Search

Sunday, May 27, 2018

নিষ্ঠুরতা কি সহনীয় হয়ে উঠছে?

বিচারবহির্ভূত হত্যা


কামাল আহমেদ

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলাভাষীদের চলতি আলোচনার কারণে ক্ষমতাসীন দলের সাংসদ আবদুর রহমান বদিকে সাম্প্রতিক কালের সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তি বললেও সম্ভবত কম বলা হবে। আলোচনায় যেসব বিষয় এসেছে, সেগুলোর মধ্যে আছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর প্রধানদের সঙ্গে কোনো একটি অনুষ্ঠানে তাঁর খোলামেলা আলোচনার ছবি, সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে অন্তত তিনটি ভিন্ন ভিন্ন অনুষ্ঠানের কিছু ছবি, ত্রাণমন্ত্রীর সঙ্গে ছবি এবং তাঁর ফেসবুকের একটি স্ক্রিনশট; যাতে লেখা আছে, ‘চলো যাই যুদ্ধে, মাদকের বিরুদ্ধে।’ জন-আলোচনায় সাংসদ বদির এই প্রাধান্য পাওয়ার কারণ সর্বনাশা ইয়াবার কারবারে তাঁর জড়িত থাকার অভিযোগ।

সরকারঘোষিত ‘মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে’ নিহতের সংখ্যা ১২ দিনে ৮১ ছাড়িয়েছে। নিহত ব্যক্তিদের সম্পর্কে যতটা তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তাতে এঁদের অধিকাংশের বিরুদ্ধে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর তৈরি তালিকায় মাদক কারবারি হিসেবে নাম নথিভুক্ত ছিল। পুলিশ ছাড়া আর যারা তালিকা করে, তাদের মধ্যে আছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের গোয়েন্দা শাখা, পুলিশের অভিজাত অংশে—র‍্যাব ও পুলিশের গোয়েন্দা শাখা। এ ছাড়া জাতীয় নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত আরও কোনো কোনো সংস্থার তালিকায়ও তাঁদের নাম থাকার সম্ভাবনা আছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন যে সাংসদ বদির বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও প্রমাণ নেই। প্রমাণ পেলে সরকার ব্যবস্থা নেবে। আইনসম্মত ও যৌক্তিক এই মন্তব্যের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ধন্যবাদ। বছর কয়েক আগে সাংসদের ছয় ভাইয়ের নাম সরকারের তৈরি তালিকায় ছিল। ছোট ভাইয়ের ইয়াবার চালান ধরা পড়ার পর পাঁচ বছরেও যেহেতু তদন্ত শেষ হয়নি, সেহেতু তাঁরা সবাই নিরপরাধ বিবেচিত হবেন, সেটাই স্বাভাবিক। শুক্রবার তাঁর যে বেয়াইয়ের নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে, তাঁর মৃত্যুও কাম্য ছিল না। তাঁর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ ছিল, তা আদালতের বিচার্য বিষয় ছিল। সাংসদের ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে যুক্তি দিলেন, তাঁর বেয়াইয়ের ক্ষেত্রেও সেই যুক্তি প্রযোজ্য হওয়ার কথা ছিল। শুধু সাংসদ বদি কেন, এর আগে আরও কয়েকজন সাংসদ এবং ছাত্রলীগের নেতার বিরুদ্ধেও মাদক ব্যবসার অভিযোগ এসেছে। যেহেতু তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার কথা শোনা যায় না, সেহেতু ধরে নেওয়া যায়, তাঁদের ক্ষেত্রেও প্রমাণের জন্য অপেক্ষার পালা চলছে। তবে নিহত ব্যক্তিদের কপাল খারাপ যে তাঁদের ক্ষেত্রে একই নীতি অনুসৃত হয়নি।

মাদকের মতো অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে মৃত্যু অথবা অপরাধীকে নির্মূল করাই যখন একমাত্র সমাধান হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, তখন যাঁদের প্রাণ গেছে, তাঁদের আসল পরিচয়টাও একটু দেখা দরকার। যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের মধ্যে কেউ আদালতে সাজাপ্রাপ্ত হয়ে পালিয়ে ছিলেন—এমন কারও কথা শোনা যায়নি। তবে গ্রেপ্তার হয়ে আদালত থেকে জামিনে ছিলেন, এমন অনেকের কথাই শোনা গেছে। পুলিশের দুর্নীতিগ্রস্তদের চাঁদাবাজির শিকার হয়েছেন, এমন কয়েকজনের কথাও পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। অন্তত একজন রাজনৈতিক বিরোধীদলীয় কর্মীর মৃত্যুর কথাও জানা গেছে। সবচেয়ে মর্মান্তিক হচ্ছে, পরিচয় ভুল হওয়ায় নিহত হওয়ার ঘটনা। অর্থাৎ সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়াই শুধু অভিযোগ ওঠার কারণেই এঁদেরকে প্রাণ দিতে হয়েছে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের বাংলাদেশ (টিআইবি) শাখার ২০১৩ সালের একটি জরিপ বলছে যে দেশটিতে জনসেবা খাতে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি হচ্ছে পুলিশ। গত পাঁচ বছরে পুলিশের ভাবমূর্তির যে খুব একটা উন্নতি ঘটেছে, সে কথা বলার মতো কোনো দৃষ্টান্ত তারা তৈরি করতে পেরেছে এমন নয়। মাদকবিরোধী যুদ্ধ চলার সময়েই ইত্তেফাক একজন পুলিশ সুপারের ভাষ্য উল্লেখ করে বলছে, সীমান্তবর্তী একটি জেলায় পুলিশ মাদক কারবারিদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা পায় (আমাদেরও অনেকে মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মিশে গেছে, ইত্তেফাক, ২৫ মে, ২০১৮)। সীমান্তবর্তী অন্যান্য জেলার অবস্থা এর চেয়ে উন্নত কিছু হবে, এমনটি মনে করা কঠিন। ইতিমধ্যে খবর বেরিয়েছে, পুলিশ টাকা আদায়ের জন্য আটক করে মাদকের অভিযোগ দিয়ে শুধু হয়রানি করছে তা-ই নয়, গাজীপুরে টাকা নেওয়ার পরও কথিত বন্দুকযুদ্ধে সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে মেরে ফেলা হয়েছে (টাকাও নিয়েছে, ক্রসফায়ারেও দিয়েছে; বাংলা ট্রিবিউন, ২২ মে, ২০১৮)। চট্টগ্রামে র‍্যাবের সোর্স পরিচয় ভুল করায় নিহত হয়েছেন একজন এবং পরে সেই সোর্সও ক্রসফায়ারে মারা পড়েছেন (‘ভুল তথ্যে’ র‍্যাবের ‘বন্দুকযুদ্ধে’ হাবিব নিহত, দাবি পরিবারের; বিডিনিউজ ২৪.কম, ২১ মে, ২০১৮)।

সন্দেহের বশে এবং বিনা বিচারে হত্যার এই ধারা ধীরে ধীরে সমাজে সহনীয় হয়ে উঠছে কি না, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। ২০১৩, ’১৪ ও ’১৫ সালে রাজনৈতিক সহিংসতার সময়েও এ রকম বিনা বিচারে নাশকতার সন্দেহে অস্ত্র উদ্ধারের অভিযানে নিয়ে যাওয়ার পরিণতিতে অনেক প্রাণহানি ঘটেছে। সংবাদমাধ্যমের একটি বড় অংশই এসব ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভাষ্য কোনো ধরনের প্রশ্ন ছাড়াই প্রকাশ করে এসেছে। কিন্তু দু-একটা সংবাদপত্রের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এসব কল্পকাহিনির গোমর ফাঁস হতে শুরু করে এবং মানবাধিকারকর্মীদের প্রতিবাদের মুখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কৌশলে পরিবর্তন আসে। শুরু হয় পায়ে গুলি করে পঙ্গু করে দেওয়ার কৌশল অনুসরণ। এরপর ২০১৬তে ধর্মীয় উগ্রপন্থীরা হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা পরিচালনার পর জঙ্গি নির্মূলে আবারও ‘বন্দুকযুদ্ধ’ একটি সমাধান হিসেবে ফিরে আসে। জঙ্গিবাদের নৃশংসতার বিপরীতে বন্দুকযুদ্ধের বিরুদ্ধে অনেকেই নীরবতার নীতি গ্রহণ করেন।

জঙ্গিবাদীদের কাছে নানা ধরনের অস্ত্রশস্ত্র ও বিস্ফোরক ছিল, তাদের কৌশল ছিল আত্মঘাতী লড়াইয়ের। মাদক কারবারিদের কাছেও অস্ত্রশস্ত্র থাকা অস্বাভাবিক নয়। তবে মাদক কারবারিদের বাজার দখল বা নিয়ন্ত্রণের জন্য বড় ধরনের কোনো লড়াই বা অস্ত্র প্রদর্শনের নজির তেমন একটা নজরে পড়ে না। আসলে মাঠপর্যায়ে যাঁরা এগুলো লেনদেন করেন, তাঁরা খুব বড় মাপের কেউ নন। এই ব্যবসায় যাঁরা বড় খেলোয়াড়, তাঁরা রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পৃষ্ঠপোষকতা যথেষ্ট পরিমাণে পেয়ে থাকেন। পুলিশের গৎবাঁধা বন্দুকযুদ্ধের কাহিনির উপর্যুপরি পুনরাবৃত্তির বিশ্বাসযোগ্যতা তাই এখন শূন্যের কোঠায়। এসব মৃত্যুর খবরে অবশ্য সরকারের প্রত্যাশা কিছুটা হলেও পূরণ হবে। কেননা, এসব বন্দুকযুদ্ধ—দুর্নীতি ও রাজনৈতিক পক্ষপাতের কারণে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য খুবই কার্যকর। আতঙ্কের কারণে মাঠপর্যায়ের খুচরা কারবারিরা আপাতত হয়তো আত্মগোপন করবেন। তবে দীর্ঘ মেয়াদে সমাজের মাদকমুক্তিতে তা খুব একটা কাজে আসবে না। ফিলিপাইন বা মেক্সিকোর অভিজ্ঞতা সে কথাই বলে।

মাদকের সমস্যা এক দিনের নয়, অতএব সমাধানও তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে—এমন ভাবনার সুযোগ নেই। এর উৎপাদনকেন্দ্র বাংলাদেশে নয়, প্রতিবেশী দেশগুলোতে। আগে আসত ভারত থেকে ফেনসিডিল এবং পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো থেকে সাগরপথে হেরোইন। এখন তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মিয়ানমারের ইয়াবা। এসব সরবরাহের পথ বন্ধে কার্যকর ভূমিকা রাখায় ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিলে চুনোপুঁটিদের ক্রসফায়ারকেই মোক্ষম দাওয়াই ভাবা হতো না। তবে আতঙ্ক সৃষ্টি করার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকলে আলাদা কথা। নির্বাচনের আগে সেই আশঙ্কাকে নাকচও করা যায় না।

‘মাদক সমস্যা মোকাবিলার উদ্দেশ্য মহৎ, কৌশল বেআইনি’ শিরোনামে গত সপ্তাহে প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত আমার নিবন্ধে শতাধিক পাঠকের মন্তব্যে দেখা যায়, বন্দুকযুদ্ধের কৌশলকে সমর্থন ও বিরোধিতার মধ্যে ব্যবধান খুব বেশি নয়। সমর্থনকারীদের অনেকের মন্তব্যে স্পষ্ট ইঙ্গিত মেলে যে এই নিষ্ঠুরতা অনেকের কাছেই সহনীয় হয়ে উঠেছে। ‘আপনি আইন ধুয়ে পানি খান’ মন্তব্যে বোঝা যায়, এই সমস্যা জনগোষ্ঠীকে কতটা ভোগাচ্ছে। কিন্তু একইভাবে রাজনৈতিক সন্ত্রাস আমাদের ভুগিয়েছে, ধর্মীয় উগ্রবাদ ভুগিয়েছে, ভোগাচ্ছে যত্রতত্র ধর্ষণের ঘটনা, শিশু নির্যাতন, চাঁদাবাজি, অপহরণ; বেপরোয়া চালকদের মানুষ চাপা দেওয়ার প্রতিযোগিতার মতো নানা অপরাধ। ইতিমধ্যে ধর্ষণ মামলার অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দ্রুত বিচার এবং মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে মানববন্ধনও হয়েছে। ধর্ষণ, শিশু নির্যাতন, মানুষ চাপা দেওয়ার মতো ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ধরতে পারলে গণপিটুনিতে মেরে ফেলার দৃষ্টান্তও আমাদের রয়েছে। এসব অপরাধের ক্ষেত্রে মানুষের ধৈর্যচ্যুতির কারণ হচ্ছে, পুলিশের দুর্নীতি ও অদক্ষতার কারণে তদন্ত ঝুলে যাওয়া, মামলায় সাক্ষ্যপ্রমাণ দিতে না পারা ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রেও কি তাহলে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ই সমাধান?

আমাদের উচ্চ আদালত অনেক বিষয়েই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অন্যায়ের প্রতিকারে উদ্যোগী হয়েছেন এবং তাঁদের সাফল্যও আছে। কিন্তু শুধু সন্দেহের বশে যেসব বেআইনি হত্যাকাণ্ডের মতো নিষ্ঠুরতার চর্চা চলছে, তা বন্ধে তাঁরা কেন উদ্যোগী হচ্ছেন না, তার কোনো উত্তর আমাদের জানা নেই। তবে আমরা উদ্বিগ্ন হচ্ছি এই ভেবে যে বিনা বিচারে সন্দেহভাজনকে সাজা দেওয়ার প্রথা আদালতের ভাবমূর্তির জন্য মোটেও শুভ নয়।এসব বন্দুকযুদ্ধ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটা বড় অংশকেও যে নিষ্ঠুরতায় অভ্যস্ত করে তুলছে, সেটাও একটা দুর্ভাবনার বিষয়।
  • কার্টেসিঃ প্রথম আলো/ মে ২৭,২০১৮


No comments:

Post a Comment