সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে নির্বাচন কমিশন নানা কারণে ব্যতিক্রম। এই সংস্থাটির প্রতিটি কার্যক্রম এবং পদক্ষেপের দিকে জনগণের সজাগ দৃষ্টি বা নিবিড় নজরদারি থাকে। বিশেষ করে, তার কার্যক্রম পরিচালনায় সরকারের মুখাপেক্ষী থাকার দিকটিই সবচেয়ে বেশি আলোচনার বিষয়বস্তু বলে গণ্য হয়। ইভিএম বিতর্কের পরে নতুন বিতর্ক হলো জাতীয় নির্বাচনের দিনক্ষণ স্থির করা। একজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী জাতীয় নির্বাচনের তারিখ সম্পর্কে মন্তব্য করায় সিইসি উষ্মা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু আমরা যদি বর্তমান নির্বাচন কমিশনের গঠন থেকে এ পর্যন্ত তার সব কর্মকাণ্ডকে বিচার-বিশ্লেষণ করি, তাহলে এটাই স্পষ্ট যে তারা অধিকাংশ সময় ক্ষমতাসীন দলের অগ্রাধিকারকে প্রাধান্য দেওয়ার প্রবণতা দেখিয়েছে।
এ কথা স্থানীয় সরকারের নির্বাচন থেকে শুরু করে প্রতিটি নির্বাচনকেন্দ্রিক তৎপরতার বিষয়ে কম-বেশি সত্য। সার্বিক বিচারে ইসির স্বাধীন সত্তা কতটা কার্যকর, সেটা একটা জ্বলন্ত প্রশ্ন হয়েই আছে। এটা স্বাভাবিক প্রত্যাশা যে রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকার এবং নির্বাচন অনুষ্ঠান পরিচালনায় ইসির নেতৃত্ব সাধারণ মানুষের কাছে অত্যন্ত স্পষ্ট থাকবে। কিন্তু বিভিন্ন ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, নির্বাচন পরিচালনা-সংক্রান্ত নীতিনির্ধারণে ইসির চেয়ে সরকারের প্রভাবটাই বেশি। সরকার চায় না, কিন্তু ইসি তাকে মেনে নিতে বাধ্য করেছে কিংবা আইনের আওতায় থেকেই তেমন কোনো তৎপরতায় ইসি নিজেকে যুক্ত করেছে, তেমন উদাহরণ বিরল কিংবা অনুপস্থিত।
ঢাকা উত্তর সিটি নির্বাচন তেমনই একটি উদাহরণ। গত ৩০ নভেম্বর মেয়র আনিসুল হকের আকস্মিক মৃত্যুর পর ডিএনসিসির মেয়র পদে উপনির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছিল ইসি। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ডিএনসিসির মেয়র পদসহ ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে নতুন যুক্ত হওয়া ১৮টি করে ৩৬টি সাধারণ ওয়ার্ড এবং ৬টি করে ১২টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডের ভোট হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ওই নির্বাচনী তফসিলের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে দুটি রিট করা হয়। ওই দুটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৭ জানুয়ারি হাইকোর্ট বিভাগের একটি দ্বৈত বেঞ্চ উত্তর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ওপর স্থগিতাদেশ দেন।
পত্রিকান্তরের প্রতিবেদন সাক্ষ্য দেবে যে তফসিল ঘোষণার পরে ইসিকে উপযুক্তভাবে না শুনে কোনো নির্বাচন স্থগিত করার বিষয়ে সংবিধানে যে রক্ষাকবচ ছিল, ইসি তার সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। সরকারের মতো তারাও আদালতের কাঁধে বন্দুক রেখে নিজেদের কর্তব্য অবহেলাকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চালিয়েছে। ইসির আইনজীবীকে আমরা কেন নির্বাচন বন্ধ করা সমীচীন হবে না, সে বিষয়ে শুনানিতে দৃঢ় ভূমিকা রাখতে দেখিনি। অথচ তাঁদের এটা বলার সুযোগ ছিল যে রিট দায়েরকারীরা পরিচ্ছন্ন হাতে আসেননি।
এটা প্রতীয়মান হয়েছে যে সরকারি দল যেকোনো বিবেচনাতেই হোক সাধারণ নির্বাচনের বছরে খোদ রাজধানীতে পরাজয় মেনে নেওয়া কিংবা বিতর্কিত কোনো ভোটের অনুষ্ঠান না করাকেই শ্রেয় মনে করেছে। গণমাধ্যমে তীব্র সমালোচনার মুখে ইসি নামকাওয়াস্তে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছিল। কিন্তু সেখানে তারা রাষ্ট্রপক্ষের অনীহাকে পরাস্ত করে শুনানির কোনো চেষ্টা করেছে বলে ইসির কোনো মুখপাত্র আমাদের নিশ্চিত করেননি।
এমনকি আমরা ৮ সেপ্টেম্বর ইসি সূত্রে এটা জেনে বিস্মিত যে গত জানুয়ারিতে দেওয়া ছয় মাসের স্থগিতাদেশের সময়সীমা অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু ইসি এই মামলার শুনানি শুরু করতে সচেষ্ট ছিল না। বরং রিট আবেদনকারীদের অনুকূলে আদালত সম্প্রতি স্থগিতাদেশের সময়সীমা সম্প্রসারিত করেছেন। এর অর্থ হলো রাজধানীবাসীর মেয়র নির্বাচনের অধিকার অনিশ্চিতই থাকল। আমরা আশা করব, ডিএনসিসি নির্বাচন নিশ্চিত করতে ইসি আদালতে তার লড়াইয়ে যথাযথ ভূমিকা রাখবে। অন্যথায় তার স্বাধীন সত্তার দাবি প্রশ্নবিদ্ধই থাকবে।
- কার্টসিঃ প্রথম আলো/সম্পাদক/ সেপ্টেম্বর ১০,২০১৮