সম্পাদকীয়
পুলিশের জবাবদিহির ব্যবস্থা চাই
অটোরিকশা চুরির অভিযোগে নরসিংদীর শিবপুর থানা-পুলিশের হাতে আটক আতিকুর রহমান ভুঁইয়া নামে এক তরুণ এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের মেঝেতে পড়ে আছেন। তাঁকে পাহারা দিচ্ছেন পুলিশের দুই সদস্য। আতিকুরের ডান পা গুলিবিদ্ধ, শরীরের ৫ শতাংশ জুড়ে পোড়াজনিত গভীর ক্ষত।
কী হয়েছে আতিকুরের? কেন তিনি থানা-হাজত কিংবা কারাগারের বদলে হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের মেঝেতে পড়ে আছেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে যে বিবরণ পাওয়া যাবে, তা অতিশয় মর্মান্তিক। আতিকুরের বাবা আবদুল হান্নান ভুঁইয়ার অভিযোগ, ১১ নভেম্বর বেলা সাড়ে তিনটার দিকে শিবপুর থানার উপপরিদর্শকের নেতৃত্বে সাদাপোশাকে চার পুলিশ সদস্য একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে তাঁদের গ্রাম লালপুর যান এবং আতিকুরকে একটি অটোরিকশা চুরির অভিযোগে আটক করে থানায় নিয়ে যান। সেদিন সন্ধ্যায় আতিকুরের বাবা থানায় গিয়ে পুলিশকে এক হাজার টাকা দেন, যেন পুলিশ থানায় তাঁর ছেলেকে নির্যাতন না করে। পরদিন সকালে তিনি আবার ছেলেকে দেখার জন্য থানায় গিয়ে দেখতে পান, ছেলের শরীর গরম পানিতে ঝলসানো। ছেলে বাবাকে বলেন, একটি অপরাধের স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য পুলিশ তাঁর এই অবস্থা করেছে।
আতিকুরের ওপর পুলিশি নিষ্ঠুরতার অভিযোগের এখানেই শেষ নয়। গরম পানিতে ঝলসানো অবস্থায় তাঁকে থানা–হাজতেই দুই দিন রাখা হয়। ১৪ নভেম্বর রাতে তাঁকে চোখ বেঁধে থানা থেকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গিয়ে ডান পায়ে গুলি করে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ১৫ নভেম্বর সকালে শিবপুর থানা থেকে আতিকুরের বাবাকে ফোন করে বলা হয়, তাঁর ছেলে পায়ে চোট পেয়েছেন, তাঁকে নরসিংদী জেলা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সেখান থেকে ১৬ নভেম্বর তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে স্থানান্তর করা হয়।
আতিকুরের সঙ্গে শিবপুর থানার পুলিশের এসব নিষ্ঠুর ও বেআইনি আচরণের অভিযোগে আমরা বিস্ময়ে হতবাক। আতিকুর কোনো অপরাধ করেছেন কি করেননি, সেই প্রশ্নে না গিয়েই তো বলা যায়, প্রজাতন্ত্রের কোনো নাগরিকের সঙ্গে এমন আচরণ করার অধিকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নেই। শিবপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আতিকুরের বাবার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, আতিকুরকে গ্রেপ্তার করার সময় গোলাগুলি হয়েছে, তখন তিনি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। কিন্তু আতিকুরের শরীর পুড়ে গেল কীভাবে এবং পোড়া শরীর নিয়ে একজন মানুষ ডাকাতির প্রস্তুতি কীভাবে নিতে পারেন, কীভাবেই–বা পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে অংশ নিতে পারেন—এই প্রশ্নের উত্তরে ওসি ‘ও একটা ডাকাত’ বলে এড়িয়ে গেছেন। আতিকুর গুলিবিদ্ধ হওয়ার আগে যখন তাঁকে শিবপুর থানায় আটকে রাখা হয়েছিল, তখন সেখানে তাঁকে দগ্ধ অবস্থায় দেখেছিলেন বাঘাবো ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তরুণ মৃধা। সুতরাং ওসির বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্য হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তা ছাড়া আটক ব্যক্তির সঙ্গে পুলিশ সদস্যদের তথাকথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’র প্রচলিত গল্পগুলো যে বিশ্বাসযোগ্য নয়, তা বলাই বাহুল্য।
শিবপুর থানার পুলিশের বিরুদ্ধে আতিকুরের পরিবারের অভিযোগ অত্যন্ত গুরুতর। এতে বাংলাদেশের আইন প্রয়োগের পুরো ব্যবস্থা সম্পর্কেই প্রশ্ন ওঠে। এ ধরনের অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত ও যথাযথ প্রতিকারের উদ্যোগ নেওয়া একান্ত জরুরি।
- কার্টসিঃ প্রথম আলো/ নভেম্বর ২২,২০১৮
No comments:
Post a Comment