Search

Wednesday, November 28, 2018

পণ্য পরিবহন - অন্যতম ব্যয়বহুল ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক

শামীম রাহমান

দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের প্রধান করিডোর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। বাংলাদেশ পণ্য পরিবহন মালিক সমিতির তথ্য বলছে, স্বাভাবিক সময়ে মহাসড়কটি দিয়ে প্রতি টন পণ্য পরিবহনে ভাড়া বাবদ ব্যবসায়ীদের গুনতে হয় কিলোমিটারপ্রতি সাড়ে ৫ টাকার বেশি (৬ দশমিক ৭ সেন্ট)। হরতাল, অবরোধের মতো সংকটকালীন সময়ে তা ১৫ টাকা (১৮ সেন্ট) পর্যন্ত উঠে যায়।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে স্বাভাবিক সময়ে পণ্য পরিবহনে যে ব্যয়, তাও বিশ্বের সর্বোচ্চ। বিভিন্ন দেশের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ভারতে সড়কপথে প্রতি টন পণ্য পরিবহনে কিলোমিটারপ্রতি সর্বোচ্চ ব্যয় ২ দশমিক ৭ সেন্ট। এছাড়া পাকিস্তানে এ ব্যয় সর্বোচ্চ ২ দশমিক ১ সেন্ট, ভিয়েতনাম ও যুক্তরাষ্ট্রে ৪ দশমিক ৮, ব্রাজিলে সর্বোচ্চ ৪ দশমিক ৮ ও অস্ট্রেলিয়ায় ৩ দশমিক ৬ সেন্ট। কিলোমিটারপ্রতি প্রতি টন পণ্য পরিবহনে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চেয়ে বেশি খরচ পড়ে কেবল আফ্রিকার কিছু দেশে।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে পণ্য পরিবহনে অত্যধিক ব্যয়ের কারণ হিসেবে মহাসড়কটি দিয়ে পণ্য পরিবহনে বাড়তি সময় লাগার কথা বলছেন ব্যবসায়ীরা। এর বাইরে বন্দরে পণ্য খালাস করতে অতিরিক্ত সময় ব্যয়কেও আরো একটি কারণ হিসেবে দেখছেন তারা। পরিবহন বিশেষজ্ঞরা যানজটকে প্রধান কারণ হিসেবে দায়ী করছেন। তারা বলছেন, যানজটে যেমন ট্রিপের সংখ্যা কমছে, তেমনি বাড়ছে পরিচালন ব্যয়, যা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া হিসেবে আদায় করে নিচ্ছেন ট্রাক-কাভার্ড ভ্যানের মালিকরা।

বাংলাদেশের সড়কে সর্বোচ্চ ২৪ টন ধারণক্ষমতার ট্রাক বা কাভার্ড ভ্যান চলতে পারে। যানবাহনের ধরন (ধারণক্ষমতা) অনুযায়ী ভাড়া নির্ধারণ করেন পরিবহন মালিকরা। তবে ভাড়ার নির্দিষ্ট কোনো তালিকা নেই। দরকষাকষিই ভাড়া নির্ধারণের একমাত্র মাধ্যম।

বাংলাদেশ পণ্য পরিবহন মালিক সমিতির আহ্বায়ক মকবুল আহমদ বণিক বার্তাকে বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে আমদানি-রফতানি পণ্যই বেশি পরিবহন করা হয়। স্বাভাবিক সময়ে ১০ টন ধারণক্ষমতার একটি ট্রাক বা কাভার্ড ভ্যান ভাড়া দেয়া হয় গড়ে ১৫ হাজার টাকায়। এ হারকে ভিত্তি ধরে বিভিন্ন ধারণক্ষমতার পরিবহনে ভাড়া আদায় করা হয়। তবে যেহেতু এখানে দরকষাকষির একটা ব্যাপার থাকে, তাই ভাড়ার পরিমাণ সামান্য এদিক-ওদিক হতে পারে।

ঢাকা থেকে সড়কপথে চট্টগ্রাম বন্দরের দূরত্ব ২৬৬ কিলোমিটার। এ পথে ১০ টনের একটি ট্রাকের ভাড়া ১৫ হাজার টাকা। এ হিসাবে এক টন পণ্য পরিবহনে কিলোমিটারপ্রতি ভাড়া গুনতে হয় ৫ টাকা ৬৩ পয়সা বা ৬ দশমিক ৭ সেন্ট।

টনপ্রতি পণ্য পরিবহনে কিলোমিটারপ্রতি এ ব্যয় ভারতের যেকোনো করিডোরের চেয়ে বেশি। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্টের তথ্য অনুযায়ী, দিল্লি-মুম্বাই করিডোরে প্রতি টন পণ্য পরিবহনে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় হয় ১ দশমিক ৬ সেন্ট। দিল্লি-চেন্নাই করিডোরে এ ব্যয় ২ সেন্ট, দিল্লি-কলকাতায় ২ দশমিক ১, মুম্বাই-চেন্নাইয়ে ২ দশমিক ১, মুম্বাই-কলকাতায় ২ সেন্ট ও চেন্নাই-কলকাতা করিডোরে প্রতি টন পণ্য পরিবহনে কিলোমিটারপ্রতি খরচ হয় ২ সেন্ট।

অন্যান্য দেশের মধ্যে পাকিস্তানে সড়কপথে প্রতি টন পণ্য পরিবহনে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় হয় সর্বনিম্ন ১ দশমিক ৫ ও সর্বোচ্চ ২ দশমিক ১ সেন্ট। যুক্তরাষ্ট্রে এ ব্যয় ২ দশমিক ৫ থেকে ৪ দশমিক ৮ সেন্ট, চীনে ৪ থেকে ৬ ও অস্ট্রেলিয়ায় ৩ দশমিক ৬ সেন্ট।

চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ঢাকায় সড়কপথে নিয়মিত পণ্য পরিবহন করে এফএমসিজি কোম্পানি ম্যারিকো বাংলাদেশ। প্রতিষ্ঠানটির জিএম (সাপ্লাই চেইন) হাবিবুর রহমান বলেন, আমার কাছে মনে হয়, ঢাকা-চট্টগ্রামে পণ্য পরিবহন বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল। এখানে আমাদের দূরত্ব ৩০০ কিলোমিটারের কম। তার পরও এত বেশি খরচের কারণে আমরা ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। অনেক সময় আবার যানবাহন সংকট দেখা যায়। তখন পরিবহন ব্যয় দু-তিন গুণ বেড়ে যায়। আন্তর্জাতিক পার্টনারদের সঙ্গে কমিটমেন্ট ঠিক রাখতে ব্যবসায়ীরা পরিবহন বাবদ বাড়তি খরচে অনেকটা বাধ্য হন।

ঢাকা-চট্টগ্রাম করিডোরে পণ্য পরিবহনে প্রতি টনে ব্যবসায়ীদের কিলোমিটারপ্রতি সাড়ে ৫ টাকার বেশি গুনতে হলেও সংকট দেখা দিলে ১৫ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করতে হয় ব্যবসায়ীদের। এর চেয়ে বেশি ব্যয় হয় আফ্রিকার কিছু দেশে। এছাড়া মিয়ানমারের পাহাড়ি এলাকায় প্রতি টন পণ্য পরিবহনে খরচ হয় ১০ সেন্টের মতো। তবে দেশটির আন্তর্জাতিক করিডোরে এ ব্যয় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চেয়ে কম, ৫ দশমিক ৮ সেন্ট।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে সবচেয়ে বেশি পরিবহন হয় পোশাকপণ্য। পরিবহন ব্যয় বেশি হওয়ায় ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলে জানান তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এসএম মান্নান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, পণ্য পরিবহন বাবদ আমাদের অনেক বেশি ভাড়া গুনতে হয়। এর অন্যতম কারণ পরিবহনে বেশি সময়ক্ষেপণ। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে পণ্য পরিবহনে যেখানে ৫-৬ ঘণ্টা লাগার কথা, কোনো কোনো সময় তা ১২-১৪ ঘণ্টা লেগে যায়। এর ওপর আছে বন্দরের জট। এ কারণেও পণ্য পরিবহনে খরচ বেড়ে যায়। দেখা যায়, পণ্য পরিবহন বিলম্বের কারণে বেসরকারি আইসিডিতে অনেক বেশি ভাড়া দিয়ে পণ্য রেখে দিতে হয়। এ সময় যোগ হয় নানাবিধ চার্জ। বন্দরে পণ্য পৌঁছাতে যদি আট লেনের সড়ক থাকত, তাহলে পোশাক রফতানিতে আরো গতি আসত। সড়কের পাশাপাশি নৌ-পরিবহন ব্যবস্থা থাকলেও বাণিজ্যের সময় অনেক কমে আসত। সার্বিকভাবে আমি মনে করি, পণ্য পরিবহনে আধুনিক সড়ক, নৌ ও রেলপথ এখন সময়ের দাবি।

শুধু ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক নয়, সমগ্র বাংলাদেশেই সড়কপথে পণ্য পরিবহন ব্যয় বেশি বলে তথ্য দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে সড়কপথে প্রতি টন পণ্য পরিবহনে কিলোমিটারপ্রতি ব্যবসায়ীদের ভাড়া পরিশোধ করতে হয় ৫ দশমিক ৫ সেন্ট। আর্জেন্টিনায় এ ব্যয় ১ দশমিক ৮ থেকে ৩ দশমিক ৮ সেন্ট, ব্রাজিলে ২ দশমিক ৫ থেকে ৪ দশমিক ৮ এবং ফ্রান্স ও ভিয়েতনামে ৫ সেন্ট খরচ পড়ে।

যানজটকে পণ্য পরিবহন ব্যয় বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. সামছুল হক। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ৫-৬ ঘণ্টার পথ যেতে যদি ১২-১৩ ঘণ্টা লেগে যায়, তাহলে পরিবহন মালিকরা বেশি ভাড়া আদায় করবেন, এটাই স্বাভাবিক। তখন তাদের পরিবহনের পরিচালন ব্যয় বেড়ে যাবে। সেটা তো তারা পণ্যের মালিকের কাছ থেকেই তুলে নেবেন। বাংলাদেশে গণপরিবহন বলি বা পণ্য পরিবহন বলি, সবই চালাচ্ছেন ছোট ছোট মালিক। তারা একটা-দুটো ট্রাক কিনে রাস্তায় নামিয়ে দিয়েই ছেড়ে দেন। এগুলোর চালকদের কোনো ট্র্যাকিং ব্যবস্থা নেই। জবাবদিহিতারও অভাব রয়েছে। আবার পেশাদারি মনোভাব নিয়ে কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। ফলে খাতটিতে অদক্ষতা ও বিশৃঙ্খলা বেড়ে যাচ্ছে।

দেশে পণ্য পরিবহনের ৮০ শতাংশ হয় সড়কপথে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমদানি-রফতানি পণ্যের সিংহভাগই পরিবহন হয় এ মহাসড়ক দিয়ে। এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ ও পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা আনা গেলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে পণ্য পরিবহন ব্যয় কমিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

ঢাকা-চট্টগ্রামে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে বলে জানান সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব নজরুল ইসলাম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, এরই মধ্যে সম্ভাব্যতা সমীক্ষাও হয়েছে। আমরা হিসাব করেছি, এটি নির্মাণে ৭০ হাজার কোটি টাকা লাগতে পারে। পরিকল্পনা করা হচ্ছে পিপিপির ভিত্তিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের।

  • কার্টসিঃ বনিক বার্তা/ নভেম্বর ২৮,২০১৮ 

No comments:

Post a Comment