মহিউদ্দিন আহমদ
প্রতিহিংসার শিকার জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সাভারের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র
জীবনের চলার পথে কিছু কিছু দৃশ্য, ঘটনা ও ব্যক্তি নজর কাড়ে। স্মৃতিতে থেকে যায় অনেক দিন। যদি কখনো শুনি তাজমহল ভেঙে ফেলা হয়েছে, তাহলে খুব কষ্ট পাব মনে। কেউ যদি বলে, এ দেশটা এমনি এমনি স্বাধীন হয়ে গেছে, সেটাও শুনতে ভালো লাগবে না। কেননা, আরও অগুনতি মানুষের মতো আমারও তো এই মহাযজ্ঞে সচেতন অংশগ্রহণ ছিল। নির্মলেন্দু গুণের কথা ধার করে বলতে চাই, গুলিটা লাগতে পারত আমার বুকেও। তেমনি কিছু কিছু মানুষকে মনে ধরে যায়। তাঁদের অর্জনগুলোর কথা স্মরণ করে আনন্দ পাই। তাঁদের ক্ষতি হলে বেদনায় ভারাক্রান্ত হই।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে জানি চার দশক ধরে। মনে আছে, হঠাৎ একদিন সকালে আহমদ ছফা আমাকে পাকড়াও করে বললেন, ‘চলো সাভার যাই।’ দেখলাম গাড়ি নিয়ে হাজির তাঁর প্রিয়ভাজন সাবেক মন্ত্রী মফিজ চৌধুরী। তিনি বাইসাইকেল তৈরির একটা কারখানা বানাতে চান। সে জন্য জাফরুল্লাহ চৌধুরীর কোনো সাহায্য বা পরামর্শ পাওয়া যায় কি না, সেই ভাবনা তাঁর।
সেই প্রথম আমি গেলাম গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে। ওষুধ কারখানাটি তখন সবেমাত্র তৈরি হয়েছে। এর বিপণন ব্যবস্থাপক হলেন ফরহাদ মজহার। আহমদ ছফার ঘনিষ্ঠ বন্ধু তিনি। কিছুদিন আগে মার্কিন মুলুকের পাট চুকিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। এখানেই থিতু হওয়ার চেষ্টা করছেন। জুতো খুলে পায়ে কাপড়ের পট্টি লাগিয়ে ওষুধ কারখানার ল্যাবরেটরি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন তিনি। আমাকে বলা হলো, বাংলাদেশে এটাই কোনো ওষুধ কোম্পানির মানসম্পন্ন আধুনিক ল্যাবরেটরি।
বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিগুলো এযাবৎ এ দেশকে কামধেনুর মতো দোহন করে গেছে। জাফরুল্লাহ চৌধুরী তাতে বাগড়া দিলেন। সরকারের ওষুধনীতি তৈরির পেছনে তিনিই ছিলেন প্রধান অনুঘটক। এই নীতির ওপর ভিত্তি করে দেশীয় ওষুধশিল্পের জাগরণ ঘটল। জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন এর পথিকৃৎ।
গণস্বাস্থ্যের আঙিনায় কেটেছিল সারাটা দিন। এক জায়গায় দেখলাম অনেকগুলো মেয়ে হাসপাতালের খাট তৈরি করছেন। তাঁদের বয়স বিশের কোঠায়। হাতে ওয়েল্ডিংয়ের যন্ত্রপাতি। পরনে নীল পায়জামা-শার্ট। সকালে তাঁরা আশপাশের গ্রাম থেকে আসেন। শাড়ি বদলে শার্ট-পায়জামা পরে সারা দিন লোহালক্কড় নিয়ে কাজ করেন। সন্ধ্যায় যাঁর যাঁর বাড়িতে ফিরে যান। একজনমাত্র পুরুষ কর্মী দেখলাম। তিনি তাঁদের সুপারভাইজার। মনে হলো, পুরো হাসপাতাল তৈরি হচ্ছে গ্রামের অল্পশিক্ষিত মেয়েদের শ্রমে-ঘামে। এ তো আরেক তাজমহল, যার পেছনে রয়েছে অন্য রকমের ভালোবাসা, গ্রামের গরিব চাষাভুষাদের বিনা মূল্যে কিংবা অল্প খরচে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার ব্রত।
এরপর কেটে গেছে আরও কয়েকটি বছর। এটা ১৯৮৮ সালের কথা। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক বাংলাদেশসহ সাতটি দেশে একটি সমীক্ষা চালাবে। বিষয় হলো কৃষি ও পল্লি উন্নয়নে সরকারের সঙ্গে এনজিওদের সহযোগিতার খাতগুলো চিহ্নিত করা। সমীক্ষায় বাংলাদেশ কান্ট্রি ডিরেক্টর মনোনীত হলাম। আমি ম্যানিলায় এডিবির কয়েকটি কর্মশালায় যোগ দিয়ে ঢাকায় এসে শুরু করলাম কাজ। এ জন্য এ দেশের এনজিও সেক্টরের প্রধান ও গুরুস্থানীয় নেতাদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার দরকার হলো। এর ধারাবাহিকতায় ওয়ান টু ওয়ান আলাপ হলো ফজলে হাসান আবেদ, জাফরুল্লাহ চৌধুরী, কাজী ফারুক আহমেদ, জেফরি পেরেরা, রাহাত উদ্দিন আহমেদ প্রমুখের সঙ্গে।
জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছিল গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ঢাকা অফিসে। ওই সময় তাঁর উন্নয়নভাবনা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছিল। তখন অধিকাংশ এনজিও নানাবিধ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিল। তবে প্রবণতাটি ছিল ক্ষুদ্রঋণের দিকে। আমার কাজ ছিল সরকারের সঙ্গে সহযোগী হয়ে কাজ করার ইচ্ছা ও সক্ষমতা আছে, এমন কিছু এনজিওর নাম সুপারিশ করা। আমি ২৫টি ‘জাতীয়’ ও ১৫টি ‘আঞ্চলিক’ এনজিওর নাম প্রস্তাব করেছিলাম। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের নাম ছিল ৫টি জাতীয় সংস্থার অন্যতম। সমীক্ষাটি ১৯৮৯ সালের আগস্টে এডিবি থেকে প্রকাশ করা হয়েছিল। এর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল পল্লী কর্ম–সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র নিয়ে অনেকেই অনেক লিখেছেন, দেশে ও বিদেশে। বাংলাদেশের জনগণের উদ্যোগ, দেশজ অর্জন ও লাগসই প্রযুক্তি নিয়ে ১৯৮০ ও ’৯০-এর দশকে আন্তর্জাতিক জার্নালগুলোতে যেসব সংগঠনের উদাহরণ দেওয়া হতো, সেগুলোর মধ্যে অবধারিতভাবেই উঠে আসত ব্র্যাক ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের নাম। অধ্যাপক মো. আনিসুর রহমানের একটি লেখায় পেয়েছিলাম, ওই সময় দেশে অনানুষ্ঠানিক শিক্ষাপদ্ধতির মাধ্যমে সাক্ষরতা প্রসারের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ছিল তার অন্যতম অংশীজন। তখন তাদের একটি স্লোগান ছিল: ‘টিপসই—ছি ছি’।
সমসাময়িক দুনিয়ায় মানবিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে অবদানের জন্য স্টকহোম থেকে দেওয়া হয় ‘রাইট লাইভলিহুড অ্যাওয়ার্ড’। ১৯৮০ সালে এর যাত্রা শুরু। অনেকেই এটিকে বিকল্প নোবেল পুরস্কার হিসেবে বিবেচনা করেন। এই পুরস্কার দেওয়া হয় ওই সব ব্যক্তি ও সংগঠনকে, যারা আমজনতার স্বার্থ ও লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে। এ অঞ্চলে এই পুরস্কার যাঁরা পেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে আছেন লোকায়ন (ভারত, ১৯৮৫), চিপকো আন্দোলন (ভারত, ১৯৮৭), মেধা পাটকার এবং বাবা আমতে (নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন, ভারত, ১৯৯১), জাফরুল্লাহ চৌধুরী (গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র, বাংলাদেশ, ১৯৯২), বন্দনা শিবা (ভারত, ১৯৯৩), আসগর আলী ইঞ্জিনিয়ার (ভারত, ২০০৪), গ্রামীণ শক্তি (বাংলাদেশ, ২০০৭), আসমা জাহাঙ্গীর (পাকিস্তান, ২০১৪)।
জাফরুল্লাহ চৌধুরী বিপাকে পড়েছেন। সম্প্রতি বাংলাদেশের সেনাপ্রধানকে জড়িয়ে একটি অপ্রাসঙ্গিক মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি সমালোচিত হন। এ ধরনের কথা বলা তাঁর উচিত হয়নি। এর কৈফিয়ত দিতে গিয়েও তিনি গোলমাল করে ফেলেন। এরপর আমরা দেখলাম তাঁর বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা হচ্ছে। বিষয়টি বিচারিক প্রক্রিয়ার ওপর ছেড়ে দিলেই ভালো হতো। কিন্তু তা হয়নি। এখন শুধু তিনি নন, তাঁর প্রতিষ্ঠান আক্রান্ত হয়েছে। স্থানীয় প্রভাবশালীরা তাঁর প্রতিষ্ঠানের প্রবেশমুখ আটকে দিয়েছে। ভেতরে ঢুকে ভাঙচুর করেছে, হোস্টেলে ঢুকে মেয়েদের অপমান করেছে, গণবিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এক পা-হারা লিমনকে ঠেঙিয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে, জাফরুল্লাহ প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন। অপরাধ হয়ে থাকলে আইনের আওতায় এনে তাঁকে শাস্তি দেওয়া যেত। কিন্তু এখন যা হয়েছে বা হচ্ছে, তা মোটেও কাম্য নয়।
জাফরুল্লাহ একজন মুক্তিযোদ্ধা। রণাঙ্গনের একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমি তাঁর প্রতি সহানুভূতিশীল। তাঁর সব মতের সঙ্গে আমি একমত নই। তাঁর রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নিয়ে আমার মনে অনেক প্রশ্ন আছে। কিন্তু তাই বলে তাঁর সাজানো প্রতিষ্ঠান তছনছ করে দিতে হবে, এটা কেমন কথা?
কেউ কেউ বলে থাকেন, রাজাকার সব সময়ই রাজাকার। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা সব সময়ই মুক্তিযোদ্ধা নন। আমি দেশের মানুষকে মোটাদাগে তিন ভাগে ভাগ করি। মুক্তিযোদ্ধা, অমুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকার। তো, কোনো এক অমুক্তিযোদ্ধা এ ধরনের কথা বলে থাকতে পারেন। এখন তো বীর উত্তমদেরও রাজাকার বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কখনো হয়তো শুনব, জাফরুল্লাহ চৌধুরীও রাজাকার, লন্ডন থেকে কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে একাত্তরে এখানে এসে হাসপাতাল খুলেছিলেন।
বিমানবাহিনীর সাবেক প্রধান জামালউদ্দিনের বিরুদ্ধে এর আগে ঘড়ি চুরির মামলা দেওয়া হয়েছিল। আওয়ামী লীগ নেতা সাবের হোসেন চৌধুরীর বিরুদ্ধে দেওয়া হয়েছিল চামচ চুরির মামলা। এই দেশে সবই সম্ভব। জাফরুল্লাহর বিরুদ্ধে নাকি ফল আর মাছ চুরির মামলা দেওয়া হয়েছে।
এ দেশে অতি উৎসাহীরা অনেক কিছুই বলেন, করেন। সাদেক হোসেন খোকার সঙ্গে মাহমুদুর রহমান মান্নার ফোনালাপ ফাঁস হলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ঘোষণা দিয়ে তাঁর ডিগ্রি বাতিল করল। ওই সময় সমিতির যিনি সভাপতি ছিলেন, তিনি আমার বন্ধু। তাঁকে ফোন করে বললাম, মান্নার তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ডিগ্রি নেই। তিনি বললেন, আমাদের ভুল হয়ে গেছে। আমি বললাম, আপনাদের সমিতি কীভাবে ডিগ্রি বাতিল করে? আপনারা তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র গোলাম আযম কিংবা কাদের মোল্লার ডিগ্রি বাতিল করেননি। মান্না এমন কী অপরাধ করলেন?
১৯৭৪ সালে ছাত্রলীগের অতি উৎসাহী নেতা-কর্মীদের মুখে একটা স্লোগান শুনতাম—বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধু, কঠোর হও, কঠোর হও। ১৫ আগস্ট সকালে তাদের টিকিটিরও দেখা পাওয়া যায়নি। এই সব মোসাহেব-চাটুকার সব যুগেই আছে। তাদের পোষা হয়।
জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ফল চুরির ব্যাপারটা কিছুতেই হজম করতে পারছি না। তিনি অসুস্থ। সপ্তাহে তিন দিন ডায়ালাইসিস করেন। অসম্ভব মনের জোর। দেশের মানুষের জন্য জীবনটা এমন করে বিলিয়ে দিয়ে শেষমেশ ‘চোর’ তকমা জুটল তাঁর কপালে! রবীন্দ্রনাথের ‘দুই বিঘা জমি’ থেকে শেষ দুটি লাইন উদ্ধৃত করে বলতে ইচ্ছা করে:
আমি শুনে হাসি, আঁখিজলে ভাসি, এই ছিল মোর ঘটে—
তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে!
- মহিউদ্দিন আহমদ : লেখক ও গবেষক
- কার্টসিঃ প্রথম আলো/ নভেম্বর ০৬,২০১৮
No comments:
Post a Comment