এ কে এম জাকারিয়া
বর্ষা শুরু হলো
বলে। স্বাভাবিক প্রকৃতির নিয়মে এপ্রিলে কালবৈশাখী দিয়ে যে ঝড়-বাদলের শুরু, মে মাসে তা রূপ নেয় বর্ষায়। বর্ষাকে বরণ করতে
হলে কিছু প্রস্তুতি লাগে, এবার ঢাকায় নাকি
সেই প্রস্তুতি নেই। ফলে স্বাভাবিক বর্ষা মানেই ঢাকা ডুববে। প্রথম আলো শিরোনাম
করেছে, ‘ডুববে ঢাকা,
দেখবে ওয়াসা’। কারণ, প্রতিবছর বর্ষার আগে ওয়াসা নর্দমা পরিষ্কারের
কাজটি শুরু করে জানুয়ারি মাস থেকে, এবার অর্থের
অভাবে সেই কাজ শেষ করা যাচ্ছে না। জলাবদ্ধতা সামাল দিতে এ বছর ওয়াসার দুটি প্রকল্প
বাস্তবায়ন করার কথা ছিল। সেই দুটিও বাদ গেছে। এই যখন অবস্থা, তখন ঢাকা ডুবলে শুধু ওয়াসা কেন, আমাদের সবাইকেই তা দেখতে হবে। ডুবে যাওয়া ঢাকায়
দুর্ভোগের সবটাই আমাদের পোহাতে হবে।
ঢাকা ওয়াসার এক
কর্মকর্তাই এবারের বর্ষায় ঢাকাবাসীকে প্রকৃতির ওপর ভরসা রাখতে বলেছেন। বৃষ্টি বেশি
হলে এবার নাকি রক্ষা নেই, ভয়াবহ হতে পারে
জলাবদ্ধতা। জলাবদ্ধতা দূর করার উদ্যোগ ও উদ্যমে সরকারের ঘাটতিতে হতাশ নগর বিশেষজ্ঞ
অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘এখন দোয়া করতে
হবে যাতে গত বছরের মতো একসঙ্গে এত বৃষ্টি না হয়।’ সৃষ্টিকর্তা ঢাকাবাসীর ডাকে সাড়া দিয়ে
বৃষ্টিপাত কমিয়ে দিলে তবেই রক্ষা! দুর্ভোগ থেকে মুক্তির আর তো কোনো পথ দেখা যাচ্ছে
না।
তবে স্রষ্টার
কাছে ঢাকায় কতটুকু বৃষ্টি আমরা চাইব বা চাইব না, তার একটি হিসাব-নিকাশ জরুরি। তা না হলে আমাদের
চাওয়ায় ভুল হয়ে যেতে পারে। আসুন গত বছরের বর্ষায় আমাদের কী অভিজ্ঞতা হয়েছিল,
তা মনে করার চেষ্টা করি।
আর তখন বৃষ্টিপাত কেমন হয়েছিল, তারও খোঁজখবর
নিই। গত বছর বর্ষা মৌসুমে ঢাকায় এক দফা অতি ভারী বৃষ্টি হয়েছিল এবং সেটা হয়েছিল
নিম্নচাপের প্রভাবে। তবে বর্ষা মৌসুমে এক বা দুই দফা এ ধরনের অতি ভারী বৃষ্টি
অস্বাভাবিক কিছু নয়। বিভিন্ন মাত্রার বৃষ্টিপাত নির্ধারণ করা হয় কিছু হিসাব মেনে।
আবহাওয়া বিভাগ ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বিবেচনায় নিয়ে বৃষ্টির ধরন নির্ধারণ
করে। এ সময়ে ১০ মিলিমিটারের কম বৃষ্টি হলে তাকে হালকা, ১০ থেকে ১৯ মিলিমিটার পর্যন্ত মাঝারি, ২০ থেকে ৪৩ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিকে মাঝারি
মাত্রার ভারী, ৪৪ থেকে ৮৮
মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিকে ভারী এবং এর চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতকে অতি ভারী বৃষ্টি
হিসেবে ধরা হয়। গত বছর আগস্টের ২২ তারিখ সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টায় ৫৪
মিলিমিটার বৃষ্টিপাতে ঢাকার অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়েছিল। এর ঠিক দুই মাস পর নিম্নচাপের
প্রভাবে ঢাকায় ২৪ ঘণ্টায় ১৪৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত একই অবস্থা তৈরি করেছিল। এই
দুটির বাইরে গত বছর মাঝারি মাত্রার বৃষ্টিতেই বেশ কয়েক দফা ঢাকা ডুবে গিয়ে অচল হয়ে
পড়েছিল।
আমাদের বর্ষা
মৌসুমের স্বাভাবিক মেয়াদ মে থেকে আগস্ট-এই চার মাস। এই সময়ের মধ্যে হালকা, মাঝারি, মাঝারি থেকে ভারী আবার কখনো ভারী থেকে অতি ভারী
বৃষ্টিও হতে পারে। মৌসুম জুড়ে সব মাত্রার বৃষ্টি মিলিয়েই একটি স্বাভাবিক বর্ষা
মৌসুম। আবার একটি বা দুটি নিম্নচাপ বা ঘূর্ণিঝড়ও বাংলাদেশে স্বাভাবিক। অক্টোবর,
নভেম্বরেও সে কারণে কখনো
টানা ও ভারী বর্ষণ হয়। এবারের বর্ষায় ডুবে যাওয়া থেকে ঢাকা নগরীকে রক্ষা করতে হলে
বা জনগণ যদি সেই দুর্ভোগ পোহাতে না চায়, তবে অনেকটা বৃষ্টিহীন বর্ষার জন্যই স্রষ্টার কাছে হাত তুলতে হবে। স্বাভাবিক
বর্ষার ধকল নেওয়ার ক্ষমতা ঢাকার নেই।
এখন দয়াময়
স্রষ্টা যদি আমাদের ডাকে সারা দিয়ে সত্যিই বৃষ্টি কমিয়ে দেন, তাহলে ঢাকা না হয় ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচল এবং
আমাদের দুর্ভোগও না হয় কমল, কিন্তু ঢাকাবাসী
বাঁচবে তো? বৃষ্টি গ্রীষ্মের
টানা গরম থেকে আমাদের স্বস্তি দেয়। শীত মৌসুম শেষ হতে হতে ঢাকা যে মাত্রায়
ধূলিধূসর হয়ে ওঠে, বাতাস যে পরিমাণ
দূষিত হয়ে পড়ে, তখন বৃষ্টি আসে
আশীর্বাদ হয়ে। বৃষ্টি ঢাকার বায়ুদূষণ কমায়। ঢাকার গাছগুলো সবুজ হওয়ার জন্য বৃষ্টির
অপেক্ষায় থাকে। ঢাকার বৃষ্টি শহরটির চারপাশের দূষণে কালো হয়ে যাওয়া নদীগুলোকে
প্রাণ দেয়। গ্রীষ্ম ও বর্ষায় বৃষ্টিতে বিরতি মানেই এসির ব্যবহার বেড়ে যাওয়া ও
বিদ্যুতে ঘাটতি এবং ঢাকার পানির স্তর নেমে যাওয়া, লোডশেডিংয়ের কারণে ওয়াসার পাম্প বন্ধ থাকা ও
পানিসংকট। বৃষ্টিহীন একটি বর্ষা কি আমরা ঢাকাবাসী আসলেই চাই?
আমরা স্বাভাবিক
বর্ষা চাই। যে বর্ষায় হালকা, মাঝারি, ভারী ও অতি ভারী সব ধরনের বৃষ্টিপাতই হবে।
কিন্তু আমরা চাই, স্বাভাবিক বর্ষায়
ঢাকা ডুববে না, আমরা দুর্ভোগে
পড়ব না। এমন হওয়ার কথা ছিল না। কারণ, ঢাকা হচ্ছে চারদিকে নদী ও শাখা-প্রশাখার মতো ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য খালের এক
দুর্লভ শহর। সমস্যা হচ্ছে, শহরের এই অনন্য
বৈশিষ্ট্যকে ধরে রাখা যায়নি। বছরের পর বছর ধরে তা ধ্বংস করা হয়েছে। যাদের এসব দেখভাল
ও রক্ষা করার দায়িত্ব ছিল এবং আছে, তারা
ধারাবাহিকভাবে ব্যর্থতার প্রমাণ রেখে চলেছে। সরকারের অনেক প্রতিষ্ঠানের যুক্ততা
রয়েছে এর সঙ্গে। ফলে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে কারোরই আসলে কোনো দায় নেই।
১৯৯৬ সালের পানি
সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন আইন অনুযায়ী, ঢাকা শহরের পানিনিষ্কাশনের
দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। ফলে নর্দমাগুলো সচল রাখা ও পরিষ্কার করার দায়িত্ব ওয়াসার। এই
নর্দমাগুলো বানানোর দায়িত্ব অবশ্য সিটি করপোরেশনের। ২০০০ সালের বাংলাদেশ পানি
উন্নয়ন বোর্ড আইন অনুযায়ী, ঢাকার নদী,
খাল ও জলাভূমি সংরক্ষণের
দায়িত্ব পানি উন্নয়ন বোর্ড বা পাউবোর। অন্যদিকে ঢাকার সব খালের মালিক ঢাকা জেলা
প্রশাসন। এই অবস্থায় নর্দমা-খালও পরিষ্কার থাকছে না, খাল-জলাভূমিকে দখলমুক্তও রাখা যাচ্ছে না।
যেকোনো সমস্যার জন্য এক পক্ষ অন্য পক্ষকে দায়ী করলেই তো হলো। ঢাকা ওয়াসা আর দুই
সিটি করপোরেশনের মধ্যে পাল্টাপাল্টি অভিযোগই শোনা গেল দুই-তিন বছর ধরে। কাজের কাজ
কি কিছু হলো!
স্থানীয়
সরকারমন্ত্রী গত বছর বলেছিলেন, ‘আমি প্রমিজ করছি,
সামনের বছর থেকে আর এসব
(জলাবদ্ধতা) দেখবেন না।’ আমরা জেনে গেছি
যে এই ‘প্রমিজ’-এর কোনো ফল এ বছর আমরা দেখব না। নর্দমা
পরিষ্কার করার জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বরাদ্দ বাড়ায়নি। এ বছর পরিস্থিতি আরও
খারাপ হতে পারে। কারণ, অর্থের অভাবে
ওয়াসা আপাতত নর্দমা পরিষ্কারের কাজে হাত গুটিয়ে রেখেছে। কবে অর্থ মিলবে আর কবে কাজ
শুরু হবে! কথা ছিল, ঢাকা ওয়াসা এ বছর
জমি অধিগ্রহণসহ পাঁচটি খাল পুনঃখনন ও কল্যাণপুর পাম্প স্টেশনে একটি রেগুলেটরি
পুকুর তৈরি করবে। মন্ত্রণালয় সেই প্রকল্প একনেক থেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এর
পেছনে নাকি রয়েছে ওয়াসা ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের ‘মান-অভিমান’। বুঝলাম ঢাকার নাগরিকেরা আসলে কত অসহায়,
কয়েকজন কর্মকর্তার
মান-অভিমানের কাছে তাদের ভালো-মন্দের বিষয়টি কতটা তুচ্ছ!
নাগরিকদের
দুর্ভোগ না হয় আমলারা বিবেচনায় নিলেন না। কিন্তু জলাবদ্ধতার আর্থিক ক্ষতির দিকটি?
বিশ্বব্যাংক ২০১৫ সালের
নভেম্বরে এক সমীক্ষা প্রকাশ করেছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, ২০১৪ সাল থেকে ২০৫০ সাল পর্যন্ত রাজধানীতে
জলাবদ্ধতার কারণে ক্ষতি হবে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। এটা স্বাভাবিক বর্ষার
হিসাব। আর আবহাওয়া উল্টাপাল্টা আচরণ করলে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যা ঘটা
অস্বাভাবিক নয়, এই ক্ষতির পরিমাণ
দাঁড়াবে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। জলাবদ্ধতা দূর করতে অর্থ খরচ, সেদিক থেকে দেখলে লাভজনক বিনিয়োগ। কারণ,
এই বিনিয়োগ দেশের অর্থের
ক্ষতি কমাবে।
ঢাকার জলাবদ্ধতা
সমস্যার দিকে নজর দিতে হলে কী কী করতে হবে বা করা উচিত, তা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের তরফে
পরামর্শেরও অভাব নেই। সমস্যা হলো এ নিয়ে সামগ্রিক পরিকল্পনা তৈরি করা, ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন মেয়াদে তা বাস্তবায়ন করা
এবং এ জন্য বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয় করা অথবা একটি নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষের
মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করা। এখানেও সেই পুরোনো প্রশ্ন-ঢাকার জলাবদ্ধতা দূর করতে
দায়িত্ব নিয়ে এই কাজ করবে কে? দুই সিটি
করপোরেশন, ঢাকা ওয়াসা,
পাউবো, জেলা প্রশাসন ও মন্ত্রণালয়-জলাবদ্ধতা নিয়ে
সবারই যখন নানা দায়িত্ব, তখন কাজটি করার
আসলে কেউ নেই। জলাবদ্ধতা ঢাকার অগুনতি সমস্যার একটি। এগুলোর কোনোটির দিকেই নজর
দেওয়া যাচ্ছে না। কারণ, ঢাকাকে দেখভাল
করার একক দায় কারও নেই। ৭ মন্ত্রণালয় ও ৫৪ সেবা সংস্থার জগাখিচুড়ি দিয়ে যে ঢাকার
সেবা-শুশ্রূষা নিশ্চিত করা যাবে না, এই বাস্তবতা আমাদের নীতিনির্ধারকেরা কি আদৌ কোনো দিন বুঝবেন? ফলে ঢাকা ডুববে, অচল হবে, এটাই তো আমাদের নিয়তি।
- সৌজন্যে - প্রথম আলো/ মার্চ ২৩, ২০১৮।