Search

Thursday, March 29, 2018

হদিস নেই ২২ হাজার ২২১ কোটি টাকার

টাকা আদায়ে বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চিঠি 
* আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠন করে শীর্ষ ১০ খেলাপির বিচার করতে হবে। প্রয়োজনে জেলে পাঠাতে হবে -ড. মইনুল ইসলাম 
* গত এক বছরে এবি, আইসিবি ইসলামিক, স্ট্যান্ডার্ড ও এনসিসি ব্যাংক এক টাকাও আদায় করতে পারেনি


বিভিন্ন ব্যাংকের ২২ হাজার ২২১ কোটি টাকার কোনো হদিস নেই। বছরের পর বছর ধরে নানা কৌশলে সাধারণ মানুষের মোটা অঙ্কের এ অর্থ নির্বিঘ্নে পকেটস্থ করেছে শীর্ষ ২০ খেলাপি। এ অর্থের পুরোটাই এখন অবলোপন। বিধান অনুযায়ী অবলোপন করার পর থেকেই এ টাকা আদায়ের কথা ছিল। কিন্তু গত এক বছরে অবলোপনকৃত অর্থের এক টাকাও আদায় করতে পারেনি এবি, আইসিবি ইসলামিক, স্ট্যান্ডার্ড এবং এনসিসি ব্যাংক। এছাড়া প্রায় একই চিত্র বিরাজ করছে অন্য ব্যাংকগুলোতেও।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে অবলোপনের টাকা আদায়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে সতর্ক করে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ১৫ মার্চ বিভিন্ন ব্যাংকে পাঠানো ওই চিঠিতে বলা হয়, ‘শীর্ষ ২০ অবলোপনকৃত ঋণ থেকে আদায় সন্তোষজনক নয়। যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তাও ফলপ্রসূ নয়। বিশেষ করে উল্লিখিত চার ব্যাংকের আদায় শূন্য। এ বিষয়ে আদায় নিশ্চিতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে আপনাদের সতর্ক করা যাচ্ছে।’

উল্লেখ্য, খেলাপি অবস্থায় পাঁচ বছর পর্যন্ত কোনো ঋণ আদায় করতে না পারলে তা ব্যাংকের মূল হিসাব থেকে বাদ দিয়ে ভিন্ন খাতায় হিসাব রাখা হয়। তখন এই ঋণকে অবলোপন বলা হয়। তবে অবলোপন করার আগে অর্থঋণ আদালতে একটি মামলা করতে হয়। পাশাপাশি ওই খেলাপি ঋণের বিপরীতে শতভাগ নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন রাখতে হয়।

জানতে চাইলে এবি ব্যাংকের কোম্পানি সচিব মহাদেব সরকার বুধবার রাতে টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন খেলাপি থাকার পর ইলিয়ার্স ব্রাদার্স, মোস্তাফা গ্র“পসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। কিন্তু এরা টাকা দিচ্ছে না। ছলে-বলে-কৌশলে পার পেয়ে যাচ্ছেন। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি কিন্তু কুলিয়ে উঠতে পারছি না।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিভিন্ন ব্যাংকের শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হিসাবে আটকা পড়েছে ৩২ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা। এ অর্থের ২২ হাজার ২২১ কোটি টাকাই অবলোপন করা হয়েছে।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবির (ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো) সর্বশেষ প্রতিবেদন (গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) অনুযায়ী, একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে চট্টগ্রামভিত্তিক কোম্পানি ইলিয়াস ব্রাদার্সের। ১৩টি ব্যাংকে প্রায় ৮৯০ কোটি টাকা ঋণ খেলাপি এই প্রতিষ্ঠান, যা অন্তত দুটি বেসরকারি ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধনের সমান। এ ঋণের বিপরীতে কোনো ধরনের যথাযথভাবে জামানতও রাখা হয়নি। যার কারণে খেলাপিদের কাছ থেকে অর্থ আদায় সম্ভব নয়। অর্থাৎ সম্পূর্ণ জালিয়াতির মাধ্যমেই এ ধরনের ঋণ নেয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্বেগ প্রকাশ করে চিঠি দিয়ে কোনো কাজ হবে না। ঋণের টাকা উদ্ধারে এখন প্রয়োজন আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠন করা। শীর্ষ ১০ খেলাপিকে ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বিচার করতে হবে। প্রয়োজনে জেলে পাঠাতে হবে। তা না হলে খেলাপিদের ধরা সম্ভব নয়।

তিনি আরও বলেন, এদের বেশির ভাগই ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি। এরা অত্যন্ত শক্তিশালী। তারা জানে ঋণ নিলে ফেরত দিতে হবে না। তারা কালো টাকা এবং শক্তি দিয়ে বছরের পর বছর আইনি প্রক্রিয়া এড়াতে সক্ষম। অর্থঋণ আদালতের মাধ্যমে খেলাপিদের ধরা সম্ভব নয়, এটা এক ধরনের প্রতারণা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, ঋণদাতা ও গ্রহীতার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া উচিত। অবসরে যাওয়া এমডিদের কার আমলে কত ঋণ, কিভাবে গেছে, কার কাছে গেছে- তা খতিয়ে বের করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ ওইসব এমডিও ঋণের নামে অর্থ লুণ্ঠন করেছেন। এজন্য বর্তমান এমডিরা দায়ী নন।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের উপদেষ্টা ও সাবেক ডেপুটি গভর্নর এসকে সুর চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, ঋণের টাকা আদায়ে মনিটরিং বাড়াতে হবে। সে লক্ষ্যে হয়তো বা সতর্ক করা হয়েছে। এটা বাংলাদেশ ব্যাংক সব সময় করে থাকে। এর থেকে বেশি কিছু করার নেই।

জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, দেশের ব্যাংকিং খাতের সবচেয়ে বড় সমস্যা খেলাপি ঋণ। আর খেলাপি ঋণের জন্যই শিল্পঋণের সুদের হার কমানো যাচ্ছে না। কারণ এই ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে মুনাফা থেকে প্রভিশন (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) করতে হয়। তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ কমাতে না পারলে এ খাতের উন্নয়ন সম্ভব নয়। মির্জ্জা আজিজ বলেন, জামানত ছাড়া যে ব্যাংক ঋণ দিয়েছে, ওই ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত। তার মতে, কোন বিবেচনায় এত বড় ঋণ দেয়া হল তা জবাবদিহিতার আওতায় আনতে না পারলে আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।

ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন- অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) ভাইস চেয়ারম্যান এবং সোনালী ব্যাংকের এমডি ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ যুগান্তরকে বলেন, প্রায় সব শীর্ষ খেলাপির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তারা বারবার রিট করে অর্থ আদায় প্রক্রিয়া থামিয়ে দিচ্ছেন। তার মতে, গরিব কখনও রিট করে না। যত রিট সব ধনীদের। তিনি বলেন, প্রতি জেলায় একটা করে অর্থঋণ আদালত আছে। আদালতের সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে। তিনি আরও বলেন, নির্বাচনী বছরের কারণে শীর্ষ ঋণখেলাপিরা কিছুটা দুর্বল থাকবে। এদের অনেকেই কোথাও না কোথাও নির্বাচন করবে। এখনই তাদের ধরার সময়। সব খেলাপি ঋণ আদায় করতে হবে। এককভাবে এটি করা সম্ভব নয়। সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। প্রয়োজনে খেলাপিদের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সামাজিকভাবে বর্জন করতে হবে।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে সর্বপ্রথম বেসরকারি উদ্যোগে খেলাপি ঋণ আদায়ের লক্ষ্যে ১৯৯৬ সালের জুন মাসে ‘দি পিপলস ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস কর্পোরেশন (পিডিএসসি) লিমিটেড’ জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে নিবন্ধিত হয়। সম্প্রতি এই প্রতিষ্ঠানটি খেলাপি ঋণ আদায়ে জটিলতা নিরসনে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ বরাবর একটি চিঠি দেয়। পিডিএসসির চেয়ারম্যান এমএ রহমান স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, খেলাপি ঋণ আদায়ে এজেন্ট নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু এজেন্টকে ক্ষমতা দেয়া হয় না। ঋণ আদায়ে যে মামলার করা হয়, সেখানে থাকে অনেক ফাঁকফোকর। মামলা পরিচালনার দায়িত্ব ব্যাংকের হাতেই থাকে। তাই চুক্তিবদ্ধ এজেন্ট চাইলেই মামলায় অংশগ্রহণ করতে পারে না। অন্যদিকে ব্যাংকের পক্ষ থেকে নিয়োজিত আইনজীবীরা খেলাপিদের সঙ্গে যোগসাজশ করে মামলা দীর্ঘায়িত বা অন্য কোনো অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য কাজ করে থাকেন। ফলে খেলাপি বা অবলোপনের ঋণ আদায় স্বাভাবিকভাবেই বন্ধ হয়ে যায়। আর এসব অপকৌশলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের অসৎ কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং প্যানেল আইনজীবীরা জড়িত বলেও অভিযোগ করা হয় ওই চিঠিতে।

  • যুগান্তর/মার্চ ২৯,২০১৮ 

No comments:

Post a Comment