মাধ্যমিক স্তরে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু হয় ২০০৮ সালে। এজন্য প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে প্রায় সব শিক্ষককে। তার পরও সৃজনশীল পদ্ধতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছে না শিক্ষকদের বড় অংশ। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) তথ্য বলছে, চালুর ১০ বছরেও সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র তৈরি করতে পারছেন না ৪৩ শতাংশ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক।
চলতি বছরের মে মাসে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ৪ হাজার ৮০১টি বিদ্যালয় পরিদর্শন করে মাউশির একাডেমিক সুপারভিশন দল। পরিদর্শনের ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে তারা। তাতে দেখা যায়, ২ হাজার ৭৫০টি বিদ্যালয়ের শিক্ষক সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করতে পারছেন। এ হিসাবে সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র তৈরিতে সক্ষম ৫৭ শতাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। বাকি ৪৩ শতাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষক এ পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র তৈরি করতে পারছেন না। এর মধ্যে ১ হাজার ২৬১টির শিক্ষকরা প্রশ্ন প্রণয়নে অন্য বিদ্যালয়ের সহায়তা নিচ্ছেন। আর বাইরে থেকে প্রশ্ন সংগ্রহ করে পরীক্ষা নিচ্ছেন ৭৯০টি বিদ্যালয়ের শিক্ষক।
সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র তৈরিতে অসমর্থ বিদ্যালয়গুলোর একটি লক্ষ্মীপুর সদর উপাজেলার পালেরহাট পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয়। বিদ্যালয়টিতে শিক্ষক রয়েছেন নয়জন, আর শিক্ষার্থী সংখ্যা ৩৩৫। সৃজনশীল পদ্ধতি অনুযায়ী বিদ্যালয়ের বিভিন্ন সাময়িক ও নির্বাচনী পরীক্ষায় শিক্ষকদের নিজেদেরই প্রশ্ন প্রণয়ন করার কথা। যদিও শিক্ষকদের অদক্ষতায় বাইরে থেকে প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করে পরীক্ষা নিতে হয় বিদ্যালয়টিকে।
মাধ্যমিকের সৃজনশীল পদ্ধতি নিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরে গবেষণা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক ড. হাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, সৃজনশীল প্রশ্নের ক্ষেত্রে দুটি দিক রয়েছে। একটি ডেভেলপিং বা প্রশ্ন প্রণয়ন। অন্যটি মার্কিং বা নম্বর দেয়া। এর কোনোটিই শিক্ষকরা সঠিকভাবে করতে পারছেন না। বিশেষ করে প্রশ্ন প্রণয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের বেশ অনাগ্রহ রয়েছে। সমিতির মাধ্যমে প্রশ্নপত্রের সহজলভ্যতা এজন্য দায়ী। আবার যারা প্রশ্ন তৈরি করছেন, তারাও ঠিকমতো তা করতে পারছেন না। বইয়ে দেয়া উদাহরণ হুবহু প্রশ্নে তুলে দেয়া হচ্ছে, যেখানে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা যাচাইয়ের সুযোগ নেই। এছাড়া নম্বর দেয়ার কাজটিও শিক্ষকরা সঠিকভাবে করতে পারছেন না। সৃজনশীলের সুনির্দিষ্ট নিয়ম না মেনে বেশির ভাগ শিক্ষকই ইচ্ছামতো নম্বর দিচ্ছেন।
শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা বলছেন, শিক্ষকরাই যেখানে সৃজনশীল পদ্ধতি ভালোভাবে বুঝতে পারছেন না, সেখানে শিক্ষার্থীদের বোঝার তো প্রশ্নই আসে না। শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে এসব বিষয় ভালোভাবে রপ্ত করতে না পারায় আগের তুলনায় শিক্ষার্থীদের কোচিং ও প্রাইভেট টিউশন এবং সহায়ক বইয়ের ওপর নির্ভরতা বেড়েছে।
কুষ্টিয়ার একটি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক জহিরুল ইসলাম বলেন, সৃজনশীল পদ্ধতি শুরুর আগে ধারণা করেছিলাম, কোচিং-প্রাইভেট বা সহায়ক বইয়ের ওপর নির্ভরতা কমবে। কিন্তু আমার সন্তানের ক্ষেত্রে ঘটছে এর উল্টোটা। কোচিং ও গৃহশিক্ষকের ওপর তার নির্ভরতা আগের চেয়ে বেড়েছে। আমি নিজেও তার পড়া দেখিয়ে দেয়ার কাজটি করতে পারছি না। কারণ যে কাঠামোয় এ শিক্ষাদান পদ্ধতি পরিচালনা করা হচ্ছে, সেটি আমার অজানা। বাধ্য হয়েই এ বিষয়ে অভিজ্ঞ শিক্ষকের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। অনেক সময় তারা নিজেরাও বিষয়টিতে সে রকম দক্ষ নন। ফলে শিক্ষার্থীদের ওপর এক ধরনের মানসিক চাপ তৈরি হচ্ছে।
বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে দেশে মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রতিষ্ঠান ছিল ২০ হাজার ৪৬৭টি। এসব বিদ্যালয়ে পাঠদানে নিয়োজিত শিক্ষকের সংখ্যা ২ লাখ ৪৩ হাজারের বেশি। আর শিক্ষার্থী ১ কোটি ৩ লাখ ৩০ হাজার ৬৯৫ জন। এসব বিদ্যালয়ের বড় অংশকেই সৃজনশীল প্রশ্নের জন্য নির্ভর করতে হচ্ছে অন্যের ওপর।
মাউশির গত কয়েক বছরের প্রতিবেদন বিশ্লেষণেও দেখা যায়, ২০১৭ সালে ৬ হাজার ৪৪২টি বিদ্যালয় পরিদর্শন করেছিল তারা। এর মধ্যে প্রায় ৪৮ শতাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষক সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়নে সক্ষম ছিলেন। বাকি ৫২ শতাংশ বিদ্যালয়কে অন্য বিদ্যালয়ের সহায়তায় বা বাইরে থেকে প্রশ্ন সংগ্রহ করতে হয়। তার আগে ২০১৬ সালে শিক্ষকরা সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্ন প্রণয়ন করতে পারতেন না, এমন বিদ্যালয় ছিল প্রায় ৫২ শতাংশ।
এজন্য শিক্ষকদের অদক্ষতা নয়, বরং পাঠদানে অতিরিক্ত চাপকেই দায়ী করছেন শিক্ষকরা। লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার পালেরহাট পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বেলায়েত হোসেন খান বলেন, সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরি করতে শিক্ষকদের বাড়তি পরিশ্রম রয়েছে। এজন্য অধিকাংশ শিক্ষকই প্রশ্ন তৈরি করতে চান না। আবার প্রশ্ন প্রণয়নে সময় দিতে গেলে পাঠদানে মনোযোগ দেয়া সম্ভব হয় না। বিশেষ করে নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন তৈরি করতে শিক্ষকদের অনেক সময় ব্যয় করতে হয়। এছাড়া শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে যে ফি আদায় করা হয়, তা দিয়ে প্রশ্ন প্রণয়নের কাজ সম্পন্নও সম্ভব হয় না। এসব কারণে আমাদের বাইরের প্রশ্নের ওপর নির্ভর করতে হয়।
তবে সৃজনশীল বিষয়ে শিক্ষকদের দক্ষতা বাড়াতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে বলে জানান শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। গত ২৮ অক্টোবর জাতীয় সংসদে লিখিত প্রশ্নের উত্তরে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, বিভিন্ন বিষয়ের শ্রেণী শিক্ষককে সৃজনশীল পদ্ধতিতে দক্ষ করার লক্ষ্যে সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (এসইএসডিপি) ও সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রামের (সেসিপ) অধীনে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এছাড়া সৃজনশীল পদ্ধতি বিষয়ে শিক্ষকদের বর্ধিত পরিসরে প্রশিক্ষণের চাহিদার বিষয়টি বিবেচনায় সেসিপের প্রোগ্রাম দলিলের বরাদ্দের আওতায় তিনদিনের প্রশিক্ষণের পরিবর্তে ছয়দিনের প্রশিক্ষণ আয়োজনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে লক্ষ্যমাত্রার তিন হাজার শিক্ষকের মধ্যে ১ হাজার ৬৯২ জনকে ১২ দিনের প্রশিক্ষণ দিয়ে মাস্টার ট্রেইনার পুল প্রস্তুত করা হয়েছে। আরো ১ লাখ ৬০ হাজার শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া বিএড প্রশিক্ষণে সৃজনশীল বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা দিতে বিষয়টি কোর্স প্ল্যানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
- কার্টসিঃ বনিক বার্তা/ নভেম্বর ১৩,২০১৮
No comments:
Post a Comment