সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে ঢাকায় সাধারণত যানজট বেশি হয়। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে দেখি, রাস্তাঘাট প্রায় ফাঁকা। স্বল্পসংখ্যক বাস চলছে। প্রাইভেট গাড়ি আরও কম। রাস্তায় যত মানুষ, তার চেয়ে বেশি পুলিশ ও র্যাব সদস্য দাঁড়িয়ে আছেন ফুটপাতে। মাঝেমধ্যে বিজিবির টহল গাড়ি আসছে, যাচ্ছে। আগের দিন সন্ধ্যা থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শহরের মোড়ে মোড়ে তল্লাশি অভিযান চালাচ্ছিল। কিন্তু অফিসযাত্রী, দিন এনে দিন খাওয়া মানুষ, কারখানার শ্রমিক, এসএসসি পরীক্ষার্থীদের তো বের হতেই হবে। বাস-রিকশা চলুক বা না চলুক। রায় নিয়ে রাস্তায়-অফিসে মানুষের মধ্যে যতটা কৌতূহল লক্ষ করেছি, তার চেয়ে বেশি উদ্বেগ দেখেছি নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে।
খালেদা জিয়ার মামলার রায় আদালতের সীমা ছাড়িয়ে রাজপথে উত্তাপ ছড়িয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে বিরোধী দলের চেয়ে সরকারি দলের ভূমিকাই বেশি। অভিযুক্ত ব্যক্তি সব সময় নিজেকে নির্দোষ দাবি করবেন। কিন্তু রায়ের অনেক আগেই যদি ক্ষমতার মঞ্চ থেকে কাউকে ‘চোর’, ‘দুর্নীতিবাজ’ বলে নিয়ত গালমন্দ করা হয়, তখন সেই বিচার নিয়ে জনমনে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।
দুর্নীতির দায়ে আওয়ামী লীগ সরকার খালেদা জিয়ার বিচার করেছে। বিএনপির আমলে বিদেশে পাচার হওয়া কিছু অর্থ ফেরতও এনেছে। কিন্তু যে এরশাদ গায়ের জোরে ক্ষমতা দখল করে নয় বছর জবরদস্তি শাসন চালিয়ে দেশে-বিদেশে মহা দুর্নীতিবাজ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, সেই এরশাদকে ক্ষমতার অংশীদার করেছে আওয়ামী লীগ। রাজনীতির এক অদ্ভুত সংশ্লেষণ।
বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টা। কারওয়ান বাজার থেকে প্রেসক্লাবে যেতে হাইকোর্টের দক্ষিণ মোড়ে সিরডাপের গা ঘেঁষে দেখা গেল সারি সারি যানবাহন। কোনোটি পুলিশের, কোনোটি র্যাব বা বিজিবির। সঙ্গে জলকামান। এ পথ দিয়েই খালেদা জিয়ার আদালতে যাওয়ার কথা। প্রেসক্লাবে থাকতেই খবর পেলাম, তিনি গুলশান থেকে রওনা হয়ে গিয়েছেন। সবাই নড়েচড়ে বসলেন। বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো লাইভ দেখাচ্ছে। কিন্তু খালেদা জিয়া জনসভায় ভাষণ দিলে কিংবা সংবাদ সম্মেলন করলে সেটি তারা লাইভ দেখাতে পারে না। এই হলো বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা। সরকার যতটুকু চাইবে প্রচার করা যাবে, যেটুকু চাইবে না প্রচার করা যাবে না।
দুপুর ১২টা। পুলিশ নয়াপল্টনে বিএনপির অফিস কর্ডন করে রেখেছে। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা অফিসে ঢুকেছেন। তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অফিস থেকে হেঁটে খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে যোগ দেবেন। কিন্তু কোনো কর্মীকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। একপর্যায়ে পুলিশ কলাপসিবল গেট বন্ধ করে দিলে কয়েকজন সাংবাদিক আটকা পড়েন। পরে অবশ্য তাঁরা বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন।
অন্যদিকে গতকাল ধানমন্ডি ৩/এ সড়কে আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর অফিসটি ছিল সরগরম। সকাল থেকে সেখানে দলের নেতা-কর্মীদের ভিড়। যাঁরা বরিশালে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়েছেন, তাঁদের বাইরের অনেকেই সেখানে হাজির। সাত মসজিদ সড়কের পাশের ফুটপাতে সার বেঁধে বসে ছিলেন আওয়ামী যুব মহিলা লীগের একদল কর্মী। আর অফিসের সামনে পুরুষ কর্মীরা ইতস্তত ঘোরাফেরা করছেন। ভেতরে নেতারা টিভি সেটের সামনে বসে আছেন। ভাবলেশহীন। রায়ে কী হবে, তা যেন তাঁদের জানা।
মামলার রায় ঘোষণার পর আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা হয়। বিএনপির নেতারা মনে করেন, এই রায় তাঁদের জন্য শাপেবর হবে। জিজ্ঞেস করি, কীভাবে? তাঁরা বললেন, উচ্চ আদালতে আপিল হলে খালেদা জামিন পাবেন। তিনিও আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর মতো সারা দেশে নির্বাচনী প্রচার চালাবেন। এরপরও যদি তাঁকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করা হয়, তাহলে সেটিই আন্দোলনের ইস্যু হবে। আর আওয়ামী লীগের নেতারা বললেন, মামলাটিকে রাজনৈতিকভাবে দেখার সুযোগ নেই। আওয়ামী লীগ সরকার এই মামলা করেনি। মামলা করেছে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার। জিজ্ঞেস করি, সেই সরকার তো আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরুদ্ধেও অনেক মামলা করেছিল। তাঁদের জবাব, প্রতিটি মামলাই আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়েছে। পরের প্রশ্ন ছিল, খালেদা জিয়া জেলে থাকলে আওয়ামী লীগের ভোট বাড়বে, না কমবে? এ প্রশ্নের সরাসরি উত্তর পাওয়া গেল না।
বেলা তিনটা। গুলিস্তানের অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ। তারপরও কিছু কিছু হকার পসরা সাজিয়ে বসেছেন। জিজ্ঞেস করি, বেচাকেনা কেমন। বললেন, রাস্তায় মানুষই নেই, বেচাকেনা হবে কী করে? তবে পাশের জন কৌতুক করে যোগ করলেন, ‘আমাদের আয় শুধু কমেনি। পুলিশের আয়ও কমেছে।’
প্রেসক্লাবের সামনে এসে দেখি একেবারে ভিন্ন চিত্র। মাসখানেক ধরে এখানে বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ অবস্থান নিয়েছিলেন, যাঁদের মধ্যে শিক্ষকই ছিলেন বেশি। সর্বশেষ স্বাস্থ্যকর্মীরা আমরণ অনশন করেন। সরকার কৌশলে তাঁদের সরিয়ে দিয়েছে। ভেতরে তখন সাংবাদিক বন্ধুরা তর্কে মশগুল। রায়ের পর খালেদা জিয়া নির্বাচন করতে পারবেন কি পারবেন না। কেউ বলছেন পারবেন, মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বলা যাবে না, তিনি অপরাধী। কেউ বলছেন, উচ্চ আদালত তাঁর শাস্তি স্থগিত রাখলেও তিনি নির্বাচন করতে পারবেন না। কেননা আইনের চোখে তিনি অপরাধী। উচ্চ আদালত অপরাধ স্থগিত করতে পারেন না। শাস্তি স্থগিত করতে পারেন। আইনমন্ত্রীও স্থির কিছু জানাতে পারলেন না। বললেন, এ বিষয়ে দুই ধরনের রায় আছে।
রাতে টিভিতে দেখলাম জাতীয় সংসদে খালেদা জিয়ার মামলার রায় নিয়ে সরকার ও আধা সরকারদলীয় সাংসদেরা গলা ফাটিয়ে বলছেন, উচিত বিচার হয়েছে। জাতীয় পার্টির একজন সাংসদ বললেন, খালেদা জিয়া অন্যায়ভাবে তাঁদের নেতা এরশাদকে জেল খাটিয়েছেন। বিএনপিও তো এখন একই কথা বলছে। অন্যায়ভাবে খালেদা জিয়াকে কারাগারে নেওয়া হয়েছে। আইনের প্রতি আইনপ্রণেতারা তখনই আস্থা রাখেন, যখন নিজের পক্ষে যায়।
মামলার অভিযোগ অনুযায়ী, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের নামে আসা টাকা খালেদা জিয়া অন্য হিসাবে জমা করেছেন। বিএনপির সরকারের আমলে বড় বড় দুর্নীতি হয়েছে। কিন্তু কোনোটারই বিচার হয়নি। বিচার হলো শুধু জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার। এর আগের বিএনপি ও আওয়ামী লীগের আমলের অনেক দুর্নীতির মামলা এখনো ঝুলে আছে।
১০ বছরেরও বেশি সময় খালেদা জিয়া ক্ষমতার বাইরে। এই সময়ে দেশে সুশাসন ও সুনীতির বন্যা বয়ে গেছে, বলা যাবে না। খালেদা জিয়ার আমলে যেমন দুর্নীতি ছিল, এখনো দুর্নীতি আছে। দুটি উদাহরণ দিই। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) জানিয়েছে, বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৯১১ কোটি ডলার পাচার হয়েছে ২০১৪ সালে, টাকার অঙ্কে যা প্রায় ৭২ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী সে দেশের ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা রাখা অর্থের পরিমাণ প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা।
এসব তথ্য কি প্রমাণ করে, দেশে দুর্নীতি হয় না? দুর্নীতি হয়। কিন্তু দুর্নীতির কুশীলবেরা ধরা পড়েন না। ধরা পড়লেও বিচার হয় না। বিচার হলে ২০১০–এর শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির হোতারা কীভাবে বাইরে থাকেন? বেসিক ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক কেলেঙ্কারির নায়কেরা কীভাবে দাপট দেখান? এসব বড় বড় দুর্নীতির জন্য যাঁরা দায়ী, তাঁদের কেশাগ্র স্পর্শ না করলে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দুর্নীতি বাড়তেই থাকবে। ‘বাছাই করা বিচার’ দিয়ে সুশাসন বা সুবিচার কোনোটাই কায়েম করা যায় না।
খালেদা জিয়ার মামলার রায়ের পর এবার সরকার ব্যাংক কেলেঙ্কারি, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির হোতা এবং বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের ধরুক। বিচার করুক। তারপরই না বলা যাবে, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নন। অপরাধী শাস্তি পাবেই।