Search

Sunday, May 20, 2018

সাংসদদের জবাবদিহি ও ‘বিষিয়ে তোলা মন’

সোহরাব হাসান

কয়েক দিন আগে একজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীর কাছে জানতে চেয়েছিলাম ‘বিরোধী দলবিহীন’ জাতীয় সংসদ কেমন চলছে। তাঁর জবাব ছিল, খুবই ভালো চলছে। এখন সরকারি ও বিরোধী দলের সাংসদদের আলোচনায় সংসদ প্রাণবন্ত। এমনকি সরকারি দলের সাংসদেরা (যাঁদের মধ্যে মন্ত্রিসভার সদস্যও আছেন) অর্থমন্ত্রীর বাজেট প্রস্তাবেরও কড়া সমালোচনা করেছেন। 

এ রকম একটি অতি কার্যকর সংসদ সম্পর্কে নিশ্চয়ই ক্ষমতাসীনেরা নেতিবাচক কোনো সংবাদ শুনতে বা দেখতে চান না। তারপরও নেতিবাচক সংবাদ আসে এবং তাঁদের সেটি হজমও করতে হয়। সংসদীয় গণতন্ত্রে সংসদই সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করে। কীভাবে সরকার চলবে, কোন খাতে কত টাকা বরাদ্দ হবে, সরকারের বৈদেশিক নীতি কী হবে—সবই ঠিক করে দেয় সংসদ। এটা হলো বইয়ের কথা। বাস্তবে কী হয়, সেটি আমরা প্রতিদিনই প্রত্যক্ষ করছি। অনেক সময় সরকার ও সংসদকে ফারাক করাও কঠিন হয়ে পড়ে। 

সংসদীয় ব্যবস্থায় বিরোধী দলের সদস্যসংখ্যা যত কমই হোক না কেন, সংসদ সব সময় সরকারকে নজরদারিতে রাখে। আমাদের সংবিধান অনুযায়ী সংসদে উত্থাপিত বিলের বিরুদ্ধে সরকারি দলের সাংসদেরা হয়তো ভোট দিতে পারেন না, কিন্তু সরকারের কাজের সমালোচনা করতে বাধা নেই। নবম সংসদেও আমরা দেখেছি, সরকারি দলের বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ সদস্য বেহাল যোগাযোগব্যবস্থা নিয়ে তৎকালীন মন্ত্রী ও সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। বর্তমানে দেশের সড়ক যোগাযোগের হাল আরও খারাপ হওয়া সত্ত্বেও সংসদে তা নিয়ে কেউ উচ্চবাচ্য করছেন না। 

সংসদে বিরোধী দলকে বলা হয় বিকল্প সরকার। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে বিরোধী দলের সাংসদদের নিয়ে ছায়া সরকার গঠন করা হয়। মন্ত্রণালয়ভিত্তিক তাদের কমিটি থাকে। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের সংসদে যে দলটি বিরোধী দলের ভূমিকায় আছে, তারা একই সঙ্গে সরকারেরও অংশীদার। সরকারে সেই দলের তিনজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী আছেন, দলের চেয়ারম্যান প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত এবং কো-চেয়ারপারসন সংসদে বিরোধী দলের নেতা। ফলে তাদের পক্ষে নীতিগত বিষয়ে সরকারের বিরোধিতা করা সম্ভব নয়। দু-একজন স্বতন্ত্র সদস্য মাঝেমধ্যে বিবেকের ভূমিকা নেওয়ার চেষ্টা করলেও তাঁদের কণ্ঠস্বর লুই কানের নকশা করা সুরম্য ভবনের দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলে ফিরে আসে। 

সরকারি ও বিরোধী দলের সাংসদেরা যে সংসদকে প্রাণবন্ত ও কার্যকর বলে অভিহিত করেছেন, গত বৃহস্পতিবার সেই সংসদের কিছুটা চিত্র তুলে ধরেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। ‘পার্লামেন্ট ওয়াচ’ নামে তারা প্রতিবছরই একটি প্রতিবেদন দিয়ে থাকে। সেই সঙ্গে সংসদকে কার্যকর করতে বেশ কিছু সুপারিশও করে। তাদের এবারের ১৪ দফা সুপারিশের মধ্যে আছে, সাংসদদের আচরণবিধি আইন প্রণয়ন, অসংসদীয় ভাষার ব্যবহার বন্ধে স্পিকারের কার্যকর ভূমিকা, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, সংসদীয় কমিটির নিয়মিত বৈঠক করা। 

এসব সুপারিশ শোনা না–শোনা সাংসদদের এখতিয়ার। কিন্তু সংসদ বা সরকার সম্পর্কে সমালোচনা করলেই সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের মন বিষিয়ে তোলার কথা বলা স্বৈরাচারী মানসিকতা ছাড়া কিছু নয়। টিআইবি যেসব তথ্য দিয়েছে, তার কোথায় ভুল আছে চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ আরেকটি সংবাদ সম্মেলন করে দেশবাসীকে জানাতে পারতেন। তা না করে তিনি সোজাসুজি বলে দিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, উন্নয়ন হচ্ছে। এসবের প্রশংসা নেই। ছোটখাটো এসব বিষয় নেতিবাচকভাবে তুলে ধরে মানুষের মন বিষিয়ে দেওয়া যাবে না।’ এই তথ্যটি তাঁকে কে দিলেন যে টিআইবি সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের মন বিষিয়ে তোলার চেষ্টা করছে। টিআইবির প্রতিবেদনে আছে প্রধানমন্ত্রী তথা সংসদ নেতা রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের পরও ৮০ শতাংশেরও বেশি সময় সংসদে থাকেন। কিন্তু সংসদ নেতা সংসদে থাকতেও দেখা যায়, অনেক মন্ত্রী ও সাংসদ সংসদে উপস্থিত থাকেন না। এটাই টিআইবি হিসাব কষে দেখিয়ে দিয়েছে। 

টিআইবির অনুসন্ধান অনুযায়ী, গত বছর বর্তমান দশম জাতীয় সংসদে গড়ে প্রতিদিন কোরাম সংকটে অপচয় হয়েছে ৩০ মিনিট, যা নবম সংসদে ছিল ৩২ মিনিট। কোরাম সংকটের কারণে গত চার বছরে ব্যয় হয়েছে ১২৫ কোটি ২০ লাখ ৬৯ হাজার ৪৪৫ টাকা। জাতীয় সংসদের সদস্য ৩৫০ জন। সংবিধান অনুযায়ী, কোরাম পূর্ণ করতে কমপক্ষে ৬০ জন সদস্য উপস্থিত থাকতে হয়। প্রতিবেদনে গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে অনুষ্ঠিত পাঁচটি অধিবেশন (১৪তম থেকে ১৮তম) বিশ্লেষণ করা হয়েছে। মোট কার্যদিবস ছিল ৭৬টি। এর মধ্যে ৩৮ ঘণ্টা ৩ মিনিট (১৩ শতাংশ সময়) কোরাম সংকটের কারণে অপচয় হয়। প্রতি কার্যদিবসে গড়ে অপচয় ৩০ মিনিট। সংসদ পরিচালনার ব্যয়ের প্রাক্কলিত হিসাব অনুযায়ী প্রতি মিনিটে গড়ে ১ লাখ ৬৩ হাজার ৬৮৬ টাকা খরচ হয়। সে হিসাবে প্রতি কার্যদিবসের গড় কোরাম সংকটের সময়ের অর্থমূল্য ৪৯ লাখ ১০ হাজার ৫৮০ টাকা। পাঁচটি অধিবেশনে কোরাম সংকটে ব্যয় হওয়া মোট সময়ের অর্থমূল্য ৩৭ কোটি ৩৬ লাখ ৯৫ হাজার ১৩৮ টাকা। গত চার বছরের কোরাম সংকটের কারণে এই ব্যয় ১২৫ কোটি ২০ লাখ ৬৯ হাজার ৪৪৫ টাকা। তাহলে ক্ষতির পরিমাণটি ভাবুন। কোরাম সংকটে অপচয় না হলে এই ১২৫ কোটি টাকা দেশ ও জনগণের কল্যাণে ব্যয় করা যেত। 

টিআইবির গবেষণায় দেখা গেছে, সংসদে বিভিন্ন আলোচনা পর্বে অসংসদীয় ভাষার ব্যবহারে মোট সময়ের ৫ শতাংশ ব্যয় হয়েছে। সংসদের বাইরের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিয়ে ১৯৫ বার অসংসদীয় ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে ২৩ বার এবং নিজ দলের সমালোচনায় একবার অসংসদীয় ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। অনির্ধারিত আলোচনার মোট সময়ের ২৬ শতাংশজুড়ে ছিল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন ও সুশীল সমাজের সমালোচনা। সংসদে যিনি উপস্থিত নেই বা যাঁদের উপস্থিত থাকার সুযোগই নেই, তাঁর বিরুদ্ধে একতরফা গালমন্দ করা সাংসদদের কাজ হতে পারে না। 

সংসদের প্রধান কাজ আইন প্রণয়ন। অথচ এই আইন প্রণয়নেই তাঁরা সবচেয়ে কম সময় দেন। একটি বিল উত্থাপন থেকে পাস করতে সময় লাগে গড়ে প্রায় ৩৫ মিনিট। আইন প্রণয়নের চেয়ে ব্যবসা–বাণিজ্যের দিকেই সাংসদদের নজর বেশি। নবম সংসদে ব্যবসায়ীদের হার ছিল ৫৩ শতাংশ। দশম সংসদে তার চেয়ে কম হওয়ার কোনো কারণ নেই। 

সংসদকে কার্যকর করতে স্থায়ী কমিটিগুলোর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। অন্যান্য সংসদীয় দেশের অনুসরণে আওয়ামী লীগ কমিটিগুলোর প্রধান করেছিল সাধারণ সদস্যদেরই। এমনকি কয়েকটি কমিটির প্রধান পদে বিরোধী দলের সাংসদকেও নেওয়া হয়েছিল। তবে অর্থ বা সরকারি হিসাব কমিটির প্রধান পদে বিরোধী দলের কাউকে কখনো নেওয়া হয়নি। নবম সংসদে চারটি কমিটির প্রধান ছিলেন বিরোধী দলের। এবার মাত্র একটি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। 

চিফ হুইপ টিআইবিকে মানুষের মনে বিষ না ঢুকিয়ে অন্যান্য দেশের সংসদ নিয়ে গবেষণা করার পরামর্শ দিয়েছেন। এ সম্পর্কে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামানের মনোযোগ আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, সংসদীয় গণতন্ত্র চালু আছে—এ রকম অন্তত ১০০টি দেশের সংসদ নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা গবেষণা ও তদারকি করে থাকে। তাই এ কথা ভাবার কারণ নেই যে বাংলাদেশের সংসদ নিয়েই শুধু মনিটরিং করা হয়। 

টিআইবি বিরোধী দলের ভূমিকা সম্পর্কে যেসব কথা বলেছে, সেসব কথা অনেক আগেই বলেছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদ ও সংসদে বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ। এমনকি তাঁরা জনগণের কাছে মুখ দেখাতে পারেন না বলে অনুশোচনাও করেছেন। আবার দুজনই প্রধানমন্ত্রীর কাছে আরজি জানিয়েছেন, দলের মন্ত্রীদের যেন তিনি সরকার থেকে বাদ দিয়ে দেন। বিরোধী দলের যে নেতা নিজ দলের নেতাদের মন্ত্রিসভা থেকে প্রত্যাহার করাতে না পেরে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আরজি পেশ করেন, তিনি কীভাবে বিরোধী দলের নেতার দায়িত্ব পালন করবেন? আর বিশেষ দূতের বিশেষ ভূমিকার কথা না হয় না–ই বললাম।
  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
  • কার্টেসিঃ প্রথম আলো/ মে ২০,২০১৮ 

No comments:

Post a Comment