— জিয়া হাসান
বিভিন্ন জনের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের অতিশয়োক্তি দেখলেও, ডিফ্যাক্টো মিডিয়া প্রথম আলোর সোর্স এবং সরকারের পক্ষে পলক সাহেবের আলোচনায় মুল্ তিনটা সুবিধার কথা বলা হচ্ছে।
১। স্যাটেলাইট ভাড়া নিতে যে বৈদেশিক মুদ্রার খরচ হতো সেইটা বাঁচবে এবং ফ্রি ট্রান্সপন্ডার দিয়ে ট্রান্সমিশন বেচে, বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা যাবে।
২। প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট ও টেলিযোগাযোগ সেবার সম্প্রসারণ করা সম্ভব হবে।
৩। দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবিলা ও ব্যবস্থাপনায় দারুণ কার্যকর ভূমিকা রাখবে এই স্যাটেলাইট। এ ছাড়া জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজেও এ স্যাটেলাইটকে কাজে লাগানো সম্ভব
কথা তিনটাই সত্য। কিন্ত, বঙ্গবন্ধু স্যাটালাইটের ক্ষেত্রে প্রতিটা দাবীই বাংলাদেশের পারস্পেক্টিভে বিভিন্ন ভাবে মিথ্যাচার এবং একটা স্বৈরাচারী সরকারের ভাবমূর্তি স্থাপনের উদগ্র বাসনা থেকে দেশের টাকায় একটা প্রজেক্ট যা, এই অর্থনীতিক এবং প্রযুক্তিগত ভাবে মোটেও যৌক্তিক নয়।
কারন এই সার্ভিসগুলো ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ নিচ্ছে কারণ এই গুলো কমার্শিয়ালি এভেলেবল এবং অনেকগুলো এখন ফ্রি পাওয়া যায়। ফলে বাংলাদেশকে এভেলেবল সার্ভিসগুলো বাদ দিয়ে কেন ৪ হাজার কোটি টাকার একটা ফিক্সড কস্ট-এর বোঝা নিতে হবে, সেটা কমার্শিয়ালি ভায়াবল কিনা সেটা সততার সাথে যাচাই করতে হবে, পুরো ফাইনান্সিয়াল মেরিট দিয়ে।
এবং একটু গভীরে গেলেই দেখবেন, এই প্রজেটের মূল উদ্দেশ্য সরকারি বেনিয়াদের ব্যবসা নিশ্চিত করার জন্যে যা দেশের মানুষের ট্যাক্সের টাকায় এবং আমাদের ফিউচার উপার্জনের ঋণের টাকায় শুধুমাত্র সালমান সাহেবদের পকেট ভারি করবে।
স্যাটেলাইট ভাড়া নেয়ার বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয়ের দাবিটা হচ্ছে সব চেয়ে অসত্য দাবি, কারন , একটা ১৫ বছর শেলফ লাইফের শুধুমাত্র ইনিশিয়াল কষ্ট যার ৩ হাজার কোটি টাকা, সেইখানে বছরে ১২০ কোটি টাকা সেভ করে আপনি কয় বছরে এই কস্ট তুলবেন।
তারপরে আছে এর প্রতি বছরের অপারেটিং কস্ট, পলক সাহেব এবং তার আব্বাদের বিদেশ ভ্রমন কস্ট, সেইটা কত হাজার কোটি টাকায় যাবে, এবং এই এইচএসবিসি ব্যাংকে থেকে হাই ইন্টেরেস্ট রেট ১৫০০ কোটি টাকা লোনের এমরটাইজেসান কোথায় যাবে সেইটা কেউ হিসেব করছেনা ।
এই গ্যাপটা কাভার দেয়ার জন্যে, জিওস্টাটিক স্যাটেলাইটের কাভার এরিয়ায় যত দেশ আছে সেইগুলোর নাম নিয়ে বলা হচ্ছে, এই দেশগুলোর নেটওয়ার্ক এই স্যাটেলাইট থেকে সার্ভিস কিনবে। বঙ্গবন্ধু সাটেলাইটের জিওস্টাটিক লোকেশানের কাভারেজে পড়েছে ইন্দোনেশিয়া, মালেশিয়া, শ্রীলঙ্কা , নেপাল সহ আর কিছু দেশ।
এগেইন এই দেশগুলোতে স্যাটেলাইট কানেকভিটিভি কিনে যে প্রতিষ্ঠানগুলো এরা অনেকেই প্রাইভেট যাদের কারো না কারো সাথে চুক্তি আছে, কারো কারো আছে নিজস্ব স্যাটেলাইট যেমন সিংটেল। আর ভারতে তো ২০১৭ সালে একটা স্যাটেলাইট আকাশে তুলে বলছে এইটা সাউথ এশিয়ান দেশের জন্যে ফ্রি গিফট। এবং সেই ফ্রি গিফট পেয়ে বঙ্গবন্ধু স্যাটালেইটের ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ প্রথমে একটু ভয় পায়, তারপরে, তাও প্রধানমন্ত্রী ২০১৭ সালে ভারতে গিয়ে সেই ফ্রি স্যাটেলাইট যাকে বলা হচ্ছে সাউথ এশিয়ান স্যাটেলাইট সেইটা ব্যাবহারের চুক্তি সাক্ষর করে এসেছেন।
তাই এই বৈদেশিক মুদ্রা আদায়ের দাবী আরেকটা ভয়ংকর মিথ্যা। রিমোট জায়গায় স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট কানেকশান দেয়ার দাবিটা হচ্ছে সবচেয়ে জঘন্য মিথ্যা।
একটা জিনিষ করা সম্ভব মানেই বলে করা ভায়াবল, তা নয়।
বেশ কিছু আলোচনায় দেখলাম , বাংলাদেশে ১৮০ টি উপজেলায় ফাইবারের কানেকশান নাই, এই কানেকশান স্যাটেলাইট দিয়ে দেয়া হবে। এই দাবিটা ক্যাটাগরিকালি মিসলিডিং। কারণ , বাংলাদেশ খুব ছোট একটা দেশ।
এই উপজেলাগুলোর মধ্যে সবগুলোতেই রেডিও লিংক দিয়ে ইন্টারনেট কানেকশান দেয়া যায়, দেয়া হয়েছে, দেয়া হচ্ছে । যেই সব উপজেলায় বর্তমানের বিটিএস নাই, সেই খানে নতুন বিটিএস বসিয়ে লাইন অফ সাইট তৈরি করে খুব সহজেই ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট দেয়া সম্ভব- যেই ব্রডব্যান্ড কানেকশান স্যাটেলাইট কখনও সম্ভব নয়- স্যাটেলাইট হাই ল্যাটেন্সির কারণে ন্যারো ব্যান্ড কানেকশান দিতে পারবে, নব্বই দশকের টেলিফোন লাইনের মত- ইয়াহু যুগের মানুষেরা মনে করতে পারবেন সেই সব দুঃসহ দিনের কথা।
টেলিকম নেটওয়ার্কগুলো এই কাজ সহজেই করছে এবং প্রতিটা নেটওয়ার্ক দাবি করে, তারা বাংলাদেশের শত ভাগ কাভার করে। ফলে স্যাটেলাইট দিয়ে রিমোট জায়গা কাভারের বিষয়টা একটা প্রপাগান্ডা।
রিমোট জায়গায় যদি গ্রামীণ বা রবির কানেকশান না যায়, তবে সেই রিমোট জায়গায় স্যাটেলাইটের কানেক্টিভিটি রিসিভ করার জন্যে ভিস্যাট বসাবে কে ? ভিস্যাটের পয়সা কে দেবে ? সেই রিমোট জায়গায় ভিস্যাটের ইলেক্ট্রিসিটি কানেকশান কোত্থেকে আসবে?
ফলে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট দিয়ে বাংলাদেশে রিমোট জায়গায় ইন্টারনেট কানেকশান দেয়া হবে, এটা জঘন্য মিথ্যা । কারণ, রিমোট জায়গায় ইন্টারনেট কানেকশান দেয়ার অনেক অপশন প্রযুক্তির হাতে আছে। যেমন, আমাদের বাংলা লায়ন এবং কিউবির ওয়াইম্যাক্স নেটওয়ার্ক যে প্রযুক্তি সেগুলো লাইন অফ সাইট না থাকলেও অনেক দূরে ইন্টারনেট কানেকশান দিতে পারে।
কিন্ত এই নেট ওয়ার্কগুলো গ্রামে বা উপজেলায় যায় নাই, কারন তাদের ইকনমিজ অফ স্কেল নাই, সেজন্যই কমারশিয়ালি ভায়াবল নয়।
জাস্ট টেলিকম কোম্পানিগুলোর ৪ জি লাইসেন্সে বিশাল ফি নিয়ে প্রথমেই সরকার প্রফিটটা নিয়ে গেছে ফলে ,কোম্পানিগুলো এখন স্ট্রাগল করছে, ৪ জি ইনভেস্টমেন্ট জাস্টিফাই করতে বা রিমোট জায়গায় ফোরজি নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে দিতে। এরা বেনিয়া এদের কাজ শেয়ারহোল্ডারদের ভ্যালু তুলে অানা, পাবলিক সার্ভিস দেয়া না।
স্যাটেলাইট থেকে অনেক কম খরচে ফোর জি বা ওয়াইম্যাক্স দিয়ে ব্রডব্যান্ড কানেকশান দেয়া যাবে। যেইটা কখনোই স্যাটেলাইট পারবেনা ভূপৃষ্ঠ থেকে দূরে থাকার কারনে, লগারিদমিকালি ডাটা লস হওয়ার কারনে এবং খুব হাই ল্যাটেন্সির স্যাটেলাইট ইন্টারনেটের কানেকশানও খুবই দুর্বল। এবং এইটার ব্যান্ডউইথ এখনো ন্যারো যেইটা দিয়ে একটা সামান্য ইউটিউব ভিডিও দেখতে পারবেন না। দেখলে, মাসিক লাখ টাকার উপরে খরচ পড়বে।
সারা দেশে ফোর জি নেটওয়ার্ক বা ওয়াইম্যাক্স দিয়ে যে রিমোট জায়গায় ইন্টারনেট দেয়ার দায় সরকারের ছিল, যাকে, অতিরিক্ত ভাড়া তুলে নেয়ার লুটেরা মনোভাবের কারণে সেই সম্ভাবনা ধ্বংস করা হয়েছে। সেইটা করে দেবে, খুবই স্লো ল্যাটেন্সির স্যাটেলাইট এবং সেইটা মিডিয়াগুলো এবং প্রযুক্তিবিদেরা যেভাবে হাইলাইট করছে তা জনগণকে ধোকা দেয়া ছাড়া কিছু নয়।
বঙ্গবন্ধু স্যাটালাইট সেটআপ দিয়ে ইন্টারনেট কানেক্টিভিটি দেয়া হবে, সেটা একটা ধুম্রজাল। বরং মূল ইস্যু হচ্ছে, তারা সালমান সাহেবের কোম্পানিকে ডাইরেক্ট টু দা হোমের ব্যবসা তৈরি করে দিতে চায়, যেটা টাটা স্কাই এর মত একটা সার্ভিস। পাকিস্তানে ২০১৭ সালে ডিটিএইচের অকশনে ১৪০০ কোটি টাকা পেয়েছে সরকার।
বাংলাদেশেও যে কোন তরঙ্গ বেচতে ওপেন অকশন হওয়ার আইন রয়েছে (শুনেছি নিশ্চিত নই)।
কিন্ত বাংলাদেশ সরকার সালমান সাহেবের কোম্পানি রিয়েল ভিউ কোম্পানিকে কোন ধরনের অকশন বাদে তবারক মুল্যে ডিটএইচের পারমিশন দিয়েছে। এই কানেক্টিভিটি তারা তৈরি করেছে, একটা রুশ কোম্পানি দিয়ে। এই ৩০০০ কোটি টাকার স্যাটেলাইট মূলত ব্যবহার হবে নামমাত্র মুল্যে ডিটিএইচ বেচার পারমিশন দেয়া হবে। এই জন্যে এই স্যাটেলাইটের সকল মিটিং এ সালমান সাহেবকে দেখা যায়।
আর আমরা ইন্টেলেকচুয়ালি এমন বেকুব একটা দেশ এইখানে, রেপিস্টের সাথে রেপডের বিয়ে দিলে সেই বিয়ে সামাজিকভাবে গ্রহনযোগ্য হয়।
এই স্যাটেলাইটেও বিষয়টা সেরকম। রেপিস্টের সাথে রেপডের বিয়েতে সবাই হাততালি দেয়।
ডিটিএইচ-এর আলোচনাটা আমরা সবার শেষে করবো, কারণ, এই খানেই বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটে সালমান এফ রহমানদের সোনার হাঁস- সেইটা আমাদেরকে ভালো ভাবে বুঝতে হবে।
— লেখক সাড়া জাগানো ব্লগার ও তরুন উদ্দ্যোক্তা।
No comments:
Post a Comment