তৈমূর আলম খন্দকার
৪ মে ২০১৮ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি আয়োজিত আইনের শাসন ও গণতন্ত্র শীর্ষক আলোচনায় দেশবরেণ্য ব্যক্তিরা বক্তব্যে বলেছেন, ‘আইনের শাসন দেশে চলছে না, চলছে পুলিশের শাসন। দেশে আইনের শাসন ও গণতন্ত্র নিয়ে জগাখিচুড়ি চলছে। এ অবস্থা যত দিন থাকবে, তত দিন আমরা নিঃশেষ হয়ে যাবো।’ এ কথাগুলো শুধু রাজনৈতিক দল বলছে না, এখন বলছেন দেশবরেণ্য আইনজীবীরা, যারা রাজনৈতিকভাবে এক প্ল্যাটফর্মের যাত্রী নন, যাদের মধ্যে অন্যতম ব্যক্তিত্ব ড. কামাল হোসেন, যিনি এক সময় আওয়ামী ঘরানার অন্যতম কর্ণধার ছিলেন।
জমিদারদের লাঠিয়াল ও পুলিশের কার্যক্রমে কার্যত কোনো তফাত নেই। লাঠিয়ালের দায়িত্ব প্রজা দমন, খাজনা পরিশোধে ব্যর্থ হলে গরু-বাছুর টেনে আনা, বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেয়া প্রভৃতি। পুলিশের সৃষ্টি হয়েছিল দুষ্টের দমন ও ভালোকে রক্ষা করার জন্য, যদিও পুলিশ সে দায়িত্ব থেকে সরে গিয়ে নিয়োগকর্তার মনোরঞ্জনকেই তাদের প্রধান দায়িত্ব হিসেবে বেছে নিয়েছে। পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন দিক থেকে পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে। মনোরঞ্জনের অর্থাৎ তৈল মর্দনের ব্যবহারও ব্যবহার হচ্ছে বিভিন্ন পদ্ধতিতে। যেমন ‘স্বাধীন’ অর্থাৎ যারা আইনগতভাবে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বাধীন; তারাও আজ্ঞাবহতার প্রতিযোগিতায় নেমেছে।
কে কত বড় দেশপ্রেমিক, এ কথা সাধারণত আলোচনা হয় না; বরং কে নিয়োগকর্তার প্রশংসায় চাপাবাজি ও তৈল মর্দনে ব্যস্ত, তা নিয়েই আলোচনা বেশি হয় এবং তৈল মর্দনকারীর গুরুত্ব ক্ষেত্রবিশেষে সেভাবেই চক্রবৃদ্ধি হারে পরিমাপ হতে থাকে। গণমানুষের আশা-আকাক্সক্ষার শেষ ভরসাস্থল ‘আদালত’। সেই আদালত এখন পুলিশের কাছে জিম্মি। কারণ, নিয়োগকর্তার লাঠিয়ালদের তোয়াজ না করলে নিয়োগকর্তা অসন্তুষ্ট হবেন; এটা ভেবেই সর্বক্ষেত্রে পুলিশের মুখোমুখি আর কেউ হতে চায় না।
রাজনৈতিক মিথ্যা মামলা-গ্রেফতার প্রভৃতি বাণিজ্যের পরে রিমান্ড-জামিনের পর জেলগেটে গ্রেফতার এবং একটি মামলায় জামিন হওয়ার পর অন্য আরেকটি মামলায় Shown Arrest করে জামিন অকার্যকর করে দেয়ার প্রবণতায় পেছনে রয়েছে নিয়োগকর্তাকে তৃপ্তি দেয়া, যা তৈলের বাটির যথাযথ ব্যবহার, অন্যটি অর্থনৈতিক লাভবান। পরিতাপের বিষয়, পুলিশের সব অপকর্ম ও বাণিজ্যের সার্বিক বিষয়গুলো জায়েজ হচ্ছে আদালতের মাধ্যমে। জনগণ এ নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য যে দরজায় গিয়ে আশ্রয় নেবেন, সেই দরজার মালিক নিজেও পুলিশের মুখাপেক্ষী। ফলে জাতি আজ আশায় বুক বেঁধে আছে, কবে এর পরিসমাপ্তি ঘটবে?
দেশে চলছে পুলিশি শাসন, এ কথা আজ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবীরা বলছেন; কিন্তু এ কথাটি সাধারণ মানুষের যারা ভুক্তভোগী। গণতন্ত্রের জন্য সরকারপ্রধান গণতন্ত্রের মানসকন্যা হিসেবে বিশ্ব স্বীকৃতি নেয়ার জন্য যেখানে মরিয়া, সেখানে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অস্তিত্ব খোঁজার জন্য হ্যাজাক লাইট বা টর্চ লাইট দিয়ে খুঁজে কতটুকু পাওয়া যাবে, তা নিয়ে আলোচনা করার আগে রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতার সুফল দেশবাসী কতটুকু ভোগ করছে, তা নিয়ে একটু কথা বলা প্রাসঙ্গিক। স্বাধীনতার চেতনার কথা বললে গোটা জনগোষ্ঠী স্বাধীনতার চেতনা কতটুকু ভোগ করছে, তা পর্যালোচনার দাবি রাখে। আব্রাহাম লিঙ্কন, ডাইসি, অ্যারিস্টটল প্রভৃতি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ‘রাষ্ট্র’ এবং রাষ্ট্রের সাথে জনগণের সম্পর্ক তা নির্ধারণে বিভিন্ন সংজ্ঞা দিয়েছেন। কিন্তু আধুনিক জগতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে যারা গবেষণা করেন, তারা একটি নতুন সংজ্ঞা রাষ্ট্রীয় বিষয়ে যোগ করেছেন। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, ‘নাগরিকদের ভয়মুক্ত রাখাই রাষ্ট্রের মূল দায়িত্ব।’ এখন প্রশ্ন বাংলাদেশের তথা স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিকরা কি ভয়মুক্ত অবস্থায় দিনযাপন করতে পারছে? নাকি তারা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস থেকে মুক্ত?
বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী A.V. DICEY বলেছেন, ‘বিলাতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তার কারণ বিলাতের গণতন্ত্র হলো জনমতভিত্তিক, কেবল আইনভিত্তিক নয়।’ The Law of constitution (1915) রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতা সম্পর্কে সংজ্ঞা প্রদানে উল্লেখ করেছে, ‘Behind the soveriegn which the lawyer recognizes, there is another sovereign to whom the legal soveriegn must bow’ এখানেও জনমতকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো সরকার ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্যই গণতন্ত্রকে নির্বাসন দিয়ে স্বৈরতন্ত্রকে গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে ব্যবহার করছে। সরকারের কাছে সব ক্ষমতা রয়েছে। ক্ষমতা রয়েছে একজন নারীকে পুরুষ এবং একজন পুরুষকে নারীতে রূপান্তরিত ছাড়া সরকার সবই করতে পারে। এ অবস্থায় সরকারের রাহুগ্রাস থেকে জনগণকে যারা নিরাপত্তা দেবে, সেই বিচার বিভাগ কি রাহুগ্রাসমুক্ত?
গণতন্ত্রের সংজ্ঞায় আব্রাহাম লিঙ্কন বলেছিলেন, ‘Democracy means for the people, by the people and of the people’ ওপর নিয়ন্ত্রণ নিতে সরকার সফল হওয়ায় সরকারের রক্ষাকবজ পুলিশ এখন বেপরোয়া। কারণ, ‘গণতন্ত্র’ তার আসল রঙ (Defination) হারিয়ে এখন নকল ছদ্মাবরণে রঞ্জিত হয়েছে।
‘গণতন্ত্র’ স্বাধীনতার মূল চেতনা- এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় আছে কি? যদি না থাকে, তবে সংজ্ঞাটিকে People’, অর্থাৎ জনগণকে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলনের ওপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে।
কিন্তু বাংলাদেশের গণতন্ত্রে এখন আর জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলনকে গুরুত্ব না দিয়ে গুরুত্ব পাচ্ছে পুলিশ, যাদের কাছে রয়েছে বৈধ অস্ত্র ও মিথ্যা মামলা দেয়ার সীমাহীন ক্ষমতা। বাংলাদেশ পুলিশ কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক ভাষণে যেমন মিথ্যার ফুলঝুরি ছোটে তেমনি মিথ্যার সাগরে বাংলার জনগণ এখন নিমজ্জিত। এ অবস্থা থেকে জাতিকে যারা রক্ষা করবে, যাদের সংবিধানের অভিভাবক বা Safe gurd হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়, সেই ‘বিচার বিভাগের’ স্বাধীন এ রাষ্ট্রের গণতন্ত্রের অস্তিত্ব কোথায়? বিভিন্ন রাষ্ট্র গণতন্ত্রের নামে রাষ্ট্র পরিচালনা করলেও গণতন্ত্রের সংজ্ঞা কিন্তু নিজ নিজ সুবিধামতো প্রদান করছে। যেমন- বাংলাদেশ সরকার বলছে উন্নয়নের গণতন্ত্রের অর্থাৎ দিনের পর দিন বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়ে গণতন্ত্রের ঘোড়া দাবড়িয়ে উন্নয়নের ডামাডোল বাজাচ্ছে। শেখ হাসিনা সরকার উন্নয়নের গণতন্ত্র আখ্যা দিয়ে গণতন্ত্রের উন্নয়নকে স্তব্ধ করে দিয়েছে।
নাগরিকদের নিরাপত্তা দেয়া সরকারের প্রধান দায়িত্ব। অন্য দিকে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, নাগরিকদের ভয়মুক্ত রাখাও রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এখানে প্রশ্ন- বাংলাদেশের নাগরিকরা কি রাষ্ট্রীয় কশাঘাত থেকে ভয়মুক্ত জীবনযাপন করতে পারছে? দেশের বিচার বিভাগ কি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে?
পুলিশ যাকে তাকে যেকোনো সময় যেকোনো অবস্থায় গ্রেফতার করছে, অভিযোগ থাকুক বা না থাকুক, যদি সে সরকারবিরোধী ঘরানার লোক হয় তবে কোনো অভিযোগের প্রয়োজন হয় না। জামিন হওয়ার পর জেলগেট থেকে পুরনো মামলা দেখিয়ে পুনরায় গ্রেফতার করে কোর্টে প্রেরণ করে।
কোর্ট জামিন নামঞ্জুর করে পুনরায় চাহিদামতো রিমান্ড মঞ্জুর বা জেলহাজতে প্রেরণ করে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে- অভিযুক্ত জেলে থাকা অবস্থায় তাকে Shown Arrest অর্থাৎ গ্রেফতার দেখানোর আবেদন করা হয়নি কেন? এ প্রশ্নটি যাদের করার কথা অর্থাৎ বিচার বিভাগ, তারা এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলে না, বরং পুলিশ যেভাবে চায় সেভাবেই আদালত আদেশ প্রদান করেন। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য যে ভূমিকা রাখা প্রয়োজন ‘গণতন্ত্র’ বিহনে তা-ও ভেস্তে গেছে।
বিচারব্যবস্থা অর্থাৎ প্রভাববিহীন বিচারব্যবস্থাই স্বাধীনতার অন্যতম চেতনা। সংবিধান নিশ্চিত করেছে, ‘আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’ অর্থাৎ নাগরিকদের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার ও সুবিচার নিশ্চিত করার জন্য পবিত্র সংবিধান প্রতিশ্রুতি প্রদান করলেও সে অধিকার কি জনগণ পাচ্ছে? সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার জন্য বিচার বিভাগের ওপর যে সাংবিধানিক দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে, ক্ষেত্রবিশেষে সে বিচার বিভাগ কি সে দায়িত্ব পালন করতে পারছে?
বাংলাদেশ একটি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র, রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়। কিন্তু কার্যত আমাদের রাষ্ট্রের বর্তমান পেক্ষাপটে বাস্তবতার নিরিখে সংজ্ঞায়িত করলে এ থেকে কী ধারণা পাওয়া যাবে?
যে রাষ্ট্রের বিচার বিভাগ যতটুকু প্রভাবমুক্ত, সে রাষ্ট্রের নাগরিকেরা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস থেকে ততটুকু নিরাপদ। ব্রিটেনে বিচারব্যবস্থার একটি প্রবাদ রয়েছে, ‘ব্রিটেনের একজন অসহায় নিঃস্ব নাগরিকের কুঁড়েঘরে বৃষ্টির পানি ঢুকতে পারে, সূর্যের আলো প্রবেশ করতে পারে, ঘর থেকে চাঁদের আলো দেখা যায়; কিন্তু বিধিবদ্ধ বিধান ছাড়া (Without due process of law) ব্র্রিটেনের রানী সে কুঁড়েঘরে প্রবেশ করতে পারেন না।’ অর্থাৎ রানীর প্রতিনিধি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কোনো নাগরিককে বিধিবদ্ধ বিধান ছাড়া নাজেহাল, হয়রানি বা গ্রেফতার করতে পারে না। কারণ, সে রাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় প্রভাবমুক্ত। অথচ আমাদের রাষ্ট্রের পুলিশের ক্ষমতার কাছে ক্ষেত্রবিশেষে আদালত অসহায়। এর প্রতিকারে জাতি কোথায় আশ্রয় পাবে? বিচার বিভাগের অসহায়ত্ব জনগণের আস্থা-অনাস্থার পাশা খেলায় পরিণত হয়েছে, যার অবসান করার জন্য একটি প্রভাবমুক্ত শক্তিশালী বিচার বিভাগ জরুরি। নতুবা আস্থা-অনাস্থার পাশা খেলা চলতেই থাকবে।
- নয়াদিগন্ত/মে ১১ ২০১৮