* দেশে চলছে নির্বাচিত স্বৈরশাসন, র্যাগিংয়ের দায়ে ছাত্রলীগের বহিষ্কৃতদের কেউ দাড়িওয়ালা ছেলেকে দিয়ে এটা ঘটিয়েছে কিনা দেখতে হবে -ডা. জাফরুল্লাহ
* ঝুঁকিতে ব্যাংক খাত, দুর্নীতির মাধ্যমে ব্যাংকের টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে -সালেহউদ্দিন আহমেদ
* দুর্নীতিবাজদের পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক মহাশক্তিশালী ক্ষমতাবানরা -আনু মুহাম্মদ
জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক সেমিনারে বক্তারা বলেন, দেশে নির্বাচিত স্বৈরশাসন চলছে । দেশে দুর্নীতির সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ভেঙে পড়ায় সর্বত্র দুর্নীতি ঢুকে পড়েছে। দুর্নীতি মহামারী আকার ধারণ করেছে। অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত হলে বদলাতে পারে পরিস্থিতি। নইলে জনগণকে আরও খেসারত দিতে হবে।
নাগরিক ঐক্য আয়োজিত ‘দুর্নীতি’ শীর্ষক এক সেমিনারের আলোচকরা এসব কথা বলেন। এতে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না। আলোচনায় অংশ নেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন, এম হাফিজ উদ্দিন খান, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ, তেল গ্যাস খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, গবেষক গওহর নাঈম ওয়ারা প্রমুখ। সেমিনারে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন নাগরিক ঐক্যের সদস্য জাহেদ-উর-রহমান।
অনুষ্ঠানে বক্তারা আরও বলেন, গণতন্ত্র না থাকায় দেশে বাকস্বাধীনতা ও জবাবদিহিতা বলতে কিছু নেই। সরকার সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করায় দুর্নীতি লাগামহীন হয়ে পড়েছে। দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য সবাইকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানানো হয়। তারা বলেন, দুর্নীতিবাজদের দৃষ্টান্তমূলক ও দৃশ্যমান শাস্তি দিতে হবে। একই সঙ্গে তাদের পেছনের খেলোয়াড়দেরও শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এ কাজগুলো করতে হলে দুর্নীতিবাজদের তাড়িয়ে ভালো লোকজনকে সামনে নিয়ে আসতে হবে।
সেমিনারে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন বলেন, দেশে নতুন শক্তি হিসেবে দুর্নীতির আবির্ভাব হয়েছে। দেশে স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠায় আমাদের পুলিশ, আমাদের কর্মকর্তারা সাহায্য করছেন। দেশের শান্তি বিনষ্ট হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলো আলোচনা করে শান্তি আনতে পারে। তিনি আরও বলেন, রাজনীতিতে উগ্র বামপন্থীদের প্রভাব ব্যাপক। তারা আমাদের রাজনীতি ধ্বংস করে দিচ্ছে।
এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, দেশে নাগরিকরা কোনো কথা বলছেন না। সব কথা বলছে সরকার। সরকার বলছে, সংবিধান অনুযায়ী পার্লামেন্ট ভাঙা যাবে না, সেনা মোতায়েন করা যাবে না। কারণ এসব সংবিধানে নেই। সরকার যখন বলে প্রশ্ন ফাঁস আগেও হয়েছে তখন প্রশ্ন ফাঁস ঠেকানো যাবে না। তিনি মনে করেন, বড় ধরনের গণআন্দোলন ছাড়া দেশকে এ পরিস্থিতি থেকে বের করে আনা সম্ভব নয়।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, সব দুর্নীতির মূল কারণ সরকার। দুর্নীতির কারণে দেশের অবস্থা ভালো না। তিনি বলেন, বড় প্রকল্পে বড় দুর্নীতি হচ্ছে। সেগুলোয় দুর্নীতির বিষয় খতিয়ে দেখা দরকার। বিশিষ্ট লেখক অধ্যাপক ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলার বিষয়ে তিনি বলেন, র্যাগিংয়ের দায়ে ছাত্রলীগের বহিষ্কৃতদের কেউ হাবাগোবা দাড়িওয়ালা ছেলেকে দিয়ে এ ঘটনা ঘটিয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংকিং খাত আগে অনেক ভালো ছিল। বর্তমানে অনেক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ব্যাংকের টাকা দুর্নীতির মাধ্যমে বিদেশে পাচার হচ্ছে। রাজনৈতিক কারণে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা না নেয়ায় ব্যাংক খাতে দুর্নীতি হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। সাবেক এ গভর্নর বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনেক শক্তিশালী নর্মস রয়েছে। সেগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে না। ফলে ব্যাংক খাত ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ব্যাংক ধ্বংস হলে সব ধ্বংস হয়ে যাবে বলে মনে করেন সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, দুর্নীতিবাজদের শাস্তি না দিয়ে শুধু ওএসডি করে নিশ্চিন্তে অবসরে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়। তাদের ওএসডি না করে শাস্তি দিন। তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করুন। এদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই।
তেল গ্যাস খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, সরকার মেগা প্রজেক্ট চালু করছে। প্রজেক্টের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি করছে। আর এই দুর্নীতি অবাধ রাখতে দেশে স্বৈরশাসন কায়েম করে জবাবদিহিতা ও বাকস্বাধীনতা বন্ধ করে দিচ্ছে সরকার। তিনি আরও বলেন, যারা টাকা পাবে তাদেরই যদি বাজেট তৈরি করতে দেয়া হয়, তাহলে দুর্নীতি থামানো যাবে কী করে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, বিচার ব্যবস্থায় ইনভেস্টিগেশন এবং প্রসিকিউশন কুক্ষিগত করা হয়েছে। আদালতের কী অবস্থা তা সবার জানা। নিু আদালত এবং উচ্চ আদালতে কী হয় তা বলার অধিকার আইন দিয়ে খর্ব করা হয়েছে।
গবেষক গওহর নাঈম ওয়ারা বলেন, আমাদের দেশে ফাঁক রেখে আইন করা হয়। প্রক্রিয়াগতভাবে দুর্নীতি আমাদের ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে। এই যে নির্বাচনের বছর এলেই নানারকম আন্দোলন, দাবি-দাওয়া আমরা এই প্রেস ক্লাবের সামনেই দেখি। এই দাবি-দাওয়া একটি সুনির্দিষ্ট জায়গায় যাওয়ার কথা ছিল। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ব্যর্থ হওয়ার কারণেই আমরা রাস্তায় আন্দোলন দেখতে পাই। আমাদের কর্মকর্তারা প্রকল্পের কাজ খুব ভালোবাসেন। কারণ, সেখানে দুর্নীতি করা যায়। প্রকল্পে বদলি করা হলে কর্মকর্তারা খুশি হন। কিন্তু কুতুবদিয়ায় পাঠানো হলে তাদের মন খারাপ হয়।
সভাপতির বক্তব্যে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, জাফর ইকবালের ওপর হামলা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন- এগুলো যারা করে তারা বিপথগামী, এটা করে বেহেশতে যাওয়া যায় না। খুন-জখম করে বেহেশতে যাওয়া যায় না ঠিকই, তাহলে ক্রসফায়ার করে কীভাবে বেহেশতে যাওয়া যায়? মানুষকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যায়, মাসের পর মাস খোঁজ থাকে না। ছয় মাস এক বছর পর লাশ পাওয়া যায়। কার বা কাদের নির্দেশে ক্রসফায়ার হয়? দেখতে দেখতে সবার ভেতর একটা ভয় ঢুকে গেছে। তিনি বলেন, ভোটারবিহীন নির্বাচন করে তারা গায়ের জোরে ক্ষমতায় আছে। আজ যদি আমরা কথা বলতে পারি, সারা দেশে যদি আমাদের কথা বলতে দেয়া হয়, তবে আশা করি ছয় থেকে এক বছরের মধ্যে কথার কারণেই এ সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরানো সম্ভব। কিন্তু তারা এ কথা বলতে দেয়াকেই ভয় পায়।
- Courtesy: The Daily Jugantor Mar 06, 2018
No comments:
Post a Comment