Search

Sunday, March 25, 2018

অসম্ভবকে ‘সম্ভব’ করে তাঁর সুপারিশ

অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানও সরকারের আর্থিক বরাদ্দ পেয়েছে বাঁশখালীর সাংসদ মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর সুপারিশে।


বাস্তবে যে শ্মশানের অস্তিত্ব নেই, সেই শ্মশান সংস্কারের জন্য কি টাকা বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব? যাঁরা ভাবছেন ‘অসম্ভব’, কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁদের ভুল ভাঙবে। যে সংগঠনের চিহ্ন দুনিয়াতে নেই, সে সংগঠন কি কখনো সরকারি টাকা বরাদ্দ পাবে? সহজ উত্তর হচ্ছে বাঁশখালীর সাংসদ সুপারিশ করলে টাকা পাবে।

চট্টগ্রামের বাঁশখালীর সাংসদ মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর সুপারিশে এমন কিছু সংগঠন সরকারি টাকা বরাদ্দ পেয়েছে, যেসব সংগঠনের নাম শুধু কাগজে আছে, বাস্তবে নেই। অবশ্য শুধু অস্তিত্বহীন সংগঠনের জন্যই তিনি সুপারিশ করেন বিষয়টি এমন নয়। বাস্তবে আছে এমন সংগঠনকে বরাদ্দ দিতেও সুপারিশ করেছেন তিনি। কিন্তু সমস্যা হয়েছে, ওই সংগঠনের লোকেরা বিষয়টি জানেন না। ফলে বরাদ্দ হওয়া টাকা সংগঠনগুলো পায়নি।

কাজের বিনিময়ে টাকা (কাবিটা) এবং গ্রামীণ রক্ষণাবেক্ষণ (টেস্ট রিলিফ বা টিআর) প্রকল্পের আওতায় ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাঁশখালীর ৩৬৫টি প্রকল্পের জন্য সুপারিশ করেন সাংসদ। এতে বরাদ্দ ছিল ২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। গত ফেব্রুয়ারি মাসে প্রথম আলো উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়ন এবং একটি পৌরসভার তিনটি ওয়ার্ডের আটটি প্রকল্পের বিষয়ে অনুসন্ধান চালায়। এর মধ্যে ছয়টি প্রকল্পের জন্য জমা দেওয়া স্থাপনা বা সংগঠনের অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায়নি।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে সাংসদ হন মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী। তবে তিনি আলোচনায় আসেন ২০১৬ সালে। ওই বছরের ২ জুন উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তাকে পিটিয়ে খবরের শিরোনাম হন তিনি।

অস্তিত্ব নেই, অস্তিত্ব আছে
সাংসদের সুপারিশে বাঁশখালী পৌরসভার উত্তর জলদীর ‘কেবল মহাজনপাড়া শ্মশান’-এর উন্নয়নের জন্য গত অর্থবছরে ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ হয়। পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডে পড়েছে পাড়াটি। স্থানীয় বাসিন্দারা এই নামের কোনো শ্মশানের সন্ধান দিতে পারেননি। পরে ওয়ার্ড কাউন্সিলর দিলীপ চক্রবর্তীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ওয়ার্ডে তিনটি শ্মশান রয়েছে। ‘কেবল মহাজনপাড়া শ্মশান’ বলে কিছু নেই।

একই ওয়ার্ডে সর্বজনীন সহমরণী শিবধাম সংস্কারের জন্য সাংসদের সুপারিশে ৬০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এই স্থাপনাটি থাকলেও বরাদ্দ করা টাকা পায়নি শ্রীধাম (মন্দির) কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি নিশ্চিত করেন মন্দির পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত কাউন্সিলর দিলীপ চক্রবর্তী।

উপজেলার বৈলছড়ি ইউনিয়নের মির্জাকাটা কবরস্থান সংস্কারের জন্য গত অর্থবছরে গ্রামীণ রক্ষণাবেক্ষণ প্রকল্পের আওতায় সাংসদের সুপারিশে দুই লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। মির্জাকাটা জামে মসজিদের পাশে একই নামের কবরস্থান। মির্জাকাটা মসজিদের ইমাম আবুল বশর জানান, কয়েক বছর আগে একটি বরাদ্দ পেয়েছিল মসজিদের পরিচালনা কমিটি। কবরস্থান সংস্কার হতে দেখেননি।

এ বিষয়ে মির্জাকাটা মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি আমিরুজ্জামান বলেন, কবরস্থান সংস্কারের জন্য ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বরাদ্দ পাননি তাঁরা।

ভুয়া প্রকল্প সম্পর্কে জানতে চাইলে সাংসদ মোস্তাফিজুর মোস্তাফিজুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিটি প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। আপনারা একজন এমপির বিরুদ্ধে মিথ্যা কথা লিখবেন?’

অবশ্য বাঁশখালী পৌরসভার মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি সেলিমুল হক চৌধুরী বলেন, টিআর ও কাবিটা প্রকল্পের নামে কোটি কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। বাঁশখালীর সাংসদ এবং তাঁর লোকজন দায় এড়াতে পারেন না।

পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ‘দক্ষিণ জলদি যুব উন্নয়ন পরিষদ’-এর জন্য গত অর্থবছরে ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এ সংগঠনের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। ওয়ার্ডের গুরা পুকুরপাড় এলাকায় ‘একতা সংঘ’ এবং মহাজনপাড়ায় ‘জাগরণ যুব সংগঠন’ নামের দুটি সংগঠন রয়েছে। জাগরণ যুব সংগঠনের সভাপতি খোকন দাশ বলেন, ‘যুব উন্নয়ন পরিষদের’ নাম কখনো শোনেননি তিনি।

ওয়ার্ডের কাউন্সিলর বাবলা কুমার দাশ বলেন, কয়েক বছর আগে ‘যুব উন্নয়ন পরিষদ’-এর একটা ব্যানার রাস্তায় টাঙানো ছিল।

উপজেলার সরল ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের পাইরাং চৌধুরীপাড়ার ‘বঙ্গবন্ধু পরিষদ’-এর ঘর নির্মাণের জন্য ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ হয়। কিন্তু ওয়ার্ডে এই সংগঠন নেই। তবে চৌধুরীপাড়া থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে বঙ্গবন্ধু পরিষদের একটি কার্যালয় আছে। সংগঠনের সভাপতি শহীদুল ইসলাম বলেন, কখনো সরকারি বরাদ্দ পাননি তাঁরা।

চাম্বল ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব চাম্বল শেখ রাসেল স্মৃতি সংসদকে ৪০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এ ওয়ার্ডে না থাকলেও পাশের ৬ নম্বর ওয়ার্ডে শেখ রাসেল স্মৃতি সংসদের কার্যালয় রয়েছে। সংগঠনের সভাপতি শেফাইতুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, গত বছরের শেষের দিকে সংগঠনের যাত্রা শুরু। এখন পর্যন্ত সরকারি বরাদ্দ পাননি।

কাথারিয়া ইউনিয়নে ৬ নম্বর ওয়ার্ডে শেখ রাসেল স্মৃতি সংসদকে ৪০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। সংগঠনের অস্তিত্ব আছে। সংগঠনের সভাপতি মোহাম্মদ মোরশেদ বলেন, ২০১৪ সালে নয় হাজার টাকা বরাদ্দ পেয়েছিলেন। এরপর আর কোনো বরাদ্দ পাননি।

পুঁইছড়ি ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের উত্তরপাড়ার ‘সুফিয়া ফাউন্ডেশন’-কে ৩৭ হাজার ১০০ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। ওয়ার্ডের বিভিন্ন পাড়া ঘুরে এর কার্যালয় পাওয়া যায়নি। পরে পুঁইছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সোলতানুল গণি চৌধুরী এবং উত্তর পাড়া এলাকার দায়িত্বে থাকা ইউপি সদস্য মো. কাশেমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তাঁরাও এই ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম এবং কার্যালয় কোথায় তা বলতে পারেননি।

ভুয়া প্রকল্পের বিষয়ে বাঁশখালী উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আবুল কালাম মিয়াজীর দাবি, প্রকল্প যাচাই করেই বরাদ্দের অর্থ ছাড় দেওয়া হয়।

হলফনামায় গরমিল
২০১৪ সালে সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনে দাখিল করা হলফনামায় মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী উল্লেখ করেছিলন, তাঁর কৃষিজমি আছে চার একর, তিন কাঠার প্লট রয়েছে, ব্যাংকে আছে ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা এবং নগদ ৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা। স্ত্রীর নামে ব্যাংকে জমা ৪ লাখ ৯০ হাজার টাকা এবং নগদ ৩৯ লাখ ৩০ হাজার টাকা। হলফনামায় বাড়ি থাকার তথ্য দেননি তিনি। অথচ চট্টগ্রামের ষোলশহরের রহমান নগরে তাঁর পাঁচতলা বাড়ি রয়েছে।

বাড়ির তথ্য গোপন রাখার বিষয়ে জানতে চাইলে সাংসদ বলেন, ‘শহরের বাড়িটি আমার স্ত্রীর নামে। তাঁর বাড়ির তথ্য আমি কেন হলফনামায় দেব?’ কিন্তু স্ত্রীর ব্যাংক হিসাব এবং নগদ টাকার তথ্য হলফনামায় দিয়েছিলেন-এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আপনি কি আয়কর বিভাগের কেউ? আপনাকে কেন প্রশ্নের জবাব দিতে হবে? আমার স্ত্রী আয়কর দেন।’

সাংসদের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন
সাংসদের বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে গত বছরের নভেম্বরে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সংবাদ সস্মেলন করেছিল বাঁশখালী আওয়ামী লীগের একটি পক্ষ। এতে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান এবং ভুয়া প্রকল্পের মাধ্যমে টিআর ও কাবিটা প্রকল্পে কোটি কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ আনা হয়। এই দুর্নীতির জন্য সাংসদ ও তাঁর লোকজনকে দায়ী করেন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত আবদুল্লাহ কবির। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বাঁশখালী আসনে আওয়ামী লীগ থেকে প্রথমে মনোনয়ন পেয়েছিলেন তিনি। পরে মনোনয়ন দেওয়া হয় মোস্তাফিজুর রহমানকে।

সত্য বলতে হবে 
সাংসদের সুপারিশে ভুয়া প্রকল্পে টাকা বরাদ্দের বিষয়ে বাঁশখালী উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রোজিয়া সুলতানা বলেন, ‘বরাদ্দের খুব সামান্য অংশই বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে। অনেক প্রকল্পের অস্তিত্বই নেই। এই সত্য কথাগুলো আমাদের বলতে হবে।’ 

রোজিয়া বাঁশখালী পৌরসভার সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডের কাউন্সিলর।

দুর্নীতি দমন কমিশন সূত্র জানায়, বাঁশখালীতে টিআর এবং কাবিটা প্রকল্পের দুর্নীতি নিয়ে সহকারী পরিচালক পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা অনুসন্ধান শুরু করেছেন।

  • প্রথম আলো/মার্চ ২৪,২০১৮

No comments:

Post a Comment