Search

Sunday, May 27, 2018

বদি ভাই ভয় নাই, জয় বাংলা বলে এগিয়ে চলো...

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী


কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ অঞ্চল থেকে আওয়ামী লীগের এমপি আবদুর রহমান বদি এখন মিডিয়ায় এক বিরাট সম্রাট। প্রতিদিনই মিডিয়া তাকে নিয়ে নানা ধরনের খবর প্রচার করছে। শুধু প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক মিডিয়াই নয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তিনি এক বিরাট হিরো। 

হিরো অবশ্য তিনি নতুন নন। রাজনীতিতে আসার আগে থেকেই টেকনাফ- উখিয়ায় তাকে সম্রাট হিসেবে চেনেন ওই এলাকার সাধারণ মানুষ। আর এমপি হওয়ার পর তো কোনো কথাই নেই। বাংলাদেশে রাজনীতি সচেতন মানুষের মধ্যে এমন কেউ নেই, যিনি আবদুর রহমান বদির নাম জানেন না। সে দিক থেকে তিনি ‘হিরো নম্বর ওয়ান’।

সম্প্রতি তার নাম মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রচারিত হওয়ার কারণ, সরকারের মাদকবিরোধী অভিযান। এই মাদকবিরোধী অভিযানের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটছে প্রতিদিন। এই লেখা যেদিন প্রকাশিত হবে, তত দিনে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড শতাধিক হয়ে যেতে পারে। সরকার এই অভিযানকে বলছে ‘বন্দুকযুদ্ধ’। 

যখন থেকে বন্দুকযুদ্ধের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড শুরু হয়েছে, তখন থেকে একই কাহিনী প্রচার করা হচ্ছে। নতুন কোনো ক্রিয়েটিভ কাহিনী আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা সরকার তৈরি করতে পারেনি। সে কাহিনী গৎবাঁধা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যাকেই আটক করুক, তাদের বক্তব্য অনুযায়ী আটক ব্যক্তি একজন ‘কুখ্যাত’ ঘাতক কিংবা সন্ত্রাসী অথবা অস্ত্রবাজ। পুলিশ বা র‌্যাবের ভাষ্য অনুযায়ী ওই ব্যক্তিসংশ্লিষ্ট বাহিনীর কানে কানে জানায় যে, অমুক জায়গায় তার আরো অস্ত্র লুকানো আছে। তখন ওই বাহিনী ফোর্স নিয়ে সে অস্ত্র উদ্ধারের জন্য নির্ধারিত এলাকার দিকে রওনা হয়। কিন্তু ওই এলাকায় আগে থেকেই ওঁৎ পেতে থাকে সন্ত্রাসীর সহযোগীরা।

ওই সহযোগীরা এতই দক্ষ যে, তারা আগে থেকেই অত্যন্ত নির্ভুলভাবে জানতে পারে যে, ঠিক কোথায় র‌্যাব বা পুলিশ অভিযানে যাচ্ছে। এদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও গোয়েন্দা নেটওয়ার্কও অত্যন্ত শক্তিশালী। কখনো তারা ভুল করে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাছাকাছি যেতেই তারা গুলিবর্ষণ শুরু করে। এ ক্ষেত্রেও আটক ব্যক্তির সহযোগীরা চিতার চেয়েও ক্ষিপ্র গতিসম্পন্ন। তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়ে মুহূর্তেই হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। আর নিহত হয় পুলিশের জিম্মায় থাকা কথিত সন্ত্রাসী। আজ পর্যন্ত ওই সন্ত্রাসীর সহযোগীদের কেউ ধরাও পড়েনি বা নিহত হয়নি। 

এসব অভিযানে গিয়ে এত বড় বন্দুকযুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ নিহত হয়নি। কখনো কখনো বলা হয় যে, এই অভিযানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকজন আহত হয়েছেন। তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। কিন্তু এসব কথা কেউ বিশ্বাস করে না। সাধারণ মানুষ মনে করে যে, কথিত ওই সন্ত্রাসীকে র‌্যাব বা পুলিশ ঠাণ্ডামাথায় গুলি করে হত্যা করেছে। সরকারের সাম্প্রতিক মাদকবিরোধী অভিযানেও হত্যা সম্পর্কে একই কাহিনী প্রচার করা হচ্ছে। আর যথারীতি মানুষ তা অবিশ্বাসও করে যাচ্ছে।

এই অভিযানেই এসেছে এমপি বদির নাম। দীর্ঘকাল ধরে বদি নিজ এলাকায় তো বটেই গোটা দেশেই মাদকসম্রাট হিসেবে সুনাম নিয়ে আছেন। তার ওপর তার বিরুদ্ধে আছে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় আদম পাচারেরও অভিযোগ। সেভাবে তাকে আদমসম্রাটও বলা হয়। এই মাদকবিরোধী অভিযানের আগে সরকারের পাঁচটি সংস্থা মিলে মাদক ব্যবসায়ীদের একটি তালিকা তৈরি করেছে। এই তালিকায় শীর্ষ মাদকসম্রাট হিসেবে আছে এমপি বদির নাম। মাদকদব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তালিকায় মাদক কারবারি হিসেবে এক নম্বরে আছে এমপি বদির নাম। কিন্তু সরকার তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে কিছুতেই রাজি নয়। এ ক্ষেত্রে সরকার বরং বদির পক্ষ নিয়ে কথা বলতে কসুর করছে না। 

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বদির পিঠ চাপড়ে দিয়ে আগে বলেছিলেন যে, উখিয়া টেকনাফে এমপি বদির বিকল্প নেই। আর এখন মাদকবিরোধী অভিযানের সময় তিনি বলছেন, একজন এমপিকে তো আর চট করে ধরা যায় না। কেন ধরা যায় না? সাধারণ মানুষ যারা বন্দুকযুদ্ধের নামে খুন হচ্ছেন, তাদের পরিবারের তো ভিন্ন ভাষ্য আছে। তারা বলছেন, পুলিশ টাকা চেয়েছিল, দিতে পারেনি বলে বন্দুকযুদ্ধের নামে খুন করা হয়েছে। এখানে তো ন্যায়বিচার হলো না।

এটা সবাই জানেন যে, ইয়াবার মতো ভয়াবহ মাদকের মূল উৎস টেকনাফ। মিয়ানমার থেকে প্রতিদিনই বিপুলসংখ্যক ইয়াবা আসছে বাংলাদেশে। টেকনাফের অনেক স্থানীয় পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালীরা ইয়াবার সঙ্গে জড়িত থাকায় বারবার এমপি বদির নাম উঠে এসেছে। এমনকি তার ঘনিষ্ঠ কর্মী ও আত্মীয়স্বজনের নামও জড়িত ইয়াবার কারবারে। তাদের কেউ কেউ এরই মধ্যে ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন। 

গত ২২ মে সচিবালয়ে এমপি বদির বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘সংসদ সদস্য বদির বিরুদ্ধে অভিযোগ আমাদের কাছে আছে। আমরা সেই অভিযোগ সম্পর্কে খোঁজ নিচ্ছি। বদিসহ অন্য মাদকব্যবসায়ীদের বিষয়ে আপনাদের কাছে কোনো তথ্য থাকলে আমাদের দিন। বদির বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, তথ্য-প্রমাণ নাই।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়।

গত ৩১ ডিসেম্বর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর থেকে ১৪১ জনের তালিকা দুর্নীতি দমন কমিশনে পাঠানো হয়। ওই তালিকায় গডফাদার হিসেবে বদি ও তার পাঁচ ভাইয়ের নাম রয়েছে। তালিকার দ্বিতীয় পৃষ্ঠার একটি প্যারায় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘মাননীয় সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি দেশের ইয়াবা জগতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী। তার ইশারার বাইরে কিছু হয় না। দেশের ইয়াবা আগ্রাসন বন্ধের জন্য তার ইচ্ছাশক্তিই যথেষ্ট।’ তালিকায় সরকারদলীয় সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদিকে মাদক সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি বলা হয়েছে। এতে বদির সঙ্গে তার পাঁচ ভাইয়ের নামও উঠে এসেছে। তাদের মধ্যে সরকারের প্রায় সব সংস্থার তালিকায় সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি ছাড়াও তার পাঁচ ভাইয়ের নাম রয়েছে। তার ভাইয়েরা ছাড়াও তালিকায় আছে তার পিএস মং মং সেন ও ভাগ্নে সাহেদুর রহমান নিপুসহ বেশ কয়েক জন ঘনিষ্ঠ ব্যক্তির নাম।

এক সহযোগী জানিয়েছে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তালিকাসংক্রান্ত গোপনীয় প্রতিবেদনের ভূমিকা অংশে বলা হয়েছে, সরকারদলীয় এমপি হওয়ার সুবাদে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অনুসারী-সহযোগী নিয়ে তিনি ইচ্ছামাফিক ইয়াবা কারবারিসহ অন্য উৎস হতে অবৈধ আয়ে জড়িত আছেন। শীর্ষ ইয়াবা কারবারিরা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ইয়াবা কারবার করার সাহস রাখে না। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জেলার অন্য শীর্ষ মাদক কারবারি বা টেকনাফের যেকোনো চাঁদাবাজ এলাকায় প্রভাব বিস্তারে সক্ষম নয়। বিশেষত, মিয়ানমার থেকে চোরাচালান হওয়া ইয়াবা কারবার বন্ধ করার জন্য তার ইচ্ছাশক্তি সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।’ এক বছর আগে মাদকদব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর যে তালিকা তৈরি করেছিল, তাতে ইয়াবা কারবারির সংখ্যা বলা হয় ২০০ জন। 

দুই বছর আগে এই তালিকায় মাদক কারবারির সংখ্যা ছিল ৫৫৪ জন। দু’টি তালিকাতেই কক্সবাজারের ইয়াবা কারবারিদের মধ্যে আবদুর রহমান বদি, তার আপন ও সৎ চার ভাই রয়েছেন। এর বাইরে বদির বেয়াই আক্তার কামাল ও শাহেদ কামাল, মামা হায়দার আলী, মামাতো ভাই কামরুল ইসলাম রাসেল ও ভাগ্নে নিপুও ইয়াবা কারবারে জড়িত বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বদির ঘনিষ্ঠজন ও ডান হাত জাফর আহমেদ ও তার চার ছেলের নাম রয়েছে শীর্ষ কারবারি হিসেবে। অর্থাৎ বদির বৃত্তের বাইরে নেই কারবারিদের কেউ। আবার টেকনাফের রাজনীতি, অর্থনীতি সব চলছে ইয়াবাকে কেন্দ্র করে। জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে শুরু করে এমন কোনো সেক্টর নেই, যারা ইয়াবা কারবারের মাঝে জড়িত নন।

আর একটি সংবাদপত্র জানিয়েছে- ভারতের সীমান্তবর্তী একটি জেলার পুলিশ সুপার তাদের জানিয়েছেন, ‘পুলিশের একটি অংশ ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকে আসক্ত। তাদের সামাল দেয়া বড় কঠিন। কারণ, তাদের বেশির ভাগই মাদক কারবারিদের সঙ্গে মিশে গেছে। মাদক কারবারিদের সঙ্গে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের একটা অংশ মিশে গেছে। তারা প্রকাশ্যে কিংবা পর্দার অন্তরালে থেকে মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ করছে। একই সঙ্গে তারা মাদক কারবারিদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারাও পাচ্ছেন। তাই মাদক নির্মূলের পাশাপাশি জড়িত পুলিশ সদস্যদের নিয়ন্ত্রণে রাখাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

তবে আপাতত আবদুর রহমান বদির কোনো ভয় আছে বলে মনে হয় না। কারণ, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান আছেন বদির পাশে। তারা বলছেন, বদির বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও কোনো প্রমাণ নেই। যেন, যে ৬০ জনের বেশি মানুষকে এ পর্যন্ত বন্দুকযুদ্ধে হত্যা করা হয়েছে, তাদের সবার বিরুদ্ধে মাদক কারবারের প্রমাণ রয়েছে! তাদের বিরুদ্ধেও কোনো প্রমাণ নেই। তাহলে কেন এই হত্যাযজ্ঞ? এই বিচারবহির্ভূত হত্যা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। সেই সঙ্গে আমরা স্লোগান দিতে পারি- ‘বদি ভাই ভয় নাই, রাষ্ট্র আছে তোমার সাথে’, ‘বদি ভাই এগিয়ে চলো, সরকার আছে তোমার সাথে’, ‘বদি ভাই চিরজীবী হোক’।
  • কার্টেসিঃ নয়াদিগন্ত/ মে ২৭,২০১৮ 

No comments:

Post a Comment