আব্বাস উদ্দিন নয়ন
রাজস্ব বাড়াতে অনলাইনের মাধ্যমে তা আহরণের উদ্যোগ নিয়েছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। কর না দেয়া বিদেশী নাগরিকদের শনাক্তকরণের পাশাপাশি বহুজাতিক কোম্পানির অর্থ পাচার রোধ ও বকেয়া রাজস্ব আহরণে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তিতেও (এডিআর) নিয়েছিল বিশেষ উদ্যোগ। উদ্যোগ নেয়া হয় ট্যাক্স কার্ড প্রদান, কর বাহাদুর পরিবারকে সম্মাননা, ট্যাক্স আইডি কার্ড প্রদানেও। যদিও এসব উদ্যোগের বেশির ভাগই মুখ থুবড়ে পড়েছে। এর প্রভাব পড়ছে রাজস্ব আহরণে। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসেই লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ২০ শতাংশ ঘাটতিতে রয়েছে এনবিআর।
এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, রাজস্ব বাড়াতে নতুন নতুন উদ্যোগ নেয়া হলেও অবকাঠামো সমস্যার কারণে অধিকাংশই কার্যকর করা যায়নি। কিছু প্রকল্পে সুফলের চেয়ে অর্থ ব্যয় বেশি হয়েছে। ব্যবসায়ীদের আপত্তি ও সরকারি অন্যান্য সংস্থার সহায়তা না পাওয়াও এর কারণ। আবার প্রযুক্তিগত সমস্যার কারণেও পিছিয়ে আসতে হয়েছে অনেক উদ্যোগ থেকে।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, রাজস্ব আহরণ বাড়াতে প্রচলিত পদ্ধতি বাদ দিয়ে ২০১৩ সালে অনলাইনে কার্যক্রম শুরু করে এনবিআর। ওই বছরই কর নিবন্ধন নম্বর (টিআইএন) বদলে অনলাইনভিত্তিক ই-টিআইএন পদ্ধতিতে নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু হয়। পুরনো ভ্যাট নিবন্ধন বাদ দিয়ে ২০১২ সালেই নতুন অনলাইন ভ্যাট আইন প্রস্তুত করে এনবিআর। আইনে ভ্যাটের নিবন্ধনসহ সব কার্যক্রম অনলাইনে করার কথা বলা হয়। এ উদ্যোগের পাঁচ বছরের বেশি চলে গেলেও আয়কর ও ভ্যাটের ক্ষেত্রে অনলাইন এখনো নিবন্ধনেই আটকে আছে। অনলাইনে রিটার্ন দাখিলের পদ্ধতি চালু হলেও আয়কর ও ভ্যাট পুরনো পদ্ধতিতে পরিশোধের কারণে তা সেভাবে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না। যদিও অনলাইন নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু করার পরই পেমেন্ট পদ্ধতিও অনলাইনে করার কথা বলেছিল এনবিআর। অন্যদিকে বারবার চেষ্টা করেও অনলাইনভিত্তিক ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করতে পারেনি সংস্থাটি। যদিও পুরনো আইনেই ভ্যাট অনলাইন বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে এনবিআর।
এনবিআরের আয়কর বিভাগের সংশ্লিষ্ট সদস্য মো. আলমগীর হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, এবারের আয়কর মেলায় গিয়ে যারা রিটার্ন জমা দেবেন, তাদের জন্য অনলাইনে অর্থ পরিশোধের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। রিটার্ন জমা দেয়া বা নিবন্ধনের মতো ঘরে বসেই অর্থ পরিশোধ এখনই করা যাচ্ছে না। বেশ আগেই উদ্যোগ নেয়া হলেও প্রযুক্তিগত নিরাপত্তা ও সার্বিক প্রস্তুতির কারণে অনলাইনে অর্থ পরিশোধের পদ্ধতি পুরোপুরি চালু করতে কিছুটা সময় নিচ্ছি আমরা।
আয়কর, মূল্য সংযোজন কর (মূসক) ও শুল্ক খাতে প্রায় ৩২ হাজার মামলায় ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব বকেয়া পড়ে আছে এনবিআরের। আদালতের দীর্ঘসূত্রতার কারণে বছরের পর বছর অতিক্রান্ত হলেও মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় রাজস্ব আহরণ করতে পারছে না সংস্থাটি। এ অবস্থায় আদালতের বাইরে গিয়ে সমঝোতার মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তি করতে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) গঠন করে এনবিআর। এজন্য রাজস্ব বোর্ডের সাবেক একজন সদস্যকে প্রধান করে একটি বিশেষ উইংও খোলা হয়। পাশাপাশি সব করাঞ্চল ও কমিশনারেটের মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু পাঁচ বছর পরও এডিআরের প্রতি ব্যবসায়ীদের আগ্রহী করা যায়নি। কিছু প্রতিষ্ঠান তাদের মামলা এডিআরের মাধ্যমে নিষ্পত্তির পথে গেলেও এতে এনবিআরের সফলতা উল্লেখ করার মতো নয়। ফলে এডিআর বন্ধ করে দেয়ার পক্ষে এনবিআরের নতুন প্রশাসন। এছাড়া আদালতে শুনানি পর্যায়ে থাকা মামলা নিষ্পত্তিতে অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে একটি বিশেষ টিম গঠন করা হলেও তার কার্যক্রমও প্রায় এক বছর ধরে বন্ধ।
এনবিআরের এডিআরের দায়িত্বে থাকা এক কর্মকর্তা বলেন, আদালতের বাইরে গিয়ে মামলা নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেয়া হলেও ব্যবসায়ীদের আগ্রহ না থাকায় তা খুব বেশি কার্যকর হয়নি। এটি সচল করতে এনবিআর অনেক উদ্যোগ নিয়েছে। সাবেক একজন সদস্যকে নিয়ে নিরপেক্ষ সেল গঠন করা হয়েছে। ব্যবসায়ীদের স্বার্থ সংরক্ষণের আশ্বাস দেয়া হচ্ছে। তবে মামলা নিষ্পত্তির হার খুব কম হওয়ায় এ থেকে সরে আসার কথা ভাবছে এনবিআর।
দেশে ব্যবসা পরিচালনা করা বহুজাতিক কোম্পানিগুলো মূল্য ঘোষণার মাধ্যমে বড় অংকের অর্থ পাচার করছে, এমন অভিযোগের অনুসন্ধানে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেয় এনবিআর। ট্রান্সফার প্রাইসিংয়ের মাধ্যমে এসব কোম্পানির রাজস্ব ফাঁকি ও অর্থ পাচার ঠেকাতে ২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবনায় একটি সেল গঠনের প্রস্তাব দেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এরপর যাবতীয় প্রস্তুতি শেষে ২০১৫ সালে ট্রান্সফার প্রাইসিং সেল গঠন করে এনবিআর। কিন্তু আইনি সীমাবদ্ধতা ও আন্তর্জাতিক আয়কর নীতির সঙ্গে সমন্বয়হীনতা দূর করতে দীর্ঘদিন কোনো কার্যক্রম পরিচালিত হয়নি সেলটির। পরে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে ট্রান্সফার প্রাইসিং ইউনিট নামে আরেকটি স্বতন্ত্র বিভাগ করার ঘোষণা দেন অর্থমন্ত্রী। এ ঘোষণার দুই বছর পর ১৫০টি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের লেনদেনের তথ্য সংগ্রহ ও আরো প্রায় ৯০০ প্রতিষ্ঠানের তালিকা সংগ্রহ করলেও দৃশ্যমান কোনো ফলাফল দেখাতে পারেনি এনবিআর।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রায় ৮৬ হাজার বিদেশী নাগরিক বৈধভাবে কর্মরত রয়েছেন। বিদেশী এসব নাগরিকের কর প্রদান বাধ্যতামূলক হলেও সর্বশেষ অর্থবছর এনবিআরে আয়কর রিটার্ন জমা দিয়েছে ১৪ হাজার। করযোগ্য আয় করলেও সরকারকে রাজস্ব না দেয়ার অভিযোগে এসব নাগরিককে খুঁজে বের করতে একটি নতুন সেল গঠন করে এনবিআর। ২০১৬ সালে গঠিত সেলটি ওই সময় বিদেশী নাগরিকদের তথ্য সংগ্রহে বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ড, এনজিও ব্যুরো, বেপজা, এফবিসিসিআই, ইমিগ্রেশন অফিসসহ বিভিন্ন সংস্থায় চিঠি দেয়। চিঠি দেয়ার দুই বছর পরও অধিকাংশ দপ্তর থেকেই তথ্য সংগ্রহ করতে পারেনি তারা। কয়েকটি কোম্পানিতে মাঠপর্যায়ে অভিযান চালিয়েই কার্যক্রম সীমিত রেখেছে বিদেশী কর্মী শনাক্তকরণ সেল।
বিদেশী কর্মী শনাক্তকরণ সেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত এনবিআরের সদস্য মো. সিরাজুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, কর না দেয়া বিদেশী কর্মীদের শনাক্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকা ধরে কাজ করছে এনবিআর। কিছু প্রতিষ্ঠানে অভিযানও পরিচালিত হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সহযোগিতা না পাওয়ায় খুব বেশি কার্যকর উদ্যোগ নেয়া যায়নি। এর বাইরে আমাদের অবকাঠামো সমস্যা ও মাঠপর্যায়ে জনবল সংকটও রয়েছে।
করদাতা বৃদ্ধি, রাজস্ব আহরণের নতুন ক্ষেত্র খুঁজে বের করা ও বাজেটের লক্ষ্যপূরণে অর্থমন্ত্রীর নির্দেশনার আলোকে ২০১৬ সালে ‘বাজেট ইমপ্লিমেন্টেশন ফোরাম’ গঠন করে এনবিআর। এনবিআরের সব বিভাগের সমন্বয়ে গঠিত এ ফোরামের মাধ্যমে প্রতি সপ্তাহে রাজস্ব অগ্রগতি পর্যালোচনা করে নতুন কর্মপরিকল্পনা ঠিক করতেন সংস্থার চেয়ারম্যান। রাজস্ব আহরণে নতুন ক্ষেত্র খুঁজে বের করা, মাঠ প্রশাসনে কাজের অগ্রগতি তদারক করা ও বকেয়া রাজস্ব আহরণে ভূমিকা রাখত এ ফোরাম। এনবিআরের গবেষণা ও পরিসংখ্যান অনুবিভাগের উদ্যোগে নতুন উদ্ভাবনের দিকনির্দেশনাও থাকত এ ফোরামে। প্রায় এক বছর ধরে বন্ধ রয়েছে ফোরামের কার্যক্রম।
করভীতি দূরীকরণ ও করদাতাদের সঙ্গে এনবিআরের যোগসূত্র বাড়াতে করদাতাদের বিশেষ সম্মাননা দিতে আয়কর মেলা উপলক্ষে প্রত্যেক করদাতার জন্য ইনকাম ট্যাক্স আইডি কার্ড চালু করে এনবিআর। মেলায় করদাতাদের এ কার্ড দেয়ার পাশাপাশি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এ আইডি কার্ড প্রদান করেন তত্কালীন চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমান। মেলার পরও অনেক করদাতাকে দেয়া হয় এ আইডি কার্ড। আইডি কার্ড তৈরি করতে যন্ত্রপাতি আমদানি ও নির্বাচন কমিশন থেকে জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর সংগ্রহে বড় ধরনের অর্থও ব্যয় করে এনবিআর। তবে এ আইডি কার্ডের কোনো ব্যবহারিক সুবিধা না থাকায় এক বছরের মাথায় তা থেকে সরে আসে সংস্থাটি। ব্যয় সংকোচন নীতি ও বিশেষ ফল না আসায় এনবিআর সরে এসেছে ‘কর বাহাদুর পরিবার’ সম্মাননার আয়োজন থেকেও। যেসব পরিবারের সব সদস্য কর দিয়ে থাকেন, তাদের মধ্য থেকে সব জেলায় একটি করে পরিবারকে এ সম্মাননা দেয়া হতো।
এছাড়াও গত কয়েক বছরে এনবিআরের নেয়া উদ্যোগগুলোর মধ্যে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে যৌথ ওয়ার্কিং সেল, রাজস্ব ফাঁকি রোধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সঙ্গে যৌথ ওয়ার্কিং সেল। সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে জাতীয় চোরাচালানবিরোধী সেলের কার্যক্রমেও গতি নেই। এসব সংস্থার সঙ্গে চুক্তি ও কয়েক মাস পর যৌথ মিটিং পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রয়েছে এনবিআরের কার্যক্রম। কমিটি গঠনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে বিনিয়োগ বাড়াতে গঠিত এনবিআরের ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন টিম ও বিদেশী বিনিয়োগ বাড়াতে গঠিত ফোকাল পয়েন্ট টিম।
বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবায়নে পিছিয়ে পড়ার প্রভাব পড়ছে এনবিআরের রাজস্ব আহরণে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে লক্ষ্যমাত্রা থেকে ২০ দশমিক ৪৫ শতাংশ পিছিয়ে রয়েছে সংস্থাটি। আয়কর, ভ্যাট ও শুল্ক মিলিয়ে জুলাই-আগস্ট সময়ে ৩৫ হাজার ৫৭৭ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে এনবিআর আহরণ করেছে ২৮ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের জন্য রাজস্ব আহরণে প্রায় ৩২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরা হলেও প্রথম দুই মাসে অর্জিত হয়েছে মাত্র ১ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, গত কয়েক বছরে রাজস্ব আহরণের প্রবৃদ্ধিতে বেশ সফলতা দেখিয়েছে এনবিআর। উদ্ভাবনেও বেশ এগিয়েছে সংস্থাটি। রাজস্ব আহরণের প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে এসব উদ্ভাবন ধরে রাখার পাশাপাশি আরো নতুন উদ্যোগ নিতে হবে। তবে উদ্যোগ নিয়ে বসে থাকলে রাজস্ব প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হবে।
- কার্টসি: বণিকবার্তা / ০৩ অক্টোবর ২০১৮