Search

Wednesday, May 30, 2018

বেসিক থেকে ফারমার্স কেলেঙ্কারির নেপথ্যে পরিচালকরা

হাছান আদনান 

বেসরকারি একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) ওপর চাপ ছিল বড় অংকের ঋণ বিতরণের। ব্যাংকিং নীতিবহির্ভূত হওয়ায় পরিচালকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ওই ঋণ বিতরণে রাজি হননি তিনি। পরিচালকদের পক্ষ থেকে আবার চাপ এলে চাকরিই ছেড়ে দেন ওই এমডি।
ব্যাংকিং নীতিবহির্ভূত এ চর্চা চলছে দেশের অধিকাংশ ব্যাংকেই। ব্যাংক চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের অনৈতিক এ চর্চা বিপর্যয় ডেকে এনেছে বেসিক ব্যাংকে। নতুন প্রজন্মের ফারমার্স ব্যাংকের বিপর্যয় সৃষ্টির মূলেও পরিচালকদের অনৈতিক হস্তক্ষেপ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেসিক থেকে ফারমার্স ব্যাংক— প্রায় সব কেলেঙ্কারির নেপথ্যেই কোনো না কোনোভাবে রয়েছেন পরিচালকরা।

যদিও পরিচালনা পর্ষদ নীতি প্রণয়ন করবে আর ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ নীতির প্রয়োগ ঘটাবে, এটিই ব্যাংক ব্যবস্থার মূলমন্ত্র। কিন্তু কয়েক বছর ধরে উল্টো ধারায় চলছে দেশের সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো। নীতি প্রণয়নের বদলে দেশের অনেক ব্যাংকের পরিচালকরা ঋণ বিতরণে জড়িয়েছেন। নিয়োগ-পদোন্নতি থেকে শুরু করে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের প্রায় সব কাজেই হস্তক্ষেপ করছেন চেয়ারম্যানরা।

ব্যাংক পরিচালনায় পর্ষদের অনৈতিক হস্তক্ষেপের মাশুল দিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক। ২০০৯-১৪ সাল পর্যন্ত লুটপাটের শিকার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটি এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। একসময়ের আদর্শ ব্যাংকটিকে ধসিয়ে দেয়ার নেপথ্যে ছিল শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর নেতৃত্বাধীন তত্কালীন পরিচালনা পর্ষদ। সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারি, জনতা ব্যাংকের এননটেক্স ও ক্রিসেন্ট কেলেঙ্কারির সঙ্গেও পরোক্ষভাবে যুক্ত পরিচালকরা। পুরো ব্যাংকিং খাতকে নাড়িয়ে দেয়া ফারমার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারির সূত্রপাতও হয়েছে মহীউদ্দীন খান আলমগীরের নেতৃত্বাধীন পরিচালনা পর্ষদের হাতেই। একই কারণে বিপদে পড়েছিল নতুন প্রজন্মের এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকও।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পর্ষদের অনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর এমডিদের ক্ষমতা ক্রমেই কমছে। অনেক ব্যাংকের ঋণ বিতরণ, আদায়, সুদ মওকুফ, নিয়োগ, পদোন্নতিসহ সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করছেন পরিচালকরা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ক্ষমতা অনেক বেশি। একই পরিবার থেকে এখন এক ব্যাংকে চারজন পরিচালক থাকার সুযোগ পেয়েছেন। পর্ষদের অন্য সদস্যদেরও আত্মীয়-স্বজন দ্বারা সাজানো হচ্ছে। ফলে বেশির ভাগ বেসরকারি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ একেকটি পরিবারের হাতে চলে গেছে। এতে ব্যাংকের সব কাজেই পরিচালকদের হস্তক্ষেপ বাড়ছে। এ অবস্থায় বেসরকারি ব্যাংকের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হতে বাধ্য। অর্থ মন্ত্রণালয়ও বাংলাদেশ ব্যাংককে বিভিন্নভাবে চাপে রাখছে। এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন মোটেও কার্যকরভাবে কাজ করছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশের ব্যাংকিং খাতে কেলেঙ্কারির ঘটনা দিন দিন বাড়বে।

পরিচালকদের ভূমিকা কী হবে, ব্যাংক কোম্পানি আইন ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালায় তা সুনির্দিষ্ট করে দেয়া আছে। আইনের ১৫খ (১) ধারায় পর্ষদের ভূমিকা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ব্যাংক-কোম্পানির নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ, অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা এবং তা পরিপালনের জন্য পরিচালনা পর্ষদ দায়বদ্ধ থাকবে।

আইনের এ ধারার বিস্তারিত ব্যাখ্যা পাওয়া যায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি’ বিভাগের ২০১৩ সালে জারি করা ১১ নম্বর প্রজ্ঞাপনে। ওই প্রজ্ঞাপনের ৪.১ (খ)তে বলা হয়েছে, বিদ্যমান আইন ও বিধিবিধানের আওতায় ঋণ ও বিনিয়োগ প্রস্তাব মূল্যায়ন, মঞ্জুরি ও বিতরণ, ঋণ আদায়, পুনঃতফসিলীকরণ ও অবলোপনের নীতি, কৌশল, বিধি ব্যবস্থা ইত্যাদি পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদনক্রমে প্রণীত হবে। পর্ষদ ঋণ ও বিনিয়োগ অনুমোদনের ক্ষমতা সুনির্দিষ্টভাবে বণ্টন করবে এবং অনুরূপ বণ্টনের ক্ষেত্রে যতদূর সম্ভব প্রধান নির্বাহী ও তার অধস্তন কর্মকর্তাদের ওপর ঋণ মঞ্জুরির ক্ষমতা অর্পণ বাঞ্ছনীয় হবে। একই বিধানে বলা হয়েছে, কোনো পরিচালক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনে ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজে প্রভাব বিস্তার বা হস্তক্ষেপ করবেন না।

যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের এসব নীতিমালা উপেক্ষিত হয়েছিল বেসিক ও ফারমার্স ব্যাংকের ক্ষেত্রে। ব্যাংক দুটির বেশির ভাগ ঋণ অনুমোদন ও বিতরণ করা হয়েছে ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের তদবিরে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুসন্ধানেই এসব তথ্য উঠে এসেছে।

এ নিয়ে কথা হয় দেশের বেসরকারি খাতের বেশ কয়েকটি ব্যাংকের এমডির সঙ্গে। তাদের প্রায় সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছেন ঋণ দেয়ার জন্য পরিচালনা পর্ষদের তদবিরের কথা। কিন্তু কেউই নাম প্রকাশ করতে চাননি। তারা বলেন, দেশের বেশির ভাগ বেসরকারি ব্যাংকেই বড় ঋণের ক্ষেত্রে পরিচালকরা তদবির করছেন। এমডিদের চাপ দিচ্ছেন জামানতের কাগজপত্র যাচাই-বাছাই না করে ঋণ দেয়ার জন্য। চেয়ারম্যান কিংবা পরিচালকদের চাপে বিতরণ করা ঋণই পরবর্তীতে খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। পর্যাপ্ত জামানত না থাকায় খেলাপি হওয়া এ ঋণ আদায় করাও সম্ভব হচ্ছে না।

বেসরকারি ব্যাংক এমডিদের এমন অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায় ব্যাংকগুলোয় খোঁজখবর নিয়েও। দেশের অধিকাংশ ব্যাংকের এমডিদের এখন সর্বোচ্চ ৫ কোটি টাকা ঋণ বিতরণের ক্ষমতা রয়েছে। অল্প কয়েকটি ব্যাংকের এমডির ক্ষমতা আছে ১২ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ বিতরণের। কিছু ব্যাংকের এমডি নিজ ক্ষমতায় ১ কোটি টাকার বেশি ঋণ বিতরণ করতে পারেন না। সে হিসেবে এমডির ক্ষমতার বাইরে থাকা সব ঋণ প্রস্তাবই বিভিন্ন কমিটিতে যাচাই-বাছাই শেষে পরিচালনা পর্ষদে উঠছে। পর্ষদের অনুমোদনের পরই সে ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি বেসরকারি ব্যাংকের এমডি বলেন, পরিচালকদের চাপেই অনেক সময় ঋণের প্রস্তাব পর্ষদে উঠছে। ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ চাইলেই সে প্রস্তাব আটকাতে পারছে না।

তবে ঋণ বিতরণের সব ক্ষমতা ও দায়ভারই ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের বলে জানান বেসরকারি ব্যাংকগুলোর উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম মজুমদার। তিনি বলেন, ব্যাংকারই যাচাই-বাছাই করে পরিচালনা পর্ষদে ঋণ প্রস্তাব নিয়ে আসেন। কাগজপত্র ঠিক থাকার পর পর্ষদ ঋণ অনুমোদন করে। পরিচালকদের গ্রাহকের অবস্থান জানার সুযোগ হয় না। যদি কোনো ঋণ প্রস্তাবে ত্রুটি থাকে, তার দায়ভার ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকেই নিতে হবে। ব্যাংকের এমডিদের দায়িত্ব হবে চেয়ারম্যান বা অন্য পরিচালকদের তদবির না শোনা। স্বাধীনচেতা মনোভাব নিয়ে কাজ করা।

ব্যাংক পরিচালকদের দায়দায়িত্ব সম্পর্কিত বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালার ৪.১(ঘ) তে বলা হয়েছে, নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, শৃঙ্খলা ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা, প্রণোদনাসহ মানবসম্পদ উন্নয়ন সম্পর্কিত নীতি এবং চাকরিবিধি পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক প্রণীত ও অনুমোদিত হবে। কিন্তু অনুমোদিত চাকরিবিধির আওতায় নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থাসহ যাবতীয় প্রশাসনিক কার্যক্রমে পর্ষদের চেয়ারম্যান বা পরিচালকরা কোনোভাবেই সংশ্লিষ্ট হতে পারবেন না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এ নীতিমালাও দেশের অধিকাংশ ব্যাংকেই লঙ্ঘিত হওয়ার অভিযোগ আছে। বেসিক ব্যাংকের নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে চেয়ারম্যান কর্তৃক ‘চিরকুট’ দেয়ার প্রমাণ বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তেও উঠে এসেছে। বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোয় নিয়োগ ও পদোন্নতি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের আশীর্বাদেই হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে।

ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালার ৪.৩-এ বলা হয়েছে, পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান বা পর্ষদ কর্তৃক গঠিত কোনো কমিটির চেয়ারম্যান কিংবা কোনো পরিচালক ব্যক্তিগতভাবে কোনো নীতিনির্ধারণী অথবা নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগের এখতিয়ার রাখেন না বিধায় তিনি ব্যাংকের প্রশাসনিক বা পরিচালনাগত তথা দৈনন্দিন কাজে অংশগ্রহণ কিংবা হস্তক্ষেপ করবেন না।

একই বিধানে বলা হয়েছে, পর্ষদের সিদ্ধান্তক্রমে ব্যাংকের ব্যবসায়িক স্বার্থে চেয়ারম্যানের অনুকূলে একটি অফিস কক্ষ, একজন ব্যক্তিগত সহকারী, একজন পিয়ন, অফিসে একটি টেলিফোন, দেশের অভ্যন্তরে ব্যবহারের জন্য একটি মোবাইল ফোন ও একটি গাড়ি দেয়া যেতে পারে।

দেশের অধিকাংশ ব্যাংকেই নীতিমালার এ বিধান লঙ্ঘিত হচ্ছে। চেয়ারম্যান ও পরিচালকরা ব্যাংকের দৈনন্দিন কাজে হস্তক্ষেপ করছেন বলে অভিযোগ আছে। একই সঙ্গে ব্যাংকের অভ্যন্তরে বিলাসবহুল কক্ষে বসে কোনো কোনো চেয়ারম্যান নিজ ব্যবসার কর্মকাণ্ড পরিচালনা কিংবা রাজনৈতিক অনুষ্ঠান করছেন।

ব্যাংকিং খাতের বড় কেলেঙ্কারির সঙ্গে পর্ষদের সম্পৃক্ততার বিষয়ে একমত অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির সঙ্গে পর্ষদ ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকলেও সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের ত্রুটিই বেশি ছিল। তবে ওরিয়েন্টাল থেকে শুরু করে হাল আমলের ফারমার্স কেলেঙ্কারির জন্য পরিচালনা পর্ষদই দায়ী।

ড. জায়েদ বখত বলেন, আশার কথা হচ্ছে, এ মুহূর্তে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ যথেষ্ট স্বাধীন। আমরা ব্যাংকের নীতি প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত থাকার চেষ্টা করছি। কোনো বড় ঋণ পুনঃতফসিল কিংবা অনুমোদনের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কোনো পরিচালক যুক্ত থাকতে পারেন। সামষ্টিকভাবে অসৎ পরিচালনা পর্ষদ এখন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে নেই। তবে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ অনেক বেশি ক্ষমতার চর্চা করছে। এ ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ যাতে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে।

  • কার্টেসিঃ বনিক বার্তা/ মে ৩০,২০১৮ 


No comments:

Post a Comment