প্রক্রিয়ায় আবেদনটি অভিবাসন কর্তৃপক্ষের কাছে করেছে। তাকে কানাডা বিএনপির কোনো কার্যক্রমে কখনোই দেখা যায়নি কিংবা তার সম্পর্কে কেউ কিছু জানেন না। আমরা সভা আয়োজন করে পুরো ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছি। তাছাড়া বিএনপি যে সন্ত্রাসী দল নয়, সে কথা বাংলাদেশের মানুষ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় জানেন। আমাদের দল বিএনপি অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় একটি অনির্বাচিত সরকারের কাছে অবর্ণনীয় নিষ্পেষণের শিকার। শুধু বিএনপি নয়, দেশের জনসাধারণেরও বাক-স্বাধীনতা বর্তমান সরকার হরণ করেছে; কেউ প্রতিবাদ জানাতে পারেন না’।

তথাপি বাংলাদেশে চাউর হওয়া সংবাদে বিএনপি আদৌ ‘সন্ত্রাসী দল’ কিনা, তা সুনিশ্চিত হতে এই প্রতিবেদক প্রায় ১০ দিন ধরে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, বিচারমন্ত্রী ও এটর্নি জেনারেল জোডি উইলসন-রেবল্ড, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড, জননিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রী রাল্ফ গোদেল, নাগরিকত্ব ও অভিবাসনমন্ত্রী আহমেদ হোসেন, বাংলাদেশে নিযুক্ত কানাডার রাষ্ট্রদূত বেনওয়া-পিয়ের লাহামিসহ তাদের মিডিয়া কর্মকর্তা এবং ফেডারেল কোর্টের প্রধান বিচারপতির প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও মিডিয়া বিষয়ক লিগ্যাল কাউন্সিলকে ওই শরণার্থীর ৩৩ পৃষ্ঠার প্রত্যাখ্যাত রায়ের কপিসহ ই-মেইল ও টেলিফোনে যোগাযোগ করেন।

এতে জননিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রীর স্পোকপার্সন বা মুখপাত্র এন্ড্রু গোউইং লিখিতভাবে মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে তালিকাভুক্ত ৫৩টি ‘টেরোরিস্ট এনটিটিজ’ বা ‘সন্ত্রাসী সংগঠনসমূহ’ খতিয়ে দেখার পরামর্শ দেন, যাতে বিএনপি বা বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টির নামটি অনুপস্থিত। এছাড়া বাংলাদেশে নিযুক্ত কানাডার রাষ্ট্রদূতের পক্ষে পররাষ্ট্রনীতি ও কূটনীতি বিভাগের সিনিয়র পাবলিক অ্যাফেয়ার্স উপদেষ্টা শাহীন ইসলাম প্রতিবেদকের মূল ই-মেইলে উল্লেখিত ‘কানাডা থেকে মিডিয়া অনুসন্ধান: বিএনপি সন্ত্রাসী দল কিনা’ শিরোনামের প্রত্যুত্তরে শুধুই ‘কানাডা থেকে মিডিয়া অনুসন্ধান’ শিরোনামটি ও লিখিত অনুসন্ধানী বিষয়বস্তু অবিকৃত রেখে কানাডার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ‘গ্লোবাল অ্যাফিয়ার্সের’ গণসংযোগ বিভাগে যোগাযোগের পরামর্শ দেন, যদিও তিনি ফোনে আগেই একটি উত্তর দেওয়া হবে বলে জানান। এদিকে গ্লোবাল অ্যাফিয়ার্সের দায়িত্বশীল মিডিয়া কর্মকর্তা জোসলিন সুইট জানিয়েছেন বিষয়টি সম্পর্কে সম্যক তথ্য দিতে পারেন একমাত্র জননিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রণালয়, যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে প্রেরিত ই-মেইলের পরিপ্রেক্ষিতে ফোনে ফেডারেল কোর্টের প্রধান বিচারপতির প্রশাসনিক কর্মকর্তা লিজ লাফ্রিনিয়ার হেনরি জানান, ‘ওই মামলাটি ছিল গাজী বনাম কানাডা পক্ষের মাঝে এবং সে কথা রায়ের প্রথম অনুচ্ছেদেই বিবৃত। সে কারণে মামলায় রাজনৈতিক দল বিএনপি কোনো পক্ষই ছিল না, গাজী কানাডায় তার শরণার্থী আবেদন মঞ্জুরের জন্য পুনর্বিবেচনার আবেদনটি করেন’। আর লিজ হেনরির সে কথাটিই ফেডারেল কোর্টের মিডিয়া বিষয়ক আইনি পরামর্শক এন্ড্রু বৌমবার্গ ই-মেইলে ভিন্নভাবে জানান, ‘ওই মামলার সিদ্ধান্ত সংবলিত প্রথম অনুচ্ছেদেই শুনানির গুরুত্বপূর্ণ ধরনটি রয়েছে, যেখানে ষোল অনুচ্ছেদে কোর্ট ইস্যুটি বেছে নিয়েছে। একইভাবে সতের থেকে বাইশ অনুচ্ছেদে কোর্ট বিচারিক পুনর্বিবেচনার সীমাবদ্ধতাটি তুলে ধরেছে, যা একান্ন অনুচ্ছেদে সারাংশ হিসেবে দাঁড়িয়েছে’। অপরদিকে বারংবার ফোনে যোগাযোগ সত্ত্বেও কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, বিচারমন্ত্রী ও এটর্নি জেনারেল জোডি উইলসন-রেবল্ড, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড এবং নাগরিকত্ব ও অভিবাসনমন্ত্রী আহমেদ হোসেনের মন্ত্রণালয় থেকে কোনো প্রত্যুত্তর না আসায় কানাডার জননিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে বিএনপি ‘সন্ত্রাসী তালিকাভুক্ত সংগঠন’ নয় সেটিই কারণ হিসেবে দৃশ্যমান।

No comments:

Post a Comment