মহিউদ্দিন অদুল
দেশে চলছে মাদকবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের করা মাদক ব্যবসায়ীদের জেলাভিত্তিক টপটেন তালিকার সঙ্গে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, কোস্টগার্ডের তালিকার সমন্বয়ে চলছে এই সর্বাত্মক অভিযান। গত এক সপ্তাহেই মাদকবিরোধী অভিযানে র্যাব-পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ প্রাণ হারিয়েছে ৩৭ জন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি এরা সবাই মাদক ব্যবসায়ী। এরপর নড়ে চড়ে বসেছে দেশের মাদক সাম্রাজ্য। গা-ঢাকা দিয়েছে দেশের শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীরা।
দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে অনেকে। ফলে রাঘববোয়াল ধরতে শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীদের আস্তানায় চালানো অভিযানে এখন অনেক ক্ষেত্রেই ধরা পড়ছে চুনোপুঁটি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. জামাল উদ্দীন আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর মাদকবিরোধী সর্বাত্মক অভিযান চলছে। এখন পুলিশ ও র্যাব আইন মেনে অভিযান পরিচালনা করলে অনেকক্ষেত্রে মাদক ব্যবসায়ীরা তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ছে। তারাও জবাবে আত্মরক্ষার্থে আইন মেনে প্রতিরোধ করতে গিয়ে গুলি ছুড়ছে। এতে কিছু মাদকব্যবসায়ী নিহত হচ্ছে। এই ভয়ে জড়িতরা গা-ঢাকা দিতে বা পালাতে পারে।
সংস্থাটির পরিচালক (অপারেশন্স ও গোয়েন্দা) সৈয়দ তৌফিক উদ্দিন আহমেদ বলেন, জেলা ভিত্তিক টপটেনসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তালিকা নিয়ে মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। অভিযান শুরুর পর থেকে সাতক্ষীরাসহ বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়াই শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ ভারতে পালিয়ে যাচ্ছে বলে জানান তিনি।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও পুলিশ-র্যাব সূত্র জানায়, ৪ঠা মে থেকে মাদকবিরোধী অভিযান জোরালোভাবে শুরু করে র্যাব, পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো। একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর দেশব্যাপী সাঁড়াশি অভিযানের সঙ্গে শুরু হয় মোবাইল কোর্ট। কয়েক মাস আগে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের করা মাদক ব্যবসায়ীদের জেলাভিত্তিক টপটেন তালিকার সঙ্গে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, কোস্টগার্ডের তালিকার সমন্বয়ে এই অভিযান চলছে। এই তালিকায় প্রায় প্রতিটি জেলা থেকে শীর্ষ ১০ জন করে মাদক ব্যবসায়ীর নাম উঠে এসেছে। অল্প কয়েকটিতে অবশ্য ১০ জনের কম নাম এসেছে। সারা দেশে ওই টপটেন তালিকায় ৬৫০ শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীর নাম উঠে আসে। এছাড়া মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন প্রয়োগের ক্ষমতা ও দায়িত্বপ্রাপ্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনী পুলিশ, এলিট ফোর্স র্যাব, সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবিরও মাদক ব্যবসায়ীর তালিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। মাদক নিয়ন্ত্রণে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে কাস্টমস ও শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ। এছাড়া মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অনুরোধে একই কাজ করে থাকে ডাক বিভাগের কর্মকর্তা, আনসার ও গ্রাম পুলিশের সদস্যরা। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর থেকে বিশেষ করে র্যাব ও পুলিশ দেশের বিভিন্ন জেলায় মাদকবিরোধী ক্রাশ প্রোগ্রাম শুরু করে। এতে বিভিন্ন জেলায় এলাকাভিত্তিক শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীরা গ্রেপ্তার হতে থাকে।
এ পর্যন্ত অন্তত এক হাজার মাদক ব্যবসায়ী গ্রেপ্তার হয়। উদ্ধার হতে থাকে মাদকের বড় বড় চালান। অভিযানে র্যাব ও পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে মাদক ব্যবসায়ীদের একের পর এক ‘বন্দুকযুদ্ধে’র খবর আসতে থাকে। এরমধ্যে গত ১৫ই মে থেকে ৮ দিনে প্রাণ গেছে ৪৩ শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীর। গতকাল বুধবার ৮ জন মারা গেছে। কিন্তু অভিযান যতই গড়াচ্ছে ততই সতর্ক হয়ে যাচ্ছে চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীরা। তারা গা-ঢাকা দিতে শুরু করেছে। এলাকা বদল করছে। ভিন্ন এলাকায় আত্মগোপন করছে। অনেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ে আত্মগোপন করেছে। অনেকে পালাচ্ছে বিদেশে। শুধু তাই নয়। মাদক ব্যবসা করে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে যাওয়া মাদক ব্যবসায়ীদের অনেকের বিদেশে থাকার নিরাপদ স্থানও রয়েছে। তাদের কেউ কেউ এরই মধ্যে সেসব দেশে সটকে পড়েছে। প্রাণে বাঁচতে তাদের অনেকেই গা-ঢাকা দিয়েছে। শুধু তাই নয়, মাদক মামলায় বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যাওয়া বন্দিরা সাধারণ জামিনের জোর চেষ্টা চালান। কিন্তু এই অবস্থায় জীবনের ঝুঁকি এড়াতে সম্প্রতি বন্দি মাদক বিক্রেতাদের জামিনে মুক্তির চেষ্টা কমে গেছে বলে জানিয়েছে একাধিক আদালত ও কারাসূত্র।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর জানায়, রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকার শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীদের অনেকেই এরই মধ্যে বিভিন্ন সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন কয়েকজনের সীমান্ত পারের খবর আসছে বলে জানান এক কর্মকর্তা। সাতক্ষীরা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বেশ কয়েকজন মাদক ব্যবসায়ী ভারতে পালিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা। তারা সীমান্তে গিয়ে ওপারের লোকদের সঙ্গে টাকার বিনিময়ে লিয়াজোঁ করছে। তারপর তাদেরকে ভারতের ভেতরে বিভিন্ন রাজ্যে গন্তব্যে পৌঁছে দিচ্ছে। সেখানে দু’তিন হাজার টাকা থেকে কয়েক লাখ টাকার লিয়াজোঁ হচ্ছে বলে জানা গেছে।
এদিকে গত মঙ্গলবার রাজধানীর মাদকের আখড়া হিসেবে পরিচিত জেনেভা ক্যাম্পে অভিযান চালানো হয়। উদ্দেশ্য ছিল চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী ইশতিয়াক, নাদিম ওরফে পঁচিশ, আরশাদ, চোরা সেলিমসহ শীর্ষ সন্ত্রাসীকে ধরা। কিন্তু তাদের কারও টিকিট পায়নি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। তাদের পরিবর্তে কয়েকজন ছিঁচকে মাদক বিক্রেতাকে ধরে আনে তারা। অপরদিকে গতকাল মঙ্গলবার চানখাঁরপুলে অভিযান চালিয়েও অনেকটা হতাশ হতে হয়েছে। তবে অন্যতম মাদক বিক্রেতা রিপনকে ১ হাজার ইয়াবা ট্যাবলেট ও ২ কেজি গাঁজাসহ গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়েছে।
সম্প্রতি চট্টগ্রামের অন্যতম মাদক ব্যবসায়ী মমতাজ ওরফে ফারুক র্যাবের বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। এরপর চট্টগ্রামের বরিশাল কলোনির অপর শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী ইউসুফ ভারতে পালিয়ে যান। কিন্তু তার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় কলকাতা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছে। কুমিল্লার অন্যতম শীর্ষ গাঁজা ব্যবসায়ী গঙ্গানগর মহল্লার আবুল হোসেন। সালদানদী রেলস্টেশনের কাছে তার বাড়ি হওয়ায় ট্রেনের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে মাদক পৌঁছান। অভিযান চালানো হলেই তিনি কুমিল্লা সীমান্তের নোম্যান্স ল্যান্ড দিয়ে ভারতে পালিয়ে যায়।
ওই অভিযানের সঙ্গে সম্পৃক্ত সংস্থাটির সহকারী পরিচালক খোরশেদ বলেন, ওই চিহ্নিত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ধরতে অভিযান চালানো হয়। কিন্তু তারা গা-ঢাকা দিয়েছে। আবার মাদকের আয়ে ব্যাপক বিত্তবৈভবের মালিক বনে যাওয়া ইশতিয়াক দেশ ছেড়ে পালিয়েছে বলেই ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া গত কয়েকদিনে সাতক্ষীরাসহ একাধিক সীমান্ত দিয়ে বহু মাদক বিক্রেতা ভারতে পালিয়েছে। সীমান্তের ভারতীয় দালালদের সঙ্গে টাকার বিনিময়ে লিয়াজোঁ করে তারা সে দেশে আত্মগোপন করছে।
- কার্টেসিঃ মানবজমিন/ মে ২৪,২০১৮
No comments:
Post a Comment