ইস্রাফিল খসরু
রামপাল কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প’র বিরুদ্ধে দেশজুড়ে জনমত অত্যন্ত শক্তিশালী অবস্থানে থাকা সত্ত্বেও, মনে হচ্ছিল যেন ইস্যুটা চাপা
পড়ে গিয়েছিল। গণমাধ্যম একটা
পর্যায়ে এসে গুরুত্ব দিয়ে ইস্যুটাকে আর
দেখছিলনা বলে মনে হচ্ছিল। অবশ্যই দু’একটা
ব্যতিক্রম ছাড়া, গণমাধ্যম - ইলেকট্রনিক অথবা প্রিন্ট, সবাই একযোগে রামপাল ইস্যুটাকে
এড়িয়ে যাচ্ছিল। একগুয়েমি অবস্থানে
থেকে সরকারও ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের এই
প্রকল্প নিয়ে দ্রুততার সাথে এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ২৬শে জানুয়ারি রামপাল প্রকল্প বিরোধীদের পূর্বঘোষিত
কর্মসূচী চলাকালে তাদের উপর ঢাকার শাহবাগ সহ অন্যান্য জায়গায় হামলা করার প্রেক্ষিতে এই ইস্যুটি আবার প্রধান
গণমাধ্যমে আলোচনায় ফিরে এসেছে। প্রকল্পটি নিয়ে সরকারের এই দ্রুততায়
জনমানসে এই প্রশ্নের উদয় ঘটেছে যে, এই প্রকল্প কিভাবে এবং কি কি কারণে এতো ব্যতিক্রমী হলো যে দেশে বিদেশে এত বিরোধিতা সত্ত্বেও সরকার
রামপাল প্রকল্প নিয়ে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। আসুন আমরা একজন সাধারণ নাগরিকের দৃষ্টিতে
ইস্যুটাকে একটু বিশ্লেষণ করে দেখি।
ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ এই কয়লা নির্ভর প্রকল্পটি ভারতের রাষ্ট্রীয় সংস্থা
ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট এবং বাংলাদেশের পাওয়ার ডেভোলপমেন্ট বোর্ড-এর একটি
যৌথ উদ্যোগ। প্রকল্পটিকে বলা হচ্ছে ‘বাংলাদেশ ভারত ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি (বিআইএফপিসি)’।
এই প্রস্তাবিত প্রকল্পটি সুন্দরবন’র সীমানা প্রাচীর থেকে মাত্র ১৪ কিমি উত্তরে ১৮৩৪ একর জমির উপর অবস্থিত,
যেটি বাস্তবায়িত হলে তা হবে দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। যদিও, পরিবেশগত ভাবে
হুমকির সম্মুখীন একটি এলাকা থেকে কমপক্ষে ২৫ কিমি দূরে এই ধরনের পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন
করতে হয়, যা বিশ্বজুড়ে একটি অপরিহার্য প্রধান মানদন্ড হিসেবে বিবেচিত। উপরন্তু, পাওয়ার প্ল্যান্টটির জ্বালানি সরবরাহের জন্য সুন্দরবনের
বুক চিরে নদীপথে প্রতিনিয়ত কয়লা পরিবহণ করতে হবে, যার ফলে সুন্দরবনের উপর বহুমাত্রিক মারাত্নক হুমকি সৃষ্টি হবে। পরিবেশগত ইস্যুগুলোকে
প্রস্তাবিত এই প্রকল্প পরিকল্পনা পত্রে যথাযথ
ভাবে দেখা
হয়নি। ইউনেস্কোর ২০১৬ সালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে ঠিকই এই প্রজেক্টটির জন্য প্রণীত
পরিবেশগত ছাড়পত্র (ইআইএ)-টিকে ব্যাপক ভাবে প্রশ্নবিদ্ধ বলা হয়েছে, যা এতদিন ধরে এই
প্রকল্প সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রকল্পটি
নিয়ে যে দ্বিধা ছিল, সেটাকে আরো যুক্তিযুক্ত ও সঠিক করেছে। অনেক পরিবেশ বিশেষজ্ঞ একই
ভাবে ইআইএ-কে মোটা দাগে ভুল বলেছেন। পরিবেশিত এবং প্রাপ্ত নানা মৌলিক তথ্যের আলোকে
পরিবেশ কর্মী এবং পরিবেশবিদদের রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পটির বিরোধিতার কারণগুলো আমরা
ঠিকই বুঝতে পারি।
প্রকল্পটির মৌলিক অর্থনৈতিক বিষয়গুলো নিয়ে
বিশ্লেষণ করলে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসে। প্রাপ্ত তথ্য মতে, এই প্রকল্পটির ৭০% বিনিয়োগ
আসবে ঋণ থেকে আর বাকি ৩০%
আসবে সমহারে বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের কাছ থাকে। ২০১৬ সালে প্রকাশিত ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি
ইকোনোমিকস অ্যান্ড ফাইনান্সিয়াল এনালাইসিস-এর একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, এই প্রকল্পে উৎপন্ন
বিদ্যুতের মূল্য বাংলাদেশে অন্য সব প্রকল্পে উৎপন্ন বিদ্যুতের চেয়ে ৩২% বেশি, বাংলাদেশ
ও ভারত সরকারের কাছ থেকে কয়েক ভাবে ভর্তুকি
পাওয়া সত্ত্বেও। এছাড়াও বাংলাদেশ সরকার ১৫ বছরের জন্য এই প্রকল্পে কর মওকুফের
প্রস্তাব করেছে, যার ফলে সরকার বড় আকারের
রাজস্ব থেকে বঞ্ছিত হবে। এইসব চিত্র আমাদের এই প্রকল্পটির অর্থনৈতিকভাবে
লাভজনক হওয়ার উৎসাহব্যঞ্জক কোন ভবিষ্যত আদৌ দেখায় না। এই প্রকল্পের অর্থনৈতিক বিষয়গুলোর এমন অনিশ্চিত ও অস্পস্ট চিত্র দেখার পর, একজন সাধারণ নাগরিকও কোনভাবেই বুঝতে পারছেনা - এমন প্রকল্প নিয়ে কেন সরকার একতরফা ভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। এখন সকারের কর্মকান্ড ও উদ্দেশ্য যদি আমরা যা ভাবছি
তার থেকে পুরো ভিন্ন হয়, তাহলে সরকার কেন এই প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, তা-ও অবোধগম্য
হবে না।
একটি সরকারকে শুধুমাত্র তার কাজ দ্বারাই বিচার করা যায়, এবং কেবলমাত্র ইতিবাচক
কাজ দিয়েই তারা সচেতন জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারে। কিন্তু সরকার যদি তা করতে ব্যার্থ
হয়, তাহলে আমরা ভবিষ্যতে রামপাল প্রকল্পের মতো আরো প্রকল্প দেখব - যেখানে বাংলাদেশের
প্রকৃতি ও পরিবেশগত নিরাপত্তার ইস্যুগুলো মোটেও গুরুত্ব পাবে না। উত্তর মিলবে না অনেক প্রশ্নের। আমি এখন ব্যাখ্যা
করে বলতে চাচ্ছি, যেখানে দুইটি ব্যবসায়িক
অংশীদার এই প্রকল্পের সমান বিনিয়োগকারি, অথচ দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ তার অংশীদারের স্বার্থকে প্রাধান্য দিচ্ছে, অন্যায়ভাবে নিজ দেশের মানুষের প্রতিবাদকে তুচ্ছ করে
দেখছে। আর এটাই যদি আসল ঘটনা, তাহলে পরিবেশগত ইস্যুগুলো আর প্রধান ইস্যু থাকে না। এখানে
আরো বড় বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে, আর তা হলো আমাদের জাতীয় সার্বভৌমত্ব। যেভাবে অর্থনৈতিকভাবে
লাভজনক না হওয়া এবং পরিবেশগত বহুমাত্রিক মারাত্নক বিপর্যয় থাকা সত্ত্বেও এই প্রকল্প
নিয়ে সরকার যে অনড় অবস্থান নিয়েছে, তাতে সরকারের দেশের জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতার অভাবের
প্রশ্নটি বড় আকারে উঠে আসে। এখন পর্যন্ত সরকার এই প্রকল্পের বিরোধিতাকারিদের শক্ত হাতে
দমন করছে এবং এই প্রকল্পের পক্ষে ব্যর্থ সাফাই গাইছে। অথচ, ন্যূনতম হুমকি থাকলেও এমন
প্রকল্প থেকে সরকারের অনেক আগেই সরে আসার কথা ছিল। উন্নয়নের নামে সরকার এই প্রকল্পের
পক্ষে কথা বলছে যদিও তারা জনগণকে এর অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতার ইতিবাচক কোনও কিছু দেখাতে
পারছে না। এছাড়া এই প্রকল্পের বিরোধিতাকারীদের সাথেও সরকার কোনও কথা বলে পুরো ব্যাপারটি
বোঝার চেষ্টা করছে না, শেষে এই প্রকল্পটির কোন
কিছু ছাড় দিতে হয় এই ভয়ে। এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে চলমান প্রতিবাদের বড়
দাবিটি হচ্ছে, এই প্রকল্পের অবস্থান। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির
জন্য বিদ্যুত শক্তিকে গুরুত্বকে ছোট করে কেউ
দেখছে না। কিন্তু সরকার এই প্রকল্প স্থানান্তরের মতো যৌক্তিক অথচ
অতিসহজে মানা যায় এমন দাবিটা পর্যন্ত মানছে না। বাংলাদেশের মানুষের প্রকল্পটি স্থানান্তরের এই নগন্য দাবিটাকে না মেনে
প্রকারান্তরে আমাদের দেশের জাতীয়
সার্বভৌমত্বকে প্রশ্নের মুখোমুখি করেছে । সরকার এমন কিছু করতে পারে না, যেখানে আমরা
আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে পারবো না, আমাদের ব্যবসায়িক অংশীদার আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের
ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি করতে পারবে। সুন্দরবন আন্দোলন গতি পাওয়ার সাথে সাথে আমাদের আরো
বড় ইস্যু সার্বভৌমত্বের ইস্যুটিকে বড় আকারে দেখতে হবে, এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার চেষ্টা
করা উচিত সবার। দেশের প্রধান গণমাধ্যমগুলোকে এই ব্যাপারে বলিষ্ঠ ও সাহসী ভূমিকা রাখতে
হবে। রামপাল প্রকল্পের সাথে অনেক ইস্যু ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কিন্তু এই ব্যাপারে গণমাধ্যমের
ভূমিকা অপর্যাপ্ত, বলা চলে নিয়ন্ত্রিত। সরকারের মতো গণমাধ্যমকেও তাদের অগ্রাধিকার ঠিক
করতে হবে। রামপাল প্রকল্প বিষয়ে সবাইকে ভূমিকা রাখতে হবে। নিরাপদে নিরপেক্ষ ভূমিকা
পালন করলে আমরা এই জটিল সমস্যা থেকে রেহাই
পাবো না।
- ইস্রাফিল খসরু ব্যবসায়ী এবং সচেতন নাগরিক।
No comments:
Post a Comment