Search

Thursday, August 10, 2017

ন্যায়হীনতার বেশে মন্ত্রীর আঙ্গুলে দম্ভের দেশ



মুনজের আহমদ চৌধুরী

মুনজের আহমদ চৌধুরী
আমাদের শ্লীলতাহীন রাজনীতির অশ্রাব্যতা নিয়ে লিখতে ভাল লাগে না। বাংলাদেশটা দাঁড়িয়ে আছে একটা ভাষার উপর। ভাষার আন্দোলন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের আঁতুড়ঘরঅথচ, ভাষার দেশেই অশ্রাব্য আর মিথ্যে ভাষ্যে দাঁড়িয়ে থাকে সব মিথ্যচারী শাসক! রাজনীতি কেবল সেখানে কথা বলতে জানে ক্রোধ আর ক্ষমতার দম্ভের অক্ষরে। দেশ ও জনগণের প্রতি অভিভাবকত্বের মমত্বের শব্দে কথা বলা এখনো শিখতে পারেনি আমাদের চলতি  স্রোতের  রাজনীতি।

বাক্যে বাক্যে উদ্ধত ভঙ্গিমা আর মিথ্যাচারের খেলা এ দেশের বহু রাজনৈতিক চরিত্রগুলোর যেন লজ্জাস্থান নিবারক বস্ত্র।

বুধবার ভোররাতে আচমকাই খুব আদরের ছোটভাই, প্রিয় সংবাদ পাঠক সাইদুল ইসলামের ফোন। তার অনুরোধ-ভাই, বিচার বিভাগের প্রতি শাসক দলের, সরকারের মন্ত্রীর অন্যায্যতা, অশ্লীলতা নিয়ে লিখুন। আমি তাকে বলছিলাম, ভাই এ বিষয়টি নিয়ে লিখতে হবে গ্রাম্য বিচারকটির পৌরাণিক সে গল্পও।  সাইদুল বলল, তাহলে ভাই এ বিষয়টা না হয় উহ্য করে লিখুন।  

উহ্য করে লিখতে গেলে দেখি, মন্ত্রীবাহাদুর সার্বভৌম একটি রাষ্ট্রের বিচারবিভাগের প্রতি কী ঔদ্ধত্য'র আঙ্গুল তুলেন।
কী করে যে একজন জৈষ্ঠ্য রাজনীতিক, সিনিয়র মন্ত্রী বলতে পারেন,”আদালতের হাত সংসদ ছোঁয়ার মত লম্বা হয়নি” আমার ভাবতে লজ্জা হয়।

অর্থমন্ত্রী ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে প্রধান বিচারপতিকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আমরা চাকরি দিই, আমাদের ওপর পোদ্দারি। যতবার কোর্ট বাতিল করবে, আমরা ততবার পাস করব। ’ বলিহারী যাই ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে নির্বাচিত সরকারের এমন সংসদীয় সার্বভৌম গণতন্ত্র আর বিচার বিভাগের প্রতি এমন শ্রদ্ধা দেখে!

আচ্ছা, সংসদ-সরকার কী আইনের ঊর্ধ্বে?
আমার ভাবনাগুলো এই ভেবে লজ্জায় নত হয়, দেশটার বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা কোন মুখে সরকারগুলি বলে। একজন সৎ দরিদ্র আইনজীবী পিতার সন্তান  হয়ে রাজনীতিকে নিজে দেখেছি স্লোগান, ব্যারিকেড, রোধ অবরোধের নিত্যদিনের বোধে। বিরক্ত জনগণের বিরক্তি আর বেদনার ভাষ্য হয়তো অবমাননা অবধি পৌছুঁতে পারে। তবুও বলি, এখনো দুর্নীতি, প্রবঞ্চনা আর জনগণের সাথে নিপুন প্রতারণার নামধারী অসৎ রাজনীতির দেশে বিচার বিভাগ হাজার গুন শত গুন নৈতিক। রাজনীতির নীতিহীন মুখগুলো কতটা প্রবলতায় যে অনৈতিক, তার দুটি বেদনার কথা লিখেই পাঠকের ধৈর্য্যচ্যুতির অবসান ঘটাচ্ছি।

বছর কয় আগে যখন তত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের রায় দিলেন আদালত তখনওতো এ সরকার ক্ষমতায় ছিল। একই নেত্রী ছিলেন প্রধানমন্ত্রী, দলও। কই তখন তো আদালতের আদেশে আয়েশি রাজনৈখায়েস পূরণের হাসি হেসেছিলেন মন্ত্রী বাহাদুরেররা। আজ কেন তবে ঔদ্ধত্যমাখা এ অদ্ভুত বৈপরীত্য। সুবিধার নামে চরিত্র বদল দেশে দেশে জাপুঁজির রাজনীচক্রের দৌরাত্ম। কিন্তু এতটা নগ্নতায় পল্টি খাওয়া নীতির বিকৃতি নাপাক পাকিস্তানের মতো দেশেও বুঝিবা বিরলপ্রায়। বিচার মানি কিন্তু বিচারক তালগাছ সব আমার - এমন বৈপরিত্বের অদ্ভুত রাজনীতিহীন বৃত্তি বড় আহত করে আমায়। অক্ষর সেখানে খুঁজে হয়রান হয় শ্রাব্যতম ক্ষোভের প্রতিবাদের ভাষা।

অনেকে এ ইস্যুটিকেও সরকারের অন্য অনেক ইস্যু ইস্যু খেলার সাথে মেলাতে চান। আমি স্তম্ভিত হই, কথারা এমত বাস্তবতার ব্যত্যয়ে হয় বাক্যহারা।

আমরা বড়ো মানুষগুলোকে, প্রতিষ্ঠানগুলোকে ছোট করে নিজেদের ছোটলোকের চোখে দেখতে ভালবাসি স্বভাবের ক্ষুদ্রতায়।

বিচার বিভাগও যদি সর্বগ্রাসী রাজনীতির দেশে স্বাধীন কন্ঠে কথা না বলতে পারে, তাহলে কোথায় থাকল দেশের মর্যাদাময়তা?

ভোট দিতে দেয়া হল বা না হল বাংলাদেশে বহু জনগণ এখন তার আর তোয়াক্কা করেন না। না করবার বাস্তবতা যে বিদ্যমান নয় তা বলা হবে মিথ্যাচার।

আসলে দম্ভের বা অহংকারের দ্বারা চালিত মানুষগুলোর মতোন সরকারগুলোও কখনো তার প্রকৃত অবস্থান দেখতে পায় না। না, রাজনীতির প্রতি বিন্দুমাত্র ক্ষোভ নেই আমার, নেই বেদনাও। আহত করে কেবল রাজনীতিহীন দম্ভ আর আস্ফালনের অন্ধকারাচ্ছনতার জন্য। কী বিশাল শুন্যতায় সেখানে যে অনুপস্থিত ন্যায্যতা। বরঞ্চ হৃদয়ের সবটুকু দিয়ে বিশ্বাস করি, রাজনীতি-সুবিধা আর স্বার্থান্ধ গদি যেদিন পাল্টাবে সেদিন পাল্টাবে দিন। কেবল রাজনীতিরই সেই ক্ষমতা আছে দুর্নীতি আর অন্যয্যতার দিনবদলের।
 
সুশাসন আর ন্যায় রাজনীতিহীন নগ্ন দুপুরে যে আসবে না সেকথা জানি। সে সুর্যোদয় কেবল মাত্র আনতে পারে রাজনীতির ইতিবাচকতাই ।


  • মুনজের আহমদ চৌধুরী - লন্ডনবাসী সাংবাদিক, সদস্য রাইটার্স গীল্ড অব গ্রেট ব্রিটেন।


Tuesday, August 1, 2017

খেলাপি ঋণ বেশি হারে বাড়ছে কেন?

রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর  


ব্যাংক ব্যবস্থা নিয়ে ইদানীং সংবাদ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। সঙ্গত কারণেই এ বিষয়ে আলোচনা হওয়া দরকার এবং সবারই এতে অংশ নেয়া প্রয়োজন। আলোচনাটি খুবই জরুরি। এ আলোচনা বাংলাদেশের অর্থনীতির সঙ্গে যেমন যুক্ত, একই সঙ্গে জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও জবাবদিহিতার সঙ্গেও সম্পৃক্ত। অন্যভাবে বলা যায়, বাংলাদেশের অর্থনীতিকে টেকসই ও মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে হলে প্রতিষ্ঠানগুলোকেও টেকসই ও শক্তিশালী করা দরকার। সেজন্য ব্যাংক ব্যবস্থা নিয়ে হওয়া আলোচনাটি অত্যাবশ্যক।
এ আলোচনা যেভাবে এগোচ্ছে, তা আসলে কতটুকু ব্যাংক ব্যবস্থার সত্যিকার পরিবর্তনের জন্য এবং কতটুকু নিছকই  আলোচনার খাতিরে হচ্ছে, সে বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন রয়েছে। অধিকাংশ ব্যক্তি বলছেন যে, রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যবস্থার বর্তমান পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। তবে তা বিরাজমান সংকটময় পরিস্থিতির কারণ নিরূপণে নির্দিষ্ট নয়। রাজনৈতিক নির্দেশিত ঋণ প্রদানের বিষয়টি এ দেশে পুরনো ব্যাপার। খেলাপি ঋণের বিষয়টিও বাংলাদেশে নতুন নয়। অতীতের অভিজ্ঞতা বলে, উন্নয়ন-বিশেষায়িত ব্যাংক ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় সবসময় খেলাপি বা মন্দ ঋণ ছিল। খেলাপি ও মন্দ ঋণের সঙ্গে রাজনৈতিক আনুকূল্য ও পৃষ্ঠপোষকতা সবসময়ই বিরাজমান; তবে প্রশ্ন হলো— এখন কি শুধু রাজনৈতিক নির্দেশিত ঋণ অনুমোদনের কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে, না এর সঙ্গে এমন এক পরিস্থিতি যোগ হয়েছে, যার কারণে আগের চেয়ে এখন খেলাপি ঋণ বেশি হারে বাড়ছে? মূলত এ মৌলিক প্রশ্নের উত্তর খোঁজা আবশ্যক। এবং এ প্রশ্নের উত্তর মিললে সংকট নিরসনের পন্থাও বাতলানো সহজতর হতে পারে।
২. ব্যাংক ব্যবস্থায় কেন খেলাপি ঋণ হয়, এ বিষয়ে কতগুলো ব্যাখ্যা হাজির করা হয়। এর মধ্যে একটি ব্যাখ্যা যারা কেতাবি অর্থনীতিবিদ, তারা হাজির করেন। বিশেষ করে সাম্প্রতিককালে তথ্যভিত্তিক অর্থশাস্ত্রে (ইনফরমেশন ইকোনমিকস) আলোচিত হওয়া নৈতিক বিপত্তি ও প্রতিকূল নির্বাচন— এ দুটি ধারণার নিরিখে আলোচ্য ব্যাখ্যাটি হাজির করা হয়। এ ব্যাখ্যার মূল বক্তব্য হলো, ব্যাংক ঠিকভাবে গ্রাহক নির্বাচন করতে পারছে না। সেজন্য গ্রাহক যথাযথভাবে কার্যক্ষমতা দেখাতে পারছেন না। ব্যাংকের কৌশলে ভুল আছে। কাজেই ঋণ খেলাপিতে পরিণত হচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে বিষয়টি যৌক্তিক মনে হয়। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিষয়টি কতটুকু যৌক্তিক, তা ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন।
দ্বিতীয় একটি ব্যাখ্যা দেয়া হয়। মূলত পোষ্য ও মুখস্থ বিদ্যায় পারদর্শী দুই দল লোক এ ধরনের বিশ্লেষণ হাজির করেন। তারা বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে ব্যক্তিমালিকানায় আনা গেলে খেলাপি ঋণের সমস্যা থেকে উত্তরণ ঘটবে। কারণ রাজনৈতিক বিবেচনায় বেশিসংখ্যক লোক পরিচালনা পর্ষদ বা ব্যবস্থাপনায় থাকতে পারবে না। কাজেই আলোচ্য সমস্যা থেকে মুক্তি মিলবে। এ দুটি ব্যাখ্যার কতক অংশ ঠিক বটে, কিন্তু কোনোভাবেই বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণে সহায়ক নয়। তাহলে এমন কী হলো, যার জন্য দেশের বর্তমান পরিস্থিতি অন্য সময় ও অবস্থানের চেয়ে ভিন্ন মাত্রার?
বিষয়টি বুঝতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মৌল সূচক পর্যালোচনা করা যাক। মোটাদাগে সত্তরের দশকের শেষের দিক থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ব্যক্তিখাতের বিস্তৃতি বেড়েছে। সেক্ষেত্রে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগ নির্ণায়কমূলক সূচক। দেখা যাবে যে, ১৯৯১ সালের পর থেকে জিডিপি যেমন বাড়ছিল, তেমনি একই হারে জিডিপিতে ব্যক্তিখাতের অংশও বাড়ছিল। জিডিপির অনুপাতে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ  ২০১১-১২ সালে ২২ দশমিক ৫০ শতাংশ, ২০১২-১৩ সালে ২১ দশমিক ৭৫, ২০১৩-১৪ সালে ২২ দশমিক শূন্য ৩ এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরে জিডিপির ২২ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ হয়েছে। অর্থাত্ ২০১২-১৩ সাল থেকে জিডিপিতে ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগের অংশ হ্রাস পেয়েছে বা স্থবির হয়ে পড়েছে।
অন্যদিকে খেলাপি ঋণ-সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০১১ সাল শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা। তা বিতরণকৃত ঋণের ৬ দশমিক ১২ শতাংশ। এর পর থেকেই বেশি হারে বাড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মার্চ শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে মোট ঋণের পরিমাণ প্রায় ৭ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭৩ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা। অর্থাত্ মোট ঋণের প্রায় ১১ শতাংশই খেলাপি। এর সঙ্গে অবলোপনকৃত খেলাপি ঋণের প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা যোগ করলে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা। এ বিপুল পরিমাণ অর্থ জিডিপির ১২ শতাংশ। বাংলাদেশের জিডিপি স্থির মূল্যে ৯ লাখ ৪৭ হাজার ৫৪২ কোটি টাকা। এ হিসাবে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ জিডিপির ১২ দশমিক ৪৫ শতাংশ। মোট ঋণের তুলনায় খেলাপি ঋণের পরিমাণের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম সারিতে। পার্শ্ববর্তী ভারতের জিডিপির পরিমাণ ২ দশমিক শূন্য ৭৪ ট্রিলিয়ন ডলার (প্রায় ২ লাখ ৭ হাজার ৪০০ কোটি ডলার)। আর তাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৫৪ বিলিয়ন ডলার (১৫ হাজার ৪০০ কোটি ডলার)। অর্থাত্ ভারতের জিডিপির ৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ খেলাপি ঋণ। খেলাপি ঋণ বাড়তে থাকায় সরকারি ব্যাংকগুলো মূলধন ঘাটতিতে পড়ছে। তাই পুনরায় মূলধনের নামে এ ব্যাংকগুলোকে ১১ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা জোগান দিতে হয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে কর থেকে ২ হাজার কোটি টাকা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে দিতে হয়েছে।
অল্প অর্থ জমা দিয়েই ঋণ পুনঃতফসিল করা যাচ্ছে। ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ দেয়া হয়েছে। এর পরও দিন দিন ঋণখেলাপির পরিমাণ বাড়ছে। আগে সাধারণত খেলাপি হলে ঋণ পুনঃতফসিল করার সুযোগ ছিল। কিন্তু বর্তমানে ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ দেয়া হয়েছে। ২০১৫ সালে বড় ঋণখেলাপিদের বিশেষ সুবিধা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বড় অংকের ঋণ পুনর্গঠনের নীতিমালা অনুমোদন দিয়েছে। এ সুবিধার আওতায় ৫০০ কোটি টাকা বা তার বেশি অংকের ঋণ পুনর্গঠন করা গেছে। নীতিমালা অনুসারে মেয়াদি ঋণ পুনর্গঠন সর্বোচ্চ ১২ বছরের জন্য। আর তলবি ও চলমান ঋণ পুনর্গঠন হবে ছয় বছরের জন্য। ঋণের পরিমাণ ১ হাজার কোটি টাকার কম হলে ডাউন পেমেন্ট বা এককালীন জমা দিতে হবে ২ শতাংশ হারে। আর ১ হাজার কোটি টাকা ও তার বেশি পরিমাণ ঋণের জন্য এককালীন জমা দিতে হবে ১ শতাংশ হারে। পরিসংখ্যান বলছে, পুনর্গঠন সুবিধা নিয়ে ব্যবসায়ীদের বড় অংশই কিস্তি পরিশোধ করছেন না। এরই মধ্যে পুনর্গঠন সুবিধা পাওয়া অর্ধেকই নতুন করে খেলাপি হয়েছেন। এ সুযোগের কারণে দেখা যাচ্ছে, ব্যাংক থেকে দেয়া ঋণের বিপুলাংশ খেলাপিতে পরিণত হচ্ছে।
লক্ষ করা যাচ্ছে, ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে জিডিপিতে ব্যক্তিখাতের অংশ হ্রাস পাওয়া শুরু করল এবং তা স্থবিরতায় দাঁড়িয়েছে; খেলাপি ঋণ দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। তাই কী কারণে ঘটল? এর দুর্বোধ্য কোনো ব্যাখ্যা নেই। এর একটি ব্যাখ্যাই যে, বিনিয়োগকারীরা আস্থাহীনতায় ভুগছেন। এর সঙ্গে পুঁজি পাচারের বিষয়টি মেলালে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করা সহজতর হয়। পরিষ্কারভাবে লক্ষ করা যাচ্ছে, বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির মূল কারণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সংকোচন (বিনিয়োগ স্থবির হওয়া) এবং রাজনৈতিক কারণে আস্থাহীনতা।
সাম্প্রতিক সময়ের হিসাব, বিশেষ করে গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) বলছে, বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ পুঁজি বা অর্থ পাচার হচ্ছে এবং ক্রমাগত এর পরিমাণ বাড়ছে। তার অভ্যন্তরীণ খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে না কিন্তু অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে। আবার লক্ষ করা যাচ্ছে, বিভিন্ন প্রকল্পে বিশেষ করে মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম প্রকল্পে (এমএমটুএইচ) বাংলাদেশীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, এরই মধ্যে ৩ হাজার ৫৪৬ বাংলাদেশী মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম গড়েছেন। শুধু মালয়েশিয়ায় নয়, সিঙ্গাপুর, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ  অন্য দেশে বাংলাদেশীদের অর্থ পাচারের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। সুইস ব্যাংকের সাম্প্রতিক হিসাব একই কথা বলছে। তার মানে যখন আস্থাহীনতা থাকে তখন ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে পুঁজির পাচার ঘটে এবং খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ে; অন্যদিকে নতুন বিনিয়োগকারী তৈরি হয় না এবং ব্যাংক থেকে অনেকে ঋণও নিতে চান না। অর্থাত্ দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির সঙ্গে ঋণযোগ্য টাকা (তারল্য বা অলস টাকা) বেড়ে যাওয়ার সংকটও দৃশ্যমান হয়। কাজেই এটা পরিষ্কার যে, এখানে আস্থাহীনতাই মূল কারণ। আস্থাহীনতার কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অনিশ্চয়তা থাকায় ব্যাংক ব্যবস্থার এ সংকট সৃষ্টি হয়েছে। তখন লুটপাটও বেড়ে যায়। বেড়ে যায় প্রকল্প খরচও। এসবই দৃশ্যমান।
আরেকটি প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ব্যক্তিমালিকানায় আনা হলে এ সমস্যার উত্তরণ ঘটত কিনা। নিশ্চয়ই ঘটত না। কারণ আর্থিক খাতের সংস্কারে বলা হয়েছিল, ব্যক্তিখাতে ব্যাংক বাড়লে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পাবে এবং প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সুদের হার কমে যাবে। কিন্তু সুদের হার প্রতিযোগিতার জন্য কমছে না; বরং এটি না কমার অন্যতম কারণ— খেলাপি ঋণের পরিমাণ। অর্থাত্ খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেশি থাকলে সঞ্চিতি বা প্রভিশনিং বেশি রাখতে হয়। ব্যাংকের ব্যয় আরো বেড়ে যায়। এ কারণেও সুদের হার কাঙ্ক্ষিত হারে কমছে না। কাজেই প্রতিযোগিতা নয়, প্রাতিষ্ঠানিক সংকটাপন্নতাই সুদের হার বেশি হওয়ার মূল কারণ। ব্যক্তিখাতের ব্যাংকগুলোয়ও রাজনৈতিক কায়দায় পরিচালনা পর্ষদ গঠন করা হচ্ছে। ব্যাংক স্থাপনে যেমন রাজনৈতিক লোকদের অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে, অন্যদিকে সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের নিয়মনীতির ক্ষেত্রেও বড় ধরনের অসুস্থ সংস্কারের প্রস্তাব করা হয়েছে। বিশেষ করে পরিচালনা পরিষদের সদস্যদের মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
আস্থাহীনতার সঙ্গে আরেকটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাপারও একেবারেই আলোচনা হচ্ছে না। নিঃসন্দেহে ব্যাংক একটি কোম্পানি। কিন্তু তা যেকোনো সাধারণ কোম্পানির মতো নয়। সাধারণ কোম্পানিতে পুঁজির জোগান উদ্যোক্তারা ও শেয়ারহোল্ডাররা দিয়ে থাকেন। শুধু কার্যকরী পুঁজি (ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল) ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নেয়া হয়। কিন্তু ব্যাংকের ক্ষেত্রে এটা ব্যতিক্রম। এখানে উদ্যোক্তা বা শেয়ারহোল্ডাররা যে পরিমাণ ঋণ দেয় বা বিনিয়োগ করে, তাতে তাদের অংশ খুবই কম। আমানতকারীরা অধিকাংশ অর্থের জোগান দেন। তার মানে ব্যাংকের মালিকানা যার হাতেই থাকুক না কেন, এটি আসলে আমানতকারীর প্রতিষ্ঠান। মূলত সেজন্য রেগুলেশনের ধরন ভিন্নতার দাবি রাখে। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে লক্ষণীয় যে, রেগুলেশনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ব্যর্থতা বিদ্যমান। নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের ব্যাংকগুলোকে আমানতকারীর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে পারেনি। যদিও গণমাধ্যম ব্যাংক ব্যবস্থার বিভিন্ন দোষ-ত্রুটি উপস্থাপন করছে, এক্ষেত্রে গণমাধ্যমও বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে পারেনি। এখনো জনমনে এ ধারণা প্রতিষ্ঠিত করা যায়নি যে, ব্যাংক আর ১০টি প্রতিষ্ঠানের মতো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নয়; এটি আমানতকারীর প্রতিষ্ঠান। কাজেই আমানতের খেয়ানত করার অধিকার কারো নেই। এবং সেজন্য যে ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক শাসন দরকার, তা দৃশ্যমান নয়। সংশ্লিষ্টদের অনেকেই এখনো ব্যক্তিখাতে ব্যাংকগুলো ছেড়ে দিলে খেলাপি ঋণ ও সুদের হার কমে যাবে— এ ধরনের ভ্রান্ত তত্ত্বের মধ্যে জীবনযাপন করছেন।
৩. আলোচনাটা হওয়া দরকার দুটি ক্ষেত্রে। এক. কীভাবে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বেশি জোগানো যায়, যার মাধ্যমে বিনিয়োগ হতে পারে এবং বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চাঙ্গা হতে পারে। অর্থাত্ বিনিয়োগকারীদের ব্যাংক ব্যবস্থায় সুযোগ, সুবিধা ও সেবা কীভাবে বাড়ানো যায় এবং সুদের হার কীভাবে কমানো যায়। দুই. ব্যাংকের প্রডাক্টে বৈচিত্র্য কীভাবে আনা যায়। এ খাতের প্রডাক্টের ক্ষেত্রে কোনো সৃজনশীলতা দেখা যায় না, বরং উল্টো কীভাবে গ্রাহককে আরো বেশি মাত্রায় শোষণ করা যায়, তার বিস্তর অভিযোগ লক্ষণীয়। অর্থাত্ উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ব্যাংক হলো একটি ইঞ্জিনের মতো এবং সৃজনশীলতার মাধ্যমে কীভাবে উৎপাদনকে সহায়তা করা যাবে, তা-ই ব্যাংক ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। কিন্তু তা হয়নি। আরেকটি ব্যর্থতা হলো, ব্যাংককে আমানতকারীর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের নিরুত্সাহ। মোটাদাগে বলতে গেলে, ব্যাংক ব্যবস্থায় আজকের যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তা আস্থার অভাব থেকে। এটি একটি রাজনৈতিক প্রশ্ন।
সন্দেহ নেই, রাজনৈতিকভাবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে। কীভাবে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে, সে রাজনৈতিক প্রশ্ন রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করা দরকার। জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ও প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার কোনো বিকল্প নেই। এ ধরনের ব্যবস্থাই আস্থার সংকট ও অনিশ্চতয়তা দূরীভূত করতে পারে। এটা প্রথম পর্যায়ের কাজ। দ্বিতীয় পর্যায়ে রেগুলেশনের ক্ষেত্রে সৃজনশীল চিন্তার প্রয়োজন, তা পোষ্য ও মুখস্থ বিদ্যায় হবে না। তৃতীয় পর্যায়ের কাজ, যা নিয়ে একেবারেই আলোচনা হয় না তা হলো, ব্যাংকের কিন্তু সব গ্রাহক বড় নন, ক্ষুদ্র গ্রাহকই বেশি। এবং ব্যাংক বিভিন্ন সেবা প্রদানের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, জনমানুষ ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সে ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে না। ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে।

লেখক: অধ্যাপক, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। চেয়ারপারসন, উন্নয়ন অন্বেষণ । 


Tuesday, July 25, 2017

নির্বাচন-পূর্ব অর্থ পাচার : সহজেই ৩টি পদ্মা সেতু তৈরি সম্ভব

আমাদের বুধবার প্রতিবেদন


যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) গত মে মাসে ‘ইল্লিসিট ফিন্যান্সিয়াল ফ্লোজ ফ্রম ডেভেলপিং কান্ট্রিজ : ২০০৫-১৪’ শীর্ষক প্রতিবেদনে অর্থ পাচারের  যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর বিপুল অর্থ পাচার হচ্ছে। এবারের প্রতিবেদনে রয়েছে ২০০৫-২০১৪ সাল সময় পর্যন্ত তথ্য। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ায় অর্থ পাচারে ভারতের পরের অবস্থানেই রয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৯১১ কোটি ডলার (প্রায় ৭২,৮৭২ কোটি টাকা) পাচার হয়েছে ২০১৪ সালে- যা ২০১৬-১৭ অর্থবছরের পরিবহন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ, কৃষি ও পানিসম্পদ খাতের মোট উন্নয়ন বাজেটের সমান। এছাড়া, ২০০৫-২০১৪ সময়কালে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ৭৫৮৫ কোটি ডলার বা ৬ লাখ ৬ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা। তবে সবচেয়ে বেশি পাচার হয়েছে ২০১৩ সালে (৯৬৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার)- যা ছিল সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের বছর পর্যন্ত। অর্থ পাচারে দেশগুলোর তালিকায় ২০১৬ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৯টি দেশের মধ্যে ছিল ২৬তম। আমদানি-রফতানির সময়ে পণ্যের প্রকৃত মূল্য গোপনসহ নানা পদ্ধতির মাধ্যমেই এই অর্থের বড় অংশ পাচার করা হয়েছে। অথচ কেবল অর্থ পাচার ঠেকাতে পারলেই মূসক খাতের আয় নিয়ে আদৌ কোনো দুশ্চিন্তা করতে হতো না এনবিআরকে। পাচার হওয়া এ অর্থ দিয়েই বাংলাদেশে ৩টি পদ্মা সেতু তৈরি করা সম্ভব হতো। সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড ২০১৬-তে দেখা যায়; ২০১৫ সালে সেদেশে বাংলাদেশীদের ব্যাংক হিসাবে অর্থ জমা বেড়েছে ১৯ শতাংশ। বর্তমানে যেখানে মোট অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। আর আগেই বলা হয়েছে যে, মে মাসের শুরুতে ওয়াশিংটন ভিত্তিক এক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে বলা হয় ১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৭৩ হাজার কোটি টাকা।

আমাদের দেশটি বর্তমানে উন্নয়নের মহাসড়কে হাঁটছে;নানা স্বপ্নও দেখানো হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের মতে, অচিরেই দেশটি মধ্যম আয়ের দেশের বলয়ে ঢুকে যাবে। ফলে অর্থপাচারের বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের আমলে না নেওয়ার কোনো কারণ দেখি না। এর আগেও অনেকবার বিষয়টি সামনে এসেছে, কিন্তু সরকার তথা সংশ্লিষ্টরা অর্থপাচার রোধে খুব যে একটা তৎপরতা দেখিয়েছে, তেমনটি মনে করা যায় না। এর প্রমাণ তো প্রতিবেদনের বছরভিত্তিক পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট। বাংলাদেশের জন্য অর্থপাচারের ঘটনাটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক হলেও, সংশ্লিষ্টদের রয়েছে অনিবার্য নির্লিপ্ততা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন ওঠা অমূলক নয় যে, দেশ থেকে অর্থপাচারের মতো ভয়াবহ ঘটনা আদৌ রোধ করা যাবে কি না?

প্রশ্ন উঠতে পারে, কীভাবে অর্থ পাচার হচ্ছে। পণ্য আমদানির সময় ওভার ইনভয়েসিং অর্থাৎ আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য বেশি দেখিয়ে এবং রফতানির সময় আন্ডার ইনভয়েসিং অর্থাৎ পণ্যের মূল্য কম দেখিয়ে আমদানি রফতানি করছেন। এ প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে। ফলে প্রশ্ন উঠতে পারে, বিষয়টি যেহেতু বারবার আলোচনায় উঠে আসছে, তাহলে তা প্রতিরোধে কেন কার্যকর উদ্যোগ নিচ্ছে না সংশ্লিষ্টরা। পণ্যের আমদানি-রফতানির জন্য ব্যাংকিং চ্যানেলই ব্যবহার করতে হয়। অর্থপাচারের এই দায় ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা অস্বীকার করতে পারে না।

অন্যদিকে, ‘সেকেন্ড হোম’ এর কথাটিও বহুল আলোচিত। এমনও দৃষ্টান্ত রয়েছে, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে স্থায়ী মোটা অংকের বিনিয়োগ করে শিল্পপতিরা সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ করে নিচ্ছেন। বাংলাদেশীদের মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোমের সুবিধা নেওয়া, কানাডায় বেগমপাড়া তৈরি, বেশকিছু ব্যবসায়ীর সিঙ্গাপুর, হংকং-এ অফিস বানানোর তথ্য সত্য বলেই এখন ধরে নেয়া যায়।

২০১৫ সালে মালয়েশিয়া সরকারের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, বিদেশিদের জন্য সরকারের ‘সেকেন্ড হোম’ প্রকল্পে বাংলাদেশ ৩য় সর্বোচ্চ বিনিয়োগকারী দেশ; যেখানে ৩ সহস্রাধিক বাংলাদেশি প্রায় ৪,০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। নিয়ম অনুযায়ী, সেকেন্ড হোম প্রকল্পে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নগদ ৫ লাখ রিঙ্গিত (১ কোটি ২৫ লাখ টাকা) দেশটিতে নিয়ে যেতে হবে। সাধারণত যে কোন দেশে নাগরিকদের বিদেশে টাকা নিতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন লাগে, যেখানে গত ১০ বছরে মালয়েশিয়ায় বিনিয়োগের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাউকে কোনো অনুমোদন দেয়নি। এক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, মালয়েশিয়ায় বিপুল পরিমাণ অর্থপাচার করা হয়েছে।  এছাড়াও যেসব দেশে বিদেশি বিনিয়োগ উন্মুক্ত রয়েছে, সেই সব দেশের আবাসিক ভবন, জমি ক্রয়, হোটেলসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছেন বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা। এদের মধ্যে অনেকে অফশোর ব্যাংকিং, বিদেশী কনসালটেন্ট নিয়োগের মাধ্যমে টাকা পাচার করেছেন।

বিশ্বজুড়ে আলোড়নকারী টাকা পাচারের কেলেঙ্কারি ফাঁস করা ‘পানামা পেপার্স’ এর প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ২৭টি ব্যাংক হিসাবের কথা প্রকাশিত হয়েছে।

গত ১০ বছরের অর্থপাচারের চিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, যেসব বছর দেশের ভেতরে রাজনৈতিক অস্থিরতা বেশি ছিল, সেসব বছরে অর্থপাচার বেড়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঘিরে অনিশ্চয়তার সময় ২০১৩ সালে বাংলাদেশ থেকে আগের ৯ বছরের তুলনায় সবচেয়ে বেশি অর্থপাচার হয়েছে। ওই বছরটিতে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ ৯৬৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার। ২০১২ সালে এর পরিমাণ ছিল ৭২২ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এর আগে ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ও বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচার অনেক বেড়ে যায়। বছরটিতে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ ছিল ৬৪৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার। এর আগের অন্যান্য বছরের মধ্যে ২০০৪ সালে ৩৩৫ কোটি ডলার, ২০০৫ সালে ৪২৬ কোটি ডলার, ২০০৬ সালে ৩৩৮ কোটি ডলার, ২০০৭ সালে ৪১০ কোটি ডলার, ২০০৯ সালে ৬১৩ কোটি ডলার, ২০১০ সালে ৫৪১ কোটি ডলার, ২০১১ সালে ৫৯২ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। এতে স্পষ্ট যে, বাংলাদেশ থেকে দিন দিন অর্থপাচারের পরিমাণ বেড়ে চলেছে।

এটাও জানা যায়, দেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হলেও এর বিপরীতে মামলা হচ্ছে মাত্র দেড় হাজার কোটি টাকার, যা মোট পাচারকৃত অর্থের ৩ শতাংশ। বাকি প্রায় ৯৭ শতাংশ বা ৪৩ হাজার কোটি টাকার কোনো রেকর্ড থাকছে না। এ অর্থ হিসাবের মধ্যে আসছে না। পাচার হওয়া অর্থের একটা বড় অংশ জমা আছে সুইস ব্যাংকে। দুঃখজনক হলেও সত্য, দীর্ঘদিন ধরে যখন বাংলাদেশে আশানুরূপ বিনিয়োগ ঘটছে না, তখনো পাচার হচ্ছে অর্থ। অথচ এই অর্থ যদি পাচার না হয়ে বিনিয়োগে আসত তাহলে শিল্প-কারখানা গড়ে উঠতো, উৎপাদন ও রফতানি বাড়তো, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটতো এবং ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতো। সব মিলে অর্থনীতি ও উন্নয়নে বড় রকমের অগ্রগতি হতো।

সাধারণত দুর্নীতি ও চোরাচালানের মাধ্যমে অর্জিত অর্থসহ অবৈধভাবে প্রাপ্ত অর্থ পাচার হয়ে যায়। এটা ঠিক, দেশে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থের নিরাপত্তার অভাব আছে। দ্বিতীয়ত, বিনিয়োগ পরিবেশেরও অভাব আছে। অর্থপাচার হওয়ার এ দু’টিই বড় কারণ। এর আগে অপ্রদর্শিত অর্থ বিভিন্ন সেক্টরে বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাতেও খুব বেশি সাড়া পাওয়া যায়নি। দুদক ও বিভিন্ন সংস্থার ভয়ে অনেকেই অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগে আগ্রহ ও উৎসাহ দেখাননি। দুর্নীতি বা অনৈতিক উপায়ে অর্থ উপার্জন কোনো দেশেই সমর্থনযোগ্য নয়। তারপরও দেখা গেছে অনেক দেশ এ অর্থ অবাধে ও বিনা প্রশ্নে বিনিয়োগের সুযোগ দিয়েছে এবং তাতে ওইসব দেশ লাভবান হয়েছে।

বিশ্ব বানিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) পরিচালিত ২০১৫ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যিক লেনদেনের গড়ে ১০ শতাংশের বেশি অর্থ পাচার হয়। ২০১৪ সালে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক হিসাবে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনীতির ৪০-৮০ শতাংশ কালোটাকা। জাতিসংঘ উন্নয়ন প্রকল্প (ইউএনডিপি) এর তথ্যমতে, স্বাধীনতার পর চার দশকে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ জিডিপির প্রায় ৩০ দশমিক ৪ শতাংশ। পাচারকৃত এ অর্থ দেশের মোট বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) এর দুই-তৃতীয়াংশ।

উৎস - amaderbudhbar.com

Saturday, July 22, 2017

একটি ভ্রমণ কাহিনি

রুমীন ফারহানা

অদ্ভুত হলেও সত্য আমার জীবনে আমি সবচেয়ে বেশি মুভি দেখেছি প্লেনে বসে। বাসায় মুভি দেখার সরঞ্জাম নাই আর হলেও যাওয়া হয়ে ওঠে না। হাতে গোনা এক দুইবার ছাড়া আমার বেশির ভাগ ভ্রমণই সরাসরি কাজ সংক্রান্ত এবং সেগুলো আমাকে একাই সারতে হয়। ভ্রমণগুলো দীর্ঘ, ক্লান্তিকর এবং অসুস্থ মা'কে একা রেখে যাওয়ার চিন্তায় কষ্টকরতো বটেই। যেকোনও যাত্রা তা সে সড়ক বা আকাশ যে পথেই হোক না কেন ঘুম যেহেতু হয় না তাই সময় কাটাবার সবচেয়ে ভালো উপায় আমার কাছে মুভি দেখা। কিছুক্ষণের জন্য হলেও সবরকম চিন্তা থেকে দূরে থাকা যায়। এবারই প্রথম প্লেনে বসে লিখছি আমি। কষ্ট, যন্ত্রণা, বিরক্তি আর অসহায়বোধ থেকে এই লেখা। শারীরিক কষ্ট, মানসিক যন্ত্রণা আর অনেকখানি অপমান, অবসাদ মিশে আছে এই লেখায়।

গত দুই বছর থেকেই আমার বিদেশ ভ্রমণের ওপর অলিখিত নিষেধাজ্ঞা আছে অজানা কোনও বড় শক্তির। অলিখিত, অজানা বলছি কারণ কোনও আদালতের আদেশ বা প্রশাসনের কোনও কারণ দর্শানো চিঠি আমার হাতে নেই যাতে বলতে পারি ঠিক এই কারণে, এই অফিস কর্তৃক আমার বিদেশ যেতে বাঁধা আছে। বেশ কয়েকবার বিমানবন্দর থেকে ফিরেও আসতে হয়েছে আমাকে। আবার কোনও কোনও সময় প্লেন ছাড়ার কয়েক মিনিট আগে হঠাৎ জানানো হয়েছে অজানা শক্তি আমাকে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে এবং দৌড়ে প্লেন ধরেছি আমি। খুবই রহস্যে ঘেরা, চাঞ্চল্য আর উত্তেজনায় মোড়া আমার গত দুই বছরের বিদেশ যাত্রাগুলো। ৫০-৫০ চান্স নিয়ে প্রতিবার যাত্রা করি আমি। এই অনিশ্চয়তার যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে না গেলে এটা বোঝানো কঠিন। সহজ করে বললে বেশ একটা ইঁদুর-বেড়াল খেলা খেলা ভাব আছে পুরো বিষয়টির মধ্যে। যদিও বেড়ালের জন্য যা খেলা, ইঁদুরের জন্য অনেক সময়ই তা সাক্ষাৎ মৃত্যু।

খেলা বলছি ঠিকই কিন্তু এটি আসলে খেলা নয়। ইমিগ্রেশন কাউন্টারে দাঁড়ানোর ১/২ মিনিটের মাথায়ই আমাকে জানানো হয় কী জানি (!) সমস্যা হচ্ছে তাই আমাকে ওসির রুমে যেতে হবে। সেখানে আমার কাছ থেকে পাসপোর্ট, টিকিট, বোর্ডিংপাস নিয়ে নেওয়া হয় আর ইমিগ্রেশন পুলিশ ঘেরা একটা ঘরে অপরাধির মতো একা বসে অনিশ্চয়তার দোলায় দুলতে থাকি আমি। দেবে নাকি দেবে না? দিলে কী ঠিকঠাক প্লেন ধরতে পারবো আমি নাকি সময় স্বল্পতার কারণে মিস হবে? আমার লাগেজ যা আগেই চেকইন হয়ে গেছে তার কী গতি হবে? অফ লোড করবে তো তারা? লাগেজ কি অক্ষত পাবো? একবার এমনও হয়েছে যে এয়ারলায়েন্স তার কাউন্টার থেকেই বিদায় করেছে আমায় এই বলে যে ওপরের নির্দেশ আছে বোর্ডিং পাস ইস্যু না করার জন্য। ওসির রুমের দরজা আর এয়ারলায়েন্সের কাউন্টারে শাটল কর্কের মতো ছুটেছি আমি টানা ৩ ঘণ্টা। কোনও কাজ হয়নি। এমনকি সেবার ওসির দেখা পর্যন্ত পাইনি। কী অপরাধে এই সাজা তাও জানা হয়নি। আদালতের দারস্থ হয়েছি বেশ কয়েকবার এবং আদালতের পাকা নির্দেশ নিয়েই যাত্রা করছি কিছুদিন যাবত। আদালতের পাকা নির্দেশ পাওয়ার পর লাভ হয়েছে এটুকুই যে তারা আমার যাত্রা বন্ধ করতে পারেনি আর কিন্তু অত্যাচার চালিয়ে গেছে আগের মতই।

এবার আমার ফ্লাইট ছিল সকাল ৮টা ২৫ মিনিটে। ঢাকা থেকে দোহা হয়ে লন্ডন। মোটামুটি দীর্ঘ পথ। এই যাত্রায় সকাল ছয়টায় এয়ারপোর্ট গেলেই চলে, কিন্তু আমি গেছি ভোর ৪ টায়। ওই যে ইঁদুর বেড়াল খেলতে হবে। পাসপোর্ট, টিকিট, বোর্ডিংপাসের সাথে উচ্চআদালতের নির্দেশও পুলিশকে জমা দিয়েছি আমি। দীর্ঘ ক্লান্তিকর অপেক্ষা। সাড়ে সাতটা বেজে গেছে তারপরও নো ক্লিয়ারেন্স। ক্ষুধা, নির্ঘুম রাত সব মিলিয়ে বিপর্যস্ত আমি। এবার বসিয়ে রেখেছে অন্য একটা ঘরে, যথারীতি সব ডকুমেন্ট তাদের হাতে। ৭টা ৪৫ মিনিটের দিকে ঢুকলাম বড় সাহেবের ঘরে, অনেকটা অনুমতি ছাড়াই। কনটেম্প অব কোর্টের কথা স্মরন করাতেই কাজ দ্রুত হলো। ফ্লাইট ধরলাম আমি। প্রতিবারই তো এই একই অপমান আর অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাই আমি, তাহলে আজ এত খারাপ লাগলো কেন?
লেখাটির ঠিক এই পর্যায় আমি দোহার খুব কাছাকাছি, এখনই ল্যান্ড করবে প্লেন। ৩ ঘণ্টার যাত্রা বিরতি। হঠাৎ কানে আসল কাতার এয়ারওয়েজ বলছে ‘... travel is a right for all... হাসছি আমি। না ভ্রমণ সকলের অধিকার না। এখনও কিছু কিছু বর্বর রাষ্ট্র আছে যেখানে স্বৈরশাসকেরা শাসন করে। সেখানে হঠাৎ হঠাৎ সাদা মাইক্রোবাসে করে হাওয়ায় মিলিয়ে যায় মানুষ, দু’একজন অতি ভাগ্যবান ফিরে আসে ঠিকই কিন্তু কিছুই মনে থাকে না তাদের, গলিত লাশ ভাসে পুকুরে, ডোবায়, ভয়ে ঢাকা চারপাশে ফিসফিস করে কথা বলে মানুষ, ৫৭ ধারা তাকে তাড়া করে ফেরে, বিকৃত বর্বর হত্যাকাণ্ড রাজনৈতিক বিবেচনায় পার পেয়ে যায়, সীমান্তে প্রতিদিন বন্ধুর ছোড়া গুলিতে লাশ পড়ে, এখানে জীবন শুধুই একটা সংখ্যা মাত্র। উন্নয়নের গল্প শোনায় শাসক, ঠিক যেমন রূপকথার গল্প, ঠাকুরমার ঝুলি শুনতাম ছেলেবেলায়। এখানে ৪ হাজার কোটি টাকা তুচ্ছ হয়ে যায় আর আয়োজন করে পাপকর বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হয় ১ লাখ টাকার ওপর। এখানে মানুষ পানিতে মরে, আগুনে পোড়ে, চাপা পড়ে পাহাড় ধসে। চাপাতির কোপ আর বন্দুকের নল এখানে চলে সমান গতিতে। এখানে ধর্ষণের সেঞ্চুরি পালিত হয় আর তনুকে খেয়ে যায় ভালুকে। এখানে জন্ম নেওয়ার আগেই শিশু গুলিবিদ্ধ হয়। জাতির সবচেয়ে বড় গৌরবের অর্জন মুক্তিযুদ্ধ এখন সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় জাতিকে বিভাজনে। এখানে ইতিহাস লেখা হয় আইন আর আদালত দ্বারা। মিথ্যাচার এখানে রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতির অংশ।

এমন এক দেশে বাস করে ভ্রমণকে আমি অধিকার বলি কী করে? সংবিধান দিয়েছে আমাকে সেই অধিকার কিন্তু এমন কত অধিকারইতো আছে সংবিধান জুড়ে। সংবিধানতো দেশের মালিকানাই তুলে দেয় আমাদের হাতে। তাই কি হয়? কাজির গরু কেতাবেই থাকে, তাকে বাস্তব জীবনে আশা করবার মতো বেকুবি করে কে। ক্লান্ত বিধ্বস্ত আমি অনিশ্চয়তায় আটকে থাকি, জানতেও পারি না কী পাপের এই সাজা। যে সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি সেখানে বেঁচে থাকাটাই অনেক বড় পাওয়া, বাকি সবটুকুই বিলাসিতা।

লেখক: সহ আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি, বিএনপি
উৎসঃ বাংলাট্রিবিউন

Sunday, July 16, 2017

The fallacy in budget making in Bangladesh

Unnayan Onneshan (UO), an independent multidisciplinary think tank, in its July 2017 issue of Bangladesh Economic Update, states that lack of fiscal accountability due to limited role of the parliament in the budget making process together with constitutional and systematic rigidities results in inefficiency, poor implementation of the budget and misuse of public resources.

To deal with the problem, the research organization calls for immediate adoption of necessary reform measures that may include revision of budget-related constitutional provisions, expansion of scope of parliamentary surveillance over fiscal management, and strengthening of concerned parliamentary standing committee.
 
The think tank finds that the status of budget implementation is on the decline since FY 2010-11. Of the total budget outlay, 97.05 percent was implemented in FY 2010-11, whereas the rate subsequently decreased to 93.18 percent, 90.76 percent, 84.59 percent, and 81.59 percent in FY 2011-12, FY 2012-13, FY 2013-14, and FY 2014-15 respectively.

Constitutional provisions relating to the budgetary process seem to fail in addressing a number of problems, such as, insufficient flow of information relating to formulation of budget, limited scope for participation by the legislators, lack of incentive for participation, and over-centralization, notes UO. 

The current structure of budget formulation that follows simple arithmetic in balancing income and expenditure and that maintains a rigid time-bound schedule for approval does not allow participation by numerous stakeholders in the final outcome of the budgetary process, says the research organization.     

As a consequence, lack of participation in the budget making process leads to over-centralization which, in turn, results in corruption, patronization and poor implementation of the budget. In addition, such a centralized budgetary process gives rise to imprudent distribution of resources and makes the budget implementation process cost-ineffective.

While the parliament is provided with exclusive power to control public finance, it regularly suffers from such weaknesses as inadequacy of time for budget approval, reluctance of members to participate in budget discussion, absence of opposition, ineffective discussion, and lack of specialized knowledge and expertise among most of the parliamentarians.

For instance, in recent times the parliament was given, on average, 20-23 days to deliberate and vote on the budget in Bangladesh, while the usual time allocated for budget discussion in other parliamentary democracies such as Australia is 1 to 2 months; in Britain 3 months, and in India more than one month.    

Along this line of budget making process, FY 2017-18’s budget speech seems to lack providing prudent and farsighted solutions to the current challenges except it earmarks an ambitious target of expenditure amidst inefficient distribution of resources and cost overrun, says Unnayan Onneshan. 
The think tank notes that political expediency along with lack of participation, accountability and transparency in fiscal management system has not only caused cost-overruns, scams, and capital flight, but the reign of uncertainty that kept the ratio of private investment to gross domestic product (GDP) stagnated over the years, slowed down growth in manufacturing resulting in underperformance in external sector.

Referring to imprudent budget making process induced inefficient channeling of resources to productive sectors and resultant lack of employment opportunities, UO notes that the youth unemployment rate in Bangladesh is higher than the regional South Asian average, with a huge sizeable youth population languishing in as NEET (not in employment, education or training).

The causes of elapsing prospects are more of institutional. The gradual corrosion of institutions has constrained allocation of resources to be channeled efficiently into productive sectors in order for the economy to get higher returns in terms of expanded productive capacity, notes the UO.

Pointing to the underachievement of NBR tax revenue collection in recent years, UO doubts that the target of collecting tax revenue of Tk. 248190 crore may not be feasible in FY 2017-18, whereas a gap of Tk. 18152 crore has been found between the budget and revised NBR tax in FY 2016-17.

Observing institutional fragility in the banking sector due to monumental rise in writing off of loans, meteoric rise in default loans and nosedive in risk and capital adequacy ratio, the research organization comments that the public in general has to pump their tax money to rescue the stripped nationalized commercial banks through recapitalization due to plunder in these banks.

Taking account of slow implementation against the planned duration of the infrastructure development projects, UO comments that increase in allocation implies rising cost induced economic rent which has made the public investments inefficient. For instance, Bangladesh spends Tk. 59 crore (proposed) to build one kilometer of 4-lane highways whereas China and India spend Tk. 13 crore and Tk. 10 crore respectively.

Pointing to failure of economic growth to create employment, the research organization notes that unemployed population increased to 2.6 million which is the highest since 2000. More than 70 percent of the total unemployed population is youth. To ensure distributional fairness in the economy, employment-friendly budgetary allocations for productive sectors are necessary.

To establish an efficient fiscal management system in the country and to root out the above-mentioned fiscal challenges, it is important that an effective participation of people’s representatives be present in the budget making process. The parliament must be given adequate time to discuss and approve the budget. Constitutional gaps that hinder the adoption of a participatory approach to formulation of budget must be addressed through necessary amendment and parliamentary reform.

Finally, the budgetary process should be decentralized in order to take account of the needs of the poor and marginalized groups.

Saturday, July 8, 2017

No, Bangladesh, The Truth is Not a ‘Smear Campaign’



Instead of Investigating, Authorities Reject Report of Enforced Disappearances

Just hours after Human Rights Watch released an 82-page report on secret detentions and enforced disappearances in Bangladesh, Home Minister Asaduzzaman Khan claimed it was a “smear campaign.” Callously ignoring victims’ families who are desperately waiting for answers, he told local media: “Whom will you say disappeared? Many businessmen went into hiding failing to repay their loans in this country. Some people went missing after developing extramarital relationship.”
Under international law, a “disappeared person” is someone held (or last seen) in the custody of agents of the state, followed by a refusal to acknowledge the deprivation of liberty or whereabouts of the person, which places them outside the protection of the law.
 Human Rights Watch has produced a detailed analysis of cases where individuals were picked up, often in front of witnesses or family members by security forces who identified themselves as members of the Rapid Action Battalion (RAB), Detective Branch (DB), or the “administration.” When these people were not produced in court within 24 hours, as required under Bangladeshi law, family members repeatedly approached police and other officials, who denied the person was detained. While many of these men were eventually produced in court, after a period of weeks or months of illegal detention, others were released with warnings to stay silent. Several were later found killed in so-called gunfights or “cross-fire,” and scores remain “disappeared.”
Instead of committing to investigate these incidents, Khan declared his government will “reject the report outright.” As head of the ministry responsible for internal security, Khan claimed the United Nations had never mentioned enforced disappearances. In fact, like the detailed letters sent by Human Rights Watch requesting comment on these abuses, the Bangladesh government has ignored repeated queries from the UN Working Group on Enforced or Involuntary Disappearances. The Human Rights Committee has also issued stern warnings.
The prime minister, Sheikh Hasina Wazed, while in opposition, repeatedly highlighted human rights violations and promised an end once she gained office. Now nearing the end of its second consecutive term, her Awami League government is not just echoing its abusive predecessors, but its security forces are secretly detaining and disappearing its political opponents and critics, as well as others it deems to be criminals. Party leader Hasan Mahmud accusedHuman Rights Watch of bias, ignoring previous work condemning opposition violence and its work on the United States. Bangladesh can and should do better.

Source - hrw.org

Friday, July 7, 2017

End Disappearances and Secret Detentions: HRW to govt




(New York) – Bangladesh law enforcement authorities have illegally detained hundreds of people since 2013, including scores of opposition activists, and held them in secret detention, Human Rights Watch said in a report released today. The Bangladesh government should immediately stop this widespread practice of enforced disappearances, order prompt, impartial, and independent investigations into these allegations, provide answers to families, and prosecute security forces responsible for such egregious rights violations.

The 82-page report, “‘We Don’t Have Him’: Secret Detentions and Enforced Disappearances in Bangladesh,” found that at least 90 people were victims of enforced disappearance in 2016 alone. While most were produced in court after weeks or months of secret detention, Human Rights Watch documented 21 cases of detainees who were later killed, and nine others whose whereabouts remain unknown. The 90 cases include three sons of prominent opposition politicians who were picked up over several weeks in August 2016; one was released after six months of secret detention, while the other two remain disappeared. In the first five months of 2017, 48 disappearances were reported. There are allegations of severe torture and ill-treatment while in secret custody.

“The disappearances are well-documented and reported, yet the government persists in this abhorrent practice with no regard for the rule of law,” said Brad Adams, Asia director. “Bangladesh security forces appear to have a free hand in detaining people, deciding on their guilt or innocence, and determining their punishment, including whether they have the right to be alive.”

The report also documents the continuing disappearance of 19 opposition Bangladesh Nationalist Party (BNP) activists. The 19 men were picked up by law enforcement authorities in eight separate incidents over a two-week period in or around Dhaka in the weeks before the January 2014 elections.

Human Rights Watch interviewed more than 100 people, including family members and witnesses, to document these cases. Details of police complaints and other legal documents are included in the report. The Bangladesh authorities failed to respond to letters seeking their views on these cases.

Witnesses and family members told Human Rights Watch that most of the abuses were carried out by the Rapid Action Battalion (RAB) or the Detective Branch of the police (DB), both of which have long-recorded histories of abuse. In the case of the 19 opposition party members, witnesses said that eight were taken by RAB, six by DB, and the rest by unknown security forces.

Ruhul Amin Chowdhury, who saw RAB take away his son, Adnan Chowdhury, on December 5, 2013, said he had trusted RAB to release his son the next day. “They said, ‘We are taking him. We will bring him back,’” he said. “They betrayed us.”

A senior RAB official privately admitted to family members of Sajedul Islam Sumon, a well-known local BNP leader who disappeared on December 4, 2013, that he had had Sumon and five other men in his custody, but that they were removed by other RAB officials after he refused orders to kill them. The official assumed the six men had all been killed.
Law enforcement authorities repeatedly deny the arrests, with government officials backing these claims, often by suggesting that the men are voluntarily in hiding. The police do not allow families to file complaints alleging that their relatives have been picked up by law enforcement authorities.

In addition to enforced disappearances, there is an alarming trend of deaths occurring in secret detention of state authorities. In one such case, on June 13, 2016, Shahid Al Mahmud, a student activist of the Jamaat-e-Islami party, was “dragged outside [his house] and taken into a black microbus,” his father, Rajab Ali, told Human Rights Watch. Rajab Ali said that police officers were present during the arrest, although they later denied they were holding his son. Two weeks later, on July 1, police said they found Shahid’s body after a gunfight with criminals. Shahid’s father told Human Rights Watch that the police are lying: “The police abducted my son and staged a ‘gunfight’ drama to justify the killing.”

Although the ruling Awami League party came to power in 2009 with a promise of “zero tolerance” for human rights violations, the practice of extrajudicial killings and enforced disappearances has persisted, with human rights organizations reporting at least 320 cases of disappearances since 2009. These include people suspected of criminal activities and militancy, as well as political opposition members.

Under international law, a forced disappearance is the deprivation of liberty by agents of the state, followed by a refusal to acknowledge the deprivation of liberty or by concealment of the fate or whereabouts of the disappeared person, which place such a person outside the protection of the law.

“The Bangladesh government is making a habit of complete disregard for human rights, human life, and the rule of law,” Adams said. “The government doesn’t even bother denying these abuses, instead remaining silent and relying on silence from the international community in return. This silence needs to end.”The Bangladesh government should invite the Office of the United Nations High Commissioner for Human Rights to investigate these allegations and make appropriate recommendations to ensure justice, accountability, and security force reform. The Bangladesh government should also invite UN experts, including the Working Group on Enforced or Involuntary Disappearances and the special rapporteur on torture, for an official country visit, allowing them full, unimpeded access to the places and people they seek to visit.

Selected Accounts

“The men approached my son on two motorbikes as he came out of the mosque after attending juma prayer. They handcuffed him after he gave his name and dragged him onto a motorbike at gunpoint. Some local people tried to stop this happening but the men aimed their guns at the local people and told people not to interfere with them as they were performing their ‘administrative duty.’”

–Nur Islam, father of Abu Jar Gifari, who was picked up on March 18, 2016. Abu’s body was recovered with gunshot injuries on April 13, 2016.

“Just after midnight, two men broke down the bamboo boundary, entered the compound of our house, and called out Shahid’s name as though they were his political associates. My wife and I woke up and went out to the gate, and one of the two men, both dressed in civilian clothes, pulled out a gun and threatened us. I opened the door and men went and pulled Shahid from his room. They allowed him to change his clothes. He was dragged outside and taken into a black microbus. There were other men present, some wearing police uniforms.”

–Rajab Ali, father of Shahid Al Mahmud, whose body was found two weeks after he was picked up on June 13, 2016
“We went to the apartment immediately. One of the guards there told us that three people in plainclothes went to the apartment and picked up my brother around midnight. When the guard tried to stop them, they introduced themselves as members of DB.”

–Moinul Hossain Opu, brother of Moazzem Hossain Tapu, disappeared since January 26, 2016

“When the door was opened, the men asked my sister-in-law, ‘Where is your husband?’ My brother then went to the door and the men said, ‘You have to come with us.’ My brother asked, ‘Can I have your identity? What is your force? Are you RAB, CID, DB?’ They did not identify themselves. He asked several times. They did not wear any uniform and they had no legal arrest warrant. Nothing. They just said, ‘Come with us.’ My brother said, ‘I am a lawyer and I need to know these things.’ And then they said, ‘We will give you five minutes to get ready. Get ready and come with us.’ … I stood in front of my brother and held the hand of one of the men. The man pulled away my hand and grabbed my brother. We were running behind him. It was total confusion. There was a white microbus and he was put in it. And the vehicle drove away.”

–Tahera Tasnim, sister of Mir Ahmad Bin Quasem, disappeared since August 9, 2016

“Suddenly we saw vehicles approaching. There was more than one car, but I can’t say exactly how many. There were some men in black uniforms who came out of the vehicles. They had weapons. The cars had their lights on so I could see the men, the color of their uniform. There was one car with ‘RAB-1’ written on it. I am sure that it was definitely RAB because of the clothes, and because I saw RAB-1 logo on the car.”

–Witness to the disappearance of six men from Bashundhara on December 4, 2013

“I approached the local police station. The duty officer told me that the police would not allow a complaint against RAB or any law enforcing agency.”

–Shamsuddin, father of Nizam Uddin Munna, disappeared since December 6, 2013

“As soon as he opened the door, they asked whether he was Pintu. He said, ‘Yes, I am Pintu.’ Then two of the men grabbed him.… Pintu asked who the men were. They said, ‘We are from the administration.’ He asked to see their ID cards, and they said, ‘It will not be a problem. You will be safe with us.’ My husband did not put up any resistance.”

–Tarannum Nahas, wife of Selim Reza Pintu, disappeared since December 12, 2013

Thursday, July 6, 2017

যাঁরা ফিরছেন, তাঁরা কিছু বলছেন না



কবি, প্রাবন্ধিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার ফরহাদ মজহারের মতো গত সাড়ে তিন বছরে ‘রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ’ বা ‘অপহরণের’ পর পরিবারের কাছে ফিরে এসেছেন কমপক্ষে ২৭ জন। 

এসব ঘটনায় অনেক ক্ষেত্রে কিছু অভিন্ন ছক বা মিল লক্ষ করা যায়। অপহৃত ব্যক্তিদের একটি বড় অংশকে অপহরণের পর ‘উদ্‌ভ্রান্ত’ অবস্থায় কোনো সড়কে পাওয়া যায়। কিন্তু ফিরে আসার পর অনেকে কোনো কথা মনে করতে পারেন না। বাকিরা মুখে কুলুপ আঁটেন।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে ২০১৪ সাল থেকে জুন ২০১৭ পর্যন্ত রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ বা অপহরণের শিকার হয়েছেন ২৮৪ জন। তাঁদের মধ্যে মৃতদেহ উদ্ধার হয় ৪৪ জনের, পরে গ্রেপ্তার দেখানো হয় ৩৬ জনকে এবং পরিবারের কাছে ফিরে আসেন ২৭ জন। বাকি ১৭৭ জনের ভাগ্যে কী ঘটেছে, সে সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি।

রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ বা অপহরণের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনেরা কখনো কখনো গণমাধ্যমের কাছে অভিযোগ করেছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তাঁদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ফিরে আসার পর নিখোঁজ ব্যক্তিরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বলেছেন, চোখ বেঁধে তাঁদের মাইক্রোবাসে করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। এর বাইরে তাঁরা কেউ আর বিস্তারিত কিছু বলেননি।
..........
১৮ ঘণ্টা নিখোঁজ থাকার পর কবি ফরহাদ মজহার গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগকে বলেছেন, শ্যামলীতে তাঁর বাসার সামনে থেকে তাঁকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর চোখ বেঁধে ফেলা হয়েছিল। এরপর আর কিছু তিনি জানেন না।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, অপহরণ বা রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হওয়ার পর ফিরে আসার একটি ঘটনারও সুরাহা হয়েছে বলে জানা যায়নি। কারও কোনো শাস্তিও হয়নি। ফলে এটা নিয়ে জনমনে, বিশেষ করে সরকারের সমালোচকদের মনে আতঙ্ক দিন দিন বাড়ছে। এই প্রেক্ষাপটেই এ ধরনের অপরাধীদের খুঁজে বের করে বিচারের সম্মুখীন করা অত্যাবশ্যক। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি আস্থা সুদৃঢ় করার জন্য সরকারের উচিত ব্যবস্থা নেওয়া।

গত সাড়ে তিন বছরে নিখোঁজ অবস্থা থেকে ফিরে এসেছেন এমন কমপক্ষে এক ডজন ব্যক্তিকে নিয়ে গণমাধ্যম সরগরম ছিল। তাঁদের নিখোঁজ থাকার সময়কাল সর্বনিম্ন ১৮ ঘণ্টা থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে সাত মাস পর্যন্ত।

১৬ এপ্রিল, ২০১৪ বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী ব্যবসায়ী আবু বকর সিদ্দিক ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে অপহৃত হন। ৩৪ ঘণ্টা পর তাঁকে চোখবাঁধা অবস্থায় কে বা কারা মিরপুরে নামিয়ে দিয়ে যায়। তাঁর পকেটে তিন শ টাকাও গুঁজে দেয় অপহরণকারীরা। তিনি চোখের বাঁধন খুলে প্রথমে রিকশায় করে মিরপুর ১০ নম্বরে, পরে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে ধানমন্ডিতে যান। ধানমন্ডি কলাবাগান খেলার মাঠের পাশে স্টাফ কোয়ার্টারের কোনায় বসানো পুলিশ চেকপোস্ট তাঁকে আটকায়। পরিচয় জানতে পেরে তাঁকে থানায় নিয়ে যায়।

আবু বকর সিদ্দিক অপহরণের ঘটনায় ফতুল্লা থানায় মামলা করেন তাঁর স্ত্রী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তবে ওই মামলার আর কোনো অগ্রগতি নেই।

নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নাকে ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে বনানীতে তাঁদের এক আত্মীয়ের বাসা থেকে সাদাপোশাকে থাকা পুলিশ তুলে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ করেন তাঁর স্ত্রী মেহের নিগার। পুলিশ সে সময় এই অভিযোগ অস্বীকার করে। ২১ ঘণ্টা নিখোঁজ থাকার পর তাঁকে ধানমন্ডির স্টার কাবাবের সামনে থেকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
১০ মার্চ ২০১৫ সালে উত্তরার একটি বাসা থেকে নিখোঁজ বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন আহমেদ ৬২ দিন পর ভারতের মেঘালয়ের শিলং থেকে উদ্ধার হন। ১২ মে তিনি মেঘালয় ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড নিউরো সায়েন্সেস হাসপাতাল থেকে তাঁর স্ত্রী হাসিনা খানকে ফোন করেন। ভারতীয় পুলিশের বরাতে বলা হয়, মেঘালয়ের গলফ গ্রিন এলাকায় ঘোরাঘুরির সময় পুলিশ তাঁকে আটক করে। সে সময় তাঁকে অপ্রকৃতিস্থ মনে হচ্ছিল।

সালাউদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, তিনি নিজে ভারতে আসেননি। যারা তাঁকে অপহরণ করেছিল, তারাই তাঁকে ভারতে রেখে গেছে। তিনি এর চেয়ে বেশি কিছু আর বলতে চাননি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনার পর তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেন তানভীর আহমেদ। ২০১৬ সালের ১৬ মার্চ দিবাগত রাতে তিনি নিখোঁজ হন। পাঁচ দিন পর তাঁকে উদ্‌ভ্রান্ত অবস্থায় বিমানবন্দর সড়কে হাঁটতে দেখে পুলিশ বাড়ি পৌঁছে দেয়।
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী পুরান ঢাকার আদালতপাড়া থেকে নিখোঁজ হন গত বছরের ৪ আগস্ট। প্রায় সাত মাস অজ্ঞাত স্থানে থাকার পর তিনি বাড়ি ফেরেন।

গত বছরের ১৫ অক্টোবর কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ইকবাল মাহমুদ রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি থেকে, ৩০ নভেম্বর পাবনা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী তানভির আহমেদ রংপুর থেকে পাবনা আসার পথে, ১ ডিসেম্বর তানভিরের বন্ধু ও একই মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী জাকির হোসেন পাবনার কলেজ ক্যাম্পাস থেকে এবং বরিশালের চাকরিপ্রার্থী তরুণ মেহেদী হাসান হাওলাদার বনানী থেকে, ৬ ডিসেম্বর ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় রাকিবুল ইসলাম রকি লক্ষ্মীপুর থেকে নিখোঁজ হন। তাঁরা সবাই পরে ফিরে আসেন।

চিকিৎসক ইকবাল মাহমুদের বাবা নুরুল আলম, পাবনা মেডিকেল কলেজের দুই শিক্ষার্থীর বাবা সুরুজ্জামান ও নুরুল আলম সরকার বলেন, সন্তান ফিরে আসাতেই তাঁরা সন্তুষ্ট। তাঁরা এ নিয়ে আর আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দায়ের করতে চান না।

মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, ‘একজন অপহরণ বা নিখোঁজ হওয়ার নির্দিষ্ট সময় পর যদি রাষ্ট্র বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁর সম্পর্কে কিছু বলতে না পারে, তখন সাধারণ মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। আমার মনে হয় নিরাপত্তা কাঠামোয় ব্যবস্থাগত ত্রুটি আছে। পুরো কাঠামোকে ঢেলে সাজানোর ব্যাপারে সমাজ ও রাষ্ট্রের এখন উদ্যোগ নেওয়া অত্যাবশ্যক।’

- প্রথম আলো থেকে সংক্ষেপিত।