অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের মন্তব্যে অনেকেই স্তম্ভিত। কারণ তিনি সাফ বলে দিয়েছেন, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচনে অযোগ্য। অথচ খালেদা জিয়া এখন পর্যন্ত জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায় পাননি। রায় না পেলে তিনি আপিল করতে পারছেন না। জিয়া চ্যারিটেবল মামলায় তিনি ৭ বছরের দণ্ড পেয়েছেন। সেই দণ্ডের বিরুদ্ধে তিনি আপিল করেছেন এবং তাতে তিনি স্থগিতাদেশ প্রার্থনা করেছেন। কিন্তু সেই বিষয়ে আদালত এখনো সিদ্ধান্ত দেননি।
ইন্ডিপেন্ডেন্ট টুয়েন্টিফোরডটকম বলেছে, ‘বেগম খালেদা জিয়া এখন খালাস পেলেও নির্বাচনে অংশ নিতে হলে, পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হবে বলেও অ্যাটর্নি জেনারেল জানান।তিনি বলেন, এ আদেশের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ আছে, কিন্তু সংবিধানের ধারা কোনো আদালতেরই অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই।’
এ পর্যায়ে মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, মহিউদ্দিন খান আলমগীর, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিচারিক আদালতে সাজা হলেও, আপিল চলমান অবস্থায় তারা নির্বাচন করেছেন, সেটা বেআইনি কিনা এমন প্রশ্ন করা হলে তা এড়িয়ে যান অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। প্রবীণ আইনজীবী আবদুল বাসেত মজুমদার এর আগে সাংবাদিকদের বলেছেন, বাংলাদেশে প্রাকটিস হলো আপিল করেই নির্বাচন করা যাবে। কারণ আপিলকে ধরা হয় চলমান বিচারের অংশ।
অভিজ্ঞ আইনজীবীরা বলেছেন, অ্যাটর্নি জেনারেল এমন কিছু বলছেন, যা আদালতে এর আগে কাউকে বলতে শোনা যায়নি। প্রবীণরা বলেছেন, তারা নতুন কিছু শুনছেন। কারণ আপিল বিভাগের রায় আছে, নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর কে যোগ্য বা অযোগ্য সেটা ঠিক করবে ইসি। আর সেখানে যদি কোনো সংবিধান লংঘনের ঘটনা ঘটে তখন তা কেবল উচ্চ আদালতে আসতে পারে। এখন তিনি যা বলেছেন, তা ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেয়ার শামিল। এমনকি তার বক্তব্য আপিল বিভাগের রায় দ্বারা সমর্থিত নয়। আপিল বিভাগের রায় অনুযায়ী যেকোনো রিটার্নিং অফিসার বেগম খালেদা জিয়ার তিনটি মনোনয়নপত্রই বৈধ বলে ঘোষণা দিতে পারেন। তারা দেবেন কিনা সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু আইন তাকে বাধা দিবে না। কেউ তা মনে করলে তার বৈধতা ইসিতে আপিলে চ্যালেঞ্জড হবে।
ইসির নেয়া সিদ্ধান্তের বৈধতা রিটে পরীক্ষা না করতেও আপিল বিভাগের নির্দেশনা আছে। বৈধতা পরখ করতে চাইলে ভোটের পরে করতে হবে, ভোটের আগে নয়। তফসিলের পরে এগুলো নির্বাচনী বিরোধ হিসেবে বিবেচিত হবে। বিষয়টি দেখবেন নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল। হাইকোর্টের বিচারকদের নিয়ে গঠিত ট্রাইব্যুনাল অনধিক ৬ মাসের মধ্যে রায় ঘোষণা করবেন।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের অতীত নজির হলো একই দণ্ডিত ব্যক্তির ক্ষেত্রে সকালে একরকম আবার বিকেলে বিপরীত সিদ্ধান্ত হয়েছে। এভাবে তিনি জিতেছেন, মন্ত্রী হয়েছেন। টানা ৫ বছর দিব্যি কেটে গেছে, আর সেটাই বর্তমান অ্যাটর্নি জেনারেল নিজেই অবলোকন করেছেন।
এবার হাইকোর্টে আপিল করা বিএনপির পাঁচ নেতা হলেন আমানউল্লাহ আমান, এ জেড এম জাহিদ হোসেন, ওয়াদুদ ভূঁইয়া, মো. মশিউর রহমান ও মো. আবদুল ওহাব। এই পাঁচ নেতার নির্বাচনে অংশ নেয়াও এখন অনেকটাই অনিশ্চিত।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘যারা আবেদন করেছিলেন তারা সবাই দণ্ডপ্রাপ্ত। তারা তাদের দণ্ড থেকে মুক্তি লাভ করেনি। তাদের ৫ বছর সময় অতিবাহিত হয়নি। এমতাবস্থায় যদি তাদের দণ্ড স্থগিত করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে দেয়া হয় তা হবে আমাদের সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের পরিপন্থি। কাজেই আদালত আমাদের আবেদন গ্রহণ করে তাদের আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন। ফলে দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের আর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার কোনো সুযোগ থাকলো না বলে আমি মনে করি।’
খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রেও একই বিধান প্রযোজ্য হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই, এটি সাংবিধানিক বিধিবিধান। যে কেউ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন কিংবা সংসদ সদস্য হিসেবে সংসদে থাকতে পারবেন না যদি কিনা ওই ব্যক্তি ২ বছরের জন্য সাজাপ্রাপ্ত হন এবং মুক্তিলাভের পর ৫ বছর সময় অতিবাহিত না হয়। এখানে শর্ত ২টি। তাহলো- তিনি যদি দণ্ডিত হন তাহলে পারবেন না। আর মুক্তিলাভের পর ৫ বছরের আগে তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। কাজেই খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে দুইটি প্রতিবন্ধকতাই রয়েছে। কোনো আদালত তার রায় দিয়ে এই সাংবিধানিক প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করতে পারেন না।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আইনবিদরা বলেছেন, অ্যাটর্নি জেনারেল যা বলেছেন, সেটা যেকোনো মীমাংসিত আইন নয়, তার জ্বলন্ত প্রমাণ তিনি নিজেই। কারণ সরকারদলীয় দণ্ডতিদের সংসদ সদস্যপদ টেকাতে তিনি যা খালেদা জিয়ার বিষয়ে বলেছেন, ঠিক তার উল্টা অবস্থান নিয়েছেন। এখন তিনি আকস্মিক তার অবস্থান পরিবর্তন করছেন। কিন্তু বড় কথা হলো, সাবজুডিশ বিষয়ে নির্দিষ্ট এবং স্পষ্ট বক্তব্য রেখে তিনি সংবিধান ও আদালতের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছেন বলেই প্রতীয়মান হয়।
বিচারিক আদালতে দণ্ডিত হওয়ার পর আপিল করে সংসদ সদস্যপদ বহাল থাকার নজির আছে। দুর্নীতির মামলায় ২০০৮ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি ঢাকার একটি আদালত ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরীকে ১৩ বছর কারাদণ্ড দেন। আর সম্পদের তথ্য গোপনের মামলায় ২০১৬ সালের ৩রা নভেম্বর সরকারদলীয় সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির তিন বছর কারাদণ্ড দেন ঢাকার একটি আদালত।
তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মওদুদ আহমদ প্রথম আলো অনলাইনকে গতকাল বলেছেন, খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। কারণ, নিম্ন আদালতের দণ্ডই চূড়ান্ত দণ্ড নয়। নিম্ন আদালতের দেয়া দণ্ডের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়া হাইকোর্টে আপিল করবেন। আবার হাইকোর্টের দেয়া দণ্ড বাতিল চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করবেন খালেদা। মওদুদ আহমদ মনে করেন, খালেদার আপিল চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি না হওয়ায় আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। বিচারিক আদালতে দণ্ডিত হওয়ার পরও আপিল করে সংসদ সদস্যপদ বহাল থাকার নজির আছে।
- কার্টসিঃ মানবজমিন/ নভেম্বর ২৭,২০১৮
No comments:
Post a Comment