ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় প্রক্টর অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম রব্বানীর পদত্যাগ দাবি করেছেন নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীরা। এ দাবিতে তারা ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন।
এতে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার স্থিরচিত্রসহ প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ১৪ ছাত্রলীগ নেতার নাম উল্লেখ করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাদের স্থায়ী বহিষ্কারের দাবি জানানো হয়।
নিরাপদ ক্যাম্পাস ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের নৃশংস হামলার প্রতিবাদে মানববন্ধন করেন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা। মঙ্গলবার ক্যাম্পাসে আলাদাভাবে এসব কর্মসূচি পালিত হয়।
এদিন দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে নিপীড়নবিরোধী শিক্ষকরা নিরাপত্তাহীনতায় আছেন বলে গণমাধ্যমকে জানান। ক্যাম্পাসে সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন শিক্ষকরা।
এগুলো হল- বৃহস্পতিবার (১৯ জুলাই) বেলা ১১টায় অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে শিক্ষকদের সংহতি সমাবেশ; ২৩ জুলাই কলাভবনের সামনের বটতলায় নিপীড়নবিরোধী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির কাছে শিক্ষক লাঞ্ছনার পরিপ্রেক্ষিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য অবিলম্বে পত্র প্রেরণ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্বতা রক্ষা, একাডেমিক মান সমুন্নত রাখা ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলরের কাছে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিপীড়নবিরোধী শিক্ষকদের উদ্যোগে শিগগিরই স্মারকলিপি প্রদান। ক্যাম্পাসে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের অব্যাহত হামলা ও লাঞ্ছনার প্রতিবাদে মঙ্গলবার দুপুরে বিক্ষোভ মিছিল করেন নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীরা। মিছিলটি অপরাজেয় বাংলার পাদদেশ থেকে শুরু হয়ে ভিসি কার্যালয়ে গিয়ে শেষ হয়।
এ সময় প্রক্টরের পদত্যাগসহ কয়েক দফা দাবিতে ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানকে স্মারকলিপি দেন তারা। স্মারকলিপি দেয়ার সময় সেখানে প্রো-ভিসি (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ ও প্রক্টর একেএম গোলাম রব্বানী উপস্থিত ছিলেন। স্মারকলিপিটি পড়ে শোনান গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী আবু রায়হান।
স্মারকলিপিতে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক পরিবেশ ধ্বংস করে এবং কোটা সংস্কার আন্দোলনে আটক ছাত্রদের মুক্তির দাবিতে লাগাতার প্রতিবাদের ধারাবাহিকতায় ১৫ জুলাই শহীদ মিনারে শান্তিপূর্ণ মানববন্ধন করা হলে সেখানে শিক্ষকদের লাঞ্ছিত ও ছাত্রছাত্রীদের ওপর হামলা চালায় চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা। বারবার হামলা ও নিপীড়নে অংশ নেয়া সন্ত্রাসীদের ছবি ও ফুটেজ গণমাধ্যমে এলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশা কাজ করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা প্রক্টর ও প্রক্টরিয়াল টিমের অব্যাহত ব্যর্থতায় তাদের প্রতি আর বিন্দুমাত্র আস্থা রাখতে পারছেন না শিক্ষার্থীরা। তাই তারা অবিলম্বে প্রক্টরের পদত্যাগ দাবি করেন। এতে আরও বলা হয়, প্রতিনিয়ত নিপীড়ক সন্ত্রাসী বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয়ে মোটরসাইকেল দিয়ে টহল দিচ্ছে। নানা জায়গায় ভয়ভীতি প্রদর্শন, হামলা ও লাঞ্ছিত করছে।
তারা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মনে ভীতি সঞ্চারের মাধ্যমে শিক্ষার পরিবেশ নষ্টের পাঁয়তারা করছে, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনামহানি করছে। একই সঙ্গে এই চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ধারাবাহিক নিষ্ক্রিয়তা শিক্ষার্থীদের সুস্থ-স্বাভাবিক পরিবেশে নিরাপদে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার পথে বাধার সৃষ্টি করছে। এ পরিস্থিতিতে আমরা আশা করছি, নিরাপদ শিক্ষার পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। অন্যথায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতি ছাত্র-শিক্ষকদের অসন্তোষ ভবিষ্যতে পরিস্থিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে বলে, ধারণা করছি।
শিক্ষকদের সংবাদ সম্মেলন
এদিকে শহীদ মিনারে শান্তিপূর্ণ সমাবেশে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা ও শিক্ষক লাঞ্ছনার প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিপীড়নবিরোধী শিক্ষকরা।
মঙ্গলবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিতি ছিলেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. ফাহমিদুল হক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন খান, সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. আবদুর রাজ্জাক খান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. সামিনা লুৎফা, অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রুশাদ ফরিদী প্রমুখ।
সংবাদ সম্মেলনে অধ্যাপক ড. ফাহমিদুল হক বলেন, শহীদ মিনারে সমাবেশের পরে হামলার বিষয়ে আমরা যখন প্রক্টরের সঙ্গে যোগাযোগ করি, তখন আমাদের বলা হল, আমরা কেন সমাবেশ করার আগে অনুমতি নিলাম না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৩’র অধ্যাদেশের কোথাও ক্যাম্পাসে সমাবেশ করার জন্য অনুমতি নিতে হবে- এমনটা বলা আছে বলে মনে হয় না। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আমাদের সমাবেশের আগে আরও একটি সমাবেশ হয়েছে। তাদেরও কোনো অনুমতি ছিল বলে মনে হয় না। তানজীমউদ্দিন খান বলেন, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশের আগে আমরা প্রক্টরের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। হামলা ও লাঞ্ছনার পরে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়।
শিক্ষার্থীদের ক্লাস বর্জনে শিক্ষকদের কোনো ইন্ধন নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা স্বাধীন। তাই যার ইচ্ছা হবে ক্লাস করবে, যার ইচ্ছা হবে না, সে করবে না। আমরা আমাদের কাজ করে যাচ্ছি। তাদের ক্লাস বর্জনে আমরা কোনো সমর্থন বা ইন্ধন দিচ্ছি না। আবদুর রাজ্জাক খান বলেন, ছাত্রলীগ কর্তৃক লাঞ্ছনার শিকার হওয়ার পরও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি আমাদের খোঁজ নেয়নি।
উল্টো প্রক্টর আমাদের বিভিন্ন ব্লেম দিচ্ছেন। যারা আমাদের ওপর হামলা করেছে, তারা ছাত্রলীগের গুণ্ডা বাহিনী। তারা কোথায় পড়াশোনা করেছে, তা জানি না। তাদের ভাষা খুবই খারাপ। ছাত্রলীগ তাদের ঐতিহ্য জানে না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ব্যবস্থা গ্রহণের অভাবে ছাত্রলীগ এত বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
যদি এখনই কিছু করা না যায়, তবে ছাত্রলীগের এমন গুণ্ডামি থামানো যাবে না। ছাত্রলীগের কমিটি নেই বলে যারা ছাত্রলীগের ওপর হামলার দায় দিতে চান না, তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে সামিনা লুৎফা বলেন, শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কার আন্দোলন নিজেদের ইচ্ছামতোই করেছে। কিন্তু যখন তারা ছাত্রলীগের আক্রমণের শিকার হল, তখন শিক্ষক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব তাদের পাশে দাঁড়ানো।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর যখন হামলা হয়েছে, তখন আমরা শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছি। কিন্তু শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে আমরাও লাঞ্ছনার শিকার হয়েছি। আমাদের বিভিন্ন ব্লেম দেয়া হয়েছে, গালাগাল দেয়া হয়েছে। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরাই শুধু নয়, আমরাও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। এ সময় তিনি নিপীড়নবিরোধী শিক্ষকদের পক্ষে কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের মানববন্ধন
এদিকে গত কয়েকদিন ক্যাম্পাসে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের অব্যাহত হামলা ও শিক্ষক লাঞ্ছনার প্রতিবাদে মানববন্ধন করেছেন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা। মঙ্গলবার সকালে মোকাররম ভবন এলাকায় এ কর্মসূচি পালন করেন তারা। এ সময় তারা নিরাপদ ক্যাম্পাসের দাবি জানান। মানববন্ধনে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ধরনের লেখা সংবলিত প্লাকার্ড ধারণ করেন।
তারা বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে যেসব অন্যায়-অত্যাচার হচ্ছে, তার বিচার দাবির অধিকার আমাদের আছে। সেই স্বাধীনতায় কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারে না।’ এ সময় এক শিক্ষার্থী অভিযোগ করে বলেন, ‘২ জুন আমাদের বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী মিঠুকে শাহবাগ ওভার ব্রিজের ওপর থেকে ধরে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়েরই কিছু সন্ত্রাসী পাবলিক লাইব্রেরির মধ্যে নিয়ে মারে। সে এখনও অসুস্থ। তার চিকিৎসার দায়ভার বিশ্ববিদ্যালয় বহন করছে না।’
সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী এসএম শাহরিয়ার বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করেছে। তারা কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেছে। এমনকি তারা শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করতেও দ্বিধা করেনি। আমরা ক্যাম্পাসে অনিরাপদ বোধ করছি। আমরা আন্দোলনকারীদের ওপর হামলায় জড়িত ছাত্রলীগ নেতাদের বিচার চাই।
- কার্টসিঃ যুগান্তর/জুলাই ১৮,২০১৮