আনু মুহাম্মদ
বাংলাদেশে গত এক দশকে জিডিপির প্রবৃদ্ধি তুলনামূলকভাবে বেশ ভালো হচ্ছে। এ ধারায় জাতিসংঘের তালিকাবিন্যাসে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের প্রাথমিক শর্ত পূরণ করেছে। এ শর্তপূরণকারী দেশ ও দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে আরো আছে লাওস এবং মিয়ানমার। তিনটি দেশকেই আরো কয়েক বছর পরীক্ষা দিয়ে যেতে হবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পাওয়ার জন্য। অবশ্য এদিক থেকে আরো এগিয়ে আছে ভুটান, কিরিবাতি সাওতোম ও সলোমন দ্বীপপুঞ্জ। তারা এরই মধ্যে সব শর্ত পূরণ করে অর্থাৎ জাতীয় আয় ও শিক্ষা-চিকিৎসার শর্ত পূরণ করে স্বল্পোন্নত দেশের গ্রুপ থেকে বের হওয়ার এবং উন্নয়নশীল দেশের কাতারে দাঁড়ানোর যোগ্যতা অর্জন করেছে।
সরকারি হিসাবে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এখন বার্ষিক ১ হাজার ৬০০ মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মাথাপিছু আয় ও জিডিপির প্রবৃদ্ধির হারও বেশ ভালো। তবে তার পদ্ধতিগত বিষয় নিয়ে সেখানকার অর্থনীতিবিদরা অনেক প্রশ্ন তুলছেন, বিতর্ক হচ্ছে। তার মধ্য দিয়ে মানুষের মধ্যেও এ সম্পর্কে ধারণা পরিষ্কার হচ্ছে। ডাটার গ্রহণযোগ্যতা, বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের তথ্য-উপাত্ত, পরিসংখ্যান, হিসাব-নিকাশ, প্রবৃদ্ধির গতি-প্রকৃতি নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ অনেক বেশি থাকলেও বাংলাদেশে এ নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা নেই, কোনো বিতর্ক নেই। সরকারি ভাষ্যের সঙ্গে মেলে না এ রকম যুক্তি, তথ্য, প্রশ্ন আর বিতর্ক সরকার পছন্দ করে না বলে প্রায় সব অর্থনীতিবিদ, থিংক ট্যাংক, মিডিয়াও বিনা প্রশ্নে সব গ্রহণ করতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। জিডিপি উচ্ছ্বাসে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে অনেক জরুরি প্রশ্ন।
যা-ই হোক, কতটা এবং কীভাবে তা নিয়ে অনেক প্রশ্নের অবকাশ থাকলেও জাতীয় আয় যে বেড়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কোনো দেশের অর্থনীতিকে জিডিপি/জিএনপি দিয়ে পরিমাপ করায় বিশ্বব্যাংক-আইএমএফই প্রধান পথনির্দেশকের ভূমিকা পালন করে। বিশ্বব্যাংকই সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করে থাকে। এগুলো হলো: ১. নিম্ন আয়ভুক্ত দেশ (মাথাপিছু আয় ১ হাজার ২৫ মার্কিন ডলার পর্যন্ত) ২. নিম্নমধ্যম আয়ভুক্ত দেশ (১ হাজার ২৬ মার্কিন ডলার থেকে ৪ হাজার ৩৫ ডলার) ৩. উচ্চমধ্যম আয় (৪ হাজার ৩৬ মার্কিন ডলার থেকে ১২ হাজার ৪৭৫ ডলার) ৩. উচ্চ আয়ভুক্ত দেশ (১২ হাজার ৪৭৬ মার্কিন ডলার থেকে বেশি)।
সে হিসাবে বাংলাদেশের মানুষের বার্ষিক গড় আয় মাথাপিছু ১ হাজার ২৫ ডলার অতিক্রম করায় বাংলাদেশ ২০১৩ সাল থেকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের নিম্ন আয়ভুক্ত দেশের তালিকা থেকে নিম্নমধ্যম আয়ের তালিকায় প্রবেশ আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হলে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর নিয়মকানুন অনুযায়ী সুবিধা-অসুবিধার কিছু পরিবর্তন হবে। যেমন— নিম্ন আয়ভুক্ত দেশগুলোর জন্য বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিশেষ সুবিধা আর পাবে না। এছাড়া স্বল্প সুদে ঋণ পাওয়ার বিবেচনার মধ্যেও বাংলাদেশ আর থাকতে পারবে না।
ভারতের অর্থনীতির ভিত বাংলাদেশের চেয়ে শক্ত হলেও গতি-প্রকৃতিতে অভিন্নতা আছে। সে দেশে মাথাপিছু আয় এখন প্রায় ১ হাজার ৮০০ মার্কিন ডলার। পাশাপাশি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রায় ৭০ শতাংশ ভারতীয় জনগণের আয় দৈনিক ১ দশমিক ২৫ মার্কিন ডলারেরও নিচে (বৈশ্বিকভাবে গৃহীত দারিদ্র্য সূচক) বা ১০০ রুপির নিচে, যদিও তাদের জাতীয় গড় মাথাপিছু আয় বছরে ১ লাখ রুপি বা দিনে ২৫৫ রুপি।
একটি দেশে জিডিপি অনেক বেশি হলেও টেকসই উন্নয়ন দুর্বল হতে পারে। মাথাপিছু আয় বেশি হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনযাত্রার মান নিম্ন হতে পারে। এ বিষয়ে অমর্ত্য সেন অনেক কাজ করেছেন। ভারতের ভেতরেই রাজ্য থেকে রাজ্যের তফাত দেখিয়েছেন। আফ্রিকার বহু দেশে মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের চেয়ে বেশি, মধ্যম আয়ের বিবরণে তারা বাংলাদেশ থেকে অনেক আগে থেকেই এগিয়ে, কিন্তু মানুষের জীবনযাত্রার মান নিম্ন। মিয়ানমারে মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের সমান, মানে তারাও নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ। মিয়ানমারও একই সঙ্গে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে যাওয়ার শর্ত পূরণ করেছে। নাইজেরিয়ার মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের দ্বিগুণেরও বেশি। কিন্তু তাদের জীবনযাত্রার মান বাংলাদেশের চেয়ে দ্বিগুণ ভালো, এটা বলা যাবে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বরং আরো খারাপ। সেজন্য মানব উন্নয়ন সূচকে নাইজেরিয়া বাংলাদেশেরও পেছনে।
সেজন্য মাথাপিছু আয় দিয়ে একটি দেশের আর্থিক লেনদেন বা বাণিজ্যিক উৎপাদন, বিতরণ, পরিষেবার বিস্তার সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় কিন্তু তা দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সামাজিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বোঝা যায় না। যে সমাজে বৈষম্য বেশি, সেখানে গড় আয়ের হিসাব বরং বিভ্রান্তিকর তথ্য দেয়। একটি পরিবার যদি ১০ লাখ টাকা আয় করে, পাশাপাশি অন্য একটি পরিবার যদি ১০ হাজার টাকা আয় করে, তাহলে উভয় পরিবারের গড় আয় হবে ৫ লাখ ৫ হাজার টাকা। এতে কি দুই পরিবারের প্রকৃত অবস্থা বোঝা যায়? বর্তমান মাথাপিছু আয় হিসাবে আমাদের দেশে চার সদস্যের পরিবারের বার্ষিক গড় আয় হয় প্রায় ৬ দশমিক ৫ হাজার মার্কিন ডলার, অর্থাৎ মাসে প্রায় ৫২ হাজার টাকা। তার মানে বাংলাদেশের সব নাগরিক— শিশু, বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ সবারই মাথাপিছু আয় মাসে এখন প্রায় ১৩ হাজার টাকা। অথচ সরকারি পরিসংখ্যান বলে, বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ মানুষের মাসিক আয় এর থেকে অনেক নিচে।
প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু গড় আয় যত, ৮০ শতাংশ মানুষ পায় তার মাত্র ৩০ শতাংশ। জাতীয় আয়ের বিন্যাসে ৫ শতাংশের হাতে ২৭ শতাংশ। এ হিসাবে চোরাই টাকার হিসাব ধরা হয়নি, যারা লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে, তাদের সম্পদের বড় অংশ এ হিসাবে নেই। একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর হাতে বিপুল পরিমাণ সম্পদ কেন্দ্রীভূত হওয়ার ফলে জিডিপি ফুলেফেঁপে উঠলেও মানুষের অবস্থা অপরিবর্তিত থাকে। সেজন্য গত সাত বছরের পরিসংখ্যানে আমরা দেখছি মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ হয়েছে কিন্তু কার্যত সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রশ্ন, আমার আয় কোথায় গেল? শিক্ষিত বেকারদের কাছ থেকে প্রশ্ন আসতে পারে, আমার কাজ আমার আয় কোথায় গেল?
বস্তুত, বাংলাদেশের জিডিপি ও মাথাপিছু আয়ের স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধির পেছনে বড় অবদান হচ্ছে প্রবাসী আয়ের। এছাড়া আছে গার্মেন্টস ও কৃষি। অথচ এ তিন ক্ষেত্রে যুক্ত শ্রমজীবী মানুষের আয় এবং জীবনের নিরাপত্তা দুটিই ঝুঁকিপূর্ণ, অনিশ্চিত। চোরাই অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের সন্ত্রাসী ও দুর্নীতিমূলক তত্পরতায় জিডিপি বাড়ে কিন্তু সমাজের বড় একটা অংশের জীবন-জীবিকা বিপদগ্রস্ত হয়। নদী-নালা, খাল-বিল, বন দখল ও ধ্বংসের মাধ্যমেও জিডিপি বাড়তে পারে কিন্তু তা দীর্ঘমেয়াদে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করে না; বরং অর্থনীতিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে। এসব তত্পরতায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রকৃত আয় বৃদ্ধি পায় না; বরং জীবনমান বিপর্যস্ত হয়। দুর্নীতি ও অপচয়ের কারণে প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি পেলেও তার কারণে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিও বড় দেখায়, জিডিপির অংকও বাড়ে। একই সময়ে শিক্ষা ও চিকিৎসার সুযোগ কমে এসেছে এর ব্যয় বৃদ্ধির কারণে। কিন্তু এ ব্যয় বৃদ্ধি আবার জিডিপি বাড়ায়।
জিডিপি/জিএনআই ও মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে উন্নয়ন পরিমাপ করা নিয়ে মূলধারার অর্থশাস্ত্রেও এখন সংশয় ও প্রশ্ন ক্রমেই বাড়ছে। সেজন্য মানব উন্নয়ন সূচক (হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স), টেকসই উন্নয়ন পরিমাপ করার জন্য প্রকৃত উন্নতি নির্দেশক (জেনুইন প্রগ্রেস ইন্ডিকেটর), মোট জাতীয় সুখ (গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস) ইত্যাদি বহু পথ ও পদ্ধতি নেয়া হয়েছে। বিশ্বের বহু দেশে এ বিষয়ে উদ্যোগ দেখা যায়। তথাকথিত অনুন্নত দেশ হলেও ভুটান মাথাপিছু জাতীয় আয়ে বাংলাদেশ থেকে অনেক এগিয়ে, আইএমএফের বৈশ্বিক রিপোর্টে বাংলাদেশে যখন মাথাপিছু আয় ১ হাজার ২০০ ডলার অতিক্রম করেছে, তখনই ভুটানে মাথাপিছু আয় তার দ্বিগুণেরও বেশি, আড়াই হাজার ডলার। তার পরও ভুটান মাথাপিছু জিডিপি নিয়ে সীমাহীন উচ্ছ্বাসে গা ভাসায়নি, বরং এ হিসাব পদ্ধতিকেই প্রত্যাখ্যান করেছে। বিশ্বকে দেয়া তাদের নিজস্ব উদ্ভাবনী পদ্ধতিতে মোট নয়টি ক্ষেত্র বিবেচনার অন্তর্ভুক্ত করা হয়— মানসিক ভালো থাকা, সময়ের ব্যবহার, সম্প্রদায়, জীবনীশক্তি, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, বাস্তুতান্ত্রিক স্থিতিস্থাপকতা, জীবনযাত্রার মান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সুশাসন। এছাড়া এসব ক্ষেত্রের সঙ্গে মাথাপিছু আয়সহ ৩৩টি নির্দেশক আছে। অন্যান্য নির্দেশক হলো— নিরাপত্তা, সাম্প্রদায়িক সম্পর্ক, সাক্ষরতা, বাস্তুতান্ত্রিক বিষয় এবং ঘুম ও কাজে ব্যয়কৃত সময়।
শুধু পরিমাণগত দিক ঊর্ধ্বে তুলে ধরায় অনেক গুণগত দিক আড়াল করা সম্ভব। এটি করপোরেট শাসকগোষ্ঠী ও তাদের অর্থশাস্ত্রের জন্য সুবিধাজনক। বাংলাদেশে অনিয়ন্ত্রিতভাবে গৃহীত বৃহৎ প্রকল্পে ব্যয়ের লাগামহীন বৃদ্ধি, আর্থিক খাত থেকে অভাবনীয় মাত্রায় লুণ্ঠন ও পাচার অব্যাহত থাকার কারণে জিডিপি বাড়ছে, আবার এজন্যই সরকারকে আরো বেশি বেশি আয়ের উৎস খুঁজতে হচ্ছে। যেহেতু চোরাই কোটিপতিদের থেকে কর আদায়ে সরকার অনিচ্ছুক, সেহেতু সহজ পথ জনগণের ঘাড়ে বোঝা চাপানো। সেজন্যই আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমলেও জ্বালানি তেলের দাম কমানো হয়নি, সেজন্যই ভ্যাট অস্ত্র প্রয়োগ করা হচ্ছে বিস্তৃতভাবে। সে কারণে বাংলাদেশের মানুষকে ঘরভাড়া, গাড়িভাড়া, গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বেশি দিতে হবে। জিনিসপত্র কিনতে হবে আরো বেশি দামে। নিত্যব্যবহার্য সব পণ্যেই মানুষকে বাড়তি টাকা গুনতে হবে। বন-নদীবিনাশী তত্পরতা চলবে।
বিভিন্ন প্রকল্পের ধরনের কারণেই দেশে ঋণ ও কর বৃদ্ধি পেলেও জনগণের নিরাপত্তাহীনতা কমবে না; বরং তার ওপর উন্নয়নের নামে সন্ত্রাস বাড়বে। সরকার কোনো ব্যাখ্যা দেবে না। কারণ জনগণের কাছে তার কোনো দায় নেই। আলোচনাও তেমন হবে না, কেননা স্তুতিগান ছাড়া সংসদসহ নানা প্রতিষ্ঠানের আর কোনো ভূমিকা নেই। আমাদের খুশি থাকতে হবে, কারণ সরকারি প্রচারণা বলতে থাকবে— আমাদের জিডিপি বেড়েছে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে, বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার পথে প্রবেশ করেছে!
- বনিকবার্তা/মার্চ ২৮,২০১৮
- লেখক: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments:
Post a Comment