Search

Monday, September 10, 2018

সিএসডিতে হরিলুট! দিনে গায়েব ২০০ টন চাল-আটা


রাজধানীর মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের আড়তে থরে থরে সাজানো চাল-আটার বস্তা। সেগুলোতে লেখা- 'গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। খাদ্য অধিদপ্তর। নিজস্ব স্বয়ংক্রিয় মেশিনে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে উৎপাদিত।' প্রশ্ন হলো- সরকারিভাবে উৎপাদিত এসব চাল-আটা বাণিজ্যিকভাবে বিক্রির জন্য কৃষি মার্কেটে গেল কীভাবে? র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত গতকাল রোববার সেই মার্কেটে অভিযান চালিয়ে ১২টি আড়তে মজুদ করে রাখা ১০০ টন চাল-আটা জব্দ করেছেন। ওই চাল ও আটা তেজগাঁওয়ের সিএসডির সরকারি খাদ্যগুদাম থেকে হাতবদল হয়ে কৃষি মার্কেটে অসাধু ব্যবসায়ীর কাছে পৌঁছে। এর আগে গত শনিবার মধ্যরাতে তেজগাঁও খাদ্যগুদাম থেকে পাচার হওয়া আরও ১১৫ টন চাল-গম-আটাবাহী আটটি ট্রাক জব্দ করেছে র‌্যাব।

একটি সংঘবদ্ধ চক্র দীর্ঘদিন ধরে খোলাবাজারে বিক্রির জন্য (ওএমএস) রাখা এ চাল-আটা বাইরে পাচার করে দিচ্ছিল। এর সঙ্গে সিএসডির ম্যানেজার হুমায়ুন কবীরসহ ৪০-৪৫ জনের একটি চক্র জড়িত বলে তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। সঙ্গে আছেন কয়েকজন বড় আড়তদার, ঠিকাদার ও শ্রমিক নেতা।

সরকারি চাল-গম গায়েব করার মধ্য দিয়ে তাদের  অনেকে অল্প সময়ে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। অসাধু এ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করতে প্রতিবেদন দেবে র‌্যাব।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম বলেন, প্রতিদিন ঢাকায় ১৪১টি পৃথক স্পটে ১৪১ টন চাল ও ২৮২ টন আটা স্বল্প আয়ের মানুষের মধ্যে ওএমএসের মাধ্যমে বিক্রি করার কথা। তবে সিএসডির একটি অসাধু চক্র দিনের ২০০ টনের বেশি চাল-আটা কালোবাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। এর সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের ব্যাপারে তদন্ত করতে দুদকের কাছে প্রতিবেদন দেওয়া হবে। 

শনিবার রাতে সিএসডি থেকে আট ট্রাক ভর্তি করে চাল ও আটা গায়েব করার জন্য অন্যত্র নেওয়া হয়। এতে ১১৫ টন পণ্য ছিল। এসবের গন্তব্য ছিল চুয়াডাঙ্গা, শ্রীমঙ্গল ও মাওনা। রোববার সকালে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেটে অভিযান চালিয়ে আরও ১০০ টন চাল ও আটা জব্দ করা হয়।

সারওয়ার আলম আরও বলেন, জালিয়াতির ঘটনায় আটক সিএসডির ম্যানেজর হুমায়ুন কবীর ও খাদ্য পরিদর্শক মনিয়ার হোসেনকে খাদ্য অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। পরে তদন্তের ভিত্তিতে তাদের ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ঘটনায় খাদ্য অধিদপ্তরও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।

গতকাল সরেজমিন মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে গিয়ে দেখা যায়, র‌্যাবের অভিযানের কারণে সকাল থেকে পাইকারি আড়তে কেনা-বেচা বন্ধ ছিল। ১১টি আড়তে মজুদ করে রাখা হয়েছিল ওএমএসের চাল-আটা। যেসব আড়তদার এসব সরকারি পণ্য কিনেছেন তারা এতটাই বেপরোয়া যে, সরকারি চাল-আটার প্যাকেট পরিবর্তন করেননি। 

তাদের মধ্যে রাহমানিয়া রাইস এজেন্সিতে অভিযান চালিয়ে ৫০ কেজি ওজনের ৪৭ বস্তা সরকারি চাল, কর্ণফুলী রাইস এজেন্সিতে ৭৫ বস্তা, এশিয়ান ট্রেডার্সে ৮০ বস্তা, বন্ধু রাইস এজেন্সিতে ৫৭৯ বস্তা ও জামি ট্রেডার্সে ৩০০ বস্তা চাল এবং জননী ট্রেডার্সে ৮৫ বস্তা, সুগন্ধা রাইস ট্রেডার্স-২-এ ৭৫ বস্তা, সুগন্ধা রাইস ট্রেডার্স-১-এ ৭০ বস্তা, মহানগর ট্রেডার্সে ১২ বস্তা ও সূর্য এন্টারপ্রাইজে ৫৮ বস্তা সরকারি আটা পাওয়া যায়। তবে এসব দোকানের সব মালিক গা-ঢাকা দিয়েছেন। এসব পণ্য জব্দ করেছে র‌্যাব। 

সুগন্ধা ট্রেডার্স-১-এর দোকান কর্মচারী মো. জাবেদ বলেন, কোথা থেকে কীভাবে এসব আটা তাদের দোকানে এসেছে, তা জানেন দোকান মহাজন মোস্তফা। সাত-আট দিন আগে রাতে সরকারি গুদামের ১৬০ বস্তা আটা তাদের দোকানে ঢুকেছে।

মোহাম্মদপুর সরকারি কৃষিপণ্যের পাইকারি বাজার ব্যবসায়ী সমিতির কোষাধ্যক্ষ আনিসুর রহমান বলেন, তাদের মার্কেটে ২০০ চালের আড়ত রয়েছে। ১৯৮২ সালে মার্কেট প্রতিষ্ঠার পর কখনও কালোবাজারি করে কেনা পণ্য তারা বিক্রি করেছে, এমন দুর্নাম নিতে হয়নি। তবে কিছুদিন ধরে রাতের আঁধারে ওই মার্কেটে রহস্যজনক ট্রাক চাল-আটা নিয়ে ঢুকছিল। ব্যবসায়ীদের জিজ্ঞেস করলে তারা স্পষ্ট কিছু বলতে চাননি। র‌্যাবের অভিযানের পর বিষয়টি তাদের কাছে পরিস্কার হয়েছে।

র‌্যাবের সূত্র জানায়, স্বল্প আয়ের মানুষের মধ্যে চাল বিক্রি করতে সরকার ৩৯ টাকা কেজিতে কিনে ওএমএসের মাধ্যমে বিক্রি করে ২৮ টাকা ধরে। আর ৩২ টাকা কেজি দরে আটা কিনে ১৬ টাকায় বিক্রি করছে। ভর্তুকি দিয়ে স্বল্প আয়ের মানুষের মধ্যে চাল-আটা বিক্রির এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে সিএসডির একটি চক্র ওএমএসের এসব পণ্যের অধিকাংশ কালোবাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। 

এর সঙ্গে যাদের জড়িত থাকার তথ্য এরই মধ্যে গোয়েন্দারা পেয়েছেন, তাদের মধ্যে রয়েছে তেজগাঁওয়ের সিএসডির ম্যানেজার হুমায়ুন কবীর, স্টোক ইনচার্জ সুখরঞ্জন হালদার, ডিও শাখার ইনচার্জ কাজী মাহমুদুল হাসান, গেট শাখার ইনচার্জ ইউনূছ আলী মণ্ডল, প্রধান নিরাপত্তারক্ষী মো. হারেছ, নিরাপত্তারক্ষী মো. বাবুল, ওজন পরিমাপক সুমন, দুলাল, শ্রমিক নেতা আলমগীর সৈকত, দুদু মিয়া ও লোকমান হোসেন। প্রতিদিন রাজধানীর ১৪১ টন চাল ওএমএসের মাধ্যমে বিক্রি করার কথা থাকলেও ১০০ টনের মতো কালোবাজারে বিক্রি করা হয়। প্রতি কেজি চাল ৪০-৪৩ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল। প্রতি টন চাল ও গম থেকে এক হাজার টাকা হাতিয়ে নেন সিএসডির ম্যানেজার হুমায়ুন। আর ৫০০ টাকা অন্যদের মধ্যে ভাগ-ভাটোয়ারা হয়। এ হিসেবে প্রতিদিন অবৈধভাবে তারা আয় করছে তিন লাখ টাকা, মাসে ৯০ লাখ। 

এ ছাড়া আরেকটি অভিনব উপায়ে তারা অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। সেটা হলো- ওএমএসের চাল-গম স্বল্প আয়ের মানুষের মধ্যে বিক্রি না করে একটি চক্র সিএসডির ভেতরেই কম দরে কিনে থাকেন। এরপর তারা সে পণ্য বাইরে বেশি দরে বিক্রি করে লাখ লাখ টাকার মালিক হচ্ছেন। সোহাগ নামে নারায়ণগঞ্জের একজন ডিলার দীর্ঘদিন ধরে এভাবে 'কৈয়ের তেলে কৈ ভেজে' সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করছেন। তাকে খুঁজছেন গোয়েন্দারা। এদিকে ওএমএসের অর্থের ভাটোয়ারা নিয়ে সর্বশেষ শনিবার সিএসডির ভেতরেই মারামারির ঘটনা ঘটে।

এ ব্যাপারে সিএসডির ম্যানেজার হুমায়ুন কবীর জানান, কীভাবে সিএসডির চাল-গম বেহাত হয়েছে সেটা তার জানা নেই। ওএমএসের মাধ্যমে বিক্রির জন্য ট্রাক ঢোকার বিষয়েও কোনো মন্তব্য করতে চাননি তিনি।

গেট শাখার ইনচার্জ ইউনুছ আলী মণ্ডল বলেন, রাতে কোনোভাবেই সিএসডিতে ওএমএসের ট্রাক ঢোকার কথা নয়। কীভাবে কার নির্দেশে শনিবার রাতে ট্রাক ঢুকেছে, এ বিষয়ে তিনি অবগত নন। অবৈধ অর্থ পাওয়ার বিষয়টিও অস্বীকার করেন তিনি। 
  • কার্টসিঃ সমকাল/ সেপ্টেম্বর ১০.২০১৮ 

No comments:

Post a Comment