একের পর এক অনিয়ম ও লুটপাটে পরিণত হচ্ছে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন ব্যাংক। এসব লুটপাটের পরও অধরাই রয়ে গেছে ব্যাংক লুটেরা চক্র। ফলে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে বেশ ভালোভাবেই জীবনযাপন করছেন অপরাধীরা।
গত কয়েক বছরে সোনালী, রূপালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংকের পর এবার হরিলুট ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে বেসিক ব্যাংক। সরকারি এই ব্যাংকটি থেকে ঋণ বিতরণের আড়ালে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি দুর্নীতিবাজ চক্র। অন্যান্য ব্যাংকের মতো অনিয়মের খবর প্রকাশের পর বেসিক ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনায় রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগের মাধ্যমে পরিবর্তন আনা হয়।
২০০৯-১৩ সাল পর্যন্ত লাগামহীন লুটপাট, জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত দেড় শতাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্ধশতাধিক মামলাও করে দুদক। ঘাটতি মেটাতে মূলধন সরবরাহ করে সরকার। তবে দুর্নীতিতে মুখ থুবড়ে পড়া রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংক আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। বরং এখনো অব্যাহত রয়েছে হরিলুট কান্ড। ফলে বারবার মূলধন সরবরাহ করে সরকার ব্যাংকটিকে টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। সঙ্গত কারণে সেই টাকা ফেরত পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছে ব্যাংকটির বর্তমান পর্ষদসহ নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকও। সূত্রমতে, বর্তমান সরকারের সময়ে লুটপাট হওয়া রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের ঘাটতি মেটাতে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা মূলধন দেয়া হয়েছে সরকারের প থেকে।
২০০৯-১৩ সালের মধ্যে দুর্নীতিতে ডুবে যাওয়া ব্যাংকটিতে ফের ঘটেছে অনিয়ম, লুটপাট ও ঋণ কেলেঙ্কারি। ফলে জনতা, সোনালীসহ রাষ্ট্রায়ত্ত অন্য ব্যাংকগুলোর মতো বেসিক ব্যাংকটিও এখন ফতুর। অথচ সরকারি এই ব্যাংকটি লুটের মূলহোতা ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুসহ সাবেক পর্ষদ এবং ব্যবসায়ী নামের ব্যাংক লুটের মাফিয়া চক্র অধরা থেকে বেশ ভালই আছেন। এর মধ্যে কেউ হয়েছেন পুরস্কৃত। কেউ পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা। কেউ আবার রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অর্থ পাচারের পর নিজেরাও দেশ ছেড়ে পালিয়ে বিদেশে অবস্থান করছেন।
বেসিক ব্যাংকের অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে কয়েকজন কারাগারে থাকলেও দুদকের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। ফলে বেসিক ব্যাংক লুটেরাদের আদৌ শাস্তি হওয়া ও লুট হওয়া অর্থ ফেরত পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকেই যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকটি লুটপাটের পর ২০১৫ সালে গডফাদারদের কৌশলে আড়ালে রেখে ১৫৬ জনকে আসামি করে ৫৬টি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এরপর আদালতের নির্দেশে ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যানসহ পর্ষদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করলেও তা শেষ হয়নি। বরং চলতি বছরের জানুয়ারিতে সময় পার হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৮ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা। আর ৬৮টি শাখার মধ্যে ২১টিই লোকসানে। অন্য সূত্র বলছে, ২০১৪ সালে প্রথমে অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাট ধরা পড়ার পর ২০১৫, ২০১৬, ২০১৭ ও চলতি ২০১৮ সালেও ঋণ কেলেঙ্কারি হয়েছে ব্যাংকটিতে। বেড়েছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। অর্থাৎ কোনোভাবেই অনিয়ম, দুর্নীতির লাগাম টানা যাচ্ছে না সরকারি এই ব্যাংকটির।
এদিকে দুর্নীতিতে ডুবন্ত বেসিক ব্যাংককে টেনে তোলার দায়িত্ব পাওয়া ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মুহাম্মদ আউয়াল খান ব্যর্থ হয়েছেন। গত ১৪ আগস্ট পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। তবে এমডির পদত্যাগে ‘বিচলিত নন’ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। সম্প্রতি তিনি বলেছেন, ‘এমডির পদত্যাগের কারণে বেসিক ব্যাংক নতুন করে কোনো সংকটে পড়বে না। পদত্যাগের বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক।’
সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, বেসিক ব্যাংকে ৮ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারি, দুর্নীতি ও হরিলুট হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। এর বিশাল অংশ বিদেশে পাচার হয়েছে। তাছাড়া ভুয়া কোম্পানির নামে ঋণদানের অন্তরালে তা লুটপাট হয়েছে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ, কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী নামের লুটেরাদের যোগসাজশে। ফলে সরকারের তথা জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা আর ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন না সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে, বেসিক ব্যাংকের ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বরের স্থিতির ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশদ পরিদর্শন শেষ হয় গত বছরের ডিসেম্বরে। ১৯তম এ পরিদর্শন প্রতিবেদনে ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয় ও ৬৮টি শাখার কার্যক্রমের সার-সংপে তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে প্রধান কার্যালয় ও ৫টি বড় শাখার ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা সরেজমিন পরিদর্শন করেছেন। ২০১৫ সালেও এরকম একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, নানা সমস্যায় থাকার পরও এককালীন পরিশোধের (ডাউন পেমেন্ট) শর্ত পরিপালন না করেই বড় অঙ্কের ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে। ঋণের গ্রেস পিরিয়ড বৃদ্ধি, জামানত গ্রহণ না করে ঋণ প্রদান, যাচাই ছাড়া এলসি খোলা এবং কৃষিঋণের সুদ হিসাবে অনিয়ম করেছে বেসিক ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়সহ বিভিন্ন শাখা। পর্ষদ পরিবর্তন হলেও নতুন করে ব্যাংকটির মূলধন পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়েছে। ২০১৬ সাল পর্যন্ত ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৪৯৪ কোটি টাকা। ২০১৪ সালে সরকার ৭৯০ কোটি ও ২০১৫ সালে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা মূলধন সরবরাহ করেছে। দুই বছরে সরকার ব্যাংকটিকে বাঁচিয়ে রাখতে ২ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা মূলধন দেয়।
গত ডিসেম্বরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সালের ডিসেম্বর শেষে বেসিক ব্যাংকের মোট আমানত ছিল ১৫ হাজার ৮০৭ কোটি টাকা, যা ১০ বছর আগে ছিল ১৪ হাজার ৮১৬ কোটি টাকা। তবে এ আমানতের ১৩ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা এসেছে মাত্র ১ হাজার ৪০১টি আমানত হিসাব থেকে। এসব হিসাবে ১ কোটি বা এর বেশি টাকা মেয়াদি আমানত হিসেবে রাখা হয়েছে। : কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে সামগ্রিকভাবে ২০১৬ সালে ব্যাংকটির তির পরিমাণ ৪ হাজার ৩১৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৪,৩১৯ কোটি টাকা ফেরত পাওয়ার আর কোনো সম্ভাবনা নেই। এই টাকা লুট করা হয়েছে।
১ বছরে মোট খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৯০০ কোটি টাকা। ২০১৬-এর ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির মোট খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় ৬ হাজার ৯৮৭ কোটি টাকা, যা ২০১৫-এর ডিসেম্বরে ছিল ৬ হাজার ৯৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছে আটকে আছে ২ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা।
সীমাহীন অনিয়ম করে কয়েক বছর ধরে সমালোচনায় থাকা বেসিক ব্যাংকের অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাট ও জালিয়াতিমূলক কর্মকান্ড থেমে নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬-এর শেষের দিকে বেসিক ব্যাংক অন্যান্য ব্যাংক থেকে ১ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা আমানত নিয়েছে। ব্যাংকের নিট সুদ আয় ঋণাত্মক হওয়া সত্ত্বেও বছরের শেষ দিকে এমনকি শেষ কার্যদিবসেও বিরূপ শর্তে অন্য ব্যাংক থেকে আমানত নিয়েছে বেসিক ব্যাংক।
- কার্টসিঃ দিনকাল/ ১৮ অক্টোবর ২০১৮