কিছুদিন স্থিতিশীল থাকার পর আবার বাড়তে শুরু করেছে চালের দাম। সরু ও মোটা সব ধরনের চালের দামই এখন বাড়ন্ত। এক সপ্তাহের ব্যবধানে পাইকারিতে মোটা চালের দাম বেড়েছে কেজিতে সর্বোচ্চ দেড় টাকা। তবে সরু চালের দাম বেড়েছে আরেকটু বেশি, কেজিতে ৩ টাকা পর্যন্ত। একইভাবে বেড়েছে খুচরা পর্যায়েও।
দেশে চালের বাজার আবার চড়তে থাকার কারণ হিসেবে ভারতের বাজারে পণ্যটির মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, ভারত থেকে চাল আমদানিতে আগের চেয়ে টনপ্রতি ২০-৩০ ডলার বেশি ব্যয় হচ্ছে। বাড়তি মূল্যে আমদানি করা এ চাল স্থানীয় বাজারেও বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের ১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সরকারিভাবে চাল আমদানি হয়েছে ৭ লাখ ৬১ হাজার টন। বেসরকারি পর্যায়ে আমদানির পরিমাণ ২১ লাখ ২৯ হাজার টন, যার সিংহভাগই এসেছে ভারত থেকে। এ চালের বড় অংশই ব্যবসায়ীরা এনেছেন দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দর দিয়ে। আমদানির এ ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে। তবে মূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে এক সপ্তাহ আগের তুলনায় বেশি।
হিলি স্থলবন্দরের চাল আমদানিকারকরা জানান, এক সপ্তাহ আগেও ভারত থেকে মানভেদে প্রতি টন স্বর্ণ চাল আমদানি হতো ৪২০-৪৩০ ডলারে। একই চাল আমদানিতে এখন ব্যয় হচ্ছে ৪৪০-৪৪৫ ডলার। একইভাবে রত্না জাতের চালেও টনপ্রতি সর্বোচ্চ ৩০ ডলার বেশি খরচ হচ্ছে। সপ্তাহখানেক আগে স্থলবন্দরটি দিয়ে প্রতি টন ভারতীয় রত্না চাল ৪৪০-৪৫০ ডলার মূল্যে আমদানি হলেও এখন ব্যয় করতে হচ্ছে ৪৭০ ডলার।
বাড়তি দামে আমদানি করা প্রতি কেজি স্বর্ণা চাল ৩৮ থেকে সাড়ে ৩৮ টাকায় বিক্রি করছেন আমদানিকারকরা। একই চাল এক সপ্তাহ আগে তারা বিক্রি করেছিলেন কেজিপ্রতি সাড়ে ৩৬-৩৭ টাকা দরে। এক সপ্তাহ আগে প্রতি কেজি রত্না চাল ৩৯ টাকায় বিক্রি হলেও এখন তা বেড়ে হয়েছে ৪২ টাকা।
আমদানিকারকদের কাছ থেকে চাল কিনে পাইকারিতে তা বিক্রি করেন হিলি স্থলবন্দরের ব্যবসায়ী অনুপ বসাক। তিনি বলেন, ভারতে চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশের বাজারেও বাড়ছে। আমদানিকারকদের কাছ থেকে আমাদের বেশি দামে পণ্যটি কিনতে হচ্ছে। বেশি দামে কেনা চাল বাড়তি দামে বিক্রি করা ছাড়া উপায় নেই।
ভারতে চালের মূল্যবৃদ্ধির সুযোগ নিচ্ছেন স্থানীয় মিলাররাও। ফলে কয়েক দিনের ব্যবধানে রাজধানীতেও সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে। রাজধানীর পাইকারি বাজারে পণ্যটির দাম কেজিতে ১ টাকা বাড়লেও খুচরায় বেড়েছে আড়াই টাকা পর্যন্ত।
রাজধানীর বাবুবাজারের চালের আড়ত ঘুরে গতকাল পাইকারিতে প্রতি কেজি মিনিকেট চাল ৫৮-৫৯ টাকায় বিক্রি হতে দেখা যায়। চারদিন আগেও এ বাজারে একই চাল বিক্রি হয়েছিল ৫৬-৫৭ টাকায়। কেরানীগঞ্জের আগানগরের বৌবাজার এলাকায় গতকাল খুচরায় প্রতি কেজি মিনিকেট চাল বিক্রি হয় ৬৩ টাকায়। চারদিন আগেও একই চাল ৬১ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন এখানকার দোকানিরা। একইভাবে ৪১ টাকার স্বর্ণা চাল এখন বিক্রি হচ্ছে ৪৩ টাকায় ও ৪৬-৪৮ টাকা কেজি দরের বিআর-২৮ চাল ৪৮-৫০ টাকায়।
নওগাঁ জেলা ধান-চাল আড়তদার সমিতির সভাপতি নিরদ বরণ সাহা বণিক বার্তাকে বলেন, দেশে বর্তমানে চালের কোনো সংকট নেই। ভারত থেকেও পর্যাপ্ত চাল আমদানি হচ্ছে। তবে বর্তমানে ভারত সরকার চাল সংগ্রহ করায় সে দেশে দাম কিছুটা বেড়েছে। আমদানিনির্ভরতা বেড়ে যাওয়ায় এর প্রভাব পড়ছে দেশের বাজারেও। ভারতে চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় বড় মিল মালিকরাও সরবরাহ সীমিত করে এনেছেন। দু-একদিনের মধ্যে দাম বাড়িয়ে তারা সরবরাহ স্বাভাবিক করবেন।
মিল থেকে সরবরাহ কমে যাওয়ার জন্য ধান সংকটকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন বাংলাদেশ অটো, মেজর ও হাসকিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক লায়েক আলী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ধানের অভাবে অনেক মিল বন্ধ থাকায় চাল সরবরাহ কমে গেছে। এছাড়া বাজারে ধানের দাম বেড়েছে। ভারত থেকে আমদানি মূল্যও বেড়েছে। এ কারণে চালের বাজার একটু বাড়তির দিকে রয়েছে।
চট্টগ্রামেও সব ধরনের চালের দাম বাড়তির দিকে রয়েছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে চট্টগ্রামের পাইকারি বাজারে পণ্যটির দাম বেড়েছে কেজিতে সর্বোচ্চ ২ টাকা। পাইকারি ব্যবসায়ীরা বেশি দামে চাল কেনার কারণে এর প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারেও। একই সময়ে খুচরায় চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ৩ টাকা পর্যন্ত।
খাতুনগঞ্জের আড়তদাররা জানান, বর্তমানে পুরনো মৌসুমের চালের মজুদ কমে আসছে। ২০১৭ সালে বাজারে অস্থিরতার পর থেকে আমদানিনির্ভর হয়ে পড়েছে দেশের চালের বাজার। বর্তমানে ৬০-৭০ শতাংশ বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে আমদানিকৃত চাল। ফলে প্রতিদিনই পাইকারি বাজারে দামের ওঠানামা রয়েছে।
আড়ত থেকে নেয়া চালের দর পর্যালোচনায় দেখা যায়, এক সপ্তাহ আগেও প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) ভারতীয় বেতি চাল বিক্রি হয়েছিল ১ হাজার ৭৫০ টাকায়। একই চাল এখন বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৮৫০ টাকায়। মিয়ানমার থেকে আমদানি করা একই পরিমাণ চাল ১ হাজার ৫৫০ থেকে বেড়ে ১ হাজার ৬৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
আমদানিকৃত চালের পাশাপাশি বেড়েছে দেশী চালের দামও। খাতুনগঞ্জে ৫০ কেজির প্রতি বস্তা মিনিকেট চাল ২ হাজার ৪০০ থেকে বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৫০০ টাকায়। এছাড়া প্রতি বস্তা পাইজাম ২ হাজার ৩০০ থেকে বেড়ে ২ হাজার ৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এসব চালের দাম খুচরা পর্যায়ে আরেক দফা বেড়ে ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছাচ্ছে। সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি কেজি চাল বাবদ অতিরিক্ত সর্বোচ্চ ৩ টাকা বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে ভোক্তাদের।
গত বছর হাওড়ে আগাম বন্যায় বোরো ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়। একই বছর দ্বিতীয়বারের বন্যায়ও ফসলহানি ঘটে। এতে চালের মজুদ অস্বাভাবিক কমে যায় এবং বাড়তে থাকে চালের দাম। বাজার স্বাভাবিক রাখতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারিভাবে চাল আমদানিতে উৎসাহ দেয়া হয়। আমদানি শুল্ক নামিয়ে আনা হয় ২ শতাংশে। এরপর ভারত থেকে ব্যাপক হারে চাল আমদানি হতে থাকে। যদিও এর প্রভাব সেভাবে পড়েনি বাজারে।
- বনিক বার্তা / ১৫-২- ২০১৮