হাছান আদনান
বিপর্যস্ত ফারমার্স ব্যাংকে আগে থেকেই রাষ্ট্রায়ত্ত চার বাণিজ্যিক ব্যাংক ও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) ৫৫৩ কোটি টাকা জমা আছে। এ অর্থ তুলে নেয়ার শর্তে নতুন করে ৭১৫ কোটি টাকা মূলধন জোগান দেয়ার কথা ছিল প্রতিষ্ঠানগুলোর। ব্যাংকটিকে টেনে তুলতে এবার সেই শর্তও শিথিল করা হয়েছে। নতুন মূলধন জোগানের পাশাপাশি আগের অর্থও জমা থাকছে ব্যাংকটিতে।
রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে অগ্রণী ব্যাংক ১৬৫ কোটি টাকা মূলধন হিসেবে ফারমার্স ব্যাংককে জোগান দিচ্ছে। গত ২ এপ্রিল ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের ৫৫৩তম সভায় চার শর্তে ফারমার্সে মূলধন জোগান দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। এর একটি হলো— অগ্রণী ব্যাংক কর্তৃক এরই মধ্যে ব্যাংকটিতে যাওয়া ১৬৪ কোটি টাকা অতি দ্রুত আদায়ের পদক্ষেপ নেয়া।
যদিও ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের ৫৫৮তম সভায় শর্তটি রহিত করা হয়েছে। একই সঙ্গে রহিত করা হয়েছে ৫৫৩তম সভায় নেয়া অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার একজন সরকারি প্রতিনিধিকে ফারমার্স ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে অন্তর্ভুক্ত করার শর্তটিও।
অগ্রণী ব্যাংকের মতো সোনালী, জনতা ও রূপালী ব্যাংকও চেয়েছিল চার শর্তে ফারমার্স ব্যাংকে মূলধন জোগান দিতে। পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্তের পরও শর্ত পালন থেকে পিছিয়ে এসেছে ব্যাংকগুলো। মূলত ব্যাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপেই চার শর্ত থেকে পিছিয়ে এসেছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। শিথিলকৃত শর্তেই গত সপ্তাহে ফারমার্স ব্যাংকে মূলধন জোগান দেয়ার চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে চার ব্যাংকসহ রাষ্ট্রায়ত্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইসিবি।
অগ্রণী ব্যাংকের ১৬৪ কোটি টাকার পাশাপাশি সোনালী ব্যাংকের ১৪৫ কোটি, রূপালী ব্যাংকের ১০০ কোটি ও জনতা ব্যাংকের ৯৯ কোটি টাকা আগে থেকেই আছে ফারমার্স ব্যাংকে। মেয়াদি আমানত ও কলমানি হিসেবে ফারমার্সকে এ টাকা ধার দিয়েছিল রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। এরই মধ্যে এ টাকার মেয়াদ উত্তীর্ণ হলেও ফেরত দিতে পারেনি ফারমার্স ব্যাংক। এমনকি প্রায় পাঁচ মাস ধরে সুদও পরিশোধ করতে পারছে না ব্যাংকটি। সুদসহ রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের বিনিয়োগ আরো বেশি। এছাড়া ফারমার্স ব্যাংকে মূলধন হিসেবে সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইসিবির বিনিয়োগ রয়েছে ৪৫ কোটি টাকা।
ফারমার্স ব্যাংক থেকে দ্রুততম সময়ে টাকা উদ্ধারের শর্ত শিথিলের বিষয়ে রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আতাউর রহমান প্রধান বণিক বার্তাকে বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে আমরা ফারমার্স ব্যাংকে মূলধন জোগানের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মূলধন দিয়েই বিনিয়োগকৃত টাকা আদায় করার পথে হাঁটলে ফারমার্স ব্যাংক দাঁড়াতে পারবে না। এজন্য আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শে এ সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে এসেছি। সরকারি পাঁচ প্রতিষ্ঠানের এমডিরা ফারমার্স ব্যাংকের পর্ষদের সদস্য হচ্ছেন। আশা করছি, ব্যাংকটিকে আমরা টেনে তুলতে পারব। ব্যাংক ঘুরে দাঁড়ালে টাকা উঠে আসতে সময় লাগবে না।
আগের অর্থ জমা রেখেই ফারমার্স ব্যাংকে ১৬৫ কোটি টাকা করে মূলধন জোগান দিচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক। ৫৫ কোটি টাকা জোগান দিচ্ছে আইসিবি। নতুন এ মূলধন পেলে ফারমার্স ব্যাংকে রাষ্ট্রায়ত্ত এ পাঁচ প্রতিষ্ঠানের অর্থের জোগান দাঁড়াবে ১ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে অগ্রণী ব্যাংকের অর্থের পরিমাণ ৩২৯ কোটি, সোনালী ব্যাংকের ৩১০, রূপালী ব্যাংকের ২৬৫, জনতা ব্যাংকের ২৬৪ এবং আইসিবির ১০০ কোটি টাকা।
নতুন করে মূলধন জোগানের বিষয়ে জনতা ব্যাংকের এমডি মো. আব্দুছ ছালাম আজাদ বলেন, ফারমার্স ব্যাংকের সঙ্গে আমাদের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। তবে এখনো নতুন মূলধন পরিশোধ করা হয়নি। আশা করছি, চলতি সপ্তাহেই এ কার্যক্রম সম্পন্ন হবে। তিনি বলেন, ব্যাংকের পর্ষদ সভায় বসেই স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তবে কবে নাগাদ নতুন পর্ষদের সভা অনুষ্ঠিত হবে, সেটি এখনো নিশ্চিত নই।
সূত্রমতে, আমানতের তুলনায় ঋণ বেশি দেয়ায় গত বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে বিপর্যয় শুরু হয় ফারমার্স ব্যাংকে। অনিয়মের মাধ্যমে বিতরণকৃত ঋণ আদায় না হওয়ায় ক্ষত আরো বাড়তে শুরু করে। এরপর থেকে ফারমার্স ব্যাংকে রাখা আমানতের টাকা ফেরত পাচ্ছেন না গ্রাহকরা। বিপর্যস্ত ফারমার্স ব্যাংকে রাখা প্রায় ৬০ কোটি টাকা তুলতে পারছে না বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। ব্যাংকটির কাছে আটকে গেছে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের জলবায়ু তহবিলের ৫০৮ কোটি, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) কর্মচারী অবসরভাতা তহবিলের ১৭ কোটি এবং বিআইডব্লিউটিএ বেনেভোলেন্ট ফান্ডের ৪ কোটি ১৫ লাখ টাকা। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ১৮০ কোটি টাকাও আটকে আছে ফারমার্স ব্যাংকে। সরকারি এ প্রতিষ্ঠানগুলো টাকা না পেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে এরই মধ্যে অভিযোগ জানিয়েছে। আমানত তুলতে মুখিয়ে আছেন সরকারি ও বেসরকারি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানসহ ফারমার্স ব্যাংকে টাকা রাখা গ্রাহকরাও।
অনিয়ম-দুর্নীতিতে বিপর্যস্ত ফারমার্স ব্যাংককে টেনে তুলতে গত বছরের শেষের দিকে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২৭ নভেম্বর ব্যাংকটির পর্ষদ থেকে পদত্যাগ করেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর। ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ও নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। একই দিন ব্যাংকটির অডিট কমিটির চেয়ারম্যান মাহাবুবুল হক চিশতীও পদচ্যুত হন। আরেক পরিচালক ড. মোহাম্মদ আতাহার উদ্দিন ভাইস চেয়ারম্যান পদ থেকে সরে দাঁড়ান। এরপর বৈঠকে ব্যাংকের পরিচালক মোহাম্মদ মাসুদকে চেয়ারম্যান ও মারুফ আলমকে ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হয়। নতুন করে ব্যাংকটির সব কমিটি পুনর্গঠন করে ঢেলে সাজানো হয়। কিন্তু ফলাফল ভালো না হওয়ায় ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদে আরো পরিবর্তন আসে। নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান রেস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সারাফাত।
পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে ফারমার্স ব্যাংকের সব ব্যক্তি পরিচালক পদ হারিয়েছেন। নতুন করে গঠিত হচ্ছে ১১ সদস্যের পরিচালনা পর্ষদ। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংক এবং আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা (এমডি) ফারমার্স ব্যাংকের পরিচালক হচ্ছেন। রেস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের প্রতিনিধি হিসেবে ব্যাংকটির পর্ষদে থাকছেন চারজন। বাকি দুজন হবেন স্বতন্ত্র পরিচালক।
এ প্রসঙ্গে ফারমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সারাফাত বণিক বার্তাকে বলেন, ফারমার্স ব্যাংকের নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন হয়েছে। এরই মধ্যে মূলধন জোগানের জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক ও আইসিবির সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে আমরা এ পাঁচ প্রতিষ্ঠানের জোগানকৃত ৭১৫ কোটি টাকার মূলধন পেয়ে যাব।
তিনি বলেন, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে কোনো ব্যক্তি উদ্যোক্তা থাকতে পারবেন না। কেবল প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের প্রতিনিধি ব্যাংকের পরিচালক হবেন। এর মাধ্যমে ব্যাংকটির পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আসবে। পৃথিবীর অনেক বড় বড় ব্যাংক এভাবেই সুনামের সঙ্গে পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়া গ্রাহকদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে পুরো ব্যাংককে ঢেলে সাজানো হবে।
- কার্টেসিঃ বনিক বার্তা / মে ২০,২০১৮