হাছান আদনান
চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই দেশে ডলারের বাজারে অস্থিরতা চলছে। এক বছরের ব্যবধানে আন্তঃব্যাংক লেনদেনে ডলারের দাম বেড়েছে ৩ টাকার বেশি। বাজার স্বাভাবিক রাখতে এরই মধ্যে প্রায় ২৪০ কোটি ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে ব্যাংকগুলোকে কয়েক দফা সতর্কও করা হয়েছে। যদিও কাজে আসছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এসব হস্তক্ষেপ। প্রতি ডলার এখনো ৮৫ টাকার উপরেই বিক্রি হচ্ছে।
ব্যাংকসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, চাহিদা থাকায় হিসাব-নিকাশ ছাড়াই ব্যাংকগুলো আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খুলেছে। এখন এলসির দায় পরিশোধ করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ের তুলনায় বেশি আমদানি এলসি খোলা ব্যাংকগুলোর বিপদ ক্রমেই বাড়ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও তুলার দাম বাড়তে থাকায় শিগগিরই ডলারের সংকট নিরসনের লক্ষণ দেখছেন না ব্যাংকাররা।
বিদ্যমান ডলার সংকট দেশের অর্থনীতির জন্য উদ্বেগের কারণ বলে মনে করেন ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ আমদানি এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে, সে পরিমাণ রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স দেশে আসেনি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ব্যাংকগুলোয় ডলারের সংকট সৃষ্টি হয়েছে। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে যেসব এলসি খোলা হয়েছে, সেগুলো এখন নিষ্পত্তি হচ্ছে। এতে ডলার সংকট আরো গভীর হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিদিনই বাজারে ডলার বিক্রি করলেও চাহিদার তুলনায় তা অপ্রতুল বলে মনে করেন আনিস এ খান। তিনি বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক পর্যায়ে আনতে বেশ কয়েকবার বৈঠক হয়েছে। তার পরও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে না। এজন্য করণীয় বিষয়ে আবারো বসতে হবে।
অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে ব্যাংকগুলোকে সতর্ক করার পাশাপাশি আন্তঃব্যাংক লেনদেনে ডলারের মূল্যও নির্ধারণ করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু চাহিদার তুলনায় জোগান না থাকায় নিয়ন্ত্রক সংস্থার এ উদ্যোগ কাজে আসেনি। ডলারের বিক্রয় মূল্য সর্বোচ্চ ৮৩ টাকা নির্ধারণ করে দেয়ার সময়ও অধিকাংশ বেসরকারি ব্যাংক ৮৩ টাকা ৫০ পয়সায় ডলার বিক্রি করতে থাকে। পরবর্তী সময়ে দুই দফায় আন্তঃব্যাংক লেনদেনে ডলারের ক্রয় ও বিক্রয় মূল্য বাড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রথমে ডলারের সর্বোচ্চ বিক্রয় মূল্য ৮৩ টাকা ৫০ পয়সা ও পরে ৮৩ টাকা ৭০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু চলতি সপ্তাহে আমদানি পর্যায়ে ডলারের বিক্রয় মূল্য ৮৩ টাকা ৭৫ পয়সা ঘোষণা করছে বেসরকারি ব্যাংকগুলো। গতকাল এনসিসি, প্রাইম ব্যাংকসহ অনেক বেসরকারি ব্যাংকই বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে ডলারের মূল্য বেশি ঘোষণা করেছে। যদিও ঘোষিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামেই ডলার লেনদেন করছে ব্যাংকগুলো। নগদ লেনদেনের ক্ষেত্রে গতকাল প্রতি ডলারের মূল্য ৮৫ টাকা নিয়েছে প্রাইম ব্যাংক।
জানা গেছে, বিদায়ী বছরের ২৮ জুন আমদানির ক্ষেত্রে প্রতি ডলার ৮০ টাকা ৬০ পয়সায় বিক্রি করেছিল এনসিসি ব্যাংক। কিন্তু এক বছরের ব্যবধানে গতকাল প্রতি ডলারের জন্য ৮৩ টাকা ৭৫ পয়সা নিয়েছে ব্যাংকটি। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে দেশে আন্তঃব্যাংক লেনদেনে প্রতি ডলারের দাম বেড়েছে ৩ টাকা ১৫ পয়সা। যদিও নগদ লেনদেনে এর চেয়েও বেশি দামে ডলার বিক্রি হচ্ছে।
ডলারের এ মূল্যবৃদ্ধিতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন দেশের আমদানিকারকরা। আমদানি পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাড়তি অর্থ গুনতে হচ্ছে ভোক্তাদেরও। ঢাকার মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতি ও বাংলাদেশ হোলসেল স্পাইসেস মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ এনায়েত উল্লাহ এ প্রসঙ্গে বলেন, প্রতিনিয়তই ডলারের দাম বাড়ছে। ফলে আমদানি পণ্যের জন্য বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানান আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের এ পরিচালক।
যদিও বাজার স্থিতিশীল রাখতে চলতি অর্থবছরের গতকাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক প্রায় ২৪০ কোটি ডলার বিক্রি করেছে। একই সময়ে বাজার থেকে কোনো ডলার কেনার প্রয়োজন হয়নি বাংলাদেশ ব্যাংকের। অথচ গত অর্থবছর বাজারে ১৭ কোটি ৫০ লাখ ডলার বিক্রির বিপরীতে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ১৯৩ কোটি ১০ লাখ ডলার ক্রয় করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর আগে ২০১৫-১৬ অর্থবছরেও বাংলাদেশ ব্যাংকের ডলার বিক্রির প্রয়োজন হয়নি। যদিও ওই অর্থবছর বাজার থেকে ৪১৩ কোটি ১০ লাখ ডলার কিনেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া ২০১৪-১৫ অর্থবছর বাজার থেকে ৩৭৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার কিনেছিল। অর্থবছরটিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিক্রি করেছিল ৩৫ কোটি ৭০ লাখ ডলার। তার আগে ২০১৩-১৪ অর্থবছর বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার থেকে ৫১৫ কোটি ডলার কিনলেও সে বছর কোনো ডলার বিক্রি করেনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যাংকগুলোর চাহিদার ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি করছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) তেল আমদানির দায় পরিশোধকে এক্ষেত্রে বেশি প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। নিজেদের ব্যবস্থাপনায় এলসির দায় পরিশোধ করতে ব্যাংকগুলোকে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
এবিবি চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, খাদ্যশস্যসহ মেগা প্রকল্পগুলোর উপকরণের জন্য বিপুলসংখ্যক এলসি খোলা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে আমদানিতে প্রবৃদ্ধির হার প্রায় ২৫ শতাংশ। কিন্তু রফতানি ও রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি সেভাবে না হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই ব্যাংকগুলোয় ডলারের সংকট তৈরি হয়েছে। সংকট উত্তরণের জন্য সব পক্ষকে একযোগে কাজ করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, দুই বছর ধরেই দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান মাধ্যম রফতানি আয় ও রেমিট্যান্সপ্রবাহে ভাটা চলছে। অন্যদিকে রেকর্ড পরিমাণ চালসহ খাদ্যশস্য ও মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি হওয়ায় বেড়েছে আমদানি ব্যয় পরিশোধ। ফলে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) দেশের চলতি হিসাবে রেকর্ড ৮৫১ কোটি ডলারের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। যদিও ২০১৬-১৭ অর্থবছরের এ সময়ে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১৭৯ কোটি ৭০ লাখ ডলার। এর আগে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের চলতি হিসাবে ৪২৬ কোটি ২০ লাখ ডলার উদ্বৃত্ত ছিল।
চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছে ৬ হাজার ৭২ কোটি ৮০ লাখ ডলারের; আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় যা ৫১ দশমিক ৯৪ শতাংশ বেশি। একই সময়ে ১৫ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ এলসি নিষ্পত্তি বেড়েছে। অথচ এ সময়ে রফতানি বেড়েছে মাত্র ৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ। অন্যদিকে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আড়াই শতাংশ কমার পর গত অর্থবছর রেমিট্যান্স সাড়ে ১৪ শতাংশ কমেছে। চলতি অর্থবছরে (জানুয়ারি-মে) রেমিট্যান্স বেড়েছে ১৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ।
- Courtesy: BanikBarta/ June 28, 2018