- দুর্নীতির মামলায় গত বছর ৮ নভেম্বর হাইকোর্টের রায় হয়
- হাইকোর্টের দেওয়া রায় এখনো বিচারিক আদালতে পৌঁছায়নি
- তাই নাজমুল হুদাকে আত্মসমর্পণও করতে হচ্ছে না
- নাজমুল হুদার সর্বশেষ গঠিত দল নিবন্ধন পেতে যাচ্ছে
- নির্বাচনের প্রাক্কালে জমে উঠেছে নাজমুল-খেল
স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নাজমুল হুদার এখন থাকার কথা জেলে। কিন্তু হাইকোর্টের দেওয়া একটি রায় প্রায় এক বছরেও রহস্যজনকভাবে বিচারিক আদালতে পৌঁছায়নি। এই বিলম্বের সুযোগে তিনি বহাল তবিয়তে রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন। আলোচনায় থাকার অভিলাষে মুখরোচক কথা বলায় তাঁর জুড়ি নেই।
নাজমুল হুদার সর্বশেষ গঠিত দল ‘তৃণমূল বিএনপি’ নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনও পেতে যাচ্ছে। গত রোববার হাইকোর্ট নির্বাচন কমিশনকে তেমন নির্দেশই দিয়েছেন। নির্বাচনের প্রাক্কালে জমে উঠেছে নাজমুল–খেল।
আইনজীবী নাজমুল হুদার বিরুদ্ধে আলোচিত মামলা তিনটি। তিনটিই হয় ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়। এর একটি জ্ঞাত আয়বহির্ভূত অবৈধ সম্পদ অর্জনের (এক্সটোরশন) অভিযোগে করা। দ্বিতীয়টি এক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রতি মাসে ২৫ হাজার টাকা হিসেবে ৬ লাখ টাকা অবৈধভাবে গ্রহণের দায়ে করা। তৃতীয় মামলার অভিযোগ ২ কোটি ৪০ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণের।
বিচারিক আদালত প্রথম মামলাটিতে নাজমুল হুদাকে ১২ বছর সাজা দেন। এই সাজার বিরুদ্ধে তাঁর আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২০১৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর প্রথম মামলাটি খারিজ করে তাঁকে শাস্তি থেকে অব্যাহতি দেন।
দ্বিতীয় মামলাটি বিচারাধীন। তবে আদালতের আদেশে মামলার কার্যক্রম বন্ধ আছে।
তৃতীয় মামলাটিতে নাজমুল হুদাকে সাত বছর এবং তাঁর স্ত্রী আইনজীবী সিগমা হুদাকে তিন বছরের কারাদণ্ড এবং উভয়কেই অর্থদণ্ড দেওয়া হয়। এই রায়ের বিরুদ্ধেও নাজমুল হুদা দম্পতি হাইকোর্টে আপিল করলে ২০১১ সালের ২০ মার্চ হাইকোর্ট আপিল মঞ্জুর করেন এবং মামলার প্রক্রিয়া শেষে বিচারিক আদালতের দেওয়া সাজার রায় বাতিল ঘোষণা করেন। হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন (লিভ টু আপিল) করে। এর ওপর শুনানি শেষে ২০১৪ সালের ১ ডিসেম্বর আপিল বিভাগ খালাসের রায় বাতিল করে পুনরায় আপিল শুনানি করতে হাইকোর্টকে নির্দেশ দেন।
এই নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট গত বছরের ৮ নভেম্বর রায় ঘোষণা করেন। তাতে নাজমুল হুদার সাজা সাত বছর থেকে কমিয়ে চার বছর করা হয়। আর তাঁর স্ত্রী সিগমা হুদাকে বিচারিক আদালতের দেওয়া তিন বছরের সাজার পরিপ্রেক্ষিতে যত দিন কারাগারে ছিলেন, তত দিনই সাজাভোগ হিসেবে গণ্য হবে বলে রায়ে বলা হয়।
বিচারপতি ভবানী প্রসাদ সিংহ ও বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চের এই রায় যেদিন বিচারিক আদালতে পৌঁছাবে, সেদিন থেকে পরবর্তী ৪৫ দিনের মধ্যে নাজমুল হুদাকে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণেরও নির্দেশ দেন আদালত। গত বছরের ৮ নভেম্বর দেওয়া হাইকোর্টের এই রায়টিই গতকাল সোমবার পর্যন্ত বিচারিক আদালতে পৌঁছায়নি বলে প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান।
জানতে চাইলে নাজমুল হুদা সম্প্রতি টেলিফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিচারিক আদালতে রায় পৌঁছার ৪৫ দিনের মধ্যে আমার সেই আদালতে উপস্থিত হওয়ার কথা। কিন্তু বিচারিক আদালতে তো রায় পৌঁছায়নি। এ ছাড়া অন্য কোনো মামলায় আমার জামিন নেওয়ার বিষয় নেই।’
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বিএনপিতে থাকাকালে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অনেক মুখরোচক কথা বলে বারবার আলোচনায় এসেছেন নাজমুল হুদা। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের তিনি কঠোর ও ব্যঙ্গাত্মক ভাষায় সমালোচনা করেছেন। একইভাবে বিএনপি ছাড়ার পর বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধেও অনেক কথা বলে আলোচিত হয়ে আসছেন।
সর্বশেষ তিনি আলোচনায় আসেন সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহার বিরুদ্ধে মামলা করে। গত ২৭ সেপ্টেম্বর শাহবাগ থানায় তিনি এস কে সিনহার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার ও ঘুষ গ্রহণের অভিযোগে মামলাটি করেন।
পেশাদার আইনজীবী থেকে নাজমুল হুদার রাজনীতিতে পদার্পণ ১৯৭৭ সালে, সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের গঠিত জাগদলের মাধ্যমে। জাগদলের ধারাবাহিকতায় গঠিত হয় বিএনপি। নাজমুল হুদা বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য। পর্যায়ক্রমে দলটির ভাইস চেয়ারম্যান হন। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি চারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বিভিন্ন মেয়াদে খাদ্য, তথ্য এবং যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
সিগমা হুদা মানবাধিকার আন্দোলনের একজন নেত্রী হিসেবে পরিচিত। নাজমুল হুদা যোগাযোগমন্ত্রী থাকাকালে তাঁর স্ত্রীর সংগঠন ‘জাতীয় মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা’-এর কার্যালয় স্থাপনের জন্য রেল বিভাগের জমি ইজারা দিয়ে দুজনেই সমালোচিত হন।
২০১০ সাল থেকে বিএনপির সঙ্গে নাজমুল হুদার টানাপোড়েন শুরু হয়। দল তাঁকে বহিষ্কার করে। সেই বহিষ্কারের আদেশের পরও বিএনপির পরিচয়েই রাজনীতিতে থাকার চেষ্টা করেন। তবে বেশি দিন নয়। ২০১২ সালের জুনে তিনি বিএনপি থেকে পদত্যাগ করেন। এর মাস দুয়েকের মধ্যে বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ) নামে নতুন একটি দল গঠনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। কিন্তু এর কয়েক মাসের মধ্যেই ফ্রন্টের আরেক নেতা আবুল কালাম আজাদ তাঁকে ফ্রন্ট থেকে বহিষ্কার করেন।
কিন্তু নাজমুল হুদা দমে যাওয়ার পাত্র নন। ২০১৪ সালের মে মাসে তিনি গঠন করেন বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট অ্যালায়েন্স (বিএনএ)। অবশ্য তাঁর এই উদ্যোগও দীর্ঘায়ু হয়নি। ফলে মাস ছয়েকের মধ্যেই ২০১৪ সালের নভেম্বরে গঠন করেন বাংলাদেশ মানবাধিকার পার্টি (বিএমপি)।
তবে রাজনৈতিক দল গঠন নাজমুল হুদার জন্য পয়মন্ত হয়নি। ফলে বিএমপিও পরিত্যক্ত হয়। ২০১৫ সালের নভেম্বরে গড়ে তোলেন নতুন দল ‘তৃণমূল বিএনপি’। এখন তিনি এই দলের সভাপতি। দলটিকে নিবন্ধন দিতে হাইকোর্ট গত রোববার নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছেন।
জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, একটি রায় পৌঁছাতে এক বছর লাগার কথা নয়। কিন্তু আজকাল পূর্ণাঙ্গ রায় পেতে ছয় মাস বা নয় মাসও লেগে যায়। এসব ব্যাপারে সংস্কার প্রয়োজন। কিন্তু সংস্কারের ব্যাপারে বহু বছর ধরে কার্যকর উদ্যোগ নেই।
- কার্টসিঃ প্রথম আলো/ নভেম্বর ০৬,২০১৮