Search

Tuesday, November 13, 2018

গ্রাহকদের আমানত ফেরত দিতে পারছে না অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান

হাছান আদনান
দেশে কার্যক্রম পরিচালনা করছে ৩৪টি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই)। এর মধ্যে ১৩টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকেই ‘রেড জোন’ বা বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। রেড জোনে থাকা এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগই গ্রাহকদের আমানত পরিশোধ করতে পারছে না। আমানত তুলে নিতে প্রতিনিয়ত সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ধরনা দিচ্ছেন ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীরা। এসব প্রতিষ্ঠানকে কলমানি ও মেয়াদি আমানত দিয়ে বিপাকে আছে দেশের ব্যাংকগুলোও। অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠানই ব্যাংকের আমানত ফেরত দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান আমানতের সুদও পরিশোধ করছে না ব্যাংকগুলোকে। এ নিয়ে প্রতিনিয়ত অভিযোগ জমা হচ্ছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকে।

গ্রাহকদের আমানত পরিশোধ করতে না পারা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিন্যান্স করপোরেশন লিমিটেড (বিআইএফসি)। প্রতিষ্ঠানটি থেকে ৭০৯ কোটি টাকা বের করে নেন বিআইএফসির সাবেক চেয়ারম্যান মেজর (অব.) আবদুল মান্নান। অনিয়মের দায়ে তাকে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক পদ থেকে অপসারণ করেছে। প্রতিষ্ঠানটির ৮৪৪ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ৭৯৪ কোটি টাকার ঋণ ও লিজ খেলাপি হয়ে পড়েছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে গতকাল প্রতিষ্ঠানটির সর্বশেষ শেয়ারদর ছিল ৫ টাকা ১০ পয়সা। তবে পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে পুনর্গঠনের পর বিআইএফসি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে বলে জানান আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির নীতিনির্ধারকরা।

বিআইএফসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএম মোস্তফা বিলাল বণিক বার্তাকে বলেন, পূর্ববর্তী পর্ষদের অনিয়ম ও অর্থ আত্মসাতের কারণে বিআইএফসির বিপুল অংকের ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে। আমরা দায়িত্ব নেয়ার পর সেগুলো পুনরুদ্ধারে সব আইনি পদক্ষেপ চালিয়ে যাচ্ছি। একই সঙ্গে ক্ষুদ্র আমানতকারীদের অর্থ অল্প অল্প করে ফিরিয়ে দেয়ার চেষ্টাও করছি। তবে অনেক প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীর অর্থ পরিশোধে অপারগতায় তারা আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে। এ অবস্থায় বিআইএফসির ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাহায্য প্রয়োজন। আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে কিছু প্রস্তাব দিয়েছি। এর মধ্যে নতুন বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে মূলধন নিয়ে পর্ষদে তাদের অন্তর্ভুক্ত করা বা বড় আমানতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর পাওনাকে ইকুইটিতে রূপান্তর করে তাদের পর্ষদে নিয়ে আসা অন্যতম। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও দীর্ঘমেয়াদে বেইল আউট ফান্ড দিয়ে আমাদের পরিচালন কার্যক্রম সক্রিয় রাখতে সহযোগিতা করতে পারে।

খারাপ পরিস্থিতি পার করা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি ফার্স্ট ফিন্যান্স লিমিটেড। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নয় মাসে ৩৬ কোটি টাকা নিট লোকসান করেছে প্রতিষ্ঠানটি। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ফার্স্ট ফিন্যান্সের ঋণ অগ্রিম ও লিজের পরিমাণ ছিল ৯১৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা, যা প্রতিষ্ঠানটির বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৩১ শতাংশ। ফার্স্ট ফিন্যান্সের কাছে বিভিন্ন ব্যাংকের কলমানি ও মেয়াদি আমানত আছে ১২০ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ প্রতিষ্ঠানের কাছে গ্রাহকদের ৬৯০ কোটি টাকার আমানত জমা ছিল। ফার্স্ট ফিন্যান্স থেকেও ৩৫০ কোটি টাকা অনিয়মের মাধ্যমে বের করে নেন প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকরা। গতকাল দিন শেষে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারদর ছিল মাত্র ৬ টাকা ৩০ পয়সা।

ফার্স্ট ফিন্যান্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নজরুল হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, রিকভারির জন্য এখন আমাদের দুটি টিম কাজ করছে। পাশাপাশি আমানতকারীদের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা ও নতুন আমানত সংগ্রহের জন্য একটি নতুন টিম গঠন করা হয়েছে। সমঝোতার ভিত্তিতে আমরা ধাপে ধাপে আমানতকারীদের পাওনা ফিরিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টাও অব্যাহত রেখেছি।

চলতি বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে প্রায় ৪৬ কোটি টাকা নিট লোকসান গুনেছে প্রাইম ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির বিতরণকৃত ঋণ ও লিজের মধ্যে ৩৫ শতাংশের বেশি খেলাপি হয়ে গেছে। খেলাপি ঋণ ও লোকসানের কারণে গ্রাহকদের আমানত ফেরত দিতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি।

লোকসান ও অনিয়মের কারণে বিপর্যস্ত আরেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ফারইস্ট ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির ১ হাজার ২১৭ কোটির মধ্যে ২২৩ কোটি টাকা খেলাপি হয়ে পড়েছে। চলতি বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে ফারইস্ট ফিন্যান্সের নিট লোকসান দাঁড়িয়েছে ২১ কোটি টাকা। গতকাল দিন শেষে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে কোম্পানিটির শেয়ারদর অভিহিত মূল্যের অর্ধেক ৫ টাকায় নেমে এসেছে।

ফারইস্ট ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শান্তনু সাহা বলেন, ব্যাংক কিংবা গ্রাহকদের আমানত পরিশোধে ব্যর্থতার অভিযোগ আমাদের বিরুদ্ধে নেই। তবে আর্থিকভাবে আমরা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ফারইস্ট ফিন্যান্স মুনাফা করেছে।

পরিচালকদের অনিয়মে বিপর্যস্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডও। প্রতিষ্ঠানটির বিতরণকৃত ৯৩৫ কোটি টাকা ঋণ ও লিজের মধ্যে ৩৫৫ কোটি টাকাই খেলাপি হয়ে গেছে। চলতি বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে পিপলস লিজিংয়ের পরিচালন লোকসান দাঁড়িয়েছে ২০ কোটি টাকা। এ প্রতিষ্ঠান থেকেও অনিয়মের মাধ্যমে কয়েকজন পরিচালক ৫৭০ কোটি টাকা বের করে নিয়েছেন। গতকাল দিন শেষে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারদর ছিল মাত্র ৫ টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধার দেয়া বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ভাষ্যমতে, খারাপ পরিস্থিতিতে থাকা এনবিএফআইগুলোর মধ্যে আরো আছে ইন্টান্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড, প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্স লিমিটেড, এফএএস ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও বে লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড।

ব্যাংকাররা বলছেন, বেশির ভাগ আর্থিক প্রতিষ্ঠান ব্যাংকের কাছ থেকে কলমানি ও মেয়াদি আমানত হিসেবে নেয়া ধারের টাকা পরিশোধ করতে পারছে না। কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান সুদের টাকা পরিশোধেও ব্যর্থ হচ্ছে। এজন্য দুর্বল আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধার দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে ব্যাংকগুলো। প্রায় একই কথা বলছেন রেড জোনে থাকা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় আমানত রাখা সঞ্চয়কারীরাও।

দু-চারটা ছাড়া প্রায় সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিস্থিতিই খারাপ বলে মনে করেন ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক আমানতের পাশাপাশি ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীদের অর্থও অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ফেরত দিতে পারছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের লাইসেন্সপ্রাপ্ত কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে ধার দেয়া টাকা ফেরত না পাওয়া দুর্ভাগ্যজনক। ব্যাংকগুলো এখন আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে টাকা ধার দেয়ার ক্ষেত্রে অনেক বেশি সতর্ক।

তবে পরিস্থিতি খারাপ হলেও এখনো উত্তরণের যথেষ্ট সুযোগ আছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলএফসিএ) চেয়ারম্যান ও ন্যাশনাল হাউজিং ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের এমডি মো. খলিলুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান খারাপ সময় পার করছে। তবে এ প্রতিষ্ঠানগুলো ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। খারাপ সময় পার করা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ নির্বাহীদের সঙ্গে আমার প্রতিনিয়তই কথা হয়। তারা আমাকে জানিয়েছেন, কিছু গ্রাহক প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করায় এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য ওই প্রতিষ্ঠানগুলো প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তবে শুধু আর্থিক প্রতিষ্ঠানই নয়, নির্বাচনের বছর হওয়ায় অনেক ব্যাংকেরও চলতি বছর মুনাফা কমেছে। আশা করছি, দ্রুতই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঘুরে দাঁড়াবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্টের চলতি বছরের জুন সংখ্যার তথ্যমতে, ‘গ্রিন’ বা নিরাপদ অবস্থানে আছে মাত্র তিনটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। ‘ইয়েলো’ বা কিছুটা নিরাপদ অবস্থানে ১৮টি। বাকি ১৩টিই আছে বিপজ্জনক বা রেড জোনে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, অর্থবাজারে এ মুহূর্তে কিছুটা নগদ তারল্যের সংকট আছে। ব্যাংকও এ সমস্যা মোকাবেলা করছে। কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান অনেক আগে থেকেই সমস্যায় ভুগছে। ওই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় সুশাসন ফেরাতে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যবেক্ষক নিয়োগ করেছে। তবে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আমানতের টাকা ফেরত না পেলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির দায়িত্ব হবে বাংলাদেশ ব্যাংকে অভিযোগ দেয়া। অভিযোগ পেলে বাংলাদেশ ব্যাংক অবশ্যই ব্যবস্থা নেবে।
  • কার্টসিঃ বনিক বার্তা/ নভেম্বর ১৩,২০১৮

No comments:

Post a Comment