সুমন আফসার
মালিকানা নিয়ে রয়েছে অস্পষ্টতা। নেই পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা। এ ধরনের ছয় ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে (আইজিডব্লিউ) প্রতিষ্ঠানের কাছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) পাওনা দাঁড়িয়েছে ৭৫০ কোটি টাকার বেশি। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হলেও পূর্ণাঙ্গ তথ্য না থাকায় পাওনা আদায়ে সৃষ্টি হয়েছে অনিশ্চয়তা।
বার্ষিক লাইসেন্স ফি ও আয় ভাগাভাগির অংশসহ অন্যান্য পাওনা নিয়মিত পরিশোধ না করায় প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে বড় অংকের এ বকেয়া পড়েছে।
বকেয়া পরিশোধ না করা প্রতিষ্ঠানগুলো হলো— বেসটেক টেলিকম, রাতুল টেলিকম, কেএওয়াই টেলিকমিউনিকেশনস, টেলেক্স, ভিশন টেল ও অ্যাপল গ্লোবাল টেল কমিউনিকেশন। ছয় প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সই বাতিল করেছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)।
জানা গেছে, ছয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাওনা রয়েছে ভিশন টেল লিমিটেডের কাছে ১৯১ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। পাওনা আদায়ে ২০১৪ সালের ১৩ জানুয়ারি পাবলিক ডিমান্ড রিকভারি (পিডিআর) অ্যাক্ট, ১৯১৩ অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। একই বছর নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট (এনআই) ও টেলিযোগাযোগ আইনেও আলাদা মামলা করা হয় প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। আইসিএক্স লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান ক্লাউড টেল লিমিটেডের সহযোগী কোম্পানি ভিশন টেল।
তবে প্রতিষ্ঠানটির মালিকানা নিয়ে রয়েছে অস্পষ্টতা। শুরুতে প্রতিষ্ঠানটির মালিকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের এক মেয়ে। তবে বিটিআরসির দায়ের করা মামলার বিবাদীরা হলেন— সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকুর ছেলে ও প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান এসএম আসিফ শামস, পরিচালক রাসেল মির্জা, ব্যবস্থাপনা পরিচালক আইরিন ইসলাম, মো. শরিফুল ইসলাম ও শেয়ারহোল্ডার জিয়াউর রহমান। এর মধ্যে আইরিন ইসলাম ও পরিচালক শরিফুল ইসলামকে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে গ্রেফতারও করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। পরবর্তী সময়ে উচ্চ আদালত থেকে জামিন নেন তারা।
আরেক আইজিডব্লিউ প্রতিষ্ঠান বেসটেক টেলিকমের বকেয়ার পরিমাণ ১৩০ কোটি ১৪ লাখ টাকা। ২০১৪ সালের ১৬ এপ্রিল প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে পিডিআর আইনের আওতায় সার্টিফিকেট মামলা করে বিটিআরসি। এ মামলার চূড়ান্ত শুনানি শেষে আদেশের দিন ধার্য করা হয়েছে। একই বছরের জুনে গুলশান থানায় টেলিযোগাযোগ আইনেও মামলা করা হয়। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান তরিকুল ইসলাম, ব্যবস্থাপনা পরিচালক এনায়েত করিম ও পরিচালক মামুন-উর-রশিদ রয়েছেন মামলার বিবাদী হিসেবে।
অ্যাপল গ্লোবাল টেল কমিউনিকেশনসের কাছে পাওনার পরিমাণ ১২০ কোটি ১ লাখ টাকা। ২০১৬ সালের এপ্রিলে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে পিডিআর আইনে মামলা করে বিটিআরসি। পাশাপাশি টেলিযোগাযোগ আইনেও মামলা করা হয়েছে। অস্পষ্টতা রয়েছে এ প্রতিষ্ঠানের মালিকানা নিয়েও। শুরুর দিকে অ্যাপল গ্লোবাল টেলের মালিকানায় ছিলেন সোহেল আহমেদ, মনির আহমেদ, ইকবাল বাহার জাহিদ ও ইমদাদুল হক মোল্লা।
আইজিডব্লিউ প্রতিষ্ঠান টেলেক্স লিমিটেডের কাছে সরকারের পাওনা রয়েছে ১০৪ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। ২০১৪ সালের ২১ জানুয়ারি পিডিআর আইনে মামলা দায়ের করা হয় প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। মামলা করা হয়েছে এনআই ও টেলিযোগাযোগ আইনেও। তিনটি মামলায়ই বিবাদীদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। সঠিক নাম-ঠিকানাও পুনরায় দাখিল করতে বলা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির লাইসেন্স পেতে সুপারিশ করেন ক্ষমতাসীন দলের এক নেতা। টেলেক্স লিমিটেডের বর্তমান মালিক আবদুর রহমান ও মুজিবুর রহমান। বিটিআরসির মামলায় এ দুজনকে বিবাদী করা হয়েছে।
রাতুল টেলিকমের কাছে পাওনার পরিমাণ ১০২ কোটি ২৩ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের ২৭ নভেম্বর পিডিআর আইনে মামলা করে বিটিআরসি। এর আগেই টেলিযোগাযোগ আইনে বনানী থানায় মামলা করা হয়। আবাসন খাতে দেশের অন্যতম শীর্ষ প্রতিষ্ঠান রূপায়ণের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রাতুলের নামে আইজিডব্লিউ লাইসেন্স নেয়া হলেও পরবর্তী সময়ে সাবেক স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানকের মেয়ে সৈয়দা আমরিন রাখী প্রতিষ্ঠানটির ৫০ শতাংশ শেয়ার কিনে নেন। এছাড়া রাতুল টেলিকমের আরো ২০ শতাংশের মালিক নানকের স্ত্রী সৈয়দা আরজুমান বানু। এ দুজনের পাশাপাশি মামলায় বিবাদী করা হয়েছে শেয়ারহোল্ডার মাসুদুর রহমান বিপ্লব, সাবেক চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী খান মুকুল, সাবেক পরিচালক আলী আকবর খান রতন, সাবেক পরিচালক মাহির আলী খান রতন, সাবেক শেয়ারহোল্ডার নওরিন জাহান মিতুল ও সাবেক শেয়ারহোল্ডার সাইফ আলী খান অতুলকে।
সরকারের পাওনা ১০৩ কোটি ১০ লাখ টাকা পরিশোধ করেনি কেএওয়াই টেলিকমিউনিকেশনস। এজন্য ২০১৪ সালের জুলাইয়ে পিডিআর আইনে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট মামলা করা হয়। একই বছর বনানী থানায় মামলা করা হয়েছে টেলিযোগাযোগ আইনেও।
শুরুতে প্রতিষ্ঠানটির মালিকানায় ছিলেন নারায়ণগঞ্জের সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের স্ত্রী সালমা ওসমান, ছেলে ইমতিয়ান ওসমান, শ্যালক তানভির আহমেদ, ঘনিষ্ঠ বন্ধু জয়নাল আবেদীন মোল্লা ও জাহাঙ্গীর হোসেন মোল্লা। পরবর্তী সময়ে মো. শাখাওয়াত হোসেন, দেবব্রত চৌধুরী ও মো. রাকিবুল ইসলাম এটির মালিকানায় রয়েছেন বলে দেখানো হয়। যদিও মামলা করার পর তাদের কারো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতিষ্ঠানের সঠিক ঠিকানা দাখিল করতে বলেছেন আদালত।
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বণিক বার্তাকে বলেন, প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে পাওনা এ অর্থ আটকে থাকায় রাষ্ট্রের ক্ষতি হচ্ছে। তবে এ বিষয়ে এখনো আমার কাছে পূর্ণাঙ্গ তথ্য নেই। সচিব ও বিটিআরসিকে এ সম্পর্কে প্রতিবেদন দিতে বলেছি। প্রতিবেদন পাওয়ার পরই বিষয়টি সম্পর্কে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণে উদ্যোগ নেয়া হবে।
মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বিটিআরসির কাছে প্রতিষ্ঠানগুলোর পূর্ণাঙ্গ তথ্য চাওয়ার পাশাপাশি সম্প্রতি ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানে পাওনা আদায়সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম পর্যালোচনায় প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকদের নাম-ঠিকানাসহ প্রতিবেদন দিতে বলা হয়।
প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে এ বকেয়া অনেকদিনের উল্লেখ করে বিটিআরসির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মো. জহুরুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, পাওনা আদায়ে এরই মধ্যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে মামলা করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। সরকারের পাওনা এ অর্থ আদায়ের চেষ্টা চলছে।
উল্লেখ্য, আইজিডব্লিউগুলো আন্তর্জাতিক কল আদান-প্রদান করছে। আইজিডব্লিউর মাধ্যমে আসা কল গ্রাহক পর্যায়ে পৌঁছে দিচ্ছে অপারেটররা। দেশে আইজিডব্লিউ লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে ২৯টি। ২০০৮ সালে নিলামের মাধ্যমে চার প্রতিষ্ঠানকে এ লাইসেন্স দেয়া হয়। আর ২০১২ সালের এপ্রিলে নতুন ২৫টি প্রতিষ্ঠান আইজিডব্লিউ লাইসেন্স পায়। ছয়টি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল হওয়ায় বর্তমানে কার্যক্রমে রয়েছে ২৩টি। সম্প্রতি আরো একটি প্রতিষ্ঠানকে আইজিডব্লিউ লাইসেন্স দেয়া হয়েছে।
- কার্টসিঃ বনিকবার্তা/নভেম্বর ২৫,২০১৮
No comments:
Post a Comment