Search

Thursday, May 24, 2018

সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র - নির্মাণ ব্যয় বৈশ্বিক গড়ের চেয়েও বেশি

সাইফ বাপ্পী ও ইয়ামিন সাজিদ 


একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হওয়ার আগ পর্যন্ত সব খরচকেই মূলধনি ব্যয় হিসেবে দেখানো হয়। ভূমি অধিগ্রহণ, অনুমোদন, আইনি বিভিন্ন প্রক্রিয়া, যন্ত্রপাতি ক্রয়, নির্মাণকাজ ও কমিশনিং অর্থাৎ বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করা পর্যন্ত সব ধরনের ব্যয়ই এর মধ্যে পড়ে। বাংলাদেশে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে এ ব্যয় কেমন, তা খোঁজার চেষ্টা করেছেন যুক্তরাজ্যের কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন গবেষক। তুলনামূলক বিশ্লেষণে তারা দেখিয়েছেন, বাংলাদেশে সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে কিলোওয়াটপ্রতি মূলধনি ব্যয় বৈশ্বিক গড়ের চেয়েও বেশি।

কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে সবচেয়ে কম মূলধনি ব্যয় চীনে কিলোওয়াটপ্রতি ৫৬৮ ডলার। আর বৈশ্বিক গড় ব্যয় ৯৭৪ ডলার। তবে বাংলাদেশে এক্ষেত্রে কিলোওয়াটপ্রতি খরচ করা হয়েছে গড়ে ১ হাজার ১৬৪ ডলার। এমনকি সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৫ ডলারও খরচ করা হয়েছে।

গ্যাস টারবাইন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে বৈশ্বিক মূলধনি ব্যয় কিলোওয়াটপ্রতি গড়ে ৫৫১ ডলার। আর বাংলাদেশে সরকারিভাবে এ প্রযুক্তির গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে কিলোওয়াটপ্রতি ব্যয় গড়ে ১ হাজার ১৭৭ ডলার।

এছাড়া আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে কিলোওয়াটপ্রতি বৈশ্বিক মূলধনি ব্যয় হচ্ছে গড়ে ১ হাজার ৬০০ ডলার। একই প্রযুক্তির বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে কিলোওয়াটপ্রতি গড়ে ৩ হাজার ৩৪৩ ডলার ব্যয় হচ্ছে বাংলাদেশে।

দেশে প্রথমবারের মতো নির্মাণ হচ্ছে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। এর মূলধনি ব্যয়ও বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে ঢের বেশি। পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে কিলোওয়াটপ্রতি বৈশ্বিক মূলধনি ব্যয় গড়ে ৪ হাজার ৪৭৪ ডলার হলেও বাংলাদেশে খরচ হচ্ছে ৫ হাজার ৬২৫ ডলার।

যদিও বাংলাদেশে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে অত্যধিক বা অযৌক্তিক ব্যয়ের সুযোগ নেই বলে দাবি করেন বিদ্যুৎ সচিব আহমদ কায়কাউস। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক টেন্ডারের মাধ্যমে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের দেয়া ব্যয়ের প্রত্যেকটি খাত অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করেই প্রকল্প চূড়ান্ত করে। ফলে বাংলাদেশে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে অধিক ব্যয় বা অযৌক্তিক ব্যয়ের প্রশ্নই আসে না।

মূলধনি ব্যয়ের এ চিত্র খুুঁজতে বাংলাদেশে চালু ও নির্মাণাধীন ৬১টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মূলধনি ব্যয় বিশ্লেষণ করেছেন কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক কুমার বিশ্বজিৎ দেবনাথ ও মনজুর মোরশেদ। গবেষণার ফলাফল গত মার্চে ফ্রন্টিয়ার্স ইন এনার্জি রিসার্চে প্রকাশ হয়েছে।

এর মধ্যেও ব্যতিক্রম নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ। সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে কিলোওয়াটপ্রতি বৈশ্বিক ব্যয় গড়ে ৪ হাজার ৫৪ ডলার হলেও বাংলাদেশে তা ৩ হাজার ৬৪৯ ডলার। তুলনামূলক কম মূলধনি ব্যয় জলবিদ্যুৎকেন্দ্রে। বাংলাদেশে এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে মূলধনি ব্যয় কিলোওয়াটপ্রতি গড়ে ২ হাজার ৬৭৬ ডলার; বৈশ্বিক গড় ব্যয় যেখানে ২ হাজার ৮৬৬ ডলার।

মোট তিনটি পর্যায়ে গবেষণাটি করেছেন গবেষকরা। প্রথম পর্যায়ে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডসহ (বিপিডিবি) বিভিন্ন প্রকল্প, ইডকল ও বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে মূলধনি ব্যয়ের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। সংগৃহীত এসব তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মূলধনি ব্যয়ের একটি ডাটাবেজ তৈরি করেছেন তারা। বিশ্লেষণের জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো নির্মাণের বছর কিলোওয়াটপ্রতি স্থাপিত ব্যয়কে টাকার অংক থেকে ডলারে রূপান্তর করেছেন গবেষকদ্বয়। এজন্য ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারিত ডলার ও টাকার বিনিময় হারকে ব্যবহার করা হয়েছে। পুরনো আমলের ব্যয়ের তথ্যকে বর্তমান সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে তারা সহায়তা নিয়েছেন ২০১৫ সালের ভোক্তা ব্যয় সারণির (সিপিআই)। এসবের ভিত্তিতে গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রযুক্তির মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে কমে এসেছে। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশে, বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মূলধনি ব্যয় বাড়ছে।

দেশে উৎপাদনে আছে গ্যাস ও স্টিম টারবাইন প্রযুক্তির ৩০টি বিদ্যুৎকেন্দ্র। কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে উৎপাদনে আছে ১৮টি। গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, সরকারি মালিকানাধীন গ্যাস টারবাইন বিদ্যুৎকেন্দ্রের সর্বোচ্চ মূলধনি ব্যয় ১ হাজার ৮২৩ ও সর্বনিম্ন ৬৮০ ডলার। অর্থাৎ সরকারিভাবে এ প্রযুক্তির বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে কিলোওয়াটপ্রতি ব্যয়ের পরিমাণ গড়ে ১ হাজার ১৭৭ ডলার।

যদিও বৈশ্বিকভাবে এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে কিলোওয়াটপ্রতি ব্যয় সর্বনিম্ন ৩৬১ থেকে সর্বোচ্চ ৭৪১ ডলার। এ হিসাবে গ্যাস টারবাইন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে কিলোওয়াটপ্রতি বৈশ্বিক গড় মূলধনি ব্যয়ের পরিমাণ ৫৫১ ডলার। অর্থাৎ বাংলাদেশে সরকারি মালিকানায় গ্যাস টারবাইন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে কিলোওয়াটপ্রতি ৬২৬ ডলার বেশি মূলধনি ব্যয় হচ্ছে।

তবে বেসরকারি মালিকানাধীন গ্যাস টারবাইন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে মূলধনি ব্যয় তুলনামূলক কম, কিলোওয়াটপ্রতি সর্বনিম্ন ৫৪৫ থেকে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৪৯৫ ডলার, যার গড় ৮১৯ ডলার। অর্থাৎ বেসরকারি গ্যাস টারবাইন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের গড় মূলধনি ব্যয় বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে ২৬৮ ডলার বেশি।

কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর গড় মূলধনি ব্যয় বেসরকারির তুলনায় ১ দশমিক ৭ ও বৈশ্বিক গড়ের তুলনায় ১ দশমিক ২ গুণ বেশি। এক্ষেত্রে সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর কিলোওয়াটপ্রতি সর্বনিম্ন মূলধনি ব্যয় ৫৪৫ ও সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৫ ডলার, যার গড় দাঁড়ায় ১ হাজার ১৬৪ ডলার। বিশ্বের অন্যান্য দেশে একই প্রযুক্তির বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে কিলোওয়াটপ্রতি মূলধনি ব্যয় হচ্ছে গড়ে ৯৭৪ ডলার।

এ প্রযুক্তির বিদ্যুৎকেন্দ্রও বেসরকারিভাবে নির্মাণ করলে সরকারি কেন্দ্রের চেয়ে কম ব্যয় পড়ছে। বেসরকারি কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর কিলোওয়াটপ্রতি সর্বনিম্ন মূলধনি ব্যয় হচ্ছে ৫৬৮ থেকে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৩৮১ ডলার। অর্থাৎ বেসরকারি কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কিলোওয়াটপ্রতি গড় মূলধনি ব্যয়ের পরিমাণ ৭০৪ ডলার। এ হিসাবে একই প্রযুক্তি (কম্বাইন্ড সাইকেল) ব্যবহার করেও সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে কিলোওয়াটপ্রতি মূলধনি ব্যয়ের ব্যবধান ৪৬০ ডলার।

রামপালসহ দেশে কয়লাভিত্তিক অন্য যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন, তার সবই আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির। এ প্রযুক্তিতে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে বাংলাদেশে কিলোওয়াটপ্রতি মূলধনি ব্যয় সর্বনিম্ন ২ হাজার ৮৬৭ থেকে সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৮২০ ডলার। এ হিসাবে কিলোওয়াটপ্রতি মূলধনি ব্যয় হচ্ছে গড়ে ৩ হাজার ৩৪৩ ডলার। যদিও বিশ্বের অন্যান্য দেশে এ প্রযুক্তিতে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে কিলোওয়াটপ্রতি সর্বনিম্ন ৮২৬ থেকে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৩৭৪ ডলার বা গড়ে ১ হাজার ৬০০ ডলার মূলধনি ব্যয় হচ্ছে। অর্থাৎ আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তিতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে কিলোওয়াটপ্রতি বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে ১ হাজার ৭৪৩ ডলার বেশি মূলধনি ব্যয় হচ্ছে বাংলাদেশে।

বাংলাদেশে সাব-ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির একমাত্র কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বড়পুকুরিয়ায়। এখানকার একটি ইউনিটের মূলধনি ব্যয় ১ হাজার ৫৮৪ ডলার, যা বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে ১৯১ ডলার বেশি। সাব-ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তিতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কিলোওয়াটপ্রতি মূলধনি ব্যয় হয় সর্বনিম্ন ৬১৯ থেকে ২ হাজার ১৬৮ ডলার, যার গড় দাঁড়ায় ১ হাজার ৩৯৪ ডলার।

পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে কিলোওয়াটপ্রতি মূলধনি ব্যয় বিশ্লেষণে নির্মীয়মাণ একমাত্র রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের তথ্য বিশ্লেষণ করেছেন গবেষকরা। এরপর বিশ্বের অন্যান্য দেশের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে তারা এ ব্যয়ের তুলনা করেছেন। তাতে দেখা গেছে, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে কিলোওয়াটপ্রতি মূলধনি ব্যয় ৫ হাজার ৬২৫ ডলার, যেখানে বিশ্বের অন্যান্য দেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে কিলোওয়াটপ্রতি গড় মূলধনি ব্যয়ের পরিমাণ সর্বনিম্ন ২ হাজার ৬৫ থেকে সর্বোচ্চ ৬ হাজার ৮৮৩ ডলার, যার গড় পরিমাণ ৪ হাজার ৪৭৪ ডলার।

এর মধ্যেও নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে বিদ্যুৎ উৎপাদনের মূলধনি ব্যয় কাঠামোয় তুলনামূলক ভালো অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। সৌর ও জলবিদ্যুৎ— উভয় ক্ষেত্রেই দেশে সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মূলধনি ব্যয় তুলনামূলক কম। এর মধ্যে সৌরশক্তিনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে কিলোওয়াটপ্রতি মূলধনি ব্যয় সর্বনিম্ন ২ হাজার ৩৯১ ও সর্বোচ্চ ৪ হাজার ৯০৭ ডলার। অর্থাৎ বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুতে কিলোওয়াটপ্রতি মূলধনি ব্যয় গড়ে ৩ হাজার ৬৪৯ ডলার। বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে এ ব্যয় ৪০৫ ডলার কম।

এছাড়া জলবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে বাংলাদেশে কিলোওয়াটপ্রতি মূলধনি ব্যয় গড়ে ২ হাজার ৬৭৬ ডলার হলেও বৈশ্বিক গড় ব্যয় এক্ষেত্রে ২ হাজার ৮৬৬ ডলার। অর্থাৎ জলবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে কিলোওয়াটপ্রতি ১৯০ ডলার কম মূলধনি ব্যয় হয়েছে বাংলাদেশে।

  • কার্টেসিঃ বনিক বার্তা / মে ২৪,২০১৮

No comments:

Post a Comment