আনু মুহাম্মদ
কোটা সংস্কারের আন্দোলন তৈরি হয়েছে কাজের খোঁজে তরুণদের হতাশা, ক্ষোভ ও তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে। কাজ না করে চাঁদাবাজি বা অপরাধ করে জীবিকা অর্জনের পথে তারা যেতে চায় না। তারা মেধা ও যোগ্যতায় নিজেদের তৈরি করতে পারবে, তার ভিত্তিতে কাজ পাওয়ার অধিকার রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে এটাই তাদের দাবি। সরকার পক্ষ বারবার এই দাবিকে বিকৃতভাবে উপস্থিত করেছে, অপপ্রচারের পথ বেছে নিয়েছে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা কোটা বাতিল নয়, সংস্কারের যৌক্তিক দাবি জানিয়ে আন্দোলন করছে। এই দাবি জানাতে গিয়ে তারা যখন সরকারের ভয়ংকর রোষের শিকার হয়, যখন পুলিশ- ছাত্রলীগের আঘাতে জর্জরিত হয় ন্যায্য দাবি জানানো সাধারণ শিক্ষার্থীরা, তখন সেই আঘাত প্রতিটি নাগরিকের ওপরই এসে পড়ে। স্পষ্ট হয় শিক্ষা ও জনস্বার্থের প্রতি সরকারের বৈরী ভূমিকা।
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশের বেকারত্বের হার বেশ কম, শিল্পোন্নত দেশগুলো থেকেও কম। সর্বশেষ ‘শ্রমশক্তি জরীপ ২০১৬-১৭’ অনুযায়ী দেশে বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ২ শতাংশ, গত বছরের তুলনায় বেকারের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ২৭ লাখ। প্রকৃতপক্ষে এর সংখ্যা অনেক বেশি। কাজ পেতে আগ্রহী কেউ সপ্তাহে একঘন্টা কাজ করলেই যদি কর্মরত বলে ধরে নেয়া হয় তাহলে বলতে হবে বাংলাদেশ এখন পূর্ণ কর্মসংস্থান স্তরে আছে! কারণ বাংলাদেশে প্রকৃতপক্ষে কর্মসন্ধানী সবাই কিছু না কিছু উপার্জনমুখি বা উপার্জন বিকল্প কাজ করে। সাধারণত কর্মসময় ১৫ বছর বয়স থেকে ৬৫ বছর ধরা হলেও বাংলাদেশে একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের কাজ শুরু হয় ৫-৭ বছর থেকেই, আর তা অব্যাহত থাকে (যদি বেঁচে থাকতে পারেন) ৬৫ বছরের পরেও। এদেশে যারা নিজেদের শৈশবকে শৈশব হিসেবে পার করতে পেরেছেন তারা বিশেষ সুবিধাভোগী।
বেকারত্বের সংকীর্ণ সংজ্ঞা দিয়ে কর্মসংস্থান মাপা খুবই বিভ্রান্তিকর। কর্মঘন্টা, ধরন, আয়, নিশ্চয়তা এগুলোও বিবেচনায় আনতে হবে। প্রবাসে প্রায় এক কোটি মানুষ কাজ করেন। তারপরও দেশে কাজের পরিমাণগত ও গুণগত অবস্থা ভালো নয়। কৃষিখাতের অনুপাত কমেছে, কর্মসংস্থানেও। কিন্তু শিল্প কারখানা খাতের অনুপাতের তুলনায় অনেক বেশি বেড়েছে পরিসেবা খাত। সেখানে স্থায়ী নিরাপদ কাজের সুযোগ খুবই কম। তাই অপ্রতিষ্ঠানিক কাজ, স্বকর্মসংস্থানেই বেশির ভাগ মানুষের নির্ভরতা। সরকারি সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরীপ অনুযায়ী দেশে কর্মসংস্থানের ৮৫ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক। এসব ক্ষেত্রে কাজের কোনো স্থিরতা নেই, আয় তুলনামূলক ভাবে অনেক কম, নিরাপত্তাও কম। স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষা নিয়েও অনেককে এ ধরনের কাজই খুঁজতে হচ্ছে। দোকান, মোবাইল, ইলেকট্রনিক জিনিসপত্র, মোবাইল ব্যাংকিং, টিউশনি, কোচিং সেন্টার, অনলাইন বিভিন্ন সার্ভিস, কুরিয়ার, পরিবহণ, বিক্রয় প্রতিনিধি সহ এজেন্ট হিসেবে কাজ এগুলোই এখন শিক্ষিত তরুণদের কাজের এলাকা। ব্যাংক, এনজিও, পুলিশ, বিজিবি, সেনাবাহিনী, কলেজ , বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে বিশেষ আগ্রহের জায়গা। সবচাইতে গুরুত্ব পাচ্ছে এখন বিসিএস ক্যাডার।
সচিব, যুগ্মসচিবসহ উচ্চ পদগুলোতে সংখ্যার তুলনায় নিয়োগ বেশি হলেও প্রয়োজনীয় নিয়োগে সরকারের অনীহা প্রবল। সর্বজন (পাবলিক) স্কুল কলেজে বহু হাজার পদ এখনও খালি। সরকারের বাজেট ক্রমশ বেড়ে যায়, অভূতপূর্ব উচ্চ ব্যয়ে বিভিন্ন প্রকল্প নেয় সরকার, কিন্তু প্রয়োজনীয় নিয়োগের ক্ষেত্রে বলে টাকার অভাব। এসব পদপূরণ যে শুধু কর্মসংস্থানের বিষয় নয়, শিক্ষার্থীদের শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করে দেশের দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতিরোধ করবার জন্যই যে দরকার সে বোধটুকু সরকারের মধ্যে দেখা যায় না। সরকার একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে, কিন্তু শিক্ষক নিয়োগ করতে গেলে বলে অর্থ নেই। বছরের পর বছর কলেজগুলোতে পদ শূণ্য, শিক্ষক নেই। বহু প্রতিষ্ঠানে ক্লাশ না করেই পরীক্ষা দিতে হয় শিক্ষার্থীদের। বহু প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকের অভাবে ঠিকমতো ক্লাশ হয় না।
অন্যদিকে প্রায় ক্ষেত্রেই মেধা বা যোগ্যতার সাথে কাজ পাবার সম্পর্ক নেই। বহু প্রতিষ্ঠানে চাকুরির কথা উঠলেই ‘কতো টাকা’ লাগবে এই প্রশ্ন নিয়ে দুর্ভোগে পড়তে হয় শিক্ষার্থীদের। অদ্ভূত নৈরাজ্যে বা বাজারী সমাজের মধ্যে পড়েছি আমরা। নিয়োগের সময় মেধা বা যোগ্যতার চাইতে কে কত টাকা দিতে পারবে সেই প্রশ্ন ওঠে। চাকুরি এখন কিনতে হয়। যে টাকায় কেনা, তার চাইতে বেশি টাকা তোলার চেষ্টা তাই অনিবার্য। শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থানের এসব জটিলতা নিয়ে উদ্বেগ দেখতে হয় নিয়মিত। এদেশে যোগ্যতা অর্জন কঠিন, যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ পাওয়া আরও কঠিন।
বিসিএস ক্যাডারের বিষয়ে স্নাতক উত্তীর্ণ তরুণদের মধ্যে আগ্রহ বেড়েছে আগের যেকোন সময়ের চাইতে বেশি। বিসিএস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি বিশ্ববিদ্যালয় ও স্নাতক কলেজ শিক্ষার্থীদের এখন প্রধান ব্যস্ততা। স্নাতক উত্তীর্ণ হবার অনেক আগে থেকে এই বিষয়ে পড়াশোনাই তাদের কাছে বেশি গুরুত্ব পায়। কারণ স্থায়ী নিরাপদ কর্মসংস্থানের আর কোনো ক্ষেত্র নেই। কিন্তু এতো ভরসা যার উপর সেখানে কোটার প্রতিবন্ধকতা দিনে দিনে ক্ষোভ বৃদ্ধি করেছে শিক্ষার্থীদের।
খুবই স্পর্শকাতর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে এই কোটা নিয়ে আলোচনা কারণ শতকরা ৫৬ ভাগের মধ্যে শতকরা ৩০ ভাগই মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য (এখন নাতি নাতনি যোগ হয়েছে)। এ বিষয়ে তাই কথাবার্তা খুব না হলেও ক্ষোভ ক্রমেই ছড়িয়েছে। এবারই তার বহি প্রকাশ ঘটেছে বেশি। স্পর্শকাতর হলেও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাপ্য সম্মানের কথা বিবেচনা করেই এ বিষয়ে কথা বলা উচিৎ। মুক্তিযোদ্ধা পরিবারগুলো থেকেই আলোচনা হওয়া দরকার বেশি। এই আন্দোলনের প্রথম দিকে, ২০১৩ সালেই কেউ কেউ বলেছেন। বাবা মা উভয়েই মুক্তিযোদ্ধা, এরকম একজন সন্তান তানিম আহমেদ তখনই এতোটা কোটা সংরক্ষণের বিরুদ্ধে লিখেছিলেন। বলেছেন, কোটার সুবিধা দেয়া হয় অনগ্রসর, সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য। মুক্তিযোদ্ধারা অনগ্রসর নয়। (https://bit.ly/2u58R8y)
লায়লা হাসিন আমার ছাত্রী, এখন বিভাগে সহকর্মী। মুক্তিযোদ্ধার মেয়ে লায়লা কোটা সংস্কারের আন্দোলনে সমর্থন জানিয়ে বলেছেন, কখনও বাবার মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় নিয়ে কোনো সুবিধা নিতে চাইনি। বাবা আমাকে যোগ্য করে তুলেছেন, নিজের যোগ্যতার বলেই এ পর্যন্ত এসেছি। আমার সন্তানদের আমি কোনো করুণার বস্তুতে পরিণত করতে চাই না। ওরা নিজেদের যোগ্যতা বলেই নিজেরা যতদূর যেতে পারে যাবে।
একজন মুক্তিযোদ্ধার, একজন শহীদের, নির্যাতিত মানুষদের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পেছনে যে অবদান তাতে তাঁদের কাছে বাংলাদেশের মানুষের ঋণ পরিশোধযোগ্য নয়। কিন্তু সেই মানুষদের তালিকা এখনও অসম্পূর্ণ। শহীদদের পরিবারের জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ খুবই খন্ডিত। এগুলোর জন্যও সরকারের সাথে যেরকম যোগাযোগ ও চুক্তির ক্ষমতা লাগে, সেটা কজন মুক্তিযোদ্ধার আছে? কটি শহীদ পরিবার সে পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে? তারফলে গ্রামে প্রামে, শহরে বন্দরে এমন অনেক পরিবারের সন্ধান পাওয়া যায় যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় সর্বোচ্চ ত্যাগ করে, সর্বোচ্চ লড়াই করেও পরে নিগৃহীত, বঞ্চিত হয়েছেন। শহরের সুবিধাভোগী পরিবারের কেউ কেউ এই পরিচয় নিয়ে নানাভাবে নিজের অবস্থার পরিবর্তন করতে পারলেও শ্রমিক, ক্ষেতমজুরসহ শ্রমজীবী মানুষের জীবনের কোনো পরিবর্তন হয়নি। সরকার যদি সমস্যাজর্জরিত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সন্তানদের শিক্ষা, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যথাযথভাবে যোগ্য করে তুলতে ভূমিকা পালন করতো তাহলে তা দীর্ঘমেয়াদে টেকসই ও সম্মানজনক হতো।
মুক্তিযোদ্ধা তালিকা নিয়ে এখনও বির্তক এবং প্রশ্নের সুরাহা হয়নি। এতো বছরেরও মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ, যুদ্ধাপরাধী তালিকা সম্পূর্ণ হয়নি। আর তার কারণে সরকার বদলের সাথে সাথে তালিকার পরিবর্তন ঘটে। এক সরকারের অধীনেও বদলাতে থাকে। এখনও মাঝে মধ্যে পত্রিকায় খবর আসে রাজাকারের নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকায়, ভুয়া সার্টিফিকেট নিয়ে উচ্চ পদে আসীন। ক্ষমতাবানদের স্পর্শ থাকলে যে রাজাকারও মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যায় তার প্রমাণ আমরা বহু পেয়েছি।
কোটা পরিচয় নিয়ে বর্তমানে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের সন্তানেরা তাই বড় যন্ত্রণার মধ্যে আছেন। করুণা নয়, সম্মান তাঁদের প্রাপ্য। সরকার যে মুক্তিযোদ্ধা কোটার অনুপাত শতকরা ৩০ ভাগ করেছে, সন্তানের পর এখন নাতি পুতি পর্যন্ত কোটা সম্প্রসারিত করেছে এটা কি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি ভালোবাসার জন্য, তাদের প্রতি দায়বোধের জন্য? বাস্তব পরিস্থিতি তা বলে না। বিভিন্ন অভিজ্ঞতা থেকে এটা বলা যায় যে, সরকার এবং বিভিন্ন পর্যায়ে ক্ষমতাবানদের বেশি বেশি কোটা রাখার আগ্রহ এই কারণে যে, এর মাধ্যমে তারা নিজেরা নিজেদের পছন্দমতো লোকজনকে চাকুরি দিতে পারে, সুবিধামতো নিয়োগ বাণিজ্য করতে পারে। সেজন্য ভুয়া সার্টিফিকেট এর জোয়ারে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা আর তাদের সন্তাননেরাও ভেসে যাচ্ছে। অলিখিত প্রবল একটি কোটা এখন অন্যসব কোটা পরিচালনা করছে সেটা হল ‘সরকারি দলের কোটা’। কোটা সংস্কারের পাশাপাশি সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ- ‘সরকারি দলের কোটা’ বা দুর্নীতি আর নিয়োগ বাণিজ্যের উৎস দূর করা।