Search

Thursday, August 10, 2017

ষোড়শ সংশোধনী রায় - কেন ক্ষমতাসীনদের এতো ক্ষোভ?



সি আর আবরার

 

গত ৯ জুলাই জাতীয় সংসদের সদস্যরা সর্বোচ্চ আদালতের ওপর তুমুল আক্রমণ চালিয়েছেন। ষোড়শ সংশোধনী খারিজ করে দেওয়া ২০১৬ সালের হাইকোর্টের রায় বহাল রাখার সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তে তারা তিক্ত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। ওই সংশোধনীতে অসদাচরণ এবং অক্ষমতাজনিত কারণে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদেরকে অপসারণে পার্লামেন্টকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল।

এর আগে ক্ষমতাসীন দলের রথী-মহারথীরা ওই বিষয়ে তৈরি হয়ে আসার জন্য সিনিয়র এমপিদের পরামর্শ দিয়েছিলেন। মিত্র দলের নেতাদেরও এ বিষয়ে কথা বলার জন্য প্ররোচিত করা হয়েছিল। তারা দ্বিধাহীন চিত্তে তাদের মনের ‘ঝাল’ ঝেড়েছেন। তারা রায়কে ‘অবৈধ’ ও ‘অসাংবিধানিক’ হিসেবে নিন্দা করতে তাদের ‘ক্ষোভ’ উগরে দিয়েছেন। তাদের বিষোদগারে, এটা কারো কারো মনে হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের রায়টি ‘১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের মৌলিক চেতনার পরিপন্থী।’ জনৈক প্রভাবশালী এমপি তার সহকর্মীদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ‘শত্রুদের সাথে শত্রু র মতোই আচরণ করতে হবে, প্রয়োজন হলে তাদেরকে ঠান্ডা করে দিতে হবে।’ বিচারকদের হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন, ‘রায়ের মাধ্যমে তাদের অভিশংসন থামানো যাবে না।’ তিনি ‘নিজেদের ভুল সংশোধনের জন্য’ বিচারকদের পরামর্শও দিয়েছেন।

আওয়ামী লীগের এক মিত্র দলের নেতা ‘বড় ধরনের ষড়যন্ত্রের’ গন্ধ পেয়ে একে ‘সংসদের সার্বভৌমত্বে’ হস্তক্ষেপ হিসেবে অভিহিত করেছেন। এমপিরা তাদের অবস্থানে ছিলেন দ্ব্যর্থহীন। তারা জোর গলায় বলেন, খারিজ করা সংশোধনীটি ছিল ‘১৯৭২ সালের সংবিধানের ৯৬ ধারা পুনঃবহালের’ লক্ষ্যে একটি অপরিহার্য প্রয়াস, তারা ‘সংবিধানের মৌলিক চরিত্র লঙ্ঘন করতে পারেন না।’ ক্ষমতাসীন জোটের আরেক নেতা বিচারপতিদের স্মরণ করিয়ে দেন, এই পার্লামেন্টেই তাদের অবসরের বয়সসীমা বাড়ানো হয়েছে, ‘মাত্র কয়েক দিন আগে’ তাদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করা হয়েছে।

পরিতাপের বিষয় হলো, এমপি মহোদয়েরা কোর্টের রায় এবং ১০ অ্যামিকাস কিউরির (তাদের ৯ জনই সংশোধনীটি বাতিল করার সুপারিশ করেছেন) পর্যবেক্ষনের মধ্যে তাদের বক্তব্য সীমাবদ্ধ রাখেননি । তারা প্রধান বিচারপতি এবং দুই অ্যামিকাস কিউরি- ড. কামাল হোসেন এবং ব্যারিস্টার আমির-উল ইসলামের অনভিপ্রেত সমালোচনা করেন। একজন উর্ধ্বতন মন্ত্রী দাবি করেন, রায়ে প্রতিপন্ন হয়েছে যে, প্রধান বিচারপতি পাকিস্তানকে তার আদর্শ বিবেচনা করেন। ড. কামাল হোসেন এবং ব্যারিস্টার আমির-উল ইসলামকে ‘সুযোগসন্ধানী,’ ‘বিবেকবর্জিত,’ এবং ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই দুই অ্যামিকাস কিউরির একজনের শ্বশুর যে ‘পাকিস্তানের নাগরিক’ এবং অপরজনের ‘জামাতা যে ইহুদি’ সেটা জোর দিয়ে বলতে কোনো কসুর করা হয়নি!

যারা এই দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং আইনের শাসন বিকশিত হওয়ার জন্য দশকের পর দশক ধরে সংগ্রাম করেছেন, তাদের জন্য ওই সন্ধ্যার কার্যক্রমটি ছিল বিশেষভাবে হৃদয়বিদারক। তাদের যুক্তি যে কেবল সংসদীয় শিষ্টাচারের বরখেলাপ এবং রাষ্ট্রের তিন অঙ্গের বিশেষ করে বিচার বিভাগ ও আইন পরিষদের মধ্যে ক্ষমতার ভাগাভাগির মূলনীতিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করেনি, সেইসাথে তারা ছিলেন ভ্রান্ত ও স্বার্থন্বেষকও।

এমপিরা দাবি করেছেন, সুপ্রিম কোর্টের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করার কাজটি ছিল ‘অবৈধ’ ও ‘অসাংবিধানিক’ এবং ১৯৭২ সালের মূল সংবিধান ‘পুনঃপ্রতিষ্ঠার’ পরিকল্পনা বানচাল করা। ২০১০ সাল থেকে সুপ্রিম কোর্ট আরো তিনটি সাংবিধানিক সংশোধনী- পঞ্চম, সপ্তম ও ত্রয়োদশ- বাতিল করেছে। বিশ্লেষকেরা উল্লেখ করেছেন, আওয়ামী লীগ পঞ্চম সংশোধনী বিষয়ক রায়কে ‘মাইলফলক’ হিসেবে উল্লেখ করেছিল এবং সপ্তম সংশোধনী বিষয়ক রায়কে স্বাগত জানিয়েছিল। ফলে অত্যন্ত যৌক্তিকভাবেই প্রশ্ন করা যায়, আওয়ামী লীগ এমপিরা যদি ওইসব রায়কে অবৈধ ও অসাংবিধানিক বিবেচনা না করেন, তবে তারা ষোড়শ সংশোধনীর ব্যাপারে এমনটা কেন করছেন?

তাদের ১৯৭২ সালের মূল সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিটিও শূন্যগর্ভ মনে হয়। ক্ষমতাসীন দলের এমপিরা যদি ১৯৭২-এর সংবিধানের মূল্যবোধ ও কার্যকারিতার বিষয়টি এত প্রবলভাবেই অনুভব করে থাকেন, তবে তারা সেটাকেই কেন অবিকলভাবে ফিরিয়ে আনার জন্য সংসদে বিল কেন আনছেন না? দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় এ ধরনের উদ্যোগ যে সফল হবে, তা নিশ্চয়তা দিয়ে বলা যায়।

ষোড়শ সংশোধনী সংবিধানের মূল কাঠামো পরিবর্তন করেনি এবং এর ফলে সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃত্ব-বহির্ভূত কাজ করেছে বলে এমপিদের জোরালো দাবি হালে পানি পায় না। স্বাধীন বিচার বিভাগ সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান থাকলেই অনুধাবন করা যায়, বিচার বিভাগ থেকে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা প্রত্যাহার করে পার্লামেন্টের কাছে সমর্পণ করার মানে হলো বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে খর্ব করা এবং সেইসূত্রে সংবিধানের মূল কাঠামোকে দুর্বল করা।

     সংসদে ৯ জুলাইয়ের বক্তৃতাবাজির তোড়ে আরেকটি বিষয় পুরোপুরি ধামাচাপা পড়ে গেছে যে, ১৯৭২ সালের সংবিধান থেকে পার্লামেন্টের বিচারপতিদের অপসারণের বহুল আলোচিত ব্যবস্থাটি উচ্ছেদ ও বাতিল করাটা প্রথম আওয়ামী লীগ সরকারেরই কর্ম। তারাই ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সেটা করেছিলেন।

সংসদে ৯ জুলাইয়ের বক্তব্যের সারমর্ম প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে, এমপিরা তাদের এখতিয়ারের মধ্যে আছেন কিনা। জবাব দ্ব্যর্থহীনভাবে না। বাংলাদেশ সংবিধানের ধারা ৯৪(৪)-এ সুস্পষ্টভাবে বলে দেওয়া হয়েছে, প্রধান বিচারপতি এবং সুপ্রিম কোর্টের অন্যান্য বিচারপতি তাদের বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনার ব্যাপারে স্বাধীন থাকবেন। এই প্রেক্ষাপটে প্রখ্যাত আইনজ্ঞ মাহমুদুল ইসলাম বলেছেন, ‘নির্বাহী সরকার বা সংসদ সদস্যরা সুপ্রিম কোর্টের কোনো বিচারকের কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা করতে পারবে না। কার্যপ্রণালীতে বলা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের কোনো বিচারপতি কার্যক্রম নিয়ে থাকা কোনো প্রশ্ন, প্রস্তাব উত্থাপনযোগ্য নয়’ (ধারা ৫৩, ৫৪ ও ১৩৩)। তিনি আরো স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘সংসদ সদস্যরা সংসদে যে কথাই বলুন না কেন, ধারা ৭৮-এর আলোকে থাকা দায়মুক্তির সুবিধাটি নিয়ে তারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের স্বাধীনতা খর্ব করতে পারে- এমন কোনো বিবৃতি বা মন্তব্য করতে পারবেন না’ (কনস্টিটিউশনাল ল অব বাংলাদেশ, তৃতীয় সংস্করণ, ঢাকা : মল্লিক ব্রাদার্স, ২০১২)।

এটাও উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে যে, কার্যপ্রণালীতে ব্যক্তিগত ধরনের কোনো অভিযোগ করা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে এমপিদের। ফলে এটা খুবই সম্ভব যে, অ্যামিকাস কিউরি প্রশ্নে অরুচিকর মন্তব্য করে এমপিরা তাদের প্রণীত কার্যপ্রণালী বিধি লঙ্ঘন করেছেন।

সম্মানিত এমপিরা জোর দিয়ে বলেছেন, কেবল পাকিস্তানেই বিচারপতিদের অপসারণে ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’ রয়েছে। তারা বলেন, বেশির ভাগ দেশেই এই ক্ষমতা পার্লামেন্টের হাতে দেওয়া আছে। এ ধরনের দাবির পক্ষে প্রমাণের ওপর আলোকপাত করা যাক। ২০১৫ সালে কমনওয়েলথের পক্ষ থেকে প্রকাশিত ‘কমপেনডিয়াম অব অ্যানালাইসিস অব বেস্ট প্রাকটিস অন দি অ্যাপয়েন্টমেন্ট, টেনিউর অব রিমোভাল অব জাজেজ আন্ডার কমনওয়েলথ প্রিন্সিপালস’-এ বলা হয়েছে, কমনওয়েলথভুক্ত ৪৮টি দেশের মধ্যে মাত্র ১৬টিতে সংসদীয় অপসারণ ব্যবস্থা (৩৪.৩%), ৩০টির মতো দেশে নির্বাহী ও আইনপরিষদ থেকে আলাদা একটি সংস্থা (৬২.৫%) রয়েছে। বাকি দুটি দেশে রয়েছে মিশ্রব্যবস্থা (৩.২%)।

     কমনওয়েলথ সমীক্ষায় দেখা গেছে, বেশির ভাগ সংসদীয় অপসারণব্যবস্থায় কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে অভিযোগের ক্ষেত্রে প্রাথমিক তদন্ত, তথ্যানুসন্ধান এবং মূল্যায়নে স্বাধীন, বহিরাগত সংস্থার  সম্পৃক্ত করার পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়ে থাকে। সম্মানিত এমপিরা আমলে নিতে পারতেন, যে ১৬টি দেশ সংসদীয় অপসারণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, তাদের ১২টিই তথ্য তদন্তের দায়িত্বটি আইনপ্রণেতাদের ওপর রাখেনি। তারা এর বদলে আইন পরিষদ ও নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা একটি সংস্থার ওপর এ  দায়িত্বটি দিয়েছে। কেবল শ্রীলঙ্কা, নাউরু ও সামোয়োর অনুসরণ করে বিচারক অপসারণে একচ্ছত্র পার্লামেন্টারি নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে বাংলাদেশ।

সমীক্ষায় সতর্কতা উচ্চারণ করে বলা হয়েছে, সংসদীয় অপসারণ পদ্ধতি ‘প্রয়োগ করা হলে মারাত্মক সাংবিধানিক সঙ্ঘাতের সৃষ্টি করতে পারে।’ এতে উল্লেখ করা হয়েছে, দুই কক্ষবিশিষ্ট পদ্ধতিই অনেকটা নিরাপদ। কিন্তু বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো ব্যবস্থা বর্তমানে সম্ভব নয়।

এক সিনিয়র মন্ত্রী উল্লেখ করেছেন, একজন অ্যামিকাস কিউরি ভারতে বিচারক অপসারণের ব্যবস্থা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টকে বিভ্রান্তকর তথ্য দিয়েছেন। তিনি এমন ধারণা সৃষ্টির প্রয়াস চালিয়েছেন যে, মনে হতে পারে, দেশটিতে এখনো সংসদের অপসারণের পুরনো পদ্ধতি চালু আছে। বাস্তবে ভারত, যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ অনেক দেশ বিচারপতি অপসারণে পার্লামেন্টকে দেওয়া ক্ষমতা হ্রাস করে সরকারি প্রভাবমুক্ত একটি ব্যবস্থার ওপর ন্যস্ত করেছে। সংবিধানের ৭০ ধারায় আবদ্ধ আমাদের এমপিদের নতুন বাস্তবতার প্রতি যথাযথ নজর দেওয়ার পরামর্শ দেয়া যেতে পারে।

ষোড়শ সংশোধনী বাতিলে আইন প্রণয়ন বিভাগের অস্বস্তিকর প্রতিক্রিয়া এবং বিচারপতি অপসারণ প্রশ্নে সংসদীয় নিয়ন্ত্রণের প্রায় সার্বজনীনভাবে বহাল থাকার ভ্রান্ত দাবি এই দেশের গণতন্ত্রের জন্য কলাণকর নয়। আশা করা যেতে পারে, যুক্তিই জয়ী হবে এবং রাষ্ট্রের সব অঙ্গ ক্ষমতা বিভাজনের মৌলিক ধারণা এবং আইনের শাসনের প্রতি যথাযথভাবে শ্রদ্ধাশীল থাকবে।

  • সি আর আবরার - শিক্ষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

উৎসঃ amaderbudhbar.com

ন্যায়হীনতার বেশে মন্ত্রীর আঙ্গুলে দম্ভের দেশ



মুনজের আহমদ চৌধুরী

মুনজের আহমদ চৌধুরী
আমাদের শ্লীলতাহীন রাজনীতির অশ্রাব্যতা নিয়ে লিখতে ভাল লাগে না। বাংলাদেশটা দাঁড়িয়ে আছে একটা ভাষার উপর। ভাষার আন্দোলন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের আঁতুড়ঘরঅথচ, ভাষার দেশেই অশ্রাব্য আর মিথ্যে ভাষ্যে দাঁড়িয়ে থাকে সব মিথ্যচারী শাসক! রাজনীতি কেবল সেখানে কথা বলতে জানে ক্রোধ আর ক্ষমতার দম্ভের অক্ষরে। দেশ ও জনগণের প্রতি অভিভাবকত্বের মমত্বের শব্দে কথা বলা এখনো শিখতে পারেনি আমাদের চলতি  স্রোতের  রাজনীতি।

বাক্যে বাক্যে উদ্ধত ভঙ্গিমা আর মিথ্যাচারের খেলা এ দেশের বহু রাজনৈতিক চরিত্রগুলোর যেন লজ্জাস্থান নিবারক বস্ত্র।

বুধবার ভোররাতে আচমকাই খুব আদরের ছোটভাই, প্রিয় সংবাদ পাঠক সাইদুল ইসলামের ফোন। তার অনুরোধ-ভাই, বিচার বিভাগের প্রতি শাসক দলের, সরকারের মন্ত্রীর অন্যায্যতা, অশ্লীলতা নিয়ে লিখুন। আমি তাকে বলছিলাম, ভাই এ বিষয়টি নিয়ে লিখতে হবে গ্রাম্য বিচারকটির পৌরাণিক সে গল্পও।  সাইদুল বলল, তাহলে ভাই এ বিষয়টা না হয় উহ্য করে লিখুন।  

উহ্য করে লিখতে গেলে দেখি, মন্ত্রীবাহাদুর সার্বভৌম একটি রাষ্ট্রের বিচারবিভাগের প্রতি কী ঔদ্ধত্য'র আঙ্গুল তুলেন।
কী করে যে একজন জৈষ্ঠ্য রাজনীতিক, সিনিয়র মন্ত্রী বলতে পারেন,”আদালতের হাত সংসদ ছোঁয়ার মত লম্বা হয়নি” আমার ভাবতে লজ্জা হয়।

অর্থমন্ত্রী ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে প্রধান বিচারপতিকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আমরা চাকরি দিই, আমাদের ওপর পোদ্দারি। যতবার কোর্ট বাতিল করবে, আমরা ততবার পাস করব। ’ বলিহারী যাই ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে নির্বাচিত সরকারের এমন সংসদীয় সার্বভৌম গণতন্ত্র আর বিচার বিভাগের প্রতি এমন শ্রদ্ধা দেখে!

আচ্ছা, সংসদ-সরকার কী আইনের ঊর্ধ্বে?
আমার ভাবনাগুলো এই ভেবে লজ্জায় নত হয়, দেশটার বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা কোন মুখে সরকারগুলি বলে। একজন সৎ দরিদ্র আইনজীবী পিতার সন্তান  হয়ে রাজনীতিকে নিজে দেখেছি স্লোগান, ব্যারিকেড, রোধ অবরোধের নিত্যদিনের বোধে। বিরক্ত জনগণের বিরক্তি আর বেদনার ভাষ্য হয়তো অবমাননা অবধি পৌছুঁতে পারে। তবুও বলি, এখনো দুর্নীতি, প্রবঞ্চনা আর জনগণের সাথে নিপুন প্রতারণার নামধারী অসৎ রাজনীতির দেশে বিচার বিভাগ হাজার গুন শত গুন নৈতিক। রাজনীতির নীতিহীন মুখগুলো কতটা প্রবলতায় যে অনৈতিক, তার দুটি বেদনার কথা লিখেই পাঠকের ধৈর্য্যচ্যুতির অবসান ঘটাচ্ছি।

বছর কয় আগে যখন তত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের রায় দিলেন আদালত তখনওতো এ সরকার ক্ষমতায় ছিল। একই নেত্রী ছিলেন প্রধানমন্ত্রী, দলও। কই তখন তো আদালতের আদেশে আয়েশি রাজনৈখায়েস পূরণের হাসি হেসেছিলেন মন্ত্রী বাহাদুরেররা। আজ কেন তবে ঔদ্ধত্যমাখা এ অদ্ভুত বৈপরীত্য। সুবিধার নামে চরিত্র বদল দেশে দেশে জাপুঁজির রাজনীচক্রের দৌরাত্ম। কিন্তু এতটা নগ্নতায় পল্টি খাওয়া নীতির বিকৃতি নাপাক পাকিস্তানের মতো দেশেও বুঝিবা বিরলপ্রায়। বিচার মানি কিন্তু বিচারক তালগাছ সব আমার - এমন বৈপরিত্বের অদ্ভুত রাজনীতিহীন বৃত্তি বড় আহত করে আমায়। অক্ষর সেখানে খুঁজে হয়রান হয় শ্রাব্যতম ক্ষোভের প্রতিবাদের ভাষা।

অনেকে এ ইস্যুটিকেও সরকারের অন্য অনেক ইস্যু ইস্যু খেলার সাথে মেলাতে চান। আমি স্তম্ভিত হই, কথারা এমত বাস্তবতার ব্যত্যয়ে হয় বাক্যহারা।

আমরা বড়ো মানুষগুলোকে, প্রতিষ্ঠানগুলোকে ছোট করে নিজেদের ছোটলোকের চোখে দেখতে ভালবাসি স্বভাবের ক্ষুদ্রতায়।

বিচার বিভাগও যদি সর্বগ্রাসী রাজনীতির দেশে স্বাধীন কন্ঠে কথা না বলতে পারে, তাহলে কোথায় থাকল দেশের মর্যাদাময়তা?

ভোট দিতে দেয়া হল বা না হল বাংলাদেশে বহু জনগণ এখন তার আর তোয়াক্কা করেন না। না করবার বাস্তবতা যে বিদ্যমান নয় তা বলা হবে মিথ্যাচার।

আসলে দম্ভের বা অহংকারের দ্বারা চালিত মানুষগুলোর মতোন সরকারগুলোও কখনো তার প্রকৃত অবস্থান দেখতে পায় না। না, রাজনীতির প্রতি বিন্দুমাত্র ক্ষোভ নেই আমার, নেই বেদনাও। আহত করে কেবল রাজনীতিহীন দম্ভ আর আস্ফালনের অন্ধকারাচ্ছনতার জন্য। কী বিশাল শুন্যতায় সেখানে যে অনুপস্থিত ন্যায্যতা। বরঞ্চ হৃদয়ের সবটুকু দিয়ে বিশ্বাস করি, রাজনীতি-সুবিধা আর স্বার্থান্ধ গদি যেদিন পাল্টাবে সেদিন পাল্টাবে দিন। কেবল রাজনীতিরই সেই ক্ষমতা আছে দুর্নীতি আর অন্যয্যতার দিনবদলের।
 
সুশাসন আর ন্যায় রাজনীতিহীন নগ্ন দুপুরে যে আসবে না সেকথা জানি। সে সুর্যোদয় কেবল মাত্র আনতে পারে রাজনীতির ইতিবাচকতাই ।


  • মুনজের আহমদ চৌধুরী - লন্ডনবাসী সাংবাদিক, সদস্য রাইটার্স গীল্ড অব গ্রেট ব্রিটেন।


Tuesday, August 1, 2017

খেলাপি ঋণ বেশি হারে বাড়ছে কেন?

রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর  


ব্যাংক ব্যবস্থা নিয়ে ইদানীং সংবাদ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। সঙ্গত কারণেই এ বিষয়ে আলোচনা হওয়া দরকার এবং সবারই এতে অংশ নেয়া প্রয়োজন। আলোচনাটি খুবই জরুরি। এ আলোচনা বাংলাদেশের অর্থনীতির সঙ্গে যেমন যুক্ত, একই সঙ্গে জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও জবাবদিহিতার সঙ্গেও সম্পৃক্ত। অন্যভাবে বলা যায়, বাংলাদেশের অর্থনীতিকে টেকসই ও মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে হলে প্রতিষ্ঠানগুলোকেও টেকসই ও শক্তিশালী করা দরকার। সেজন্য ব্যাংক ব্যবস্থা নিয়ে হওয়া আলোচনাটি অত্যাবশ্যক।
এ আলোচনা যেভাবে এগোচ্ছে, তা আসলে কতটুকু ব্যাংক ব্যবস্থার সত্যিকার পরিবর্তনের জন্য এবং কতটুকু নিছকই  আলোচনার খাতিরে হচ্ছে, সে বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন রয়েছে। অধিকাংশ ব্যক্তি বলছেন যে, রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যবস্থার বর্তমান পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। তবে তা বিরাজমান সংকটময় পরিস্থিতির কারণ নিরূপণে নির্দিষ্ট নয়। রাজনৈতিক নির্দেশিত ঋণ প্রদানের বিষয়টি এ দেশে পুরনো ব্যাপার। খেলাপি ঋণের বিষয়টিও বাংলাদেশে নতুন নয়। অতীতের অভিজ্ঞতা বলে, উন্নয়ন-বিশেষায়িত ব্যাংক ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় সবসময় খেলাপি বা মন্দ ঋণ ছিল। খেলাপি ও মন্দ ঋণের সঙ্গে রাজনৈতিক আনুকূল্য ও পৃষ্ঠপোষকতা সবসময়ই বিরাজমান; তবে প্রশ্ন হলো— এখন কি শুধু রাজনৈতিক নির্দেশিত ঋণ অনুমোদনের কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে, না এর সঙ্গে এমন এক পরিস্থিতি যোগ হয়েছে, যার কারণে আগের চেয়ে এখন খেলাপি ঋণ বেশি হারে বাড়ছে? মূলত এ মৌলিক প্রশ্নের উত্তর খোঁজা আবশ্যক। এবং এ প্রশ্নের উত্তর মিললে সংকট নিরসনের পন্থাও বাতলানো সহজতর হতে পারে।
২. ব্যাংক ব্যবস্থায় কেন খেলাপি ঋণ হয়, এ বিষয়ে কতগুলো ব্যাখ্যা হাজির করা হয়। এর মধ্যে একটি ব্যাখ্যা যারা কেতাবি অর্থনীতিবিদ, তারা হাজির করেন। বিশেষ করে সাম্প্রতিককালে তথ্যভিত্তিক অর্থশাস্ত্রে (ইনফরমেশন ইকোনমিকস) আলোচিত হওয়া নৈতিক বিপত্তি ও প্রতিকূল নির্বাচন— এ দুটি ধারণার নিরিখে আলোচ্য ব্যাখ্যাটি হাজির করা হয়। এ ব্যাখ্যার মূল বক্তব্য হলো, ব্যাংক ঠিকভাবে গ্রাহক নির্বাচন করতে পারছে না। সেজন্য গ্রাহক যথাযথভাবে কার্যক্ষমতা দেখাতে পারছেন না। ব্যাংকের কৌশলে ভুল আছে। কাজেই ঋণ খেলাপিতে পরিণত হচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে বিষয়টি যৌক্তিক মনে হয়। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিষয়টি কতটুকু যৌক্তিক, তা ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন।
দ্বিতীয় একটি ব্যাখ্যা দেয়া হয়। মূলত পোষ্য ও মুখস্থ বিদ্যায় পারদর্শী দুই দল লোক এ ধরনের বিশ্লেষণ হাজির করেন। তারা বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে ব্যক্তিমালিকানায় আনা গেলে খেলাপি ঋণের সমস্যা থেকে উত্তরণ ঘটবে। কারণ রাজনৈতিক বিবেচনায় বেশিসংখ্যক লোক পরিচালনা পর্ষদ বা ব্যবস্থাপনায় থাকতে পারবে না। কাজেই আলোচ্য সমস্যা থেকে মুক্তি মিলবে। এ দুটি ব্যাখ্যার কতক অংশ ঠিক বটে, কিন্তু কোনোভাবেই বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণে সহায়ক নয়। তাহলে এমন কী হলো, যার জন্য দেশের বর্তমান পরিস্থিতি অন্য সময় ও অবস্থানের চেয়ে ভিন্ন মাত্রার?
বিষয়টি বুঝতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মৌল সূচক পর্যালোচনা করা যাক। মোটাদাগে সত্তরের দশকের শেষের দিক থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ব্যক্তিখাতের বিস্তৃতি বেড়েছে। সেক্ষেত্রে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগ নির্ণায়কমূলক সূচক। দেখা যাবে যে, ১৯৯১ সালের পর থেকে জিডিপি যেমন বাড়ছিল, তেমনি একই হারে জিডিপিতে ব্যক্তিখাতের অংশও বাড়ছিল। জিডিপির অনুপাতে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ  ২০১১-১২ সালে ২২ দশমিক ৫০ শতাংশ, ২০১২-১৩ সালে ২১ দশমিক ৭৫, ২০১৩-১৪ সালে ২২ দশমিক শূন্য ৩ এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরে জিডিপির ২২ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ হয়েছে। অর্থাত্ ২০১২-১৩ সাল থেকে জিডিপিতে ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগের অংশ হ্রাস পেয়েছে বা স্থবির হয়ে পড়েছে।
অন্যদিকে খেলাপি ঋণ-সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০১১ সাল শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা। তা বিতরণকৃত ঋণের ৬ দশমিক ১২ শতাংশ। এর পর থেকেই বেশি হারে বাড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মার্চ শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে মোট ঋণের পরিমাণ প্রায় ৭ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭৩ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা। অর্থাত্ মোট ঋণের প্রায় ১১ শতাংশই খেলাপি। এর সঙ্গে অবলোপনকৃত খেলাপি ঋণের প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা যোগ করলে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা। এ বিপুল পরিমাণ অর্থ জিডিপির ১২ শতাংশ। বাংলাদেশের জিডিপি স্থির মূল্যে ৯ লাখ ৪৭ হাজার ৫৪২ কোটি টাকা। এ হিসাবে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ জিডিপির ১২ দশমিক ৪৫ শতাংশ। মোট ঋণের তুলনায় খেলাপি ঋণের পরিমাণের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম সারিতে। পার্শ্ববর্তী ভারতের জিডিপির পরিমাণ ২ দশমিক শূন্য ৭৪ ট্রিলিয়ন ডলার (প্রায় ২ লাখ ৭ হাজার ৪০০ কোটি ডলার)। আর তাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৫৪ বিলিয়ন ডলার (১৫ হাজার ৪০০ কোটি ডলার)। অর্থাত্ ভারতের জিডিপির ৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ খেলাপি ঋণ। খেলাপি ঋণ বাড়তে থাকায় সরকারি ব্যাংকগুলো মূলধন ঘাটতিতে পড়ছে। তাই পুনরায় মূলধনের নামে এ ব্যাংকগুলোকে ১১ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা জোগান দিতে হয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে কর থেকে ২ হাজার কোটি টাকা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে দিতে হয়েছে।
অল্প অর্থ জমা দিয়েই ঋণ পুনঃতফসিল করা যাচ্ছে। ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ দেয়া হয়েছে। এর পরও দিন দিন ঋণখেলাপির পরিমাণ বাড়ছে। আগে সাধারণত খেলাপি হলে ঋণ পুনঃতফসিল করার সুযোগ ছিল। কিন্তু বর্তমানে ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ দেয়া হয়েছে। ২০১৫ সালে বড় ঋণখেলাপিদের বিশেষ সুবিধা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বড় অংকের ঋণ পুনর্গঠনের নীতিমালা অনুমোদন দিয়েছে। এ সুবিধার আওতায় ৫০০ কোটি টাকা বা তার বেশি অংকের ঋণ পুনর্গঠন করা গেছে। নীতিমালা অনুসারে মেয়াদি ঋণ পুনর্গঠন সর্বোচ্চ ১২ বছরের জন্য। আর তলবি ও চলমান ঋণ পুনর্গঠন হবে ছয় বছরের জন্য। ঋণের পরিমাণ ১ হাজার কোটি টাকার কম হলে ডাউন পেমেন্ট বা এককালীন জমা দিতে হবে ২ শতাংশ হারে। আর ১ হাজার কোটি টাকা ও তার বেশি পরিমাণ ঋণের জন্য এককালীন জমা দিতে হবে ১ শতাংশ হারে। পরিসংখ্যান বলছে, পুনর্গঠন সুবিধা নিয়ে ব্যবসায়ীদের বড় অংশই কিস্তি পরিশোধ করছেন না। এরই মধ্যে পুনর্গঠন সুবিধা পাওয়া অর্ধেকই নতুন করে খেলাপি হয়েছেন। এ সুযোগের কারণে দেখা যাচ্ছে, ব্যাংক থেকে দেয়া ঋণের বিপুলাংশ খেলাপিতে পরিণত হচ্ছে।
লক্ষ করা যাচ্ছে, ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে জিডিপিতে ব্যক্তিখাতের অংশ হ্রাস পাওয়া শুরু করল এবং তা স্থবিরতায় দাঁড়িয়েছে; খেলাপি ঋণ দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। তাই কী কারণে ঘটল? এর দুর্বোধ্য কোনো ব্যাখ্যা নেই। এর একটি ব্যাখ্যাই যে, বিনিয়োগকারীরা আস্থাহীনতায় ভুগছেন। এর সঙ্গে পুঁজি পাচারের বিষয়টি মেলালে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করা সহজতর হয়। পরিষ্কারভাবে লক্ষ করা যাচ্ছে, বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির মূল কারণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সংকোচন (বিনিয়োগ স্থবির হওয়া) এবং রাজনৈতিক কারণে আস্থাহীনতা।
সাম্প্রতিক সময়ের হিসাব, বিশেষ করে গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) বলছে, বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ পুঁজি বা অর্থ পাচার হচ্ছে এবং ক্রমাগত এর পরিমাণ বাড়ছে। তার অভ্যন্তরীণ খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে না কিন্তু অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে। আবার লক্ষ করা যাচ্ছে, বিভিন্ন প্রকল্পে বিশেষ করে মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম প্রকল্পে (এমএমটুএইচ) বাংলাদেশীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, এরই মধ্যে ৩ হাজার ৫৪৬ বাংলাদেশী মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম গড়েছেন। শুধু মালয়েশিয়ায় নয়, সিঙ্গাপুর, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ  অন্য দেশে বাংলাদেশীদের অর্থ পাচারের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। সুইস ব্যাংকের সাম্প্রতিক হিসাব একই কথা বলছে। তার মানে যখন আস্থাহীনতা থাকে তখন ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে পুঁজির পাচার ঘটে এবং খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ে; অন্যদিকে নতুন বিনিয়োগকারী তৈরি হয় না এবং ব্যাংক থেকে অনেকে ঋণও নিতে চান না। অর্থাত্ দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির সঙ্গে ঋণযোগ্য টাকা (তারল্য বা অলস টাকা) বেড়ে যাওয়ার সংকটও দৃশ্যমান হয়। কাজেই এটা পরিষ্কার যে, এখানে আস্থাহীনতাই মূল কারণ। আস্থাহীনতার কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অনিশ্চয়তা থাকায় ব্যাংক ব্যবস্থার এ সংকট সৃষ্টি হয়েছে। তখন লুটপাটও বেড়ে যায়। বেড়ে যায় প্রকল্প খরচও। এসবই দৃশ্যমান।
আরেকটি প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ব্যক্তিমালিকানায় আনা হলে এ সমস্যার উত্তরণ ঘটত কিনা। নিশ্চয়ই ঘটত না। কারণ আর্থিক খাতের সংস্কারে বলা হয়েছিল, ব্যক্তিখাতে ব্যাংক বাড়লে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পাবে এবং প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সুদের হার কমে যাবে। কিন্তু সুদের হার প্রতিযোগিতার জন্য কমছে না; বরং এটি না কমার অন্যতম কারণ— খেলাপি ঋণের পরিমাণ। অর্থাত্ খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেশি থাকলে সঞ্চিতি বা প্রভিশনিং বেশি রাখতে হয়। ব্যাংকের ব্যয় আরো বেড়ে যায়। এ কারণেও সুদের হার কাঙ্ক্ষিত হারে কমছে না। কাজেই প্রতিযোগিতা নয়, প্রাতিষ্ঠানিক সংকটাপন্নতাই সুদের হার বেশি হওয়ার মূল কারণ। ব্যক্তিখাতের ব্যাংকগুলোয়ও রাজনৈতিক কায়দায় পরিচালনা পর্ষদ গঠন করা হচ্ছে। ব্যাংক স্থাপনে যেমন রাজনৈতিক লোকদের অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে, অন্যদিকে সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের নিয়মনীতির ক্ষেত্রেও বড় ধরনের অসুস্থ সংস্কারের প্রস্তাব করা হয়েছে। বিশেষ করে পরিচালনা পরিষদের সদস্যদের মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
আস্থাহীনতার সঙ্গে আরেকটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাপারও একেবারেই আলোচনা হচ্ছে না। নিঃসন্দেহে ব্যাংক একটি কোম্পানি। কিন্তু তা যেকোনো সাধারণ কোম্পানির মতো নয়। সাধারণ কোম্পানিতে পুঁজির জোগান উদ্যোক্তারা ও শেয়ারহোল্ডাররা দিয়ে থাকেন। শুধু কার্যকরী পুঁজি (ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল) ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নেয়া হয়। কিন্তু ব্যাংকের ক্ষেত্রে এটা ব্যতিক্রম। এখানে উদ্যোক্তা বা শেয়ারহোল্ডাররা যে পরিমাণ ঋণ দেয় বা বিনিয়োগ করে, তাতে তাদের অংশ খুবই কম। আমানতকারীরা অধিকাংশ অর্থের জোগান দেন। তার মানে ব্যাংকের মালিকানা যার হাতেই থাকুক না কেন, এটি আসলে আমানতকারীর প্রতিষ্ঠান। মূলত সেজন্য রেগুলেশনের ধরন ভিন্নতার দাবি রাখে। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে লক্ষণীয় যে, রেগুলেশনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ব্যর্থতা বিদ্যমান। নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের ব্যাংকগুলোকে আমানতকারীর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে পারেনি। যদিও গণমাধ্যম ব্যাংক ব্যবস্থার বিভিন্ন দোষ-ত্রুটি উপস্থাপন করছে, এক্ষেত্রে গণমাধ্যমও বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে পারেনি। এখনো জনমনে এ ধারণা প্রতিষ্ঠিত করা যায়নি যে, ব্যাংক আর ১০টি প্রতিষ্ঠানের মতো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নয়; এটি আমানতকারীর প্রতিষ্ঠান। কাজেই আমানতের খেয়ানত করার অধিকার কারো নেই। এবং সেজন্য যে ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক শাসন দরকার, তা দৃশ্যমান নয়। সংশ্লিষ্টদের অনেকেই এখনো ব্যক্তিখাতে ব্যাংকগুলো ছেড়ে দিলে খেলাপি ঋণ ও সুদের হার কমে যাবে— এ ধরনের ভ্রান্ত তত্ত্বের মধ্যে জীবনযাপন করছেন।
৩. আলোচনাটা হওয়া দরকার দুটি ক্ষেত্রে। এক. কীভাবে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বেশি জোগানো যায়, যার মাধ্যমে বিনিয়োগ হতে পারে এবং বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চাঙ্গা হতে পারে। অর্থাত্ বিনিয়োগকারীদের ব্যাংক ব্যবস্থায় সুযোগ, সুবিধা ও সেবা কীভাবে বাড়ানো যায় এবং সুদের হার কীভাবে কমানো যায়। দুই. ব্যাংকের প্রডাক্টে বৈচিত্র্য কীভাবে আনা যায়। এ খাতের প্রডাক্টের ক্ষেত্রে কোনো সৃজনশীলতা দেখা যায় না, বরং উল্টো কীভাবে গ্রাহককে আরো বেশি মাত্রায় শোষণ করা যায়, তার বিস্তর অভিযোগ লক্ষণীয়। অর্থাত্ উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ব্যাংক হলো একটি ইঞ্জিনের মতো এবং সৃজনশীলতার মাধ্যমে কীভাবে উৎপাদনকে সহায়তা করা যাবে, তা-ই ব্যাংক ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। কিন্তু তা হয়নি। আরেকটি ব্যর্থতা হলো, ব্যাংককে আমানতকারীর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের নিরুত্সাহ। মোটাদাগে বলতে গেলে, ব্যাংক ব্যবস্থায় আজকের যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তা আস্থার অভাব থেকে। এটি একটি রাজনৈতিক প্রশ্ন।
সন্দেহ নেই, রাজনৈতিকভাবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে। কীভাবে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে, সে রাজনৈতিক প্রশ্ন রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করা দরকার। জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ও প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার কোনো বিকল্প নেই। এ ধরনের ব্যবস্থাই আস্থার সংকট ও অনিশ্চতয়তা দূরীভূত করতে পারে। এটা প্রথম পর্যায়ের কাজ। দ্বিতীয় পর্যায়ে রেগুলেশনের ক্ষেত্রে সৃজনশীল চিন্তার প্রয়োজন, তা পোষ্য ও মুখস্থ বিদ্যায় হবে না। তৃতীয় পর্যায়ের কাজ, যা নিয়ে একেবারেই আলোচনা হয় না তা হলো, ব্যাংকের কিন্তু সব গ্রাহক বড় নন, ক্ষুদ্র গ্রাহকই বেশি। এবং ব্যাংক বিভিন্ন সেবা প্রদানের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, জনমানুষ ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সে ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে না। ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে।

লেখক: অধ্যাপক, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। চেয়ারপারসন, উন্নয়ন অন্বেষণ । 


Tuesday, July 25, 2017

নির্বাচন-পূর্ব অর্থ পাচার : সহজেই ৩টি পদ্মা সেতু তৈরি সম্ভব

আমাদের বুধবার প্রতিবেদন


যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) গত মে মাসে ‘ইল্লিসিট ফিন্যান্সিয়াল ফ্লোজ ফ্রম ডেভেলপিং কান্ট্রিজ : ২০০৫-১৪’ শীর্ষক প্রতিবেদনে অর্থ পাচারের  যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর বিপুল অর্থ পাচার হচ্ছে। এবারের প্রতিবেদনে রয়েছে ২০০৫-২০১৪ সাল সময় পর্যন্ত তথ্য। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ায় অর্থ পাচারে ভারতের পরের অবস্থানেই রয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৯১১ কোটি ডলার (প্রায় ৭২,৮৭২ কোটি টাকা) পাচার হয়েছে ২০১৪ সালে- যা ২০১৬-১৭ অর্থবছরের পরিবহন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ, কৃষি ও পানিসম্পদ খাতের মোট উন্নয়ন বাজেটের সমান। এছাড়া, ২০০৫-২০১৪ সময়কালে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ৭৫৮৫ কোটি ডলার বা ৬ লাখ ৬ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা। তবে সবচেয়ে বেশি পাচার হয়েছে ২০১৩ সালে (৯৬৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার)- যা ছিল সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের বছর পর্যন্ত। অর্থ পাচারে দেশগুলোর তালিকায় ২০১৬ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৯টি দেশের মধ্যে ছিল ২৬তম। আমদানি-রফতানির সময়ে পণ্যের প্রকৃত মূল্য গোপনসহ নানা পদ্ধতির মাধ্যমেই এই অর্থের বড় অংশ পাচার করা হয়েছে। অথচ কেবল অর্থ পাচার ঠেকাতে পারলেই মূসক খাতের আয় নিয়ে আদৌ কোনো দুশ্চিন্তা করতে হতো না এনবিআরকে। পাচার হওয়া এ অর্থ দিয়েই বাংলাদেশে ৩টি পদ্মা সেতু তৈরি করা সম্ভব হতো। সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড ২০১৬-তে দেখা যায়; ২০১৫ সালে সেদেশে বাংলাদেশীদের ব্যাংক হিসাবে অর্থ জমা বেড়েছে ১৯ শতাংশ। বর্তমানে যেখানে মোট অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। আর আগেই বলা হয়েছে যে, মে মাসের শুরুতে ওয়াশিংটন ভিত্তিক এক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে বলা হয় ১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৭৩ হাজার কোটি টাকা।

আমাদের দেশটি বর্তমানে উন্নয়নের মহাসড়কে হাঁটছে;নানা স্বপ্নও দেখানো হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের মতে, অচিরেই দেশটি মধ্যম আয়ের দেশের বলয়ে ঢুকে যাবে। ফলে অর্থপাচারের বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের আমলে না নেওয়ার কোনো কারণ দেখি না। এর আগেও অনেকবার বিষয়টি সামনে এসেছে, কিন্তু সরকার তথা সংশ্লিষ্টরা অর্থপাচার রোধে খুব যে একটা তৎপরতা দেখিয়েছে, তেমনটি মনে করা যায় না। এর প্রমাণ তো প্রতিবেদনের বছরভিত্তিক পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট। বাংলাদেশের জন্য অর্থপাচারের ঘটনাটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক হলেও, সংশ্লিষ্টদের রয়েছে অনিবার্য নির্লিপ্ততা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন ওঠা অমূলক নয় যে, দেশ থেকে অর্থপাচারের মতো ভয়াবহ ঘটনা আদৌ রোধ করা যাবে কি না?

প্রশ্ন উঠতে পারে, কীভাবে অর্থ পাচার হচ্ছে। পণ্য আমদানির সময় ওভার ইনভয়েসিং অর্থাৎ আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য বেশি দেখিয়ে এবং রফতানির সময় আন্ডার ইনভয়েসিং অর্থাৎ পণ্যের মূল্য কম দেখিয়ে আমদানি রফতানি করছেন। এ প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে। ফলে প্রশ্ন উঠতে পারে, বিষয়টি যেহেতু বারবার আলোচনায় উঠে আসছে, তাহলে তা প্রতিরোধে কেন কার্যকর উদ্যোগ নিচ্ছে না সংশ্লিষ্টরা। পণ্যের আমদানি-রফতানির জন্য ব্যাংকিং চ্যানেলই ব্যবহার করতে হয়। অর্থপাচারের এই দায় ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা অস্বীকার করতে পারে না।

অন্যদিকে, ‘সেকেন্ড হোম’ এর কথাটিও বহুল আলোচিত। এমনও দৃষ্টান্ত রয়েছে, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে স্থায়ী মোটা অংকের বিনিয়োগ করে শিল্পপতিরা সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ করে নিচ্ছেন। বাংলাদেশীদের মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোমের সুবিধা নেওয়া, কানাডায় বেগমপাড়া তৈরি, বেশকিছু ব্যবসায়ীর সিঙ্গাপুর, হংকং-এ অফিস বানানোর তথ্য সত্য বলেই এখন ধরে নেয়া যায়।

২০১৫ সালে মালয়েশিয়া সরকারের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, বিদেশিদের জন্য সরকারের ‘সেকেন্ড হোম’ প্রকল্পে বাংলাদেশ ৩য় সর্বোচ্চ বিনিয়োগকারী দেশ; যেখানে ৩ সহস্রাধিক বাংলাদেশি প্রায় ৪,০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। নিয়ম অনুযায়ী, সেকেন্ড হোম প্রকল্পে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নগদ ৫ লাখ রিঙ্গিত (১ কোটি ২৫ লাখ টাকা) দেশটিতে নিয়ে যেতে হবে। সাধারণত যে কোন দেশে নাগরিকদের বিদেশে টাকা নিতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন লাগে, যেখানে গত ১০ বছরে মালয়েশিয়ায় বিনিয়োগের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাউকে কোনো অনুমোদন দেয়নি। এক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, মালয়েশিয়ায় বিপুল পরিমাণ অর্থপাচার করা হয়েছে।  এছাড়াও যেসব দেশে বিদেশি বিনিয়োগ উন্মুক্ত রয়েছে, সেই সব দেশের আবাসিক ভবন, জমি ক্রয়, হোটেলসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছেন বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা। এদের মধ্যে অনেকে অফশোর ব্যাংকিং, বিদেশী কনসালটেন্ট নিয়োগের মাধ্যমে টাকা পাচার করেছেন।

বিশ্বজুড়ে আলোড়নকারী টাকা পাচারের কেলেঙ্কারি ফাঁস করা ‘পানামা পেপার্স’ এর প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ২৭টি ব্যাংক হিসাবের কথা প্রকাশিত হয়েছে।

গত ১০ বছরের অর্থপাচারের চিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, যেসব বছর দেশের ভেতরে রাজনৈতিক অস্থিরতা বেশি ছিল, সেসব বছরে অর্থপাচার বেড়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঘিরে অনিশ্চয়তার সময় ২০১৩ সালে বাংলাদেশ থেকে আগের ৯ বছরের তুলনায় সবচেয়ে বেশি অর্থপাচার হয়েছে। ওই বছরটিতে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ ৯৬৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার। ২০১২ সালে এর পরিমাণ ছিল ৭২২ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এর আগে ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ও বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচার অনেক বেড়ে যায়। বছরটিতে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ ছিল ৬৪৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার। এর আগের অন্যান্য বছরের মধ্যে ২০০৪ সালে ৩৩৫ কোটি ডলার, ২০০৫ সালে ৪২৬ কোটি ডলার, ২০০৬ সালে ৩৩৮ কোটি ডলার, ২০০৭ সালে ৪১০ কোটি ডলার, ২০০৯ সালে ৬১৩ কোটি ডলার, ২০১০ সালে ৫৪১ কোটি ডলার, ২০১১ সালে ৫৯২ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। এতে স্পষ্ট যে, বাংলাদেশ থেকে দিন দিন অর্থপাচারের পরিমাণ বেড়ে চলেছে।

এটাও জানা যায়, দেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হলেও এর বিপরীতে মামলা হচ্ছে মাত্র দেড় হাজার কোটি টাকার, যা মোট পাচারকৃত অর্থের ৩ শতাংশ। বাকি প্রায় ৯৭ শতাংশ বা ৪৩ হাজার কোটি টাকার কোনো রেকর্ড থাকছে না। এ অর্থ হিসাবের মধ্যে আসছে না। পাচার হওয়া অর্থের একটা বড় অংশ জমা আছে সুইস ব্যাংকে। দুঃখজনক হলেও সত্য, দীর্ঘদিন ধরে যখন বাংলাদেশে আশানুরূপ বিনিয়োগ ঘটছে না, তখনো পাচার হচ্ছে অর্থ। অথচ এই অর্থ যদি পাচার না হয়ে বিনিয়োগে আসত তাহলে শিল্প-কারখানা গড়ে উঠতো, উৎপাদন ও রফতানি বাড়তো, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটতো এবং ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতো। সব মিলে অর্থনীতি ও উন্নয়নে বড় রকমের অগ্রগতি হতো।

সাধারণত দুর্নীতি ও চোরাচালানের মাধ্যমে অর্জিত অর্থসহ অবৈধভাবে প্রাপ্ত অর্থ পাচার হয়ে যায়। এটা ঠিক, দেশে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থের নিরাপত্তার অভাব আছে। দ্বিতীয়ত, বিনিয়োগ পরিবেশেরও অভাব আছে। অর্থপাচার হওয়ার এ দু’টিই বড় কারণ। এর আগে অপ্রদর্শিত অর্থ বিভিন্ন সেক্টরে বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাতেও খুব বেশি সাড়া পাওয়া যায়নি। দুদক ও বিভিন্ন সংস্থার ভয়ে অনেকেই অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগে আগ্রহ ও উৎসাহ দেখাননি। দুর্নীতি বা অনৈতিক উপায়ে অর্থ উপার্জন কোনো দেশেই সমর্থনযোগ্য নয়। তারপরও দেখা গেছে অনেক দেশ এ অর্থ অবাধে ও বিনা প্রশ্নে বিনিয়োগের সুযোগ দিয়েছে এবং তাতে ওইসব দেশ লাভবান হয়েছে।

বিশ্ব বানিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) পরিচালিত ২০১৫ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যিক লেনদেনের গড়ে ১০ শতাংশের বেশি অর্থ পাচার হয়। ২০১৪ সালে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক হিসাবে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনীতির ৪০-৮০ শতাংশ কালোটাকা। জাতিসংঘ উন্নয়ন প্রকল্প (ইউএনডিপি) এর তথ্যমতে, স্বাধীনতার পর চার দশকে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ জিডিপির প্রায় ৩০ দশমিক ৪ শতাংশ। পাচারকৃত এ অর্থ দেশের মোট বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) এর দুই-তৃতীয়াংশ।

উৎস - amaderbudhbar.com