মহিউদ্দিন আহমদ
সাধারণ নির্বাচন হয়েছিল। এতে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থীরা ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে ভূমিধস জয় পেয়েছিলেন। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে ঢাকায় মন্ত্রিসভা গঠিত হলো। তারপর তিনি চিকিৎসার জন্য কলকাতায় যান। ৪ মে (১৯৫৪) কলকাতায় এক সংবর্ধনা সভায় তিনি বলেন, বাংলা ভাগ হয়েছে, কিন্তু বাঙালির সংস্কৃতি আর বাঙালিত্বকে কোনো শক্তিই কোনো দিন ভাগ করতে পারবে না। দুই বাংলার বাঙালি চিরকাল বাঙালিই থাকবে। নিউইয়র্ক টাইমস-এর সংবাদদাতা কালাহান শেরেবাংলার একটা সাক্ষাৎকার নেন এবং তাঁর প্রতিবেদনে শেরেবাংলার বক্তব্যে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদের’ ইঙ্গিতের কথা বলা হয়। এই সাক্ষাৎকার ছাপা হওয়ার পর রাজনৈতিক মহলে
হইচই পড়ে যায়। গুজব ছড়িয়ে পড়ে, ‘দেশদ্রোহী’ ফজলুল হককে বরখাস্ত করে পূর্ব বাংলায় কেন্দ্রীয় শাসন চালু করা হবে। এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রের সঙ্গে বোঝাপড়ার জন্য ফজলুল হক করাচি যান। সঙ্গে যান তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্য আতাউর রহমান খান, শেখ মুজিবুর রহমান, নান্না মিয়া, মোহন মিয়া ও আশরাফউদ্দিন চৌধুরী।
২৯ মে ফজলুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান ও নান্না মিয়া করাচি থেকে ঢাকার পথে রওনা হন। পরদিন ঢাকায় পৌঁছে তাঁরা জানতে পারেন, তাঁরা আর সরকারে নেই। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার অস্থায়ী সংবিধানের ৯ (ক) অনুচ্ছেদ প্রয়োগ করে ফজলুল হকের মন্ত্রিসভা বরখাস্ত করে পূর্ব বাংলায় গভর্নরের শাসন জারি করেছে। শেখ মুজিবসহ পূর্ব বাংলা আইন পরিষদের ৩৫ জন সদস্য এবং হাজারের ওপর লোক গ্রেপ্তার হন। ফজলুল হককে নিজ বাড়িতে অন্তরীণ করা হয়। পুলিশ যুক্তফ্রন্টের ৫৬ নম্বর সিমসন রোডের অফিসে তালা ঝুলিয়ে দেয় (সূত্র: মহিউদ্দিন আহমদ, আওয়ামী লীগ: উত্থানপর্ব ১৯৪৮-১৯৭০, প্রথমা প্রকাশন)।
যে সময়ের কথা বলছি, তখন ভারত ছিল বৈরী দেশ। ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে খোলামেলাভাবে সৌহার্দ্যের কথা বলা ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের চোখে ভীষণ খারাপ কাজ।
ইতিমধ্যে পেরিয়ে গেছে অনেকগুলো বছর। পূর্ব বাংলা এখন স্বাধীন বাংলাদেশ। পাকিস্তান এখন বৈরী দেশ, ভারত আমাদের পরম মিত্র। আমাদের প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি ভারতে দুদিনের সফরে গিয়ে দুটি ভাষণ দিয়েছেন। তিনি দুই দেশের সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক বন্ধনের কথা বারবার উচ্চারণ করেছেন। বলেছেন, এ বন্ধন এবং বন্ধুত্ব দিন দিন মজবুত হচ্ছে এবং কেউ এই সম্পর্কে ফাটল ধরাতে পারবে না। এই বন্ধনের প্রতীক হলেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁরা আমাদের সবার, সব বাঙালির সম্পদ।
৬৪ বছর আগে শেরেবাংলা যে কথা বলে ‘শাস্তি’ পেয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথায় তা-ই ঘুরেফিরে এসেছে। তাঁর কথার মধ্যে একটি সুর ছিল স্পষ্ট-আমরা শান্তিপূর্ণভাবে আমাদের সমস্যাগুলো মিটিয়ে ফেলছি এবং আরও যেসব সমস্যা আছে, তারও শান্তিপূর্ণভাবে সুরাহা হবে।
প্রধানমন্ত্রী রবীন্দ্রস্মৃতিধন্য শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের আর্থিক অনুদানে তৈরি ‘বাংলাদেশ ভবন’ উদ্বোধন করতে। পরদিন তিনি আসানসোলে কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডি-লিট খেতাব পান। প্রথমটির সঙ্গে বাংলাদেশ রাষ্ট্র জড়িত। সে ক্ষেত্রে এটাকে প্রধানমন্ত্রীর সাংস্কৃতিক সফরও বলা যায়। দ্বিতীয়টি ছিল একান্তই তাঁর ব্যক্তিগত। তিনি বলেছেন, এটি তিনি সব বাঙালির জন্য উৎসর্গ করেছেন। এটি তাঁর বদান্যতা, আমরা সবাই খুশি।
বিদেশে আমাদের অনেক স্থাপনা তৈরি হয়। এসব উদ্বোধনের জন্য সরকারপ্রধানের যেতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী গেলেন। এটি তাঁর রাষ্ট্রীয় সফরও ছিল না। তবে তিনি যাওয়ায় সফরটি গণমাধ্যমে গুরুত্ব পেয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি স্বয়ং দিল্লি থেকে ছুটে এলেন শান্তিনিকেতনে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যৌথভাবে বাংলাদেশ ভবন উদ্বোধন করার জন্য। তাঁরা দুজন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনেও উপস্থিত ছিলেন। মোদি ছিলেন পদাধিকারবলে, আচার্য হিসেবে। শেখ হাসিনা ছিলেন বিশেষ সম্মানিত অতিথি। তাঁদের দুজনের মধ্যে কোনো আনুষ্ঠানিক শীর্ষ বৈঠক হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু একটি উদ্বোধনপর্বকে কেন্দ্র করে দুই প্রতিবেশী দেশের প্রধানমন্ত্রীর ‘হাই প্রোফাইল’ উপস্থিতিকে হালকা করে দেখা যায় না।
আমাদের দুই দেশের মধ্যে হাজারো সমস্যা, অনেক সমস্যা মিটে গেছে। অনেকগুলো এখনো ঝুলে আছে। সমস্যার সমাধানে ভারতের আন্তরিকতা নিয়ে বাংলাদেশে অনেক প্রশ্ন আছে। ১৯৭৪ সালে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি হলো স্থলসীমানা নিয়ে। আমাদের জাতীয় সংসদ ওই বছরেই চুক্তিটি অনুমোদন করে। ভারতের পার্লামেন্ট এটা অনুমোদন করতে সময় নিয়েছে চার দশকেরও বেশি। এর মধ্যে লাখো ছিটমহলবাসী অবর্ণনীয় দুর্দশার মধ্যে দিন কাটিয়েছে। সমুদ্রসীমা নিয়ে আমাদের দুই দেশের মধ্যে বিরোধ ছিল। আলোচনা করে সেটা মেটানো যায়নি। শেষমেশ সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক ফোরামে মামলা করে সীমানা নির্ধারণ করতে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের দুই প্রতিবেশী মিয়ানমার এবং ভারতের আচরণ ও ভূমিকা ছিল একই রকম।
আমাদের ৫৪টা নদীর প্রবাহ ও পানি ভাগাভাগি নিয়ে সমস্যা আছে। গঙ্গা নিয়ে টালবাহানা হয়েছে অনেক। দেব গৌড়ার প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর আগ্রহ ও সহানুভূতিশীল ভূমিকার কারণে ১৯৯৭ সালে গঙ্গার পানির ভাগাভাগি নিয়ে একটি মধ্যমেয়াদি চুক্তি করা সম্ভব হয়েছিল। আমরা আশা করেছিলাম, গঙ্গার পথ ধরে অন্য নদীগুলোর পানি ভাগাভাগি নিয়ে সমঝোতা করা সম্ভব হবে। কিন্তু তিস্তায় গিয়ে আমরা হোঁচট খেলাম। এখানে দিল্লির সঙ্গে কলকাতার বোঝাপড়ার সমস্যা আছে। সমাধান আমাদের হাতে নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্যই চাইছেন, এর একটি সুরাহা হোক। কিন্তু হচ্ছে না।
তিস্তা নিয়ে এই সফরে যে কিছু হবে না, তা জানাই ছিল। হুটহাট করে এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ কিংবা স্পর্শকাতর বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয় না। কিন্তু শুধু সৌজন্যের খাতিরে দুই প্রধানমন্ত্রী একসঙ্গে বসেছিলেন, এটি মনে হয় না। নিশ্চয়ই তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ে মতবিনিময় করেছেন।
অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে এমনকি কোনো সম্মেলনের করিডরে দাঁড়িয়ে কথাবার্তা বলেও অনেক জটিল সমস্যার সমাধান করা যায়। চীন-মার্কিন সম্পর্কের বরফ গলা শুরু হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে চীনের একটি টেবিল টেনিস দলের সফরকে কেন্দ্র করে। যা পিংপং ডিপ্লোম্যাসি হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে। দুই প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার বলেছেন, তাঁদের প্রধানমন্ত্রীদের মেয়াদেই তিস্তা সমস্যার সমাধান হবে। এখন তো বেলা পশ্চিমে হেলেছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বর্তমান মেয়াদ বড়জোর আর সাত মাস। নরেন্দ্র মোদিকেও আগামী বছর নির্বাচনযুদ্ধে যেতে হবে। আমরা আশা করছি, তাঁদের মেয়াদেই হয়তো সমস্যার সুরাহা হবে, বর্তমান মেয়াদে না হলেও পরবর্তী মেয়াদে। পরবর্তী মেয়াদেও যে তাঁরা থাকছেন, এ ব্যাপারে তাঁরা যথেষ্ট আস্থাশীল।
প্রধানমন্ত্রীর সফর উপলক্ষে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় একটা খবর ছাপা হয়েছে—হাসিনা ‘প্রতিদান’ চান মোদির কাছে। তিনি কী চেয়েছেন বা আদৌ চেয়েছেন কি না, তা তিনিই জানেন। মোদির সঙ্গে তাঁর ৩০ মিনিটের ‘একান্ত বৈঠকে’ তাঁরা কী আলোচনা করেছেন, তাঁরা সেটি না জানালে আমরা কোনো দিনই জানতে পারব না। সফরের আগে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, মোদি চাইলে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হতে পারে। ইঙ্গিতটি স্পষ্ট।
আমাদের নির্বাচন হবে এ বছরের শেষে। আমাদের নির্বাচনে ভারতের একটা স্টেক বা ভূমিকা থাকে, এটা সবাই জানি। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ভারতের পররাষ্ট্রসচিবের প্রকাশ্য দৌড়ঝাঁপ আমরা দেখেছি। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ভারতের কাছে গ্যাস বিক্রি করতে রাজি না হওয়ায় ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে হারিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ বিদেশিরাই ঠিক করে দেন, এখানে কে জিতবে, কে হারবে।
হঠাৎ মনে পড়ে গেল জীবনানন্দ দাশের আকাশলীনা কবিতার একটি লাইন-কী কথা তাহার সাথে? একান্ত বৈঠকে কি তাঁরা নির্বাচন নিয়ে কথা বলেছেন? গুঞ্জন আছে এ নিয়ে এবং ক্রমেই তা ডালপালা মেলছে।
- কার্টেসিঃ প্রথম আলো/ মে ৩১,২০১৮
No comments:
Post a Comment