২০০৭ সালের এক সন্ধ্যায় ঢাকার প্রান্তে আত্মীয়ের বাড়ি থেকে ফিরছিল ১৩ বছরের একটি মেয়ে। পরিচিত দুজন তরুণ তাকে ডেকে নিয়ে সারা রাত আটকে রেখে ধর্ষণ করেন। এই অভিযোগে মায়ের এজাহারে মামলা হয়। ডাক্তার ধর্ষণের আলামত পেয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ এক আসামির হদিস বের করতে না পারায় তিনি অব্যাহতি পান। অন্যজন প্রায় আট বছর বিচার চলার পর সাক্ষীর অভাবে খালাস পান। মেয়েটির পরিবার বলছে, দুজনই এখনো এলাকায় আছেন।
২০১৪ সালের ২৪ নভেম্বর বিকেলে ভাটারা এলাকায় বাড়ির পাশের দোকানে গিয়েছিল নয় বছরের মেয়েটি। বাবা পরদিন কাছের এক ডোবায় তার বস্তাবন্দী লাশ পেলেন। মেয়েটিকে কেউ ধর্ষণ করার পর গলা টিপে মেরেছিল। পরপর ছয়জন পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্মকর্তা মামলাটির তদন্ত করেন। চারজন গ্রেপ্তারও হয়। কিন্তু সর্বশেষ কর্মকর্তা চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে তাদের অব্যাহতি চান। তিনি লেখেন, আগের তদন্তে অবহেলার কারণে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেননি। মেয়েটির বাবা এই প্রতিবেদনে নারাজি দিয়েছেন।
শ্যামলীর ১৩ বছরের পিংকীকে উত্ত্যক্ত করতেন এলাকার দুই যুবক। ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি পাড়ার ওষুধের দোকানে তাঁরা মেয়েটির হাত ধরে টানাহেঁচড়া করেন, চড়-থাপ্পড় মারেন। ঘরে ফিরে পিংকী আত্মহত্যা করে, কারণটা চিরকুটে লিখে যায়। অভিযুক্ত দুজন গ্রেপ্তার হয়ে বছর না ঘুরতেই জামিন পেয়েছেন। সাড়ে সাত বছর ধরে বিচার চলছে। সাক্ষ্য দিয়েছেন শুধু তিনজন আত্মীয়।
পিংকীর পরিবার মধ্যবিত্ত। বাকি দুটি নিম্নবিত্ত। ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে করা এই মামলাগুলোর বিচার হচ্ছে একই নামের ট্রাইব্যুনালে।
ঢাকা জেলার পাঁচটি ট্রাইব্যুনালে আসা গুরুতর ছয়টি অপরাধের মামলা নিয়ে প্রথম আলোর প্রায় দেড় বছরের অনুসন্ধান বলছে, বিচারের পরিস্থিতি এ রকমই। পুলিশ আসামিদের খুঁজে পাচ্ছে না অথবা তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ পাচ্ছে না। পুলিশ আর সরকারি কৌঁসুলিরা (পিপি) সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির করে মামলা জিততে পারছেন না। ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণের জন্য হত্যা, যৌতুকের জন্য হত্যা, আত্মহত্যায় প্ররোচনা আর যৌন পীড়নের মতো গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রেও না।
ট্রাইব্যুনালগুলোর বিচারিক নিবন্ধন খাতা থেকে প্রথম আলো এই ছয় অপরাধে ২০০২ থেকে ২০১৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত আসা ৭ হাজার ৮৬৪টি মামলার প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ করেছে। তখনো পর্যন্ত নিষ্পত্তি হয়েছিল ৪ হাজার ২৭৭টি মামলা। সাজা হয়েছিল মাত্র ১১০টি মামলায়। অর্থাৎ বিচার হয়েছিল ৩ শতাংশের কম ক্ষেত্রে। বাকি ৯৭ শতাংশ মামলার আসামি হয় বিচার শুরুর আগেই অব্যাহতি পেয়েছে, নয়তো পরে খালাস হয়ে গেছে।
মামলাগুলোর বেশির ভাগ থানায় করা, কয়েক শ মামলা হয়েছে সরাসরি ট্রাইব্যুনালে। সব কটিরই তদন্তের ভার পুলিশের। তদন্তে অবহেলা, গাফিলতি ও অদক্ষতা থাকে। আদালতে সাক্ষী আনা আর সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপনে পুলিশ আর পিপিদের অযত্ন ও গাফিলতি থাকে। ভুক্তভোগী পক্ষ হয়রানি আর টাকা খেয়ে মামলা ঘুরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ করে।
অনেক মামলা বছরের পর বছর ঝুলে থাকে। কখনো আদালতের বাইরে আপস হয়। ট্রাইব্যুনালের মাথায় মামলার পাহাড় জমে। এসবের জন্য জবাবদিহি বা নজরদারির নজির চোখে পড়েনি। ভাটারায় ধর্ষণের পর খুন হওয়া শিশুটির বাবা এখনো আদালতের বারান্দায় ঘুরছেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘পুলিশের ভুলে আসামিরা ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। আমি কি তাহলে আমার মেয়ে হত্যার বিচার পাব না?’
আর শ্যামলীর পিংকীর চাচা আলী আশরাফ আখন্দ বলেছেন, ‘আমরা অনেক আগে আদালতে সাক্ষ্য দিয়ে এসেছি। অথচ মামলার তদন্ত কর্মকর্তাসহ অন্য সাক্ষীরা আদালতে সাক্ষ্য দিতে হাজির হচ্ছে না। বিচার চাইতে গিয়ে প্রতি পদে বিড়ম্বনা সহ্য করতে হচ্ছে।’
মামলা প্রমাণ করতে রাষ্ট্রপক্ষের ব্যর্থতার কারণ হিসেবে আরও এসেছে অভিযোগকারী আর আসামিদের মধ্যে আপস অথবা আঁতাত হয়ে যাওয়ার কথা। আর এসেছে মিথ্যা মামলা হওয়ার অভিযোগ। তা ছাড়া, আজ পর্যন্ত সরকার আইনটির কোনো বিধি করেনি। এতে নানা রকম সমস্যা হচ্ছে। আইনজীবীরা আইনের কিছু ঘাটতির কথাও বলেছেন।
অনুসন্ধানী দলের সদস্যরা ৬৫টি মামলার নথিপত্র খুঁটিয়ে পড়েছেন। এগুলোর এবং এর বাইরেও অনেকগুলো নথির ঠিকানা ধরে ভুক্তভোগী আর আসামিপক্ষের লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন। কথা বলেছেন সরকারি কৌঁসুলি আর পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে, রাষ্ট্রের পক্ষে অভিযোগ প্রমাণের দায়িত্ব যাঁদের। কথা হয়েছে অভিজ্ঞ আইনজীবী আর মানবাধিকারকর্মীদের সঙ্গে।
আসামির সঙ্গে অভিযোগকারীর আপসের নেপথ্যে অনেক রকম কথা থাকে। ২০০২ সালের মাঝামাঝি ঢাকার এক উপজেলায় অতি দরিদ্র একজন কিশোরী গ্রামের পাঁচ যুবকের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করেছিল। বিচার চলছিল। কিন্তু ২০১০ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চিঠি লিখে পিপিকে জানায়, ‘মামলাটি না চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’ রাষ্ট্রপক্ষ মামলাটি আর চালাতে চায় না জানিয়ে পিপি আবেদন করলে ১ নম্বর ট্রাইব্যুনাল তা মঞ্জুর করেন।
অভিযোগকারীরা অবশ্য এত কথা জানেন না। গত অক্টোবরের এক সন্ধ্যায় মেয়েটি ও তাঁর মা প্রথম আলোকে বলেন, আসামিরা জামিনে বের হয়ে আসার পর থেকে এলাকায় তাঁদের ওপর আপস করার জন্য খুব চাপ ছিল। মেয়েটি বলেন, ‘নেতা লগে থাকছে, আর দ্যাশের মইধ্যে গইন্যমাইন্য লোকেরা আছে। মাতবর-চেয়ারম্যান এরা বলছে। আসামির লোকেরা বলছে, এ রকম আর কোনো সময় হইব না, যা হওয়ার হয়া গেছে। মাথা নত হয়া মাইন্যা নিছি।’
অভিযোগকারীদের বড় অংশ দরিদ্র। খুঁটিয়ে দেখা ৬৫টি মামলার ৫১ টিতেই অভিযোগকারীরা স্বল্প আয়ের পোশাককর্মী, গৃহকর্মী, বস্তিবাসী বা ছিন্নমূল নারী ও শিশু। তাঁরা থানা আর আদালতে চক্কর কেটে খরচপত্র করে মামলা টানতে পারেন না। মামলা তদারকির জন্য তাঁরা মূলত পিপির ওপর নির্ভরশীল। সহায়ক আইনজীবী নিয়োগের সামর্থ্য তাঁদের নেই।
আপসের বাস্তবতার সঙ্গে মিলেমিশে আসে এই সাধারণ অভিযোগ যে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে করা অধিকাংশ মামলাই মিথ্যা। ২০১৬ সালের জাতীয় বিচার বিভাগীয় সম্মেলনে সারা দেশের ৪০ টির বেশি ট্রাইব্যুনালের বিচারকেরা মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ার এক নম্বর কারণ হিসেবে মিথ্যা মামলাকে চিহ্নিত করেছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, এমনকি ধর্ষণের মামলারও নেপথ্যে অন্য বিরোধ থাকে।
তবে প্রথম আলোর খুঁটিয়ে দেখা মামলাগুলো ভুয়া মামলার ঢালাও অভিযোগকে সমর্থন করেনি। তা ছাড়া সাবেক ও বর্তমান অন্তত আটজন পিপি, বেশ কয়েকজন আইনজীবী, পুলিশ কর্মকর্তা ও অভিযোগকারীরা বলেছেন, হত্যা বা আত্মহত্যা তো বটেই, গুরুতর এই ছয় অপরাধের মামলাগুলোর বেশির ভাগ ঘটনাই সত্য।
ধর্ষণ ও যৌন পীড়নের অভিযোগকারীকে থানা থেকে আদালত পর্যন্ত অশেষ হয়রানি পোহাতে হয়। লোকলজ্জা আর ধিক্কারের মুখোমুখি হতে হয়। তাদের সান্ত্বনা-পরামর্শ বা পুনর্বাসনের সুযোগ খুবই কম। নিতান্ত মরিয়া না হলে কেউ মামলা করতে আসে না।
অব্যাহতি, খালাস, ঝুলে থাকা
পুলিশ যখন এজাহারে বর্ণিত আসামির বিরুদ্ধে মামলা প্রমাণ করার মতো তথ্য পায় না, তখন চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়। ট্রাইব্যুনাল শুনানিতে সেটা গ্রহণ করলে সেখানেই মামলার ইতি হয়, আসামি অব্যাহতি পায়। তদন্তে প্রাথমিক প্রমাণ পেলে পুলিশ অভিযোগপত্র দেয়, যার ভিত্তিতে শুনানির পর ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ গঠন করেন। অথবা আসামি অব্যাহতিও পেতে পারে।
অভিযোগ গঠিত হলে বিচার শুরু হয়। দীর্ঘ সময়ে ন্যূনতম সাক্ষী ও প্রমাণ হাজির করা না হলে আদালত মামলার ইতি টেনে আদেশ দিতে পারেন। তখন সাক্ষীর অভাবে আসামি খালাস পায়। আবার রাষ্ট্রপক্ষ পূর্ণ শুনানিতে সাক্ষ্য-প্রমাণ দিয়ে অভিযোগ প্রমাণ করতে না পারলে আসামি বেকসুর খালাস পায়।
ছয় অপরাধে ১৫ বছরে নিষ্পত্তি হওয়া মামলাগুলোর ৪১ শতাংশের ক্ষেত্রে আসামিরা বিচার শুরুর আগেই অব্যাহতি পেয়েছে। আর ৫৫ শতাংশ মামলায় সাক্ষ্য-শুনানির শেষে আসামিরা বেকসুর খালাস পেয়েছে। কিছু মামলা নিষ্পত্তির কারণ নিবন্ধন খাতায় লেখা নেই, কয়েকটির নিষ্পত্তি হয়েছে আসামির মৃত্যুতে। এভাবে ৯৭ শতাংশ মামলার আসামির বিরুদ্ধেই এসব গুরুতর অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।
চলমান মামলাসহ মোট দেখা মামলার তিন-চতুর্থাংশের কিছু কম ধর্ষণের অপরাধে করা। প্রায় এক-চতুর্থাংশ হচ্ছে যৌন পীড়নের মামলা। দেখা যায়, ২০১২ সালের পর থেকে মামলা আসা বেড়েছে এবং সেটা মূলত যৌন অপরাধের মামলার জন্য।
সাজার হার সবচেয়ে কম যৌন পীড়নের মামলাগুলোতে, সবচেয়ে বেশি হচ্ছে ধর্ষণের পর হত্যা মামলায়। তবে এই মামলাগুলো সংখ্যায় খুবই কম আর সেখানেও নিষ্পত্তি হওয়া তিন-চতুর্থাংশ মামলায় আসামি অব্যাহতি বা খালাস পেয়েছে।
চলমান ছিল ৩ হাজার ৫৮৭টি মামলা। ২০০২ সালে আদালতে আসা ১৬টি মামলা তখনো ঝুলছিল। এর বড় অংশ ধর্ষণ ও গণধর্ষণের মামলা। চলমান মামলার প্রায় ৪০ শতাংশ (১ হাজার ৩৪৬ টি) ছয় থেকে ১৩ বছর ধরে ঝুলছিল। বিচার শুরু হতে হতেই অনেকটা সময় পার হয়ে যায়। এভাবে ঝুলে থাকার সময়টা ২০ বছর পেরিয়ে যাওয়ারও নজির আছে।
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ প্রথম আলোকে বললেন, ‘অস্বীকার করার উপায় নেই যে প্রসিকিউশন পক্ষের (রাষ্ট্রপক্ষ) দুর্বলতার কারণে আসামিরা ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে।’ তিনি বলেন, অনেক মামলা শক্তভাবে অতি দ্রুত বিচার করা উচিত। কিন্তু তদন্ত, অভিযোগপত্র দেওয়া আর অভিযোগ গঠনে অনেক সময় চলে যায়। বিচারও ধীরগতিতে চলে।
মামলা যত গড়ায়, সাক্ষী এনে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে আসামিদের শাস্তি দেওয়ার সম্ভাবনা তত কমে। আপসের সম্ভাবনাও বাড়ে। ২০০২ সালে আসা মামলাগুলোর মাত্র চারটিতে সাজা হয়েছে। সবই ২০০৪ সালের মধ্যে। এরপর সব মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে খালাসে।
অব্যাহতির চক্কর
ভাটারার ধর্ষণ ও হত্যা মামলাটি একে একে থানা, গোয়েন্দা বিভাগ আর সিআইডির ছয়জন কর্মকর্তা তদন্ত করেছিলেন। শেষ তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির উপপরিদর্শক মো. শামসুদ্দিন চূড়ান্ত প্রতিবেদনে লিখেছেন, সুরতহালের সময় লিজার যৌনাঙ্গ থেকে নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করানোর দরকার ছিল। তা ছাড়া মেয়েটির পোশাক সিআইডির ডিএনএ পরীক্ষণাগারে পাঠানো হয়েছিল ২৬ দিন পরে। আসামি শনাক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় নমুনা তখন আর পাওয়া যায়নি।
শামসুদ্দিন লিখেছেন, ‘পূর্ববর্তী তদন্তকারী অফিসারের অবহেলার কারণে’ তদন্তে কোনো ফলপ্রসূ তথ্য পাওয়া যায়নি। বারবার চেষ্টা করেও তিনি ওই কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাননি। সব শেষে তিনি লিখেছেন, এটি একটি ‘সত্য মামলা বলে প্রতীয়মান হলেও’ কোনো আসামিকে শনাক্ত করা বা ঘটনা উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়নি।
চূড়ান্ত প্রতিবেদনটি শামসুদ্দিন দেন মামলা হওয়ার এক বছর এক মাস পর, ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে। এজাহারকারী মেয়েটির বাবার নারাজির ওপর শুনানি এখনো চলছে। আসামিরা জামিনে আছেন।
বিচারিক নিবন্ধন খাতার লিপিকারদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, অব্যাহতির প্রায় সবই চূড়ান্ত প্রতিবেদন মূলে হয়েছে। ছয় অপরাধের মোট মামলার সেটা প্রায় চার ভাগের এক ভাগ। ঘটনা ‘সত্য’, কিন্তু অপরাধী মিলছে না-এমনটা বলে চূড়ান্ত প্রতিবেদন হয়েছে। তবে অনেকগুলোই হয়েছে এজাহার ‘মিথ্যা’ বা ‘ভুল তথ্য’ দিচ্ছে বলে।
পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদন ট্রাইব্যুনালে পাঠানোর আগে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) ও ঢাকার মুখ্য বিচারিক হাকিম (সিজিএম) আদালতে জমা পড়ে। তাদের ২০১৬ সালের নিবন্ধন খাতায় এই ছয় অপরাধের মামলায় যত চূড়ান্ত প্রতিবেদন হয়েছে, প্রায় অর্ধেকই ‘ভুল তথ্য’ হিসেবে।
অনেকেরই অভিযোগ, পুলিশ আসামিপক্ষের কাছ থেকে টাকা খেয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়। মামলা না নেওয়ার অভিযোগও আছে। সরাসরি ট্রাইব্যুনালে মামলা হওয়ার এটা একটা কারণ। বেশ কয়েকজন এজাহারকারী ও ভুক্তভোগী নারী প্রথম আলোকে আরও বলেছেন, থানায় মামলা করার সময় পুলিশ সন্দেহ বা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, খারাপ কথা বলে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলছেন, কোনো পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অসদুপায় ও গাফিলতির সুস্পষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে তা যাচাই করে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
আর ডিএমপির মতিঝিল বিভাগের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার মোনালিসা বেগম বলেছেন, ‘অনেক ক্ষেত্রে ভিকটিম সাবালক হলে অন্য তথ্য মেলে, ঘটনাস্থল ভুল বেরোয়। তখন সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। গ্রহণ বা অগ্রহণ আদালতের এখতিয়ার।’
মোনালিসা বলেছেন, ‘৫ কি ১০ শতাংশ ক্ষেত্রে পুলিশের ভুলভ্রান্তি থাকতে পারে।’ তবে এই আইনের মামলাগুলো পুলিশ খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখে। জ্যেষ্ঠ একজন কর্মকর্তা তদন্ত তদারক করেন। প্রথম আলো শিশু ধর্ষণ ও হত্যার কয়েকটি মামলায় বারবার তদন্ত হতে দেখেছে।
মিথ্যা মামলা হলে বাদীর বিরুদ্ধে বিচারের বিধান আইনেই আছে। প্রথম আলো মাত্র একটিতে সেটা হতে দেখেছে। মোনালিসা বলেছেন, পুলিশের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এর প্রস্তাব থাকে, কিন্তু আদালত বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই করেন না। আদালতের ওপর এমনিতেই অনেক মামলার চাপ।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সরকারের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারটির (ওসিসি) আইনজীবী ফাহমিদা আক্তার বহু বছর ধরে ভুক্তভোগী নারী ও শিশুদের পক্ষে মামলা লড়ছেন। তিনি বলছেন, মামলা দায়েরের পর আপস হয়ে গেলে তদন্ত কর্মকর্তাকে অভিযোগকারী বলেন, আসামিপক্ষের সঙ্গে তাঁর কোনো বিরোধ নেই। তখন পুলিশ ‘তথ্যগত ভুল’ বলে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়। ফাহমিদা বলেন, ‘তখনই পুলিশ বলছে এগুলো মিথ্যা মামলা।’
একাধিক মামলায় পুলিশ আসামির হদিস পায়নি। প্রথম আলো অবশ্য তাদের খুঁজে পেয়েছে। আসামি ভুল বেরোলে পুলিশ সঠিক আসামিকে খুঁজে বের করতে পারেনি। নাম-ঠিকানার ছোটখাটো ভুল দেখিয়ে আসামির অব্যাহতি চেয়েছে। প্রাথমিক তথ্য-আলামত সংগ্রহে খামতি, ডাক্তারি বা ফরেনসিক পরীক্ষা নিয়ে সমস্যা আর ঠিক লোককে সাক্ষী না করায় সাজা হয়নি। পরবর্তী প্রতিবেদনগুলোয় এমন উদাহরণ এবং পুলিশের নানা সীমাবদ্ধতার বিষয় খতিয়ে দেখা হবে।
এদিকে গত নভেম্বরে পুলিশ ব্যুরো অব ইভেস্টিগেশন (পিবিআই) ২৩৮টি হত্যা মামলার ওপর একটি গবেষণা প্রকাশ করেছে। গবেষণাটি বলছে, থানা-পুলিশ আর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের তদন্তে গাফিলতি, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে ত্রুটি আর ম্যাজিস্ট্রেটের ভুলে অর্ধেকের বেশি মামলায় আসামিরা খালাস পেয়েছেন।
সময়ের ফেরে আপস
নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের সব অপরাধই বিচারের জন্য গ্রহণ করতে হবে। অর্থাৎ আপস-মীমাংসার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু বিচার চলাকালেও আপস হয়।
সচরাচর ভুক্তভোগীর চেয়ে আসামিপক্ষ সবল থাকে। তাদের চাপে ভুক্তভোগীরা আপস করতে বাধ্য হয়। ফাহমিদা বলেন, ‘চাপটা এমন হয় যে আপস করতে হবে, নয়তো এলাকা ছাড়তে হবে।’ কয়েকটি নথিতে দেখা যায়, স্বয়ং ভুক্তভোগী আদালতে হলফনামা বা সাক্ষ্য দিয়ে অভিযোগ তুলে নিচ্ছেন। খালাসের রায় হয়ে যাচ্ছে।
তা ছাড়া বিচার হবে-এই আস্থার প্রশ্নটি বড়। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভিকটিম যদি জানেন মামলার সঠিক বিচার হবে, তখন কিন্তু তিনি আর আপসের দিকে যাবেন না। তিনি বিচার চাইবেন। কিন্তু অভিযোগকারী যখন দেখেন আসামি টাকার জোরে নিজেকে খালাস করে নেবেন, তখন আপস করে ফেলেন। রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীরাও আদালতে পাল্টি খান।’
পিবিআইয়ের গবেষণাটি দেখেছিল, লম্বা সময় লাগায় ৩৭ শতাংশ সাক্ষী আপস করেছেন। বিচারে দেরি হলে বাদীপক্ষের লোকজনও আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। আর সাক্ষ্য দিতে আসেন না।
সাক্ষী গরহাজির
যে ধর্ষণের মামলার কথা দিয়ে এই প্রতিবেদন শুরু হয়েছে, তাতে রাষ্ট্রপক্ষের ১৩ জন সাক্ষী ছিলেন। আট বছরে ২৯টি শুনানির তারিখে এজাহারকারী মা ও ভুক্তভোগী মেয়েটি ছাড়া আর কেউ সাক্ষ্য দিতে আসেননি। ট্রাইব্যুনালের বিচারক এক আদেশে মামলাটির ইতি টানেন।
সাক্ষী হাজির করার দায়িত্ব পুলিশের। সাক্ষীকে কোর্টে তোলা, সাক্ষ্য উপস্থাপনের ভার পিপির। পিপিদের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে এই দায়িত্বে গাফিলতির অভিযোগ আছে। পিপিরা অবশ্য এ কথা মানেন না। আর অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব বলছেন, বেশির ভাগ পিপি রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পান। তাঁদের দায়বদ্ধতা থাকে না।
সর্ব অঙ্গে ব্যথা
কয়েকজন আইনজ্ঞ বলেছেন, বড় পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে অনেকগুলো অপরাধে মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবনের মতো চরম সাজার বিধান থাকা আসামিদের খালাস পাওয়ার একটি কারণ। সাজা কম হলে শাস্তি পাওয়া বাড়ে। তা ছাড়া, আইনে কিছু অপরাধের ধারা ঢালাও হওয়ায় মিথ্যা মামলা দায়েরের সুযোগ বেশি। পাল্টা মামলা না করায় ‘মিথ্যা মামলা’র অভিযোগের সুরাহা হচ্ছে না।
আইনে তদন্ত ও বিচারের জন্য সময়সীমাসহ পুলিশ, ডাক্তার, পিপি ও ট্রাইব্যুনালের জবাবদিহির বিধান আছে। কিন্তু শেষের দুই ক্ষেত্রে বিচ্যুতির শাস্তি সুনির্দিষ্ট নয়। বিধি না থাকায় অনেক কাজের পদ্ধতি সুনির্দিষ্ট হচ্ছে না। জবাবদিহি হওয়ার হিসাব-কিতাব বা নজরদারি নেই। আর ভুক্তভোগীর ভোগান্তির শেষ নেই।
- প্রথম আলো/৮-৩-১৮