Search

Sunday, March 18, 2018

প্রকল্পের শুরুতেই বড় ঘাপলা!

ঘোড়াশাল-পলাশ ইউরিয়া সার কারখানা পুনঃস্থাপন



সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ‘ঘোড়াশাল-পলাশ ইউরিয়া ফার্টিলাইজার’ প্রকল্পের শুরুতেই অনিয়মের অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, গণখাতে ক্রয় আইন (পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অ্যাক্ট বা পিপিএ) এবং গণখাতে ক্রয় বিধি (পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস বা পিপিআর) লংঘন করে প্রকল্পের কাজ সর্বোচ্চ দরে দেয়ার সব আয়োজন সম্পন্ন করা হয়েছে।

বিধান অনুযায়ী, দরপত্র আহ্বানের আগে প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় নির্ধারণের বাধ্যবাধকতা থাকলেও সেটি অনুসরণ করা হয়নি। এমনকি প্রকল্প সমাপ্তির সময়সীমা ৩৩ মাস নির্ধারিত থাকলেও নিয়মবহির্ভূতভাবে তা বাড়িয়ে ৩৯ মাস করা হয়েছে। এতে সরকারের অতিরিক্ত ব্যয় হবে প্রায় ১৪৭৩ কোটি টাকা।

শুধু তাই নয়, ঠিকাদার নিয়োগে ‘উন্মুক্ত পদ্ধতি’তে প্রাকযোগ্যতা যাচাই করে চারটি প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচন করা হয়। পরবর্তীকালে এ চারটি থেকে একটিকে বাছাই করতে ‘এক ধাপ দুই খাম’ পদ্ধতিতে পুনরায় কারিগরি ও আর্থিক প্রস্তাব নিতে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। পিপিআরের বিধান অনুযায়ী কোনো দরপত্রে দুই পদ্ধতি অনুসরণের কোনো সুযোগ নেই। এমন পরিস্থিতিতে ‘দরপত্র আহ্বান ও মূল্যায়ন’ প্রক্রিয়া সঠিকভাবে হয়নি- এ মর্মে লিখিতভাবে দুই দফা মতামত দিয়েছে ক্রয় আইন ও বিধির ব্যাখ্যাদানকারী পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট (সিপিটিইউ)। এরপরও এটি অনুমোদনের জন্য শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির কাছে সুপারিশ করা হয়েছে। সরকারের কতিপয় ব্যক্তিরা অনৈতিক সুবিধা বাগিয়ে নিতে পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ দিতেই এ সুপারিশ করা হয়েছে বলে সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ করা হয়েছে।

এদিকে অর্থ মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, অভিযোগের বিষয়টি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির আহ্বায়ক ও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে উত্থাপন করা হয়েছে। ‘দরপত্রে বিসিআইসি-শিল্প মন্ত্রণালয়ের ক্রয় বিধি লঙ্ঘন, অনিয়ম ও জালিয়াতি; ঘোড়াশাল পলাশ ইউরিয়া সার কারখানা প্রকল্পের দুর্নীতিতে প্রধানমন্ত্রী ও ক্রয় কমিটির সদস্যদের ফাঁসানোর ব্যবস্থা’ শিরোনামের ওই অভিযোগের সত্যতা যাচাই করতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে নির্দেশ দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এ নির্দেশের পরপরই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে ২৭ ফেব্র“য়ারি শিল্প সচিব মোহাম্মদ আবদুল্লাহর কাছে চিঠি দিয়ে লিখিতভাবে অভিযোগের ব্যাখা চাওয়া হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ক্রয় ও অর্থনৈতিক অধিশাখার উপসচিব মো. মেহেদী হাসান স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, ‘অভিযোগের বিষয়গুলো যাচাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে জানাতে নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হল।’

এছাড়া ওই প্রকল্পের ঠিকাদার নিয়োগে অনিয়মের বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) নজরে এসেছে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পরবর্তী প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে জানায় দুদক সূত্র। ঘোড়াশাল ইউরিয়া সার কারখানা ৪৪ বছর এবং পলাশ ইউরিয়া সার কারখানা ২৯ বছরের পুরনো। আয়ুষ্কাল ফুরিয়ে যাওয়ায় এ দুটি সার কারখানার উৎপাদন চালিয়ে যাওয়া অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক বিবেচিত হচ্ছে না। এ অবস্থায় ২০১৪ সালের ২৪ আগস্ট শিল্প মন্ত্রণালয় পরিদর্শনের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পলাশ ও ঘোড়াশাল সার কারখানা দুটির পুরনো যন্ত্রপাতির পরিবর্তে নতুন যন্ত্রপাতি স্থাপন করে দ্রুত নতুন সার কারখানা স্থাপনের নির্দেশ দেন। এরপর উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে কাজটি করার উদ্যোগ নেয়া হয়।

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, প্রকল্পটি আরও কম খরচে বাস্তবায়নের সুযোগ ছিল। কিন্তু শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিসিআইসির মূল্যায়ন কমিটি এতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। অসৎ উদ্দেশ্যে ও অনৈতিক সুবিধা বাগিয়ে নিতে তারা একমাত্র বা সর্বোচ্চ দরদাতার মাধ্যমে সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়েই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য অনড় থাকেন। উন্মুক্ত পদ্ধতির মাধ্যমে প্রাকযোগ্যতা যাচাই করে ১১টি প্রতিষ্ঠান থেকে ৪টিকে যোগ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

কিন্তু নিয়মবহির্ভূতভাবে ‘এক ধাপ, দুই খাম’ পদ্ধতি অনুসরণ করে একটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়ার সুপারিশ করা হয়। এ পদ্ধতি অন্য তিন প্রতিষ্ঠানকে যাচাই-বাছাই করা হয়নি। এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সিপিটিইউ সুস্পষ্টভাবে আপত্তি দিয়ে শিল্প মন্ত্রণালয় ও বিসিআইসিকে লিখিতভাবে জানিয়েছে, ‘একই ক্রয়ে একটি পদ্ধতি চলমান থাকা অবস্থায় অন্য পদ্ধতি অনুসরণ করার সুযোগ নেই।

এক্ষেত্রে এক ধাপ, দুই খাম অনুসরণ করতে হলে, আগের প্রক্রিয়াটি (প্রাকযোগ্যতা যাচাইয়ে ব্যবহৃত উন্মুক্ত পদ্ধতি) বাতিলপূর্বক এক ধাপ, দুই খাম পদ্ধতি উল্লেখপূর্বক উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মতো বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ও বিধি-৬৮ খ, ৬৮গ, ৬৮ঙ অনুসরণে প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে।’ কিন্তু ঠিকাদার নিয়োগে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের এ সুপারিশ বাস্তবায়ন করেনি শিল্প মন্ত্রণালয়।

‘এক ধাপ দুই খাম’ পদ্ধতি হচ্ছে ঠিকাদার নির্বাচনের জন্য দুটি মূল্যায়ন কমিটি গঠন। এর একটি কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি এবং অপরটি হচ্ছে আর্থিক মূল্যায়ন কমিটি। কারিগরি মূল্যায়ন কমিটির কাজ হচ্ছে- সক্ষমতার ভিত্তিতে প্রাকযোগ্যদের মধ্য থেকে একটি প্রতিষ্ঠানকে বাছাই করবে। আর আর্থিক কমিটির কাজ হচ্ছে- কারিগরি কমিটির সুপারিশকৃত প্রতিষ্ঠানের আর্থিক প্রস্তাব চূড়ান্ত করবে।

প্রকল্পের প্রাক-বাস্তবায়ন পর্যায়ে এসব অনিয়ম সম্পর্কে জানতে চাইলে শিল্প সচিব মোহাম্মদ আবদুল্লাহ ২৮ ফেব্র“য়ারি যুগান্তরকে বলেন, প্রকল্পটি এখনও প্রি-ম্যাচিউরড অবস্থায় আছে। এখনই এ বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই। যদি নিয়মের ব্যত্যয় ঘটে থাকে, তাহলে কাজটি যারা করেছে (বিসিআইসির মূল্যায়ন কমিটি) তাদের প্রশ্ন করেন কোথায় কী হয়েছে?

মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়ে সবকিছু করা হয়েছে বিসিআইসির মূল্যায়ন কমিটির এমন দাবি প্রসঙ্গে জিজ্ঞাস করা হলে শিল্প সচিব বলেন, ‘যদি কেউ বলে থাকেন, এটা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে করা হয়েছে, তাহলে সে নির্দেশনা কে দিয়েছে, তাদের বলতে বলুন। কেউ যদি আমার নাম বলে থাকে, তাহলে আমি আমার মতো করে জবাব দেব। এর বেশি কিছু বলব না। কিছু পেলে আপনারা ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখতে পারেন।’

অভিযোগের বিষয়গুলো যাচাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশ প্রসঙ্গে জানতে ১২ মার্চ দুপুর ১২টার দিকে শিল্পসচিবের দফতরে উপস্থিত হন যুগান্তরের সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদক। কিন্তু তিনি সাক্ষাৎ করেননি। তবে তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তার মাধ্যমে জানিয়ে দেন, তিনি (শিল্প সচিব) এ প্রসঙ্গে কোনো কথা বলবেন না।

এদিকে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) মহাপরিচালক মো. ফারুক হোসেন যুগান্তরকে বলেন, গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে ঠিকাদার নিয়োগে আহূত দরপত্র ও মূল্যায়ন প্রক্রিয়াটি সঠিক হয়নি। বিসিআইসি ও শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে সিপিটিইউর মতামত চাওয়া হয়েছিল। আমরা একাধিকবার এ সংক্রান্ত পর্যবেক্ষণ দিয়ে বলেছি যে, প্রক্রিয়াটি সঠিক হচ্ছে না। এরপরও তারা তাদের মতো করেই ঠিকাদার নিয়োগের প্রক্রিয়া শেষ করেছেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থেই প্রধানমন্ত্রী দ্রুতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছেন। এরপর নিয়ম মেনে প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব পেয়েছে সংশ্লিষ্ট সংস্থা। সেখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত কাউকে তো তিনি (প্রধানমন্ত্রী) যুক্তিসঙ্গত নয়, এমন কিছু করতে বলেননি। দ্রুততার সঙ্গেই নিয়ম মেনে প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা যেত। বাস্তবতা হচ্ছে, এ প্রকল্পের দরপত্র আহ্বান ও মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় তার ব্যত্যয় ঘটেছে, যা ক্রয় আইন ও ক্রয়বিধির সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ নয়।

দুদকে দাখিল করা অভিযোগপত্র থেকে জানা গেছে, প্রকল্পে সর্বোচ্চ দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে ঠিকাদার নিয়োগ দেয়ার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হয়। অথচ ঠিকাদার নিয়োগে আহূত দরপত্র পদ্ধতিই সঠিকভাবে মানা হয়নি। এখানে পরিকল্পিতভাবে উপেক্ষা করা হয় দরপত্র আহ্বানের পদ্ধতি ও ক্রয় আইন। এ ব্যাপারে সিপিটিইউর দেয়া দুই দফা মতামতও উপেক্ষা করে প্রাথমিক দরপত্র আহ্বানের পর প্রাকযোগ্যদের মধ্য থেকে ‘এক ধাপ দুই খাম’ পদ্ধতিতে পুনরায় দরপত্র আহ্বান করা হয়। এতে উন্মুক্ত দরপত্রে অবাধ প্রতিযোগিতা ক্ষু্ণ্ণ হয় এবং এ কার্যক্রমে স্বচ্ছতাও নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এসব প্রক্রিয়ায় জারিকৃত সংশ্লিষ্ট প্রজ্ঞাপনের কার্যপরিধি (টার্মস অব রেফারেন্স) সঠিকভাবে অনুসরণ করেনি। নিয়ম অনুযায়ী পিপিআরের বিধি ১৬-এর উপবিধি (৫ক) ও (৫খ) অনুযায়ী দরপত্র আহ্বানের আগে প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় নির্ধারণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু এখানে সেটি করা হয়নি।

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, পছন্দের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে সর্বোচ্চ দরে কাজ পাইয়ে দিয়ে মোটা অঙ্কের আর্থিক সুবিধা লাভের উদ্দেশ্যেই এসব অনিয়মের আশ্রয় নেয়া হয়েছে। যার নেপথ্যে ভূমিকা রেখেছে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সংস্থা বিসিআইসি ও নিয়ন্ত্রণাধীন শিল্প মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা। এই প্রস্তাব সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে অনুমোদিত হলে এর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে।

অনিয়মের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের (বিসিআইসি) চেয়ারম্যান শাহ মো. আমিনুল হক যুগান্তরকে বলেন, ‘বিসিআইসিতে আমি সদ্য যোগদান করেছি। আপনি আমাকে হাজারবার বললেও সঠিক উত্তর দিতে পারব না। কারণ এ প্রক্রিয়ায় ঘটেছে বা কী আছে, সেটি আমার নজরে নেই।’

তবে বিসিআইসির প্রকল্প পরিচালক ও ঘোড়াশাল-পলাশ ইউরিয়া সার কারখানা স্থাপনে দরপত্র আহ্বান ও উন্মুক্তকরণে গঠিত মূল্যায়ন কমিটির সদস্য সচিব রাজিউর রহমান মল্লিক দাবি করেন, কোথাও কোনো ধরনের অস্বচ্ছতা নেই। সবকিছু নিয়ম-কানুন মেনেই করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়েই সবকিছু করা হয়েছে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রাকযোগ্য চারটি প্রতিষ্ঠানের মধ্য থেকে চূড়ান্তভাবে একটিকে নির্বাচিত করতে টেকনিক্যাল (কারিগরি) ও ফিন্যান্সিয়াল (আর্থিক) নামে দুটি মূল্যায়ন কমিটি করা হয়েছে। বিসিআইসির দরপত্রের শর্তাবলীতে যেসব শর্ত ছিল ওই চার প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কেবল একটি প্রতিষ্ঠানই সেসব শর্ত পূরণ করতে পেরেছে। যাকে আমরা নির্বাচিত করেছি।

শর্তের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, আমরা চেয়েছি স্টিম টারবাইন, কিন্তু অনির্বাচিতরা প্রস্তাব করেছে গ্যাস টারবাইনের। ফলে টেকনিক্যাল কমিটির বিবেচনায় ওই তিনটি উত্তীর্ণ হয়নি। একইভাবে যোগ্য হিসেবে বিবেচিত না হওয়ার কারণে তাদের আর্থিক প্রস্তাবও আর খোলা হয়নি। অন্যদিকে যে প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচিত করা হয়েছে, তারা আমাদের শর্তাবলী পূরণ করেছে। পরে আর্থিক মূল্যায়ন কমিটি তাদের জমাকৃত আর্থিক প্রস্তাব খুলে জানতে পারে, প্রকল্প ব্যয় সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা প্রস্তাব করেছে নির্বাচিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যে সর্বোচ্চ দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়ার বিষয়টি সত্য নয় বলেও দাবি করেন তিনি।

২০১৫ সালের ৪ নভেম্বর অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় দুটি সার কারখানায় ব্যবহৃত গ্যাসে পলাশের খালি জায়গায় এই নতুন সার কারখানা স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। এ সুপারিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হলে তা অনুমোদন করেন তিনি। মন্ত্রিসভা কমিটির ওই সভায় প্রকল্পটির দরপত্র ‘এক ধাপ, দুই খাম’ পদ্ধতিতে আহ্বানের জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হলেও তা উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে বলা হয়।

এরপরই বিসিআইসি প্রকল্প বাস্তবায়নে ঠিকাদার নিয়োগের উদ্যোগ নেয়। যার ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালের ১৪ জানুয়ারি এই প্রকল্পের জন্য দরদাতা নির্বাচনের প্রথম পর্যায়ে প্রাকযোগ্যতা নির্ধারণের জন্য আগ্রহ প্রস্তাব (এক্সপ্রেশন অব ইন্টারেস্ট বা ইওআই) আহ্বান করা হয়। এতে ১১টি প্রতিষ্ঠান প্রস্তাব জমা দেয়। উন্মুক্ত পদ্ধতির মাধ্যমে এই ১১টির মধ্য থেকে চারটিকে বাছাই করা হয়। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে- ১. চায়না হুয়াংজিও কন্ট্রাক্টিং অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন (এইচকিউসি), চায়না অ্যান্ড টেকনিপ, ইতালি। ২. মিৎসুবিসি হেভি ইন্ডাস্ট্রিজ লি., (এমএইচআই) জাপান ও সিসি-সেভেন জেভি। ৩. উহুয়ান ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন লি., চায়না অ্যান্ড চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইম্পোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট কর্পোরেশন (সিএমসি) এবং ৪. চায়না ন্যাশনাল টেকনিক্যাল ইম্পোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট কর্পোরেশন (সিএনটিআইসি)-বেইজিং হুয়াফু ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন লি. (এইচএফইসি) কনসোর্র্টিয়াম চায়না।

এরপর একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে চূড়ান্ত করতে ২০১৬ সালের ১ আগস্ট শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে ‘এক ধাপ দুই খাম’ পদ্ধতিতে বাস্তবায়নের জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের (সিপিটিইউ) মতামত চেয়ে চিঠি দেয়। কিন্তু সিপিটিইউর দু’দফা আপত্তিসহ উল্লিখিত মতামত উপেক্ষা করে সর্বোচ্চ দরদাতা জাপানের মিৎসুবিসি হেভি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডকে (এমএইচ আই) যোগ্য বিবেচিত করা হয়।

মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় যেসব বিচ্যুতি : দুদকে দাখিল করা অভিযোগপত্র থেকে জানা গেছে, পিপিআরের বিধি ১৬-এর উপবিধি (৫ক) ও (৫খ) অনুযায়ী দরপত্র আহ্বানের আগে প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় নির্ধারণের বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা করা হয়নি। সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় সার কারখানা নির্মাণ ব্যয় ৮০ কোটি ৯০ লাখ ডলার দেখানো হয়। কিন্তু এমএইচআই-সিসি-সেভেন জেভির সঙ্গে ১০৩ কোটি ডলারের ইপিসি চুক্তির সুপারিশ করা হয়েছে। এতে নিয়ম অনুযায়ী দেশীয় মুদ্রা কত হবে- তা উল্লেখ করা হয়নি। সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় প্রকল্প বাস্তবায়নে যে ব্যয়ের কথা বলা হয়েছে, তার চেয়ে ২১ কোটি ১০ লাখ ডলার বা ১৮০০ কোটি টাকারও বেশি দরে ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছে। এছাড়া প্রকল্পের বাস্তবায়নকাল দরপত্রে নির্ধারিত ৩৩ মাস থেকে ৬ মাস বেশি অর্থাৎ ৩৯ মাসের প্রকল্প কাজ শেষে হবে। এ ছয় মাস বেশি সময় ধরায় বিসিআইসির ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ১৪৭৩ কোটি টাকা। কিন্তু দরপত্র মূল্যায়নে গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।

অভিযোগপত্রে আরও উল্লেখ করা হয়, উন্মুক্তকরণ কমিটির কার্যপরিধিতে পিপিআরের ৯৭ বিধি অনুসরণের মাধ্যমে চেকলিস্ট তৈরি করতে বলা হলেও কমিটির সদস্য সচিব মো. রাজিউর রহমান মল্লিক চার দরদাতার দর প্রস্তাব উন্মুক্ত করার সময় ৯৭ বিধির উপবিধি (৪)(ই) অনুযায়ী দরপত্র মূল্য উল্লেখ করেননি এবং তুলনামূলক দর বিবরণীও তৈরি করেননি। বরং দরদাতাদের আর্থিক প্রস্তাব না খুলে সেটি রেখে দিয়েছেন, যা ৯৭ বিধির লঙ্ঘন।

প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়সীমা নির্ধারিত আছে ৩৩ মাস। নির্বাচিত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান এমএইচআই-সিসি সেভেন (জেভি) তা ৪৪ মাসে বাস্তবায়নের প্রস্তাব দিয়েছে। শিল্প সচিব মুহাম্মদ আবদুল্লাহ স্বাক্ষরিত ক্রয় প্রস্তাব বা সারসংক্ষেপে ঠিকাদারের প্রকল্পটি ৩৯ মাসে বাস্তবায়ন করার তথ্য দেয়া হয়েছে। পিপিআরের ৯৮ বিধি অনুযায়ী দরপত্রে নির্ধারিত বাস্তবায়নকাল পরিবর্তনের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঠিকাদারের ৪৪ মাস বাস্তবায়নকাল দরপত্রের ৩৩ মাসের চাহিদা পূরণ করে না। অর্থাৎ শিল্প সচিব ক্রয় কমিটিকে মূল্যায়ন প্রতিবেদন সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য দেননি বলে দুদকে দাখিল করা অভিযোগ পত্রে উল্লেখ করা হয়।

  • যুগান্তর/১৮-৩-১৮

No comments:

Post a Comment