সম্পাদকীয়
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থেকে গুলিবিদ্ধ তিন যুবকের লাশ উদ্ধার এবং এ ঘটনায় কারও গ্রেপ্তার না হওয়া উদ্বেগজনক ঘটনা। এই যুবকদের সামাজিক পরিচয় উদ্ঘাটিত হওয়ার পর সন্দেহ আরও গভীর হয়েছে। তাঁদের পরিবার দাবি করেছে, তাঁরা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, তঁাদের জীবনে ব্যবসায়িক বা ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব এতটা প্রকট ছিল না, যাতে এ রকম লোমহর্ষ তিন খুনের ঘটনা ঘটতে পারে। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মনে রাখা দরকার, যে নাটকীয়তায় তিন ব্যক্তিকে ‘ডিবি পরিচয়ে’ তুলে নেওয়ার পর হত্যা করা হয়েছে, তা জনগণকে এর আগের চাঞ্চল্যকর সাত খুনের কথা স্মরণ করিয়ে দেবে।
কিছু বিষয় অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে তদন্তের দাবি রাখে। প্রথমত, পরিবারগুলোর দাবি, এ ঘটনায় এজাহার দায়ের করতে পুলিশ উৎসাহ দেখিয়েছে। এ ধরনের অনেক ঘটনায় পুলিশ মামলা নিতে উদাসীন কিংবা শীতল মনোভাব দেখিয়ে থাকে। কিন্তু এ ঘটনায় তারা পরিবারগুলোর ‘বিলম্ব’ দেখে নিজেরাই একটি এজাহার দাখিল করেছে।
পুলিশের অতি উৎসাহ দেখানোর অভিযোগ রুটিনমাফিক হতে পারে। কিন্তু এটা খতিয়ে দেখতে হবে। তারা বলেছে, মৃত ব্যক্তিদের পক্ষে কেউ এজাহার দায়ের করতে এগিয়ে না আসায় পুলিশ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে এজাহার লেখা হয়েছে। কিন্তু ‘ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের’ নাম প্রকাশ করা হয়নি।
দ্বিতীয়ত, এজাহারের বিবরণে পুলিশ যে এতটা উদারতার সঙ্গে খুনিদের শুধুই ‘অজ্ঞাতনামা আসামি’ হিসেবে উল্লেখ করেছে, তা–ও স্বাভাবিক নয়। আমরা অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, পুলিশ এ ধরনের ঘটনায় অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসী বা দুষ্কৃতকারীর মতো পরিভাষা ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু এত বড় একটি ঘটনার বয়ানে তারা নিস্পৃহ।
তৃতীয়ত, পরিবারগুলোর উদ্ধৃতি দিয়ে পুলিশ এজাহারে বলেছে, ইমো, ফেসবুক ও বিভিন্ন ইলেকট্রনিক সংবাদমাধ্যমে নিহত ব্যক্তিদের ছবি প্রকাশের পর তাঁদের আত্মীয়স্বজন এসে লাশ শনাক্ত করেছেন। অথচ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে তথ্য স্বজনেরা দিয়েছিলেন, সেসব পুলিশ এজাহারে উল্লেখ করেনি। স্বজনেরা পুলিশকে বলেছেন, ১০ সেপ্টেম্বর রাতে ঢাকা-যশোর রুটের পূর্বাশা পরিবহনের বাসে ওই তিনজনকেই তুলে দেওয়া হয়েছিল। ওই বাস দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ঘাট পার হয়ে পাটুরিয়া প্রান্তে এলে দুটি মাইক্রোবাস গাড়িটি ব্যারিকেড দেয়। সাদাপোশাকের ১৫-২০ জন নিজেদের ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে বাস থেকে তাঁদের তুলে নিয়ে যান। এই তিন হত্যার ঘটনার সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক ও স্পর্শকাতর তথ্য ছিল এটি।
কিন্তু আমরা বিস্মিত যে এজাহারে কথিত ডিবি পুলিশ–সংক্রান্ত কোনো তথ্যের উল্লেখ নেই। যদিও নিহত একজনের পকেট থেকে ‘৬০টি ইয়াবা’ উদ্ধারের তথ্য উল্লেখে তাদের ভুল হয়নি । এটাও লক্ষণীয় যে প্রাপ্ত তথ্য নির্দেশ করছে, নিহত ব্যক্তিদের কারও বিরুদ্ধে কোনো মামলা দায়েরের রেকর্ড নেই।
এই ভয়ানক অপরাধের তদন্ত অনতিবিলম্বে ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। নিহত সোহাগ, নূর ও শিমুলের শরীরকে একাধিক বুলেট যেভাবে বিদীর্ণ করেছে, তাতেও এই হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের কেউ কেউ এই হত্যাকাণ্ডে অন্যান্য কারণের মধ্যে ‘সাত খুনের’ মতো কোনো বিষয় (নিশানা ভুল হতে পারে) থাকতে পারে বলেও ইঙ্গিত করেছেন।
আমরা আশা করি, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা রূপগঞ্জের এই তিন হত্যাকাণ্ডের দ্রুত তদন্ত করে প্রকৃত ঘটনা জনসমক্ষে প্রকাশ করবেন।
- কার্টসিঃ প্রথম আলো/ সেপ্টেম্বর ১৮,২০১৮