সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম
ধারাবাহিকতা আলোচনা কেন
আমার রাজনৈতিক দৃষ্টিতে ২০১৮ সালটি বাংলাদেশের জন্য একাধিক আঙ্গিকের দ্বন্দ্বের বৈশিষ্ট্যে বিশেষায়িত। এ কথা খেয়াল রেখেই গত তিন বুধবারে তিনটি কলাম লিখেছি এবং পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেছি। একই সুতায় গাঁথা কলামগুলোর মধ্যে আজকেরটি হলো চতুর্থ কলাম। বর্তমানে যে মাস চলছে সেটি মার্চ মাস। স্বাধীনতার মাস। অতএব, এই মার্চ মাসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব তথা স্বাধীন অস্তিত,¡ স্বাধীন অবয়ব ও স্বাধীন পথচলা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিঞ্চিৎ আলোচনা বিগত তিনটি কলামে (২৮ ফেব্রুয়ারি, ৭ মার্চ ও ১৪ মার্চ ২০১৮) করা হয়েছে; আজ একটু করব এবং আগামী সপ্তাহে আরেকবার হবে। এই অনুচ্ছেদের প্রথম বাক্যটি এখানে পুনরায় লিখছি : ‘আমার রাজনৈতিক দৃষ্টিতে ২০১৮ সালটি, বাংলাদেশের জন্য একাধিক আঙ্গিকের দ্বন্দ্বের বৈশিষ্ট্যে বিশেষায়িত।’ ওই দ্বন্দ্বগুলোর সাথে তথা একাধিক দ্বন্দ্বের সাথে, অবশ্যই অনেক কিছু জড়িত বা সংশ্লিষ্ট। উদাহরণস্বরূপ কয়েকটি মাত্র আঙ্গিক উল্লেখ করছি।
এক. আন্তর্জাতিক রাজনীতি তথা পৃথিবীর পরাশক্তিগুলোর রাজনীতিতে ছোট দেশগুলোর ভূমিকা (ইন্টারন্যাশনাল পলিটিক্স) জড়িত।
দুই. আঞ্চলিক রাজনীতি তথা দক্ষিণ এশিয়া, পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া নামক ভূ-রাজনৈতিক অঞ্চলে আঞ্চলিক সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর (রিজিওনাল পলিটিক্স) জড়িত।
তিন. আন্তর্জাতিক সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব (কালচারাল কনফ্লিক্ট) জড়িত। এ কথা খেয়াল রেখেই গত সপ্তাহের (১৪ মার্চ ২০১৮) কলামে চারটি অনুচ্ছেদে নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও মিয়ানমার নিয়ে আলোচনা করেছিলাম।
আলোচনার শেষপর্যায়ে পাঠক অবশ্যই প্রশ্ন করতে পারেন, বাংলাদেশ কোন দিকে যাবে বা বাংলাদেশের কোন দিকে যাওয়া উচিত বা বাংলাদেশকে কোন দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? এর উত্তর সন্ধানের জন্যই এতগুলো কলাম। যেহেতু ২০১৮ সালের শেষে বা ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে একটি নির্বাচন হওয়ার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা আছে, সেহেতু বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তন হবে কি হবে না সেটাও আলোচনার সুযোগ আছে। সে জন্যই এ আলোচনা।
পরিবর্তনের চারটি ভিন্ন প্রক্রিয়া
২০১৮ সালের শেষ নাগাদ অথবা ২০১৯ সালের প্রারম্ভে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অঙ্গনেও পরিবর্তন হতে পারে; আবার না-ও হতে পারে। একটি পক্ষ চাচ্ছে পরিবর্তন হোক, একটি পক্ষ চাচ্ছে পরিবর্তন না হোক। বরং স্ট্যাটাসকো মেইনটেইন হোক বা বর্তমান অবস্থায় স্থিত থাকুক। বাংলাদেশের ইতিহাসের বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্যে কোনোটি স্বাভাবিক ও সুখকর ও কোনোটি অস্বাভাবিক ও বেদনাদায়ক। বয়সের প্রবীণত্বে এসে একান্ত কামনা করি যেন অস্বাভাবিক ও বেদনাদায়ক পরিবর্তন পরিহার করা যায়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের, বিশেষত অনুন্নত দেশের বা কোনো-না-কোনো সময় ইউরোপিয়ানদের কলোনি ছিল এমন দেশের, প্রশাসনে বা রাজনীতিতে পরিবর্তনগুলোকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বা রাজনীতির পর্যবেক্ষকেরা অন্তত চারটি শিরোনামের অধীনে ক্যাটাগরাইজ বা পর্যায়ভুক্ত করেন।
একটি ক্যাটাগরি হলো, ব্যালটের মাধ্যমে তথা মানুষের স্বাভাবিক ভোট দেয়ার মাধ্যমে। দ্বিতীয় ক্যাটাগরি হলো, বুলেটের মাধ্যমে তথা ভায়োলেন্সের মাধ্যমে তথা রক্তারক্তির মাধ্যমে। তৃতীয় ক্যাটাগরি হলো, ব্যালটও না বুলেটও না, গণদাবির মুখে তথা গণজাগরণের মুখে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। চতুর্থ ক্যাটাগরি হলো, বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামোর ভেতরে থেকেই দুর্বলতাগুলোকে সংস্কার করে, কাঠামোকে শক্তিশালী করে ব্যালট ও হস্তান্তরের যৌথ প্রক্রিয়ায়, যাকে আমরা বলতে পারি ‘সংস্কার’ ক্যাটাগরি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ইতিহাস থেকে, প্রত্যেকটি ক্যাটাগরির জন্যই উদাহরণ টেনে এনে আলোচনা করা যায়। বাংলাদেশের গত ৪৬ বছরের ইতিহাস থেকেও প্রত্যেক ক্যাটাগরির জন্যই উদাহরণ বা ঘটনার রেফারেন্স টেনে আনা যায়। আমরা ইতোমধ্যে সেরূপ আলোচনা, অতীতের গত দুই-তিন সপ্তাহের কলামগুলোতে করেছি।
বর্তমান অবস্থায় স্থিত থাকার অর্থ : কয়েকটি উদাহরণ
আমি গত পাঁচ-সাত বছরের শত সহস্র কোটি কোটি টাকার বড় বড় আর্থিক কেলেঙ্কারিগুলোর কথা তুলে ধরছি না। যথা ডেসটিনি নামক মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কোম্পানির কেলেঙ্কারি, হলমার্ক গ্রুপের কেলেঙ্কারি, বিসমিল্লাহ গ্রুপের কেলেঙ্কারি, বেসিক ব্যাংকের কেলেঙ্কারি, ফারমার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারি ইত্যাদি নিয়ে এখানে আলোচনা করছি না। অতি সম্প্রতি ঢাকা মহানগর থেকে প্রকাশিত কয়েকটি পত্রিকার শিরোনাম, দু’চার লাইন ব্যাখ্যাসহ আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।
এক নম্বর উদাহরণ ১০ জানুয়ারি ২০১৮; মানবজমিন পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার একটি শিরোনাম : ‘সাড়ে আট হাজার ভুয়া পিএইচডি’র তদন্তে দুদক।’ অর্থাৎ কিনা প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা থেকে শুরু করে অষ্টম শ্রেণীর সমাপনী, দশম শ্রেণীর পর মাধ্যমিক পরীক্ষা, দ্বাদশ শ্রেণীর পর উচ্চ মাধ্যমিক, ডিগ্রি এবং মাস্টার্স লেভেল সব কিছুকে ধ্বংস করার পর, শিক্ষাজগতের সম্মানজনক অর্জন পিএইচডিকেও শেষ করা হয়েছে গত ৯-১০ বছরে। পত্রিকার ভাষ্য মতে, প্রায় সাড়ে আট হাজার লোক বাংলাদেশে আছেন, যাদের পিএইচডি অর্জন ছিল ভুয়া বা প্রতারণা। এটা হলো শিক্ষা সেক্টরের তদারকির অমার্জনীয় অদক্ষতার প্রমাণ।
দুই নম্বর উদাহরণ ৩ মার্চ ২০১৮; ডেইলি স্টারের প্রথম পৃষ্ঠার একটি শিরোনাম ÔCurious case of GMG loan : Rescheduled once, Tk 57cr interest waived; Sonali Bank could not recover Tk 190cr from the airlines despite years of legal battle’ অর্থাৎ জিএমজি এয়ারলাইন্স নামে একটি প্রাইভেট এয়ারলাইন্সের কাহিনী। কোম্পানিটি ছয় বছর ধরে বন্ধ। তারা ৪০০ শতাংশ প্রিমিয়াম দেখিয়ে ৩০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করে প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে। এসইসি বা সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশনের সতর্কতায় জনগণের কাছে উন্মুক্ত শেয়ার ক্রয়ের জন্য উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি; হলে বিশালসংখ্যক জনগণ প্রতারিত হতো। বেক্সিমকো লিমিটেডের গ্যারান্টিতে সোনালী ব্যাংক ২৪৭ কোটি টাকা লোন দিয়েছিল। সেই লোন এবং ৩০০ কোটি টাকা পাওয়ার পর কোম্পানিটি বন্ধ করে দেয়া হয়। অন্য ভাষায় এ রকমও বলা যায়, ব্যাংকের কাছে সোনালি ছবি এঁকে লোন নেয়া হয় এবং মানুষকে প্রলোভন দেখিয়ে ৩০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করা হয়। তারপর কোম্পানিটি বন্ধ করে দেয়া হয়। ডেইলি স্টারের ভাষায়, এই কোম্পানটির ঘটনাটি হলো : এ ক্ল্যাসিক একজামপল অব হাউ টু টুইস্ট এ ব্যাঙ্কস আরম উইথ কোর্ট অর্ডারস।
তিন নম্বর উদাহরণ ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮; মানবজমিনের প্রথম পৃষ্ঠার একটি শিরোনাম : ‘ঋণের টাকায় দানবীর ইউনুস বাদল।’ বাদল জীবন শুরু করেছিলেন বাসচালকের সহকারী হিসেবে। পত্রিকার ভাষায়, ২০১০ সালে তার হাতে আসে আলাদিনের চেরাগ। ২০১০ সাল থেকে পরের ছয় বছরে একক ব্যবসায়ী হিসেবে জনতা ব্যাংক থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে গড়ে তোলেন এনন টেক্স গ্রুপ। পত্রিকার ভাষায়, অনিয়ম করেই তার সব লোন সংগ্রহ করা হয়েছে।
চার নম্বর উদাহরণ ১১ মার্চ ২০১৮; বণিক বার্তার প্রথম পৃষ্ঠার একটি শিরোনাম : ‘আইএফআইসি ব্যাংক : নদী, কবরস্থানের ভূমি বন্ধক রেখে ২৫০ কোটি টাকা ঋণ।’ আইনানুযায়ী সরকারি খাসজমি, শিকস্তি ও পয়স্তি এবং কবরস্থানের ভূমি জামানত রাখার কোনো সুযোগ নেই। তার পরও এ ধরনের ভূমি বন্ধক রেখে রাজ হাউজিং লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে বড় অঙ্কের ঋণ দিয়েছে আইএফআইসি ব্যাংক।
পাঁচ নম্বর উদাহরণ ১ মার্চ ২০১৮; প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠার একটি শিরোনাম : ‘২৫ শীর্ষ খেলাপির তালিকায় নেই প্রভাবশালীদের নাম।’ বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাংকে বহু ঋণখেলাপি আছেন, অর্থাৎ যারা সময়মতো তাদের ঋণ বিভিন্ন কারণে ফেরত দিতে পারেননি। সেখানে দুই লাখ বা পাঁচ লাখ টাকার ঋণখেলাপি আছেন, ৩০-৪০ লাখ টাকার ঋণখেলাপি আছেন, এক-দুই কোটি টাকার ঋণখেলাপি আছেন, ১০০-২০০ কোটি টাকার ঋণখেলাপি আছেন, ৫০০ বা হাজার কোটি টাকার ঋণখেলাপি আছেন, তিন-চার বা পাঁচ হাজার কোটি টাকার ঋণখেলাপি আছেন। যাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি, তাদের বলা হচ্ছে শীর্ষ খেলাপি। সরকারি কর্তৃপক্ষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিভিন্ন সময় শীর্ষ খেলাপিদের তালিকা প্রকাশ করে, এবারো করেছে। কিন্তু এবারের সেই তালিকায় যারা আসলে শীর্ষ বা বাস্তবিকভাবেই সবচেয়ে বড় খেলাপি, তাদের নাম নেই। এমন কৌশল ব্যাংকের মাধ্যমে অবলম্বন করা হয়েছে, যেন তাদের নাম খেলাপিদের তালিকায় জনসমক্ষে প্রকাশ করা না হয়।
পত্রিকার মন্তব্য : মূলত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠনের নামে প্রভাবশালীরা ঋণ নিয়মিত দেখানোর সুযোগ পাচ্ছেন। সংবাদের ভাষ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক মইনুল ইসলামের একটি মন্তব্য উদ্ধৃত করা হয়।
মন্তব্যটি : ‘খেলাপি গ্রাহকদের বিচারে বিশেষ ট্রাইব্যুলান করতে হবে। তাদের সম্পত্তি জব্দ করে জেলে পাঠাতে হবে। এসব টাকা সহজে ফেরত আসবে না। এর বড় অংশই পাচার হয়ে গেছে। ব্যাংক খাতকে দিনে দিনে ক্ষুদ্র প্রভাবশালী গোষ্ঠীর কাছে কুক্ষিগত করে ফেলা হচ্ছে। ফলে সামনের দিনে যে নতুন করে বড় খেলাপি সৃষ্টি হবে না; তা বলা যাবে না।
ছয় নম্বর উদাহরণ ৩ মার্চ ২০১৮, বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রথম পৃষ্ঠার অন্যতম শিরোনাম : ‘কোনোভাবেই থামছে না অর্থপাচার।’ বিভিন্ন পদ্ধতিতে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হয়ে বিদেশে চলে যাচ্ছে। ফলে বাংলাদেশে ডলারের দাম বেশি, তা ক্রমেই বাড়ছে। অপর পক্ষে বিশ্ববাজারে মার্কিন ডলারের দাম কমছে। সংবাদের ভাষ্যে অর্থনীতিবিদদের উদ্ধৃত করা হয়েছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচারের কারণ মূলত তিনটি। প্রথম কারণ হচ্ছে দুর্নীতি। দুর্নীতি বেড়েছে বলে অর্থপাচারও বেড়েছে। দ্বিতীয় কারণ দেশে বিনিয়োগ পরিবেশ না থাকা। তৃতীয় কারণ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতা।
সাংবিধানিক ঘোষণা লঙ্ঘিত হচ্ছে পদে পদে
১৯৭১ সালের এপ্রিলের ১০ তারিখের কথা। তখনো আনুষ্ঠানিকভাবে মুজিবনগর সরকার বা প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়নি। গঠনের প্রক্রিয়া প্রায় সমাপ্তির পথে ছিল। তখন যে ক’জন নির্বাচিত এমএনএ ও এমপিএ কলকাতা পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছিলেন, তারা একত্র হয়েছিলেন কলকাতায়। তারা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র (ইংরেজি পরিভাষায় প্রোক্লামেশন অব ইনডিপেনডেন্স) রচনা, গ্রহণ ও প্রচার করেন। সেখানে মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে যে তিনটি বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত ও প্রকাশ করা হয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম হলো ‘সাম্য’।
এই কলামের উপরের অনুচ্ছেদটিতে, ছয়টি উদাহরণ দিয়েছি, যেগুলো অনৈতিকতা ও দুর্নীতির সাক্ষ্য বহন করে। এখন যে উদাহরণটি দিচ্ছি তথা সাত নম্বর উদাহরণ, সেটি হলো সাম্যের লঙ্ঘন ও এর সাথে পরিহাসের উদাহরণ। ১২ মার্চ ২০১৮ বণিক বার্তার প্রথম পৃষ্ঠার একটি শিরোনাম : ‘ইউএনডিপির পর্যবেক্ষণ : ১০ শতাংশের হাতে সব কিছু কেন্দ্রীভূত হচ্ছে।’ পত্রিকার মতে, দেশের শীর্ষ ১০ শতাংশ ধনী পরিবারের হাতে দেশের মোট আয়ের ৩৮ শতাংশ জমা হচ্ছে বা জমা আছে। আয় বণ্টন ব্যবস্থার এরূপ কেন্দ্রীভবনের জন্য রেন্ট-সিকিং বা লুটপাট ও দুর্নীতির প্রবণতাকে দায়ী করেছে জাতিসঙ্ঘ উন্নয়ন কর্মসূচি বা ইউএনডিপি।
ইউএনডিপির মতে, আয়ের এত বড় অংশ কিভাবে মাত্র ১০ শতাংশ মানুষের হাতে কুক্ষিগত হলো, তা বুঝতে হলে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সেই ঋণ ফেরত না দেয়ার ঘটনাগুলো জানতে হবে ও বুঝতে হবে। পুঁজিবাজারে কারসাজি করে অবিশ্বাস্য রকমের লাভ সংগ্রহ করার পদ্ধতি এবং সেই লাভের টাকার গন্তব্যস্থল জানতে ও বুঝতে হবে, কর ফাঁকি দেয়ার ঘটনাগুলো জানতে ও বুঝতে হবে, সরকারি কেনাকাটা ও সরকারি ব্যয়ে যে দুর্নীতি করা হয় এবং সেই দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকার গন্তব্য পথ জানতে ও বুঝতে হবে এবং সর্বোপরি, বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপকভাবে ভূমি দখলের ঘটনা জানতে ও বুঝতে হবে। ইউএনডিপির পর্যবেক্ষণ মতে, গত ছয় বছরে দেশের জনগণের মধ্যে আয়ের বৈষম্য ক্রমান্বয়ে অনেক প্রকট হয়ে উঠেছে।
এ অবস্থার পরিবর্তন চাই
এ অবস্থা বলতে কী বুঝালাম? এ অবস্থা বলতে বোঝাতে চাচ্ছি, শুধু আজকের কলামে উল্লিখিত দুর্নীতির অবস্থা নয়। গত চার বা অন্তত তিনটি কলামে (২১ ফেব্রুয়ারি, ২৮ ফেব্রুয়ারি, ৭ মার্চ ও ১৪ মার্চের কলাম) যে রাজনৈতিক অবস্থা এবং আর্থসামাজিক অবস্থা বর্ণনা করেছি; সে অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। আমি একজন রাজনৈতিক কর্মী; বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান। বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি জন্মদিনেই ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্র প্রকাশ এবং প্রচার করেছিল; সেগুলো হালনাগাদ অবস্থায় এখনো মুদ্রিত আছে অথবা কল্যাণ পার্টির ওয়েবসাইটেও পাওয়া যাবে। আমাদের ঘোষিত লক্ষ্যের সারমর্ম একটি কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। অর্থাৎ বর্তমান অবস্থা থেকে পরিবর্তন না আনলে, আমরা কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারব না। অতএব আমাদের পরিবর্তন আনতেই হবে। তাই বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির ঘোষিত নীতিবাক্য পরিবর্তনের জন্য রাজনীতি। এই পরিবর্তন আনার লক্ষ্যেই আমি রাজনীতিতে নাম লিখিয়েছি।
গত ১০ বছর চার মাস ধরে আল্লাহর দেয়া জীবনের পরিশীলিত মেধা, কনসেনট্রেইটেড অভিজ্ঞতা ও অবসর জীবনের সময় রাজনীতির জন্য ব্যয় করছি। রাজনীতিতে খরচ অবশ্যই আছে এবং সেটিও হালাল উপায়ে করছি। নিজের ও দলের নেতাকর্মীদের পরিবার, দলের নেতাকর্মী এবং শুভাকাক্সক্ষীরা দোয়া ও সহযোগিতা করছেন। অতএব আমি পরিবর্তনের একজন জোরালো প্রবক্তা। আমরা একা এই পরিবর্তন করতে পারব না; তাই বন্ধুবান্ধব প্রয়োজন। কিন্তু দূষিত হওয়া বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশে, পরিবর্তনে আগ্রহী বন্ধু পাওয়া অসম্ভব না হলেও কঠিন। এরূপ আশা-নিরাশার সন্ধিক্ষণে, মহান আল্লাহ তায়ালার একটি বাণী বারবার মনে পড়ে। পবিত্র কুরআনের ৩৯ নম্বর সূরা আয-জুমার। এই সূরার ৫৩ নম্বর আয়াতের মাঝখানে বলা আছে : ‘লা তাকনাতু মির রাহমাতিল্লাহি’। পুরো আয়াতের বাংলা অর্থ এইরূপ : ‘বলুন, হে আমার বান্দাগণ, যারা নিজেদের ওপর জুলুম করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সব গোনাহ মাফ করেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ আমি আশাবাদী এই মর্মে যে, আমরা বাংলাদেশের মানুষ, যারা মহান আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর নির্দেশাবলিতে বিশ্বাস করি ও ওই মর্মে চলতে চাই, আমরা আশাবাদী হবো পরিবর্তনের ব্যাপারে।
জুলুম বন্ধ হবে, ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হবে, নিষ্ঠুরতা বন্ধ হবে, দয়া প্রতিষ্ঠিত হবে। আমি নিরাশ হতে চাই না, আশাবাদী থাকতে চাই। মনে করি, অনেক কষ্ট ও অনেক বঞ্চনার কারণে নিশ্চয়ই বাংলাদেশের মানুষ পরিবর্তন চান। সেই পরিবর্তনের জন্য ভোটারদেরও পরিশ্রম করতে হবে। একটি উদাহরণ দিচ্ছি। আমার মতে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী লীগের প্রধান একটি অন্যায় কাজ করেছেন। সেই অন্যায় কাজটি হলো এইরূপ : তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করেছেন। এই অন্যায় কাজটি করার জন্য তিনি অনেক বুদ্ধি, ধৈর্য ও কৌশল প্রয়োগ করেছেন বা অবলম্বন করেছেন। কাজটি যত বড় অন্যায়ই হোক না কেন (অবশ্যই আমার দৃষ্টিতে বা অনেকের দৃষ্টিতে), কিন্তু করানো হয়েছে নির্বাচিত সংসদ দ্বারা। সে জন্যই আমি একটি কথায় জোর দিচ্ছি।
দুর্নীতি পরিহার করে সুনীতি যদি আনতে চাই, অনৈতিকতা পরিহার করে নৈতিকতা যদি আনতে চাই, পররাষ্ট্রনীতিতে পরনির্ভরশীলতা পরিহার করে যদি আত্মনির্ভরশীলতা আনতে চাই, তাহলে এ রকম সাহসী পরিবর্তনে আগ্রহী মানুষের সংসদ বা পার্লামেন্ট প্রয়োজন।
পরিবর্তনের প্রক্রিয়া
পরিবর্তনের জন্য বা পরিবর্তন আনার জন্য যে প্রক্রিয়া অবলম্বন করা যায় বা যেগুলো মানুষের কাছে সুপরিচিত, সেটিও এই কলামের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে উল্লেখ করেছি। আমি নিশ্চিতভাবেই স্বাভাবিক শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে তথা ব্যালটের মাধ্যমে পরিবর্তন আসুক বা পরিবর্তনের জন্য প্রেক্ষাপট প্রস্তুত হোক বা পরিবর্তনে সহায়তা করবে এমন শক্তি নির্বাচিত হোক, সেই কামনা করি। তার জন্য সংসদের ভেতরে এবং বাইরে যেসব সচেতন রাজনৈতিক দল আছে, তাদের সবার সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন। একটি উদাহরণ দেই সংসদের ভেতরে অবস্থিত জাতীয় পার্টির সংসদীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ আজ থেকে ১২-১৪ দিন আগে, সংসদ অধিবেশন চলাকালে একটি করুণ আবেদনময়ী বক্তব্য রেখেছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর দয়া, সাহায্য, সহযোগিতা কামনা করেছেন তার নিজের দলকে বাঁচানোর জন্য। তার দলের পরিচয় পরিষ্কার করার জন্য এবং তার দলের ইজ্জত বাঁচানোর জন্য।
আমি সংসদ নেতা শেখ হাসিনা এবং সংসদের বিপদগ্রস্ত বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, উভয়ের কাছেও আবেদন রাখব, এখনো সময় আছে আপনাদের ভূমিকা রাখার। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে, ‘ইট ইজ নেভার টু লেট টু স্টার্ট সামথিং গুড।’ অর্থাৎ কোনো ভালো কাজ শুরু করার জন্য, দেরি হলেও ওই দেরির কারণে শুরু করা যাবে না এমন ভাববেন না। অপর ভাষায়, দেরি হয়ে গেছে এই অজুহাতে কোনো ভালো কাজ শুরু করতে দেরি করবেন না বা দ্বিধা করবেন না। ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ থেকে আজ ২১ মার্চ ২০১৮ পর্যন্ত পাঁচটি কলাম লিখলাম ধারাবাহিকভাবে; একটি উপসংহারে আসার জন্য। পত্রিকার হার্ড কপি পেতে যদি কষ্ট হয়, তাহলে নয়া দিগন্তের ওয়েবসাইটে, আর্কাইভসে ঢুকে পড়তে পারেন। অথবা আমার ওয়েবসাইটে ঢুকে কলাম যেখানে আছে, সেখানে পড়তে পারেন। আমার ওয়েইসাইট মানে ইংরেজিতে এতটুকু : জেনারেলইবরাহিম.কম.বিডি। যেই উপসংহারটি তুলে ধরব সেটি আগামী ২৮ মার্চ ইনশা আল্লাহ উপস্থাপন করব। তারপর দুই সপ্তাহ কলাম লিখতে পারব না অপরিহার্য ব্যস্ততার ও বিশ্রামের অপরিহার্য প্রয়োজনে; সে জন্য অগ্রিম ক্ষমাপ্রার্থী।
- নয়া দিগন্ত/২১-৩-১৮
- লেখক : মেজর জেনারেল (অব:)/ বীর প্রতীক/ চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি