সম্পাদকীয়
সরকারের পক্ষ থেকে সাফল্যের কথা বলা হলেও চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসেই সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ঘাটতিতে পড়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। প্রকৃত আদায় বিবেচনা ছাড়াই উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ ও ভ্যাটে অনলাইন পদ্ধতি কার্যকর করতে না পারা, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ব্যবসায়ীদের করছাড় ও আমদানি-রফতানি কমে যাওয়ায় চলতি অর্থবছর রাজস্ব আহরণে বড় ধরনের ঘাটতির আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। বণিক বার্তায় প্রকাশিত সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অর্থবছরের শুরু থেকেই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে আছে। প্রথম তিন মাসে খাদ্যদ্রব্যসহ প্রায় সব পণ্য আমদানিই আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় কমেছে। হ্রাস পেয়েছে রফতানিও। ব্যাংকিং খাতে করপোরেট কর কমানো ও ব্যাংকের নিজস্ব আয় কমে যাওয়ায় রাজস্ব আহরণে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি বড় হচ্ছে। ধনবান শ্রেণীর সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি মোট জনসংখ্যার প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ এখন মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তের তালিকায়। দামি বাড়ি-ফ্ল্যাটে বিপুলসংখ্যক নাগরিকের বসবাস। শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের বিকাশ ঘটছে। বিলাসদ্রব্যের ব্যবহার বাড়ছে। কিন্তু সে তুলনায় কি রাজস্ব আদায় বাড়ছে? যথেষ্ট আয় ও বিলাসী জীবনযাপন করেন কিন্তু আয়কর দেন না কিংবা নামমাত্র কর দেন, এমন নাগরিকের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে মতভেদ থাকতে পারে। তবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, আয়কর বিভাগ কোমর বেঁধে নামলে বাংলাদেশের রাজস্ব আহরণ পরিস্থিতিতে উল্লেখযোগ্য অর্জন চোখে পড়বে।
বর্তমানে বিনিয়োগের হার মাত্র ২৮ শতাংশ। আগামী তিন বছরে ৩৫ শতাংশে উন্নীত করার চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এখন আমরা যদি এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের সার্বিক আয়োজন নিয়ে বিশ্লেষণ করি তাহলে প্রথমেই যে বিষয়গুলো আসবে তা হলো করবান্ধব পরিবেশ, রাজস্ব প্রদানে সেবা নিশ্চিতকরণ, আইনকানুন সময়োপযোগী করা। এ বিষয়গুলো নিরসনে স্বল্পমেয়াদি কোনো ব্যবস্থা নেই। তথ্য বলছে, ১৬ কোটি মানুষের দেশে টিনধারী করদাতার সংখ্যা ৩৩ লাখ এবং তাদের মধ্যে আয়কর রিটার্ন জমাদানকারী করদাতার সংখ্যা মাত্র ১৩ থেকে ১৫ লাখ। কেন বাকিরা আয়কর রিটার্ন জমা দেন না বা কেন সরকার আয়কর আইনে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে না, এ প্রশ্নগুলো বারবার ঘুরেফিরে আসে। এতে বোঝা যায়, আয়কর আইন সময়োপযোগী নয়। সার্বিকভাবে অর্থনীতি যদি গতিশীল হয়, তবে কর আহরণের পরিমাণ বাড়বে সত্যি, কিন্তু যাদের আয় প্রচুর কিন্তু দিতেই যত অনীহা, তাদের ব্যাপারে কী করা হবে? কিছু পেশাজীবী এখনো আয়করের আওতার বাইরে রয়ে গেছেন। গ্রামে অনেক ব্যবসায়ী ও জোতদার কৃষক রয়েছেন, যাদের আয় শহরের যেকোনো চাকরিজীবীর চেয়ে বেশি। সংশ্লিষ্ট সবাইকে কীভাবে রাজস্ব আহরণ প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করা যায়, তার পথ অনুসন্ধানও জরুরি। এ বিষয়গুলোয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সক্রিয় না হলে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে না। আবার কেউ কেউ বলছেন, রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, বিনিয়োগ বৃদ্ধিসহ আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা জরুরি। তবে দেশ যে হারে অগ্রগতির দিকে যাচ্ছে, সে হারে রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। এ অবস্থায় সবচেয়ে জরুরি রাজস্ব ব্যবস্থাকে পুরোপুরি ডিজিটালাইজ করা। পাশাপাশি দেশী ও বহুজাতিক কোম্পানিসহ যাদের কাছে অধিক হারে রাজস্ব পাওনা রয়ে গেছে, তা আদায়ে উদ্যোগ নেয়া। একই সঙ্গে রাজস্ব ফাঁকির উৎস বন্ধ ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
২০২১ সালে আমাদের লক্ষ্য মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়া। এজন্য অপরিহার্য শর্ত— জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৭ থেকে ৮ শতাংশ নিশ্চিত করা। বিনিয়োগ বাড়াতে পারলেই কেবল এ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। আর রাজস্ব আয় বাড়াতে সর্বাগ্রে দরকার করবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি। বিদ্যমান ব্যবস্থায় পরিকল্পনাজনিত সমস্যা তো রয়েছেই, সঙ্গে রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক নানা জটিলতা। আছে দুর্নীতির অভিযোগও। এসব বিষয়ে সরকারকে আরো জোরালো ভূমিকা নিতে হবে।
Courtesy: Banikbarta Nov 06, 2018