জিয়া হাসান
তাহলে প্রশ্ন করতে পারি , এই স্যাটেলাইট কি কাজে আসবে , কার কাজে আসবে? এটা কি শুধু শুধু? মোটেও নয়। এই স্যাটেলাইট আমাদের অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ একটা কাজে আসবে।
কিন্ত সেটা আমরা কাজে লাগাতে পারবো নাকি তার গুড়টা অন্য কেউ খেয়ে নেবে, সেটা সরকারের কিছু সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে।
শেষ পর্বে আমরা একটু সামারি করি, স্যাটেলাইটের উল্লিখিত বেনেফিটগুলো নিয়ে সরকারের দাবি কি এবং আমরা কি পাচ্ছি।
১। দাবী --- ২৬ টা কিউব্যান্ড এবং ১৪ টা সিব্যান্ডের ট্রান্সপন্ডার দেশীয় স্যাটেলাইট চ্যানেল ব্যবহার করবে। এবং তার ফলে বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে।
বাস্তবতা - একাত্তর টিভির প্রধান মোজাম্মেল বাবুরা পর্যন্ত স্বীকার যাচ্ছেন যে এই স্যাটেলাইট তার অরবিটাল স্লটের অবস্থান দেশীয় চ্যানেলগুলির জন্যে একটা চ্যালেঞ্জ কারণ কিউব্যান্ডে এই অ্যাঙ্গেলে বৃষ্টির কারণে খুবই ডিজরাপশান হয় এবং তাদের আলোচনা থেকেই আমরা জেনেছি, তাদের জন্যে আরো উল্লম্ব (vertical) খাড়া অবস্থানে (৯০ডিগ্রি বা কাছাকাছি) যে সব স্যাটেলাইট আছে তাদের কাছ থেকেই স্লট নিয়ে বরং চ্যানেল পরিচালনা সহজ।
ফলে সরকার যদি তাদেরকে বাধ্য না করে, বা সিব্যান্ডের প্রযুক্তি কনভার্ট করতে জোর না করে, বা তাদের পুরনো কন্ট্রাক্টের জন্যে কম্পেনসেট না করে - এই চ্যানেলগুলো কিউব্যান্ড ট্রান্সপন্ডার ব্যবহার না-ও করতে পারে।
২। দাবী --- বিদেশী কোম্পানিকে বিক্রয় করা হবে।
বাস্তবতা --- এই স্যাটেলাইটের জোনে যে দেশগুলো আছে তাদের মধ্যে মিয়ানমার ২০১৯ এ স্যাটেলাইট ছাড়বে। শ্রীলঙ্কার ইতিমধ্যে আছে, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া এদের আছে। ভারতের মার্কেটে ডিটিএইচ অপারেটরদের কাছে কিউ ব্যান্ডের চাহিদা আছে, কিন্ত সেখানেও অ্যাঙ্গেল খারাপ। এবং সেইখানে রেগুলেটরি এমবারগো আছে । এবং এশিয়ান সাউথ ইস্ট এশিয়ান বাজার খুব দুর্বল।
তবে যদি একদম নামমাত্র মুল্যে দেওয়া হয়, সেটা অন্য কথা। কিন্ত স্যাটেলাইটের কম্পিটিটিভ মার্কেটে এই ট্রান্সপন্ডার বিক্রি সরকার রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট আনতে পারবে - এটা নিয়ে খুবই সন্দিহান থাকতে হবে আমাদের।
৩। দাবী --- দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট ও টেলিযোগাযোগ সেবার সম্প্রসারণ করা সম্ভব হবে ।
বাস্তবতা --- আমরা বলেছি, বাংলাদেশে প্রত্যন্ত অঞ্চল বলে কিছু নাই। তবুও যদি থেকে থাকে, তবে স্যাটেলাইট দিয়ে যে খরচে, ন্যারোব্যান্ড ডাটা পাওয়া যাবে এবং তার যে দাম পড়বে লাইন অফ সাইট রেডিও লিংক দিয়ে তার চেয়ন ১০০ গুন সস্তা ব্রড ব্যান্ড পাওয়া যাবে।
এবং বলেছি, ফোর জি নেটওয়ার্ককে, রেন্ট সিকিং করে অতিরিক্ত চার্জ করার কারণে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে হাইস্পিড ডাটা সম্প্রসারণে টেলিকমগুলো পিছিয়ে পড়েছে - এটা কমার্শিয়াল সিদ্ধান্ত, টেকনলজিকাল নয়।
সো অ্যাভেইলেবল এবং সস্তা টেকনলজিকে ফেলে রেখে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট দিয়ে দূরবর্তী অঞ্চলে ইন্টারনেট কানেকশান দেয়ার বিষয়টি একটা প্রপাগান্ডা মাত্র।
একই সাথে টেলিযোগাযোগের ক্ষেত্রে বলেছি এটা এক ভয়ংকর মিথ্যাচার। কারণ স্যাটেলাইট দিয়ে টেলিযোগাযোগ দিতে পারে, বিশ্বের মাত্র ৮টি কোম্পানি যেমন ইরিডিয়াম, ইন্মারসেট- ইত্যাদি।
কারণ স্যাটেলাইট দিয়ে আপ লিঙ্ক এবং ডাউনলিঙ্ক করা যাবে কিন্ত এই টেলিযোগাযোগ স্থাপন করতে গ্রামীন বা রবির চেয়ে বিশাল বড় একটা টেলিকম কোম্পানি তার, সার্ভার, তার পেমেন্ট সিস্টেম, নাম্বার মাচিং সুইচ, রাউটিং সব বসাতে হবে।
তাই বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট দিয়ে টেলিযোগাযোগের গল্প প্রতারণামুলক দাবী।
এবং এদের এক একটা সেট ফোনের দাম এক লাখের কাছাকাছি এবং চাইলেই সরকার এই সেটগুলো কিনে সরবরাহ করতে পারে। এবং র্যাব, ইউএন বা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় নিযোজিত সংস্থা গুলো ইতিমধ্যেই এই সেটফোন ব্যবহার করছে। এর জন্যে নতুন করে, আরেকটা টেলিকম কোম্পানি বসানো,আর একটা স্যাটেলাইট লাগে না।
৪। দাবী --- দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবেলার করা হবে।
এই বিষয়ে আমরা বলেছি, এই স্যাটেলাইট একটি কমিউনিকেশান স্যাটেলাইট। এর কোন ধরনের ইমেজিং, সেন্সিং ক্যাপাসিটি নেই।এবং দুর্যোগ মোকাবেলার মূল ইস্যুই হচ্ছে, ইমেজিং এবং সেন্সিং। মনে করেন, কোন নদীতে পানি বেড়েছে কিনা বা একটা জলোচ্ছ্বাসের পরে কোন কোন এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হলো কোথায় ত্রাণ বেশি লাগবে এই তথ্য গুলো যাচাই করা।
যেহেতু এই স্যাটেলাইটে এই ধরনের কোন সেন্সর এবং ক্যামেরা লাগান হয়নি, তাই এই সার্ভিস গুলো দেয়ার প্রশ্নই আসেনা।
এবং আমরা আরো বলেছি, এই ডাটা এবং ইমেজগুলো জাতিসঙ্ঘের ইউনিসেফ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ইতিমধ্যেই পাওয়া যায় কিন্ত সরকার এটা বিগত চল্লিশ বছরে ব্যবহার করেনি, তাই , স্যাটেলাইট দিয়ে এইগুলো হবে, সেটা জাস্ট একটা কল্পবাস্তবতা।
তাহলে এই স্যাটেলাইট কি কাজে আসবে ? এই ২৪টা কিউব্যান্ডের ট্রান্সপন্ডার কি সরকার ফেলে রাখবে ?
নাহ, এই স্যাটেলাইটের বিশেষ একটা ‘গোল’ আছে। এই স্যাটেলাইট দিয়ে, আল্টিমেটলি যেটা করা হবে, সেটা হচ্ছে ডিটিএইচ বা ডাইরকেট টু হোম সার্ভিস দেয়া হবে। এই সার্ভিসে আপনি একটা সেট টপ বক্স কিনবেন এবং সেইটা দিয়ে আপনি সরাসরি স্যাটেলাইট থেকে ডিশ কানেকশান নিবেন - পাড়ার কেবল টিভি অপারেটর থেকে লাইন আর নিতে হবে না।
বাংলাদেশে দুইটি কোম্পানি ১। বেক্সিমকো গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রিয়েল ভিউ । এবং বায়ার মিডিয়া ইতিমধ্যেই এই সারভিসের লাইসেন্স পেয়েছে। এর মধ্যে রিয়েল ভিউ ইতোমধ্যেই ডিটিএইচ সম্প্রচার করছে এবং সার্ভিস বিক্রি করছে। আমি কয়েকটি ফ্যামিলিকে দেখেছি এই সার্ভিস নিতে।
ডাইরেক্ট টু হোম বোঝার সহজ উপায় হচ্ছে, টাটা স্কাই, যেটা গ্রামে বা মফস্বলে যেখানে কেবল টিভি নাই সেই ধরনের কিছু এলাকায় দেখা যায়। টাটা স্কাই যদিও বাংলাদেশে অবৈধ কিন্ত অনেকেই এটা এখন ব্যবহার করছেন।
এই ডাইরেক্ট টু হোম স্যাটেলাইট চ্যানেল সার্ভিসের বাংলাদেশের বাজার অনেক বড় বাজার। এইটা সরাসরি সারা দেশের কেবল টিভি নেটওয়ার্কের সাথে কম্পিট করবে, যারা অনেকে দাম বাড়িয়েছে। এদের অনেকের সার্ভিস খারাপ এবং অনেক জায়গায় এখনো অ্যাকসেসিবলও নয়।
এবং ডিটিএইচ প্রযুক্তি অনেক ম্যাচিওর প্রযুক্তি। ভারতে ২০০৪ সাল থেকেই ডাইরেক্ট টু হোম সার্ভিস আছে।
পাকিস্তান, বাংলাদেশে এই প্রযুক্তি অনেক পরে এসেছে। পাকিস্তান, ২০১৭ সালে ডাইরেক্ট টু হোমের অকশন করে, এবং তাতে তাদের টেলিকম রেগুলেটরি অথরিটি ডিটিএইছ স্পেক্টরাম বিক্রি করে ১৫০০ কোটি রুপি আয় করে।
কিন্ত বাংলাদেশে ডাইরেক্ট টু হোম সার্ভিস দেয়ার পারমিশান দেয়া হয়েছে যে দুইটা কোম্পানিকে তারা , নিউইয়র্কে তথ্য মন্ত্রণালয়ের বিটিআরসি চেয়ারম্যানের দেওয়া সাক্ষাতকার মতে, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে সরাসরি অনুমতি নিয়ে এই সার্ভিস চালু করা হয়েছে।
ইউটিউবে এই সেমিনারের একটি ভিডিও আছে যেখানে বিটিআরসির চেয়ারম্যান স্বীকার করেছেন যে এই প্রতিষ্ঠান দুইটিকে কোন পদ্ধতিতে লাইসেন্স দেয়া হয়েছে ডাইরেক্ট টু হোম সার্ভিস স্থাপনের জন্যে, সেইটা তিনি জানেন না।
অাপনি বলতে পারেন, দুটি কোম্পানিতো ডাইরেক্ট টু হোম ইতিমধ্যেই চালু করেছে, তবে, তাদের আবার কেন এই স্যাটেলাইটের ট্রান্সপন্ডার ব্যবহার করতে হবে?
এই কোম্পানি দুটো এখনো বাংলাদেশে ব্রেক ইভেনে যেতে পারেনি। এখনো তাদের খরচ অনেক হাই, যেহেতু, অল্প কিছু কাস্টমারের জন্যেও তাদেরকে হয় ট্রান্সপন্ডার ভাড়া করতে হয়েছে বা কারো সাথে শেয়ার করতে হচ্ছে। ফলে তাদের এখন অনেক লস দিতে হচ্ছে।
কিন্ত যদি সরকারের নিজস্ব স্যাটেলাইট থেকে কোন কম্পিটিশান ছাড়া মনোপলি আকারে ট্রান্সপন্ডার ভাড়া নেয়া যায় এবং সেই খানে যদি কম্পিটিশান না থাকে তবে ইনিশিয়াল খরচটা কমে আসবে।
এবং এই খানে সমস্যা মনোপলির ।
একটা ডিটিএইচ কোম্পানিকে, ১০ থেকে ২০ টি ট্রান্সপন্ডার ব্যবহার করতে হয়। তাহলে ২৪ টি কিউট্রান্সপন্ডার যদি এভেলেভেল থাকে, দুইটি কোম্পানির জন্যেই এই সুযোগ খোলা, ফলে এই কোম্পানি দুইটি দেশের টাকায় মনোপলি ব্যবসা করতে পারবে। এবং তাদের ইনভেস্টমেন্টের রিস্ক কাভার হবে।
এভাবে আমাদের দেশের মালিকেরা কইয়ের তেলে কই ভেজে, সেই কইটি খেয়ে আপনার কাছ থেকে আবার কই কেনার পয়সা আদায় করে নেয়।
এটাই আমি যত দূর বুঝতে পেরেছি, অ্যাভেইলেবেল তথ্য ব্যবহার করে --- এটাই স্যাটেলাইট গেম-এর গোমর ফাঁক।
এটা যদি সরকার সৎ ভাবে ব্যবহার করে, তবে এখনো ডিটিএইচ অপারেটরদেরকে বেচে লাভ করে আনতে পারতেও পারে। কিন্ত এখানে নিয়ত, ক্রিপ্টোক্রেসি এবং অতিরিক্ত পলিটিক্সের লোভটাই সব চেয়ে বড় অবস্টাকল।
তাই সময় বলবে, এই স্যাটেলাইট শ্বেতহস্তি হবে নাকি সরকার এই স্যাটেলাইটের সার্ভিসকে ঠিক মত সেল করে প্রফিট আনতে পারবে।
তবে রিয়ালিটি হচ্ছে, আমাদের অপারেশান কস্ট কিন্ত উঠা শুরু হয়েছে এবং কার সাথে কি ডিল হয়েছে এবং এখনও পর্যন্ত স্যাটেলাইট আকাশে উঠে গেলেও কোন বিক্রয় চুক্তি কমপ্লিট হওয়ার কথা সরকার স্বীকার করে নাই, ফলে প্রতি দিনই কিন্ত লস শুরু হয়ে গেছে।
এটা আমার শেষ বিশ্লেষণ।
— লেখক সাড়া জাগানো ব্লগার ও তরুন উদ্দ্যোক্তা।