Search

Monday, November 12, 2018

অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ঝুঁকির মুখে

ব্যাংকবহির্ভূত প্রতিষ্ঠানের লেনদেনের তথ্য নেই

আশরাফুল ইসলাম

ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বাইরে অর্থনৈতিক লেনদেন হয় এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় দুই লাখ। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের কী পরিমাণ অর্থনৈতিক লেনদেন হয় তার সঠিক তথ্য নেই বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে। এসব প্রতিষ্ঠানের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করার জন্য পরামর্শ দেয়া হয়েছিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে। কিন্তু লোকবলের অভাবে দীর্ঘ তিন বছরেও এ কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের লেনদেনের তথ্য না থাকায় ঝুঁকির মুখে পড়ছে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। 

জানা গেছে, ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বাইরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত রয়েছে প্রায় দুই লাখ প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বাংলাদেশ সমবায় অধিদফতরের অধীনে রয়েছে এক লাখ ৯৪ হাজার ৬৬২টি সমবায় সমিতি। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের অধীনে (আইডিআরএ) রয়েছে ৭৭টি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের (এমআরএ) অধীনে রয়েছে ৭০০টি ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম প্রতিষ্ঠান এবং পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) অন্তর্ভুক্ত ৪১টি মিউচুয়াল ফান্ড ও ৫৫টি মার্চেন্ট ব্যাংক। এসব প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেনের তথ্য নেই বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে। দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের তথ্য যাচাইয়ের জন্য তিন বছরের আগে এ প্রস্তাব করে আইএমএফ। 

বাংলাদেশে ওয়াশিংটন হতে আগত আইএমএফের টেকনিক্যাল মিশন ২০১৬ সালের ২৮ এপ্রিল থেকে ১ মে পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করে একটি প্রতিবেদন দাখিল করে। ওই প্রতিবেদনে ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেনের পরিসংখ্যান তৈরি করতে প্রস্তাব করে। আইএমএফের এ প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ফজলে কবিরের সভাপতিত্বে গত ২৫ এপ্রিল এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই সময় আলোচ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। ওই সভায় একটি আলোচ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি অভিন্ন রিপোর্টিং ফরমেট নীতিগতভাবে অনুমোদিত হয়। গত ২৭ জুন এ-সংক্রান্ত একটি নীতিমালাভাবে চূড়ান্ত করা হয়। যদিও আইএমএফ থেকে ২০১৬ সালের ৩০ জুন থেকে চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বেরের মধ্যে এসব প্রতিষ্ঠানের পরিসংখ্যানের প্রতিবেদন তৈরি করতে বলা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, এসব প্রতিষ্ঠানের লেনদেনের কোনো তথ্য-উপাত্তের প্রতিবেদন তৈরির কাজ গত ১৬ আগস্ট পর্যন্ত শুরু করা হয়নি। এতে আইএমএফ বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে এসব প্রতিষ্ঠানের তথ্য-উপাত্ত তৈরির কাজ শেষ হওয়া নিয়েও সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, প্রয়োজনীয় লোকবলের অভাবে এসব প্রতিষ্ঠানের লেনদেনের তথ্য-উপাত্ত তৈরির কাজ শুরু করা যায়নি। তবে এসব প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেনের জরিপ কাজ শুরু করার জন্য একটি ইউনিট গঠন করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় লোকবল পেলে জরিপ কার্যক্রম শুরু করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে বলা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আলোচ্য প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক লেনদেনের তথ্য না থাকায় দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক চিত্র প্রতিফলিত হচ্ছে না। এতে ঝুঁকির মুখে পড়ছে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। প্রতিবেদনে আইএমএফের বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে এসব প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক লেনদেনের তথ্য নির্ধারণের জরিপ কাজ সম্পন্ন করার জন্য পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

  • কার্টসিঃ নয়াদিগন্ত/নভেম্বর ১২, ২০১৮ 

ডলারের বিপরীতে টাকার অতিমান - মুদ্রা পাচার ও লেনদেন ভারসাম্যে চাপ বাড়াচ্ছে

হাছান আদনান 

প্রতিবেশী ভারত, চীন, ভিয়েতনাম, শ্রীলংকাসহ বিশ্বের অনেক দেশের মুদ্রার বিপরীতে শক্তিশালী হচ্ছে মার্কিন ডলার। সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় ডলারের বিপরীতে রেকর্ড দর হারিয়েছে তুর্কি লিরা। রফতানি আয় বৃদ্ধি, উৎপাদনমুখী শিল্পের সুরক্ষা ও অর্থ পাচার রোধের পদক্ষেপ হিসেবে অনেক দেশই নিজস্ব মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটাচ্ছে। যদিও বাংলাদেশ হাঁটছে উল্টো পথে। ডলারের বিপরীতে টাকার মানকে শক্তিশালী করে দেখানো হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডলারের বিপরীতে টাকার এ অতিমূল্যায়ন আমদানিনির্ভর বাণিজ্য বাড়াচ্ছে। বিপরীতে রফতানিমুখী শিল্পের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমে যাওয়ায় নিরুৎসাহিত হচ্ছে উৎপাদনমুখী শিল্পের বিকাশ। অর্থ পাচারও এতে উৎসাহিত হচ্ছে। সর্বোপরি চাপ বাড়াচ্ছে লেনদেনের ভারসাম্যে।

ডলারের বিপরীতে প্রতিবেশী দেশগুলোর মুদ্রার তুলনায় বাংলাদেশী টাকার শক্তিশালী মান ধরে রাখার কারণ অনুসন্ধান করেছে বণিক বার্তা। এজন্য কথা বলা হয় বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে। তারা বলছেন, টাকার বিপরীতে ডলারের যে মূল্যমান, তা অনেকটাই কৃত্রিম। টাকাকে অতিমূল্যায়িত করেই শক্তিশালী দেখানো হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তথ্যও বলছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ৮০ টাকা ৬০ পয়সা। কিন্তু ওই সময় ডলারের নমিনাল ইফেক্টিভ রেট (নিয়ার) ছিল ১০১ টাকা ২০ পয়সা। একই সময়ে ডলারের প্রকৃত মূল্য বা রিয়াল ইফেক্টিভ রেট (রিয়ার) ছিল ১৩৯ টাকা ৩০ পয়সা।

ডলারের বিনিময় মূল্যের সঙ্গে নমিনাল ও রিয়াল ইফেক্টিভ রেটের বিশাল এ ব্যবধান সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ডলারের নমিনাল ও রিয়াল ইফেক্টিভ রেটের সঙ্গে বিদ্যমান বিনিময় হারের বিশাল এ ব্যবধানে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। আমদানিনির্ভর বাণিজ্য এর একটি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রেকর্ড ৫৮ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলারের আমদানি হয়। এ সময়ে আমদানি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ২৫ দশমিক ২৩ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসেই (জুলাই-সেপ্টেম্বর) আমদানি ব্যয় হয়েছে ১৪ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার। এ সময়ে আমদানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১১ দশমিক ৪৮ শতাংশ।

রেকর্ড আমদানি হলেও রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধিতে তার প্রতিফলন দেখা যায়নি গত অর্থবছর। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রফতানি হয়েছে ৩৬ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। এ সময়ে রফতানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৫ দশমিক ৮১ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) বিভিন্ন দেশে পণ্য রফতানি হয়েছে ১৩ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলারের।

টাকার অতিমূল্যায়নের প্রভাব পড়েছে চলতি হিসাবের ভারসাম্যে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশে রেকর্ড ৯ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি সৃষ্টি হয়। এর আগে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে চলতি হিসাবে ঘাটতি ছিল ১ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার। যদিও এর আগের অর্থবছরগুলোয় চলতি হিসাবে বড় অংকের উদ্বৃত্ত ছিল। চলতি হিসাবের বিশাল এ ঘাটতি দেশের ব্যালান্স অব পেমেন্টেও (বিওপি) ঘাটতি তৈরি করেছিল। তবে সম্প্রতি বিওপির ঘাটতি থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে।

চলতি হিসাবের ধারাবাহিক ঘাটতির প্রভাব পড়ছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও। এক বছর ধরে

রিজার্ভের পরিমাণ না বেড়ে উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ৭ নভেম্বর পর্যন্ত দেশের বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩২ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার। যদিও এর আগে ৩৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছিল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ।

টাকার অতিমূল্যায়ন উৎসাহিত করছে অর্থ পাচারকেও। ওয়াশিংটনভিত্তিক গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৬ লাখ ৬ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০১৩ সালে দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ ৭৭ হাজার কোটি টাকা। আর ৭৩ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে ২০১৪ সালে।

অর্থ পাচারের বেশির ভাগই হচ্ছে আমদানি-রফতানি চালানে জালিয়াতির মাধ্যমে। আমদানিকারকদের একটি বড় সিন্ডিকেট কয়েক বছর ধরেই আমদানির নামে অর্থ পাচার করছে। অর্থ পাচারে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলো একদিকে আমদানির ক্ষেত্রে পণ্যমূল্য বেশি দেখাচ্ছে, অন্যদিকে ঘোষণার সঙ্গে আমদানিকৃত পণ্যের পরিমাণেও মিল থাকছে না। মূলধনি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা হলেও চট্টগ্রাম, বেনাপোল ও মোংলা শুল্ক গোয়েন্দার কায়িক পরীক্ষায় মিলছে খালি কনটেইনার। কখনো আবার শিল্পের কাঁচামালের ঘোষণায় আনা হচ্ছে ছাই, ইট, বালি, পাথর ও সিমেন্টের ব্লক।

একে টাকার অতিমূল্যায়নের প্রভাব হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, যেকোনো মুদ্রার মূল্যমান নির্ধারণের ক্ষেত্রে অতিমূল্যায়ন অথবা অবমূল্যায়নের ঝুঁকি নিতে হয়। আমরা এ পর্যন্ত অতিমূল্যায়ন করার দিকেই হেঁটেছি। এর সমস্যা হলো, এটি সবসময় আমদানিকে উৎসাহিত করে। আমদানিনির্ভর ব্যবসা-বাণিজ্যে, তথা শপিং মল, দোকান এগুলোর জন্য এটি ভালো। নন-ট্রেডেবল সেক্টর, তথা যেসব সেবা আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করা যায় না, সেসব সেবা খাত উৎসাহিত হয়। কিন্তু মুদ্রার অতিমূল্যায়নের কারণে রফতানি, রেমিট্যান্সের মতো অর্থনীতির উৎপাদনমুখী খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রফতানিমুখী হোক কিংবা অভ্যন্তরীণ বাজারমুখী, দুই ধরনের উৎপাদনই বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ে।

ডলারের বিপরীতে টাকার প্রকৃত বিনিময় মূল্য নির্ধারিত হয় একটি পদ্ধতি অনুসরণ করে। যেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ভালো, পণ্য আমদানি-রফতানি বেশি, অর্থনীতির মধ্যে যোগাযোগ রয়েছে, এমন দেশের রফতানি, আমদানি, মূল্যস্ফীতি, পণ্যমূল্য, উৎপাদনশীলতা বিবেচনায় নিয়ে এ মূল্য বের করা হয়। দেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ৮৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রিত হয়, এমন ১৫টি দেশের মুদ্রা নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি বাস্কেট তৈরি করে। এ মুদ্রাগুলো হলো মার্কিন ডলার, যুক্তরাজ্যের পাউন্ড, ইউরো, কানাডিয়ান ডলার, মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত, ভারতীয় রুপি, চীনের ইউয়ান, জাপানের ইয়েন, কোরিয়ান ইয়েন ও সিঙ্গাপুরের ডলার। এসব মুদ্রার সঙ্গে তুলনা করে ডলারের প্রকৃত বিনিময় হার বের করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় ডলারের মূল্য নির্ধারণ করা হলে সেটিকে রিয়াল ইফেক্টিভ রেট বা প্রকৃত মূল্য বলে অভিহিত করা হয়। অন্যদিকে বাজারের চাহিদা ও সরবরাহের ওপর ভিত্তি করে ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণ করা হলে তাকে নমিনাল ইফেক্টিভ রেট বা নিয়ার বলা হয়।

নিয়ার বা রিয়ারের ভিত্তিতে ডলার বিনিময় না হওয়ায় বাজারের সঙ্গে এর খুব বেশি সম্পর্ক নেই। দেশের বাজারে গতকাল আমদানি ও রফতানির ক্ষেত্রে প্রতি ডলার বিক্রি হয়েছে ৮৩ টাকা ৯০ পয়সায়। নগদ ডলার ৮৬ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করছে ব্যাংকগুলো।

বাজারে বিদ্যমান ডলারের এ বিনিময় মূল্য ও প্রকৃত বিনিময় মূল্যের মধ্যে বড় ধরনের তফাত নেই বলে দাবি বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। তারা বলছেন, প্রতিদিনই বাণিজ্য অংশীদার শীর্ষ দেশগুলোর মুদ্রার মানের সঙ্গে সমন্বয় করে ডলারের মূল্য তদারক করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে টাকার কিছুটা অতিমূল্যায়ন থাকতে পারে। দেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এখনো আমদানিনির্ভর। এ অবস্থায় টাকার বড় অবমূল্যায়ন হলে বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকবে না। মূল্যস্ফীতি বেড়ে ভারসাম্য নষ্ট হবে।

যদিও ডলারের বিপরীতে টাকার অতিমূল্যায়ন কিছুটা বেশি বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যায়ন রিয়াল ইফেক্টিভ রেটের ভিত্তিতে নির্ধারণ করে না। এটি করলে ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার বেড়ে যাবে। তবে এটি ঠিক, টাকা কিছুটা অতিমূল্যায়িত হচ্ছে।

টাকার এ অতিমূল্যায়নের প্রভাব পড়ছে রেমিট্যান্সের ওপরও। ডলারের বিপরীতে টাকা কম পাওয়ায় রেমিট্যান্স পাঠাতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন প্রবাসীরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন ১৪ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলার। অথচ ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে ১৫ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল।

যদিও জনশক্তি রফতানি ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যমতে, শুধু ২০১৭ সালেই ১০ লাখের বেশি বাংলাদেশী কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশে গেছেন। চলতি বছরসহ গত পাঁচ বছরে চাকরির উদ্দেশ্যে বিদেশ পাড়ি দেয়া বাংলাদেশীর সংখ্যা ৩৩ লাখ ৩২ হাজার।

টাকার অতিমূল্যায়নের কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে উৎপাদনমুখী শিল্পের বিকাশ। এর প্রভাব পড়ছে কর্মসংস্থানে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৬-১৭ অর্থবছরে কর্মসংস্থান কমেছে প্রায় এক লাখ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে ১৩ লাখ, যা আগের অর্থবছর ছিল ১৪ লাখ।

এ অবস্থায় ডলারের বিনিময় মূল্য ও প্রকৃত মূল্যের ব্যবধান কমিয়ে আনা দরকার বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, এক বছর আগেই টাকার অবমূল্যায়ন ঘটিয়ে ডলারের বিনিময় মূল্য ও প্রকৃত মূল্যের ব্যবধান কমিয়ে আনা দরকার ছিল। ডলারের বিপরীতে টাকার অতিমূল্যায়ন করে কোনো লাভ হচ্ছে না। এটি আমদানিকে অনেক বেশি উৎসাহিত করছে। আমদানিনির্ভর অর্থনীতি কোনো দেশের জন্যই সুখকর নয়।

টাকার অতিমূল্যায়নে রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জানিয়ে এ বিশেষজ্ঞ বলেন, অনেক আগে থেকেই আমি বলে আসছি, ডলারের প্রকৃত মূল্যের সঙ্গে বাজারমূল্যের সমন্বয় করে দেয়া দরকার। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে টাকাকে অতিমূল্যায়িত দেখানো হচ্ছে। নির্বাচনের আগে নীতিনির্ধারকরা অবমূল্যায়নের ঝুঁকি নিতে চাইছেন না। নির্বাচনের পর হলেও এটি আমাদের করতেই হবে।

২০১৩ সালের নভেম্বরে প্রতি ডলার কিনতে খরচ হতো ৭৭ টাকা ৬৫ পয়সা। ২০১৭ সালের ৭ নভেম্বর ডলারের মূল্য বেড়ে ৮০ টাকা ৯৫ পয়সায় উন্নীত হয়। এরপর ডলারের তীব্র সংকট সত্ত্বেও এ মূল্য চলতি মাসের ৭ নভেম্বর পর্যন্ত ৮৩ টাকা ৮৫ পয়সায় বেঁধে রাখা হয়েছে। এর পেছনে নীতিনির্ধারকদের মনস্তাত্ত্বিক কারণকে বড় করে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।

ড. জাহিদ হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, মনস্তাত্ত্বিক কারণেই আমাদের নীতিনির্ধারকরা টাকার অবমূল্যায়নের ঝুঁকি নিতে চান না। বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেই ‘স্ট্রং কারেন্সি মিথ’ কাজ করে। সবাই চায়, তার নিজস্ব মুদ্রা শক্তিশালী হোক। কিন্তু বাস্তবতা হলো, মুদ্রা কোনো দেশের জাতীয় পতাকা নয়। মুদ্রাকে বাজার পরিস্থিতির ওপর ছেড়ে দেয়া উচিত। তার মানে এই নয় যে ডলারের মূল্যমানকে একেবারে বাজার পরিস্থিতির ওপর ছেড়ে দিতে হবে। বরং নিয়ন্ত্রণে রেখেই ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন ঘটানো দরকার।

  • Courtesy: Banikbarta/ Nov 12, 2018

শাপলা চত্বরে শতাধিক নিহত ও আহত হয়েছিল অগণিত - বাবুনগরী


হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী বলেন, শাপলা চত্বরে গিয়েছিলাম বিশ্ব নবী (সা.) ইজ্জত সম্মান রক্ষা করার জন্য। সেখানে গিয়ে দেখি নারায়ণগঞ্জের ছয় লাশসহ আমার সামনে আরও আটটি লাশ পড়েছিল। ওইদিন শতাধিক নিহত ও আহত হয়েছে অগণিত। সেদিন আমার চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। আমার টেলিফোনে বারবার ফোন আসছিল আপনি চলে যান। 

শনিবার রাত ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত ফতুল্লার মাসদাইর কেন্দ্রীয় ঈদগাহ ময়দানে বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড (বেফাক)-এর উদ্যোগে নারায়ণগঞ্জ জেলার কৃতী শিক্ষার্থীদের পুরস্কার বিতরণ ও সংবর্ধনাসহ ইসলামী সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি ওইসব কথা বলেন। 

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বেফাক’র জেলা শাখার সভাপতি আল্লামা আবদুল কাদের। কোরআনের বয়ান উদ্ধৃত করে বাবু নগরী আরও বলেন, কওমি গোষ্ঠী ও মুসলমানদের পিতা ইব্রাহীম (আ.)। তাহলে কওমি জননীও সে রকম হতে হবে। দিলদার ও পরহেজগার হতে হবে। 

তিনি বলেন, কোনো কোনো মন্ত্রী সচিবরা বলছে, বর্তমান সরকার ওলামায়ে দেওবন্দিদের মূল ধারায় নিয়ে আসছে, তাহলে বোঝা যাচ্ছে এতদিন ওলামা কেরামদের কোনো মূলধারা ছিল না। সরকার আমাদের সনদের স্বীকৃতি দিয়ে মূলধারায় আনে নাই বরং সরকারই মূলধারায় চলে এসেছে।

এতদিন স্বীকৃতি না দিয়ে সরকার মূলধারায় ছিল না। আমরা আগের থেকে মূলধারায় আছি। সরকার আমাদের স্বীকৃতি দিয়ে সম্মানিত করে নাই, সরকার নিজেই সম্মানিত হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ওইদিন নাকি শাপলা চত্বরে কাউকে হত্যা করা হয়নি, যারা এ রকম বলে তারা মিথ্যা বলছে।
  • কার্টসিঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন/  নভেম্বর ১২, ২০১৮ 

সংলাপের পর আরও ১০০ গায়েবি মামলা

  • ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সংলাপের পর ১০ দিনে ১০০ মামলা
  • হয়রানিমূলক ও গায়েবি ১০০ মামলার মধ্যে ৯৭টি মামলারই বাদী পুলিশ 


কেরানীগঞ্জের কদমতলী গোলচত্বরের কাছে ৬ নভেম্বর দুপুরে কিছু লোককে ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটাতে ও গাড়ি ভাঙচুর করতে ‘দেখেছে’ পুলিশ। কিন্তু কদমতলীর স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, বিস্ফোরণ হলে অন্তত শব্দ শোনা যেত। ভাঙচুর হলে এলাকায় শোরগোল হতো। এ ছাড়া সেদিন সকাল থেকেই কদমতলী এলাকা পুলিশের নিয়ন্ত্রণে ছিল।

ভাঙচুরের ওই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ঘটনাস্থল থেকে ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করার কথা মামলায় উল্লেখ করেছে পুলিশ। এ বিষয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য, সেদিন পুলিশ গাড়ি থেকে নামিয়ে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে।

এ ধরনের মামলার কথা ১ নভেম্বর গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রথম দফার সংলাপে তুলেছিলেন বিএনপির নেতারা। তখন প্রধানমন্ত্রী তাঁদের আশ্বাস দিয়েছিলেন, রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা দেওয়া হবে না।

কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ১ থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত রাজধানীর বাইরে ২০ জেলায় বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ১০০ টি। এর মধ্যে ৯৭টি মামলারই বাদী পুলিশ। বিএনপির নেতাদের দাবি, এই মামলাগুলো হয়রানিমূলক ও গায়েবি।

আর ৬ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সমাবেশের দিন ঢাকার ছয়টি থানায় ছয়টি মামলা হয়। এসব মামলায় গাড়ি ভাঙচুর, রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা, পুলিশের ওপর হামলা, ককটেল বিস্ফোরণসহ নাশকতার ঘটনার কথা উল্লেখ রয়েছে। ছয়টি মামলায় ঘটনাস্থল থেকে ১৩৮ জনকে গ্রেপ্তার করার কথা বলেছে পুলিশ। কিন্তু যে এলাকায় এবং যে সময়ে এসব ঘটনা ঘটেছে বলে পুলিশ দাবি করেছে, স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে এর কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। উল্টো এসব ঘটনার বিবরণ শুনে স্থানীয় লোকজন বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।

কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকলে মামলা দেওয়া উচিত নয় বলে জানান জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আইনের বাইরে গিয়ে কিছু করা ঠিক নয়।

প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, ১ থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত চাঁদপুর, কুমিল্লা, দিনাজপুর, ঝালকাঠি, কুষ্টিয়া, সিলেট, বরিশাল, বাগেরহাট, শেরপুর, কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, সিরাজগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নড়াইল, নওগাঁ, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বান্দরবান ও চট্টগ্রাম জেলায় বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ১০০টি মামলা হয়েছে। এসব মলায় ২ হাজার ৩৮০ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। আর অজ্ঞাতপরিচয় আসামি আড়াই হাজারের বেশি।

বিএনপির নেতারা বলছেন, এসব মামলার সবই গায়েবি। মামলায় বর্ণিত ঘটনার কোনো সত্যতা নেই। নেতা-কর্মীদের ধরে জেলে ঢোকাতেই এসব মামলা।

ঝালকাঠি জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সংসদ নির্বাচনের আগে নতুন করে মামলা হবে না বলে সংলাপে প্রধানমন্ত্রী যে আশ্বাস দিয়েছিলেন, তার বাস্তবায়ন নেই। গায়েবি মামলা অব্যাহত রয়েছে। নির্বাচনের আগে বিরোধী শক্তিকে মাঠে নামতে বাধাগ্রস্ত করার জন্যই মামলা ও ধরপাকড় চলছে।

গায়েবি ঘটনায় করা মামলার বিষয়ে সম্প্রতি উচ্চ আদালতে রিটও হয়েছে। ঐক্যফ্রন্টের নেতারা গায়েবি মামলার একটি তালিকাও প্রধানমন্ত্রীকে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপের পর ৬ নভেম্বর ঢাকায় হওয়া ছয়টি মামলার বিষয়ে অনুসন্ধান চালায় প্রথম আলো।

কেউ জানে না

বিস্ফোরক আইনে করা কেরানীগঞ্জ থানার মামলায় বলা হয়েছে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশে যোগ দিতে মঙ্গলবার (৬ নভেম্বর) দুপুরে বুড়িগঙ্গা দ্বিতীয় সেতুর দক্ষিণ পাশে বিএনপির নেতা-কর্মীরা জড়ো হন। পরে তাঁরা কদমতলী গোলচত্বরের লায়ন টাওয়ারের (সেতুর পাশেই) সামনে গাড়ি ভাঙচুর করেন। ঘটনাস্থল থেকেই ১৩ জনকে আটক করা হয়।

পুরান ঢাকার বাবুবাজার থেকে কেরানীগঞ্জে যেতে হয় বুড়িগঙ্গা দ্বিতীয় সেতু পার হয়ে। এই সেতু পার হয়ে ঢাকা থেকে কেরানীগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, নবাবগঞ্জ ও দোহারে যাওয়া যায়।

বাবুবাজার সেতুসংলগ্ন লায়ন টাওয়ারের পাশেই এসএস মোটরসাইকেল সার্ভিস সেন্টার। ৮ নভেম্বর সেখানে গিয়ে কথা হয় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানটির মালিক স্বপন সরকারের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ককটেল বিস্ফোরণ বা গাড়ি ভাঙচুরের কোনো ঘটনাই তিনি দেখেননি।

লায়ন টাওয়ারের নিচতলার জেজে ফ্যাশনের মালিক মো. রকি বলেন, সেদিন সারা দিনই তিনি দোকানে ছিলেন। ভাঙচুর, হামলার কোনো ঘটনা তাঁর চোখে পড়েনি।

মামলার বাদী ঢাকা জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (দক্ষিণ) উপপরিদর্শক (এসআই) কাজী এনায়েত হোসেন বলেন, লোকজন যা বলছে, তা মোটেও ঠিক নয়।

তবে পুলিশের করা মামলার জব্দ তালিকার সাক্ষী ও মাইক্রোবাসচালক সুলতান হোসেন বলেন, সেদিন তাঁর গাড়িতে করেই ওই ১৩ জন দোহার থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশে যাচ্ছিলেন। সেতুর কাছে তাঁকেসহ সবাইকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। রাতে তাঁকে ছেড়ে দিলেও অন্যদের নামে মামলা দেওয়া হয়।

লেগুনা ভাঙচুর নিয়ে মালিকের বিস্ময়

তেজগাঁও থানায় পুলিশের করা আরেকটি মামলায় বলা হয়েছে, ৬ নভেম্বর গ্রিন রোডের আরএইচ হোম সেন্টার বিল্ডিংয়ের সামনে বিএনপির নেতা-কর্মীরা নাশকতা করার জন্য ইটপাটকেল, লাঠিসহ অবস্থান করছিলেন। একপর্যায়ে সেখান থাকা লেগুনা গাড়িসহ (ঢাকা মেট্রো-ছ ১৪০৭৩৭) বিভিন্ন লেগুনা ভাঙচুর করেন। ঘটনাস্থল থেকে একটি লেগুনা গাড়ি, ছয়টি ইটের টুকরা এবং বিভিন্ন লেগুনা গাড়ির কাচের টুকরা জব্দ করা হয়।

আরএইচ হোম সেন্টারের ঠিক সামনেই চা বিক্রি করেন সেন্টু নামের এক ব্যক্তি। ৮ নভেম্বর তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সেদিন সারা দিনই তাঁর দোকান খোলা ছিল। লেগুনা ভাঙচুর বা পুলিশের সঙ্গে ইটপাটকেল ছোড়াছুড়ির কোনো ঘটনা তিনি দেখেননি।

মামলার বাদী তেজগাঁও থানার এসআই শরিফুল ইসলাম বলেন, ঘটনাটি খুব অল্প সময়ের মধ্যে ঘটেছিল। তাই হয়তো কেউ খেয়াল করেনি।

গ্রিন রোডের মাথাতেই লেগুনাস্ট্যান্ড। এই স্ট্যান্ড পরিচালনা করা শ্রমিক ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক মনির হোসেন বলেন, এই এলাকায় সাম্প্রতিক সময়ে লেগুনা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেনি।

আর ওই লেগুনার (পুলিশের জব্দ করা) মালিক সাদ্দাম হোসেন মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, সেদিন চালক লেগুনাটি আরএইচ হোম সেন্টারের সামনে রেখে চা খেতে গিয়েছিলেন। এসে দেখেন, পুলিশ লেগুনাটি থানায় নিয়ে গেছে। পরে রাতে তাঁরা থানা থেকে লেগুনা ছাড়িয়ে আনেন।

এই মামলায় পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ৪১ জনকে গ্রেপ্তার দেখিয়েছে।

দুই মাসেও বিএনপির সমাবেশ দেখেনি কেউ

গেন্ডারিয়া থানায় করা মামলায় পুলিশ বলছে, ৬ নভেম্বর বিকেলে সাদেক হোসেন খোকা মাঠের সামনে বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীরা জড়ো হয়ে সরকারবিরোধী স্লোগান দিয়ে জনগণের মধ্যে ভীতির সৃষ্টি করেন। ঘটনাস্থল থেকে সাতজনকে পুলিশ আটক করে।

তবে মাঠের সামনে থাকা দোকান রুবেল স্টোরের মালিক বাদশা মিয়া জানান, সেদিন এখানে বিএনপির কোনো মিছিল হয়নি।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গেন্ডারিয়া থানার এসআই বাবুল হোসেনের দাবি, নাশকতা করার জন্য সেদিন বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীরা জড়ো হয়েছিলেন।

নর্থ সাউথ রোডে প্রতিবন্ধক

পল্টন থানায় সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার মামলায় পুলিশ বলেছে, ৬ নভেম্বর সন্ধ্যায় বিজয়নগরের রেইনবো গলির মুখে নর্থ সাউথ সড়কের ওপর বিএনপি, জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে যান চলাচল বন্ধ করে দেন। বিকেল ৫টা ৩০ মিনিট থেকে সন্ধ্যা ৬টা ১৫ মিনিট পর্যন্ত রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ ছিল। দফায় দফায় পুলিশকে লক্ষ্য করে হামলা চালানোর সময় ৩৮ জনকে আটক করা হয়। 
মামলার বাদী পল্টন থানার এসআই তবিবুর রহমান বলেন, যা ঘটেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতেই মামলাটি করা হয়েছে।

রেইনবো গলির মুখে চায়ের দোকান রয়েছে আবুল খায়েরের। তিনি বলেন, এমন ঘটনা ঘটলে তাঁর দোকান বন্ধ থাকত। সেদিন রাত আটটা পর্যন্ত তিনি দোকানে ছিলেন। 

ফাঁকা ছিল বিজি প্রেস উচ্চবিদ্যালয় এলাকা

তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার পুলিশ বলছে, ৬ নভেম্বর দুপুরে বিজি প্রেস স্কুলের সামনে ঐক্যফ্রন্টের সমাবেশে যোগ দেওয়ার জন্য বিএনপির নেতা-কর্মীরা জড়ো হয়ে নাশকতার পরিকল্পনা করছিলেন। খবর পেয়ে পুলিশ ২৭ জনকে আটক করে।

স্কুল ও এর পাশের একটি প্রতিষ্ঠানের দুজন নিরাপত্তারক্ষী বলেন, বাইরের কোনো লোক জড়ো হওয়া বা তাঁদের আটক করার মতো কোনো ঘটনা তিনি সেদিন দেখেননি।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার এসআই বাবলুর রহমান বলেন, মামলাটি তদন্তাধীন। তদন্ত শেষে বাকিটা বলা যাবে।

মিছিল দেখেননি, আটক করতে দেখেছেন

ওয়ারী থানায় করা মামলায় পুলিশ বলেছে, ৬ নভেম্বর বিকেলে ওয়ারীর কাপ্তানবাজারের কাছে এরশাদ সুপার মার্কেট-১-এর পশ্চিম পাশের রাস্তায় বিএনপির নেতা-কর্মীরা জড়ো হয়ে যান চলাচলে বাধা দেন। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ১২ জনকে আটক করে।

যদিও এরশাদ সুপার মার্কেটের সামনে থাকা দোকানের কর্মীরা বলেছেন, সেদিন বিএনপির কোনো মিছিল দেখেননি তাঁরা। তবে ঘটনাস্থল থেকে অনেককে আটক করে নিয়ে যেতে দেখেছেন। দোকানি মো. আসাদ ও এরশাদ সুপার মার্কেটের নিরাপত্তারক্ষী কবির হোসেন বলেন, রাস্তায় গাড়ি চলাচলে বাধা দেওয়ার কোনো ঘটনাই সেদিন ঘটেনি।

মানবাধিকারকর্মী নূর খান প্রথম আলোকে বলেন, বাস্তবের সঙ্গে ঘটনার মিল নেই—এমন আজগুবি মামলা দিচ্ছে পুলিশ। যারা মিথ্যা অভিযোগে মামলা করছে, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত। যা ঘটছে তা গণতন্ত্রের জন্য শুভ নয়।
  • কার্টসিঃ প্রথম আলো/ নভেম্বর ১২, ২০১৮ 

EC must take action against code of conduct breaches

EDITORIAL

THE violation of the directives that the Election Commission usually enforces on political parties during the election time comes to be worrying. The commission which has not lifted a finger, but for sounding indirect warnings, to attend to such violations, so far committed by the ruling alliance, appears not to be in a position to ensure a level playing field. Electoral violence has already started stalking the next parliamentary elections, so far scheduled for December 23, as two young people, claimed to be Awami League supporters, died on Saturday as a pick-up truck hit them during an infighting of the incumbent political party in Dhaka. The clash ensued between two Awami League leaders seeking nomination for the Dhaka 13 constituency. The motorcade of a leader of the party’s north city unit, on the way to collect the nomination form from the party president’s office at Dhanmondi, came to be attacked by the people of the party’s joint general secretary. While the home minister seeks to say that it was the Election Commission, which is now in control of the law enforcement agencies, that would look into the issue and the commission pleads ignorance of the incident, the prime minister is reported by the party’s general secretary to have asked the home minister to take action against the perpetrators.

The Election Commission, furthermore, asked the law enforcement agencies not to allow any political parties and alliances to hold rallies before the general elections. But Awami League leaders and their streaming pick-up trucks and supporters walking down the roads, especially towards the party president’s office at Dhanmondi, have gone unchecked. A situation like this has brought life there to a standstill and caused severe traffic congestion in surrounding areas for the past three days. Yet the Election Commission sees such processions and marches as something adding to the election-time festivity. It is time the Election Commission defined electoral marches and festive marches in its mental map in its preparation for action to stop the violation of electoral code. The commission has also asked individuals and political parties to remove campaign materials that they have put in public display such as posters, banners and pull down gates erected on roads in seven days. The commission has asked city and municipal mayors and representatives of other local government agencies to remove campaign materials as their display before December 1 would constitute the violation of the code of conduct. Roadside walls in Dhaka and elsewhere have already been covered with posters seeking votes for Awami League aspirants. Reports coming from outlying areas say that Awami League leaders aspiring to nomination, and in some cases representatives of local government agencies, have already begun electoral campaign. Yet no initiative has got off the ground for the commission to take action and for the authorities concerned to remove the materials.

All this suggests that the Election Commission has so far failed to take any action against violations of the electoral code of conduct by Awami League leaders and their people and even the law enforcers and elected local government representatives. Neither of the law enforcement agencies, nor local government representatives care to act, keeping to what the Election Commission asks them to, that could displease the leaders of the incumbent political party and their people. The Election Commission must rise up to the occasion.

  • Courtesy: New Age Nov/ 12, 2018

কে এই জাফরুল্লাহ চৌধুরী

কাফি কামাল 

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। মহান মুক্তিযুদ্ধের কিংবদন্তি যোদ্ধা। রণাঙ্গনে ফিল্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে প্রাণ বাঁচিয়েছেন অসংখ্য আহত ও অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধার। জাতির যেসব সূর্যসন্তান আজকের এই স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ গড়ার নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন এবং রাজনীতির বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গনে ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন তাদের অন্যতম তিনি। 

স্বাধীন  দেশে তিনি হতে পারতেন দেশসেরা সার্জন। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারতেন চিকিৎসাখাতের প্রধান ব্যবসায়ী। কিন্তু ভিন্নধাতুতে গড়া এক লড়াকু মানুষ ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। স্বাধীন দেশে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন গণমানুষের স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়নে।

প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নারীদের করেছেন প্রাথমিক স্বাস্থ্যকর্মী। প্রথম উদ্যোগ নিয়েছেন জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের। জনকল্যাণধর্মী চিকিৎসানীতির মাধ্যমে দেশে ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার নীতি প্রণয়ন, জাতীয় শিক্ষা কমিটির সদস্য হিসেবে অগ্রসর শিক্ষা নীতি প্রণয়ন ও নারী উন্নয়নে রেখেছেন যুগান্তকারী ভূমিকা। সরকার ও রাষ্ট্রের, ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর যেকোনো অনিয়মের বিরুদ্ধে তিনি দাঁড়িয়েছেন বুকচিতিয়ে। দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ-পরিস্থিতি যখন উত্তপ্ত, অনিশ্চিত তখনই বিবদমান পক্ষের মাঝখানে সমঝোতার সেতুর ভূমিকা নিয়েছেন। 

রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে থেকে একজন ব্যক্তিমানুষের পক্ষে দেশ ও দেশের মানুষের জন্য যতটুকু কাজ করা সম্ভব তার সর্বোচ্চটাই করেছেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। সাম্প্রতিক সময়েও তিনি অবস্থান নিয়েছেন কোটাবিরোধী ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে ছাত্রদের আন্দোলনে। সবমিলিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন ব্যক্তিত্বের শিখরস্পর্শী এক উচ্চতায়। মহান এ ব্যক্তিত্বকে আজ অপমান, মানহানি আর অব্যাহতভাবে তার বিরুদ্ধে দায়ের করা হচ্ছে মামলা।

দেশের মানুষকে কম পয়সায় চিকিৎসা দিতে তিলতিল করে যে হাসপাতালটি তিনি গড়ে তুলেছেন সেটির ওপর দুর্বৃত্তদের হাত পড়ছে। ছাত্রজীবনে চড়তেন দামি গাড়িতে। ছিল পাইলটের লাইসেন্স। লন্ডনে পড়াশোনা অবস্থায় রাজকীয় দর্জি তার বাসায় এসে মাপ নিয়ে স্যুট তৈরি করতেন বলে অতিরিক্ত পরিশোধ করতেন ২০ পাউন্ড। বাস্তবজীবনে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী এ মহান চিকিৎসক বর্তমানে যাপন করেন সাধারণ জীবন। দেশে-বিদেশে কোথাও তার একটি ফ্ল্যাট পর্যন্ত নেই। বোনকে দান করে দিয়েছেন পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া জমিজমা। মরণোত্তর দেহদান করায় দাফনের জন্যও প্রয়োজন হবে না জমির। অথচ তার বিরুদ্ধেই অভিযোগ তোলা হয়েছে ভূমি দখলের। 

১৯৪১ সালের ২৭শে ডিসেম্বর চট্টগ্রামের রাউজানে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জন্ম ও পৈত্রিক নিবাস। বড় হয়েছেন ঢাকায়। তার বাবার শিক্ষক ছিলেন বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেন। পিতামাতার দশজন সন্তানের মধ্যে তিনি সবার বড়। পড়াশোনা করেছেন বকশীবাজার স্কুল, ঢাকা কলেজ ও ঢাকা মেডিকেলে। ছাত্র ইউনিয়নের মেডিকেল শাখার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ছাত্র অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দুর্নীতির বিরুদ্ধে করেছিলেন সংবাদ সম্মেলন। ১৯৬৪ সালে ডিএমসি থেকে এমবিবিএস ও ১৯৬৭ সালে বিলেতের রয়্যাল কলেজ অব সার্জনস থেকে জেনারেল ও ভাস্কুলার সার্জারিতে এফআরসিএস প্রাইমারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কিন্তু চূড়ান্ত পর্ব শেষ না করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে দেশে ফিরে আসেন। বৃটেনে প্রথম বাংলাদেশি সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন (বিডিএমএ)’র প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক তিনি। 

মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বাংলাদেশে ফেরার গল্পটি সিনেমার কাহিনীকে হার মানায়। পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মমতার প্রতিবাদে লন্ডনের হাইড পার্কে যে কয়েকজন বাঙালি পাসপোর্ট ছিঁড়ে আগুন ধরে রাষ্ট্রবিহীন নাগরিকে পরিণত হয়েছিলেন তাদের একজন ডা. চৌধুরী। তারপর বৃটিশ স্বরাষ্ট্র দপ্তর থেকে ‘রাষ্ট্রবিহীন নাগরিকের’ প্রত্যয়নপত্র নিয়ে সংগ্রহ করেন ভারতীয় ভিসা। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম তার কালজয়ী সৃষ্টি ‘একাত্তরের দিনগুলি’র ১৬১-১৬২ পৃষ্ঠায় ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে নিয়ে লিখেছেন- ‘চেনা হয়ে উঠেছে ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ডা. এমএ মোবিন। এরা দুজনে ইংল্যান্ডে এফআরসিএস পড়ছিল। ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে বিলেতে চার বছর হাড়ভাঙা খাটুনির পর যখন এফআরসিএস পরীক্ষা মাত্র এক সপ্তাহ পরে, তখনই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু। ছেলে দুটি পরীক্ষা বাদ দিয়ে বাংলাদেশ আন্দোলনে অংশ নিলো, পাকিস্তানি নাগরিকত্ব বর্জন করলো, ভারতীয় ট্রাভেল পারমিট যোগাড় করে দিল্লিগামী প্লেনে চড়ে বসলো। উদ্দেশ্য ওখান থেকে কলকাতা হয়ে রণাঙ্গনে যাওয়া। প্লেনটা ছিল সিরিয়ান এয়ারলাইন্স-এর। দামাস্কাসে পাঁচ ঘণ্টা প্লেন লেট, সবযাত্রী নেমেছে। ওরা দুইজন আর প্লেন থেকে নামে না। ভাগ্যিস নামেনি। এয়ারপোর্টে এক পাকিস্তানি কর্নেল উপস্থিত ছিল ওই দুইজন ‘পলাতক পাকিস্তানি নাগরিককে’ গ্রেপ্তার করার জন্য।

প্লেনের মধ্য থেকে কাউকে গ্রেপ্তার করা যায় না, কারণ প্লেন হলো ইন্টারন্যাশনাল জোন। দামাস্কাসে সিরিয়ান এয়ারপোর্ট কর্মকর্তা ওদের দুইজনকে জানিয়েছিল- ওদের জন্যই প্লেন পাঁচ ঘণ্টা লেট। এমনিভাবে ওরা বিপদের ভেতর দিয়ে শেষ পর্যন্ত মে মাসের শেষাশেষি সেক্টর টু রণাঙ্গনে গিয়ে হাজির হয়েছে।’ 

যুদ্ধ যখন বিস্তার লাভ করে যুদ্ধক্ষেত্রে হতাহত যোদ্ধা, উদ্বাস্তু ও নির্যাতনের শিকার অসংখ্য নর-নারীর জরুরি চিকিৎসাসেবায় প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় একটি হাসপাতালের। মুক্তিযুদ্ধের ২ নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ ও  ভারতের জিবি হাসপাতালের প্রধান সার্জন ডা. রথিন দত্তের সহযোগিতায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের প্রথম জিএস ডা. এমএ মবিনকে নিয়ে আগরতলার বিশ্রামগঞ্জের মেলাঘরে হাবুল ব্যানার্জির আনারস বাগানে গড়ে তোলেন প্রথম ফিল্ড হাসপাতাল- ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’। হাসপাতালটির কমান্ডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন ডা. সিতারা বেগম বীরপ্রতীক। সেসময় প্রশিক্ষিত নার্স না থাকায় নারী স্বেচ্ছাসেবীদের প্রাথমিক চিকিৎসার প্রশিক্ষণ দেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। সে হাসপাতালের দুই স্বেচ্ছাসেবী ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল ও তার বোন সাঈদা কামাল। মুক্তিযুদ্ধের সময় অসংখ্য মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে ৪৮০ শয্যাবিশিষ্ট এ হাসপাতাল। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল আতাউল গনি ওসমানীকে বহনকারী যে হেলিকপ্টারটি হামলার শিকার হয়েছিল তাতে অন্যদের মধ্যে ছিলেন- ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। 

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর গ্রামে ফিরে গিয়ে স্বাস্থ্যযুদ্ধ শুরু করেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের ফিল্ড হাসপাতালটি গণস্বাস্থ্যকেন্দ্র নামে গড়ে তুলেন কুমিল্লায়। পরে সেটা স্থানান্তর করেন ঢাকার অদূরে সাভারে। এ ‘গণস্বাস্থ্যকেন্দ্র’ নামটি দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কেন্দ্রের ভবিষ্যৎ কর্মকাণ্ডের জন্য বরাদ্দ দিয়েছিলেন প্রায় ৩১ একর জমি সরকারিভাবে। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর পাইলট প্রজেক্ট গণস্বাস্থ্যকেন্দ্র প্রাইমারি কেয়ার কনসেপ্ট মাঠে প্রমাণ করে এবং এর ভিত্তিতে হু আর ইউএনও আলমাআতা কনফারেন্সের মাধ্যমে গ্লোবাল ইউনিভার্সাল প্রাইমারি কেয়ার প্রকল্পের ঘোষণা দেয়। গ্লোবাল প্যারামেডিক যে কনসেপ্ট ও ট্রেইন্ড প্যারামেডিক দিয়ে মিনি ল্যাপারোটমির মাধ্যমে লাইগেশন সার্জারির উদ্ভাবক ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। এ সংক্রান্ত তার পেপারটি বিশ্ববিখ্যাত মেডিকেল জার্নাল ল্যানসেট মূল আর্টিকেল হিসেবে ছাপা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের মূল পেডিয়াটিক্স টেক্সট বইয়ের একটা চ্যাপ্টার ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী লিখতেন অনেক বছর ধরে। দেশে-বিদেশে তার লেখা বই ও পেপারের সংখ্যা প্রচুর। প্রাইমারি কেয়ার নিয়ে লেখা তার সম্পাদিত ও প্রকাশিত একটি বই ‘যেখানে ডাক্তার নেই’-একসময় অবশ্য পাঠ্য ছিল বাংলাদেশের ঘরে ঘরে। 

স্বাধীনতা যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ গঠনের লক্ষ্যে প্রথম বৈঠকটিতে সভাপতিত্ব করেছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। পরে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রধান ছিলেন তিনি। ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’ ছিল এদেশের মধ্যবিত্তের মৌলিক একটি প্রকাশনা। সর্বোচ্চ প্রচারণা ছিল বিচিত্রার প্রধান হাতিয়ার। সত্তর দশকের বিচিত্রায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, মওলানা ভাসানী প্রমুখ ছাড়া হাতেগোনা যে ক’জন বিচিত্রার প্রচ্ছদে স্থান পেয়েছিলেন- ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী তাদের একজন। সোনালী ধানক্ষেতের ব্যাকগ্রাউন্ডে দাঁড়িয়ে আছেন ঝাঁকড়া চুলের তরুণ ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এমন একটি ছবি প্রচ্ছদ করেছিল বিচিত্রা। ১৯৭৯ সাল থেকেই তিনি জাতীয় শিক্ষা কমিটির ও নারী কমিটির সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন বাংলাদেশে শিক্ষা ও নারীনীতি প্রণয়নে। তবে গণস্বাস্থ্যের পর তার ম্যাগনাম ওপাস হচ্ছে ১৯৮২ সালের জাতীয় ঔষুধ নীতি। স্বাধীনতার পর স্বাস্থ্যখাতে যেটাকে বিবেচনা করা সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হিসেবে। তার প্রচেষ্টায় আমদানি ওষুধের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ২২৫। বর্তমানে ৯০ শতাংশ ওষুধই দেশে তৈরি হচ্ছে এবং বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে একটি ওষুধ রপ্তানিকারক দেশে। অথচ জাতীয় স্বাস্থ্যনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় ১৯৯২ সালে তার সদস্যপদ বাতিল করেছিল বিএমএ। বিনা বিচারে তার ফাঁসি চেয়ে পোস্টারও সাঁটিয়েছিল। তাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা-বিশ্বাস করেন রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধারা। ফিল্ড হাসপাতালের সহযোগী চিকিৎসক ও গেরিলা যোদ্ধা ডা. মোরশেদ চৌধুরী আমৃত্যু কাজ করেছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে। ফিল্ড হাসপাতালের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত চিকিৎসক এমএ মুবিন বাংলাদেশে এলে এখনো চিকিৎসা দেন গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে। 

স্বাধীন বাংলাদেশে বিভিন্ন সরকারের সময়ে মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব পেয়েও ফিরিয়ে দিয়েছেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। কিন্তু অনুপ্রাণিত করেছেন বহু ভালো পদক্ষেপ গ্রহণে। তার পরামর্শে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের পক্ষে পাসপোর্ট ইস্যু করে বিলেতের এক লাখ বাঙালির কাছ থেকে আবু সাইয়িদ চৌধুরীর সংগ্রহ করেছিলেন ১০ লাখ পাউন্ড চাঁদা। বঙ্গবন্ধুকে বহুজাতিক কোম্পানির দুর্নীতির বিষয়ে অবহিত করে সমাজতান্ত্রিক দেশ থেকে ঔষুধ আমদানিতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। বাকশালে যোগ দিতে বঙ্গবন্ধুর অনুরোধ উপেক্ষা করেছিলেন। জিয়াউর রহমান মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব দিলে বিএনপিতে স্বাধীনতাবিরোধী থাকায় চার পৃষ্ঠার চিঠির মাধ্যমে সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মাধ্যমে নাগরিকের পাসপোর্ট পাওয়াকে সহজলভ্য ও নিশ্চিত করেছিলেন। ১৯৮০ সালে জিয়ার গড়া প্রথম জাতীয় মহিলা উন্নয়ন কমিটির দুই পুরুষ সদস্যের একজন হিসেবে প্রাথমিকে ৫০ শতাংশ মহিলা শিক্ষক ও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ ছাত্রী নেয়ার সুযোগ করেছিলেন, যা কার্যকর হয়েছিল এরশাদ আমলে। জিয়াউর রহমানের আমলে পুলিশে মহিলা নিয়োগ দেয়া শুরু হলে দেশের প্রথম দুই নারী পুলিশ- হিসেবে নিয়োগ পান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কর্মী হোসনে আরা ও চামেলী বেগম। স্বাস্থ্যমন্ত্রী হতে উপেক্ষা করেছিলেন এরশাদের প্রস্তাব। তার পরামর্শেই এরশাদ আমলে পোস্টার, বিলবোর্ড বাংলায় লেখা ও সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলন, উপজেলাব্যবস্থা ও সফল জাতীয় ঔষুধনীতি ও জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি করেছিলেন।  

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যেমন সর্বোচ্চ শ্রদ্ধার আসনে রাখেন, তেমনি কিংবদন্তি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জিয়াউর রহমানের প্রতিও রয়েছে তার অকুণ্ঠ সম্মান। ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিহত হওয়ার পর সেদিন দুপুরে লন্ডনের হিথ্রো এয়ারপোর্টে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বৃটিশ সাংবাদিকদের বলেছিলেন- ‘তিনি নিজের রক্ত দিয়ে জাতির ঋণ পরিশোধ করে গেলেন।’ 

শারীরিকভাবে খুব একটা সুস্থ নন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। সপ্তাহে তিন দিন ডায়ালাইসিস’র ওপর নির্ভর করে একরকম বেঁচে আছেন। কিন্তু জনগণের অধিকার আদায়ের তাড়না যার হৃদয়ে- তাকে কি আদৌ ডায়ালাইসিস দমাতে পারে? তাকেও পারেনি! শরীরের এমন নাজুক অবস্থার মধ্যেও তিনি ছুটে বেড়াচ্ছেন অফুরন্ত মানসিক শক্তি নিয়ে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের রাজনীতিতে একটি সুস্থ পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে নানাভাবে তৎপরতা চালিয়ে আসছেন। রাজনৈতিক সংস্কারের দাবি জানিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে খোলা চিঠি দিয়েছেন। বৈঠক করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রতিও নানা পরামর্শ দিয়েছেন।

বামপন্থি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন প্রথম জীবনে। দেশে-বিদেশে রয়েছে তার ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা। জাতীয় সংকটে নিজের দায়বোধ থেকে তিনি উদ্যোগী হয়েছেন জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলায়। তিনি সুবিধাবাদী সুশীল নয়, একজন বিবেকবান বুদ্ধিজীবী। তিনি কোনো ‘বাঁকা চোখের’ পরোয়া করেননি। সম্প্রতি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী সেনাবাহিনী প্রধান সম্পর্কে একটি ভুল তথ্য উপস্থাপন করে একটি বক্তব্য দিয়েছিলেন। সেটা উপলব্ধি করে তিনি পরদিনই সংবাদ সম্মেলন করে এর জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর চাঁদাবাজি, জমিদখল, পুকুরের মাছ চুরির অভিযোগসহ একের পর এক মামলা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের দুটি প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালসের এন্টিবায়োটিকের কাঁচামাল জব্দ ও এন্টিবায়োটিক বিভাগ সিলগালা ও প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করে ১৫ লাখ টাকা। গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ রাখার অভিযোগে হাসপাতালকে আরো ১০ লাখ টাকা জরিমানা করে। অথচ সাধারণ মানুষকে কমদামে ওষুধ সরবরাহ করতে গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দামি অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলের বদলে ট্যাবলেট তিনি প্যাকেট করার প্রচলন করেন সাধারণ কাগজে। 

২০১৫ সালে বৃটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যানের আদালত অবমাননার সাজায় উদ্বেগ জানিয়ে বিশিষ্ট নাগরিকদের বিবৃতি দেয়ার ঘটনায় ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে এক ঘণ্টার কারাদণ্ড দিয়েছিলেন ট্রাইব্যুনাল। তার প্রতিষ্ঠিত গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে মাত্র এক হাজার ২০০ টাকায় ডায়ালাইসিস করতে পারেন দরিদ্র মানুষ। তার প্রতিষ্ঠিত গণবিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর স্বামী প্রয়াত বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়া। যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষার্থীকে স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস, জেন্ডার ইস্যু, নীতিবিদ্যা ও সমাজ, পরিবেশবিদ্যা, ইংরেজি এবং বাংলা অবশ্যই পড়তে হয়। দরিদ্র ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের জন্য এই বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে সংরক্ষিত আসন। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের দাপ্তরিক কাজ হয় বাংলাভাষা ও বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসারে। বাংলাদেশের পাবলিক হেলথ সার্ভিসের এই আইকন সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক স্বাধীনতা পদক পান ১৯৭৭ সালে পদকটি প্রবর্তনের বছর। বিকল্প নোবেল খ্যাত র?্যামন ম্যাগসাই পান  ১৯৮৫ সালে। এ ছাড়া ১৯৭৪ সালে সুুইডিশ ইয়ুথ পিস প্রাইজ, স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার, ১৯৯২ সালে সুইডেনের লাইভ লাই হুড পুরস্কার, ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইন্টারন্যাশনাল পাবলিক হেলথ হিরোজ’ পুরস্কার লাভ করেন। 

  • কার্টসিঃ মানবজমিন/ নভেম্বর ১২,২০১৮ 

পোস্টার দেখলেই তো বোঝা যায় লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডটা কোথায়?

মরিয়ম চম্পা 

সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, এমন নির্বাচন হোক যেখানে হয়রানি-ভয়ভীতি থাকবে না। ২০০৮-এর মতো মানুষ ভোট দিতে পারবে। কারণ এর পরে আর মানুষ ভোট দিতে পারেনি। সাউথ এশিয়ান   ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্নেন্স (এসআইপিজি)-এর অনারারি ফেলো অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ড. এম সাখাওয়াত হোসেন মানবজমিনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন। দেশের রাজনীতি, সংলাপ, সামাজিক সংকটসহ নানা ইস্যুতে খোলামেলা কথা বলেন তিনি।  

ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, এত বছরের একটি রাজনৈতিক সংকট দুটি সেটিং বা সংলাপে সমাধান হবে- এটা আশা করা যায় না। এটা আশা করা অনেক বেশি হয়ে যাবে। তবুও বলা যায় যে, দেরিতে হলেও সরকারের তরফ থেকে একটি উদ্যোগ নেয়া হয়েছে এবং পাশাপাশি যারা অংশ নিয়েছে উভয়কেই স্বাগত জানানো উচিত।

কিন্তু তারপরও বেসিক কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। নির্বাচনটা কতটুকু ফেয়ার হবে এবং ভোটাররা কতটুকু স্বাচ্ছন্দ্যে ভোট দিতে পারবে। প্রশ্নগুলো রয়ে গেছে এই কারণে যে, বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হতে যাচ্ছে যেখানে সংসদ রেখে এবং ৩৫০ জন এমপি স্বপদে থেকে নির্বাচন করবেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এমপিরা তৃণমূলে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেন। গত দশ বছরে পালাক্রমে একধরনের প্রভাব বলয় তারা সৃষ্টি করেছে। সেখানে এমপিরা অকার্যকর থাকবেন এটা ঠিক কথা নয়। সর্বোপরি আসন্ন নির্বাচনে তৃণমূল থেকে শুরু করে ঊর্ধ্বতন পর্যায় পর্যন্ত তাদের প্রভাবটা থেকে যাবে। 

সাধারণ জনগণের ভোটাধিকার ফিরে পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যদি জাতীয় সংসদ নির্বাচন ভালো হয় এবং একইসঙ্গে ভোটারদের কাছে এবং অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের কাছে যদি গ্রহণযোগ্য হয় ও জেনারেল পারসেপশন যদি ভালো হয় তাহলেই এই পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটানো সম্ভব। কারণ ২০১৪ সালের নির্বাচন ভালো হয় নি বলে পরবর্তী কোনো নির্বাচনই ভালো হয় নি। সব নির্বাচনে একই ধারাবাহিকতা দেখা গেছে। কেন্দ্র দখল, জালভোট সব ঘটনাই ঘটেছে। যেখানে নির্বাচন কমিশনকে অতটা কার্যকর দেখা যায় নি। কাজেই আসন্ন নির্বাচনটা ভালো হলে বাকি নির্বাচনও ভালো হবে। 

নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা প্রসঙ্গে সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, বাংলাদেশে প্রত্যেকটি নির্বাচন কমিশন আস্থার সংকটে থেকে কাজ করেছে। কিছু কিছু নির্বাচন কমিশন সে আস্থার সংকট কাটিয়ে উঠতে পারলেও অনেক কমিশনই আস্থার সংকট কাটিয়ে উঠতে পারে নি। যারা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে তারা মোটামুটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে পেরেছে। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন ভালো হয় নি বলে ওটার কনটিনিউটি বজায় রয়েছে। একই সঙ্গে আমাদের দেশের যে সব প্রতিষ্ঠানগুলোর গণতান্ত্রিক ধারা ও জবাবদিহিতা অব্যাহত রাখার কথা সে সমস্ত প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এখান থেকে যদি আমরা বেরিয়ে আসতে না পারি তাহলে সমস্যা রয়েই যাবে। 

নির্বাচনে সেনা মোতায়েন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রথমত যেকোনো নির্বাচনে নিরাপত্তা সবচেয়ে বড় একটি ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ায়। অর্থাৎ সিকিউরিটি অব ম্যান অ্যান্ড ম্যাটারিয়ালস। যেহেতু ১ দিনে ৩শ’ আসনে নির্বাচনটা করা হয় এবং প্রতিবছর ভোটার এবং ভোটিং সেন্টার সব মিলিয়ে ৪০ হাজার ভোটকেন্দ্রে পাহারা দেয়ার জন্য যে পরিমাণ ফোর্স দরকার সেই ফোর্স কিন্তু কখনোই পাওয়া যায় না। তখন ফোর্স মাল্টিপ্লায়ার হিসেবে সেনাবাহিনীকে ডাকা হয়। সরকারের আওতায় যেহেতু আর কোনো রিজার্ভ ফোর্স নেই তাই এই সীমিত পরিসরে সেনাবাহিনীকে দিয়ে একদিনের নির্বাচন সম্পন্ন করা হয়। দ্বিতীয় কারণ পুলিশ বাহিনীসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা থাকার কথা থাকলেও প্রতিনিয়ত তারা বিশ্বাস যোগ্যতা হারাচ্ছে। কাজেই সেখানে সামরিক বাহিনীর ওপর মানুষের আস্থা রয়েছে। তাদের কেউ খুব একটা প্রভাবিত করতে পারে না। একইভাবে ম্যাজিস্ট্রেসি অর্ডারের বাইরে তাদের কোনো কার্যকারিতাও থাকে না। 

রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তোলার বিষয়ে তিনি বলেন, এর জন্য দায়ী আমাদের পলিটিক্যাল সিস্টেম ও কালচার। পলিটিক্যাল সিস্টেম গড়ে তোলার জন্য যে পদ্ধতি এখন পুরো দুনিয়াতে আছে সেগুলোতে আমরা এখনো যাই নি। আমরা সঠিক লোক নির্বাচন করে সঠিক জায়গায় দেই নি। এর কারণ হচ্ছে আমি যাকে দেবো তাকে বা সেই প্রতিষ্ঠানকে আমার মতো চলতে হবে। অন্যথায় তাকে বিতাড়ন, বা চরিত্র হনন করা হবে। এটা যদি হয় তাহলে প্রতিষ্ঠানগুলো কখনোই গড়ে তোলা সম্ভব নয়। প্রতিষ্ঠান মানে এই নয় দালানকোঠা ও বাড়ি-গাড়ি বানালাম, পতাকা দিলাম। এগুলো হচ্ছে অবকাঠামো। আমি অবকাঠামো বানালাম কিন্তু গায়ে রক্ত দিলাম না। ভাবার জন্য ব্রেইন দিলাম না। শোনার জন্য, দেখার জন্য, কথা বলার জন্য প্রয়োজনীয় সব যদি না থাকে তাহলে সুন্দর অবকাঠামো দিয়ে কি হবে? আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর সুন্দর অফিস আছে কিন্তু গায়ে রক্ত নেই, চিন্তা করার ব্রেইন নেই। 

বিরোধী রাজনৈতিক জোট ঐক্যফ্রন্টের আবির্ভাব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা নতুন কোনো বিষয় নয়। বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনের আগে ছোট ছোট দলগুলো বড় দলের সঙ্গে ভিড়ে যায়। সে হিসেবে ঐক্যফ্রন্টের বিষয়ে বলা যায় যে, এক্ষেত্রে উভয় দিকেই লাভবান হয়েছে। বিএনপির এই মুহূর্তে নেতৃত্ব নেই। সেখানে ড. কামাল হোসেনের মতো ইন্টারন্যাশনাল ফিগারের নেতৃত্ব পাওয়া অনেক বড় একটি বিষয়। তিনিও বহু আগে থেকেই রাজনীতি করতেন। এদেশের স্বাধীনতার সঙ্গে তিনি জড়িত। সবচেয়ে বড় কথা তিনি বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সহচর। তাকে নেতা হিসেবে সামনে রাখা এবং তার সঙ্গে একাত্মতা স্বীকার করা, সেদিক থেকে মনে করি ঐক্যফ্রন্টের একটি প্লাস পয়েন্ট আছে। সম্প্রতি তাদের সংলাপের কারণে রাজনীতিতে যে একটি গুমোট হাওয়া ছিল সেখানে নাড়া পড়েছে। আমরা আশাবাদী যে, তিনবারের প্রধানমন্ত্রী একটানা ১০ বছর ক্ষমতায় থাকার পরে তার অন্যান্য অবদানের মধ্যে এই সংলাপটি যদি সফল করতে পারেন সেটা হবে খুবই ভালো একটি উদ্যোগ। 

সিভিল সোসাইটি সম্পর্কে তিনি বলেন, সিভিল সোসাইটি বলতে আমরা স্বল্প পরিসরে বুঝি ১০ জন লোক টকশোতে কথা বললো তারাই সিভিল সোসাইটি। এমনটা নয়। এটা আইনজীবী থেকে শুরু করে প্রত্যেকেই যাদের কথাবার্তা ও চিন্তাধারা সমাজকে অগ্রগতির দিকে নিয়ে যাবে। সমাজের মানুষের ভালোর জন্য, গণতন্ত্রের ভালোর জন্য সরকার বা তার প্রতিষ্ঠানকে চাপ প্রয়োগ করবে- সেটাই সিভিল সোসাইটি। বাংলাদেশে সিভিল সোসাইটি গড়ে ওঠেনি কখনো। এটা শুনতে যদিও খারাপ শোনা যাবে। বাংলাদেশে যেটা গড়ে উঠেছে সেটা হচ্ছে মোরাললেস চাটুকার সোসাইটি। এবং তারা বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত। আজকে কিছু সংখ্যক লোক আছে যারা নানা ভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছে। কাজেই হয়রানির মধ্যে থেকে সিভিল সোসাইটির মুভমেন্ট হয় না। বাকিরা তো চাটুকার টাইপের। তাদের ভাব অনেকটা এমন যে, আপনি সরদার আর আমি ঝাড়ুদার। ঝাড়ু দিয়ে সব পরিষ্কার করে  দেবো। তারা খুব অল্পতেই তুষ্ট হয়ে যায়। এজন্য দোষারোপ করা যেতে পারে ১৯৭২ থেকে ’৯১-এর পরিস্থিতিকে। বঙ্গবন্ধুর সময়েও সিভিল সোসাইটির বিষয় ততোটা গুরুত্ব পায় নি। সিভিল সোসাইটি বিভিন্ন ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। কারণ হালুয়া-রুটি তাদের সামনে চলে এসেছে। সহজভাবে যদি বলি বাংলাদেশে কোনো সিভিল সোসাইটি দেখি না। অথচ পৃথিবীর বহু দেশে ঐতিহাসিকভাবে সিভিল সোসাইটির কারণে অনেক বিপ্লব এসেছে। 

অবাধ এবং বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের বিষয়ে তিনি বলেন, প্রথমত হচ্ছে রাজনৈতিক সদিচ্ছা। তারপর হচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো সেই লক্ষ্যে কাজ করা। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব হচ্ছে নির্বাচন কমিশনের। পাশাপাশি গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করার দায়িত্ব কিন্তু সরকার এবং সরকারের ইনস্টিটিউশন ও সিভিল সোসাইটির। সেটা যদি না হয় তাহলে গত ৫ বছরের মারামারি-হানাহানি, গুম-খুন ৪০ দিনে ঠিক করা যাবে না। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের কথা বলা হচ্ছে অথচ সেটা আগেই তো ছিল না। এই ৪০ দিনে কি করে হবে? পোস্টার দেখলেই তো বোঝা যায় লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডটা কোথায়? এর অন্যতম কারণ হচ্ছে এখন যোগ্যতার ভিত্তিতে নয়, টাকার মাধ্যমে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়। যার টাকা আছে সেই নির্বাচন করে। অথচ দেখা যাবে রাজনীতি বিষয়টা কি সেটাই অনেকে জানে না।
  • কার্টসিঃ মানবজমিন/ নভেম্বর ১২,২০১৮ 

একটি বিয়ে ও নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণের গল্প

আগামী একাদশ জাতীয় নির্বাচনের তফসিল চূড়ান্ত করতে একাধিক বৈঠক করেছে নির্বাচন কমিশন। বৈঠকগুলোতে কমিশনারদের তরফে তফসিলসহ ভোটগ্রহণের দিন-তারিখ নিয়ে আলাদা আলাদা প্রস্তাব আসে। প্রস্তাবিত দিন-তারিখ নিয়ে বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনা-পর্যালোচনাও হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আগামী বছরের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে ভোট গ্রহণের প্রস্তাব দেন অন্তত দুইজন কমিশনার। এর মধ্যে একজনের প্রস্তাব ছিল ভোটগ্রহণের দিন নির্ধারণ হোক ৩রা জানুয়ারি বৃহস্পতিবার। এদিকে সরকারের সঙ্গে সংলাপ চলমান থাকায় এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর তফসিল ও নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার দাবি ছিল বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর। অনেক জল্পনা-কল্পনার পর ৮ই নভেম্বর সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণের মাধ্যমে একাদশ জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নূরুল হুদা। 

ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী ভোটগ্রহণের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে ২৩শে ডিসেম্বর।

ফলে জানুয়ারিতে ভোটগ্রহণের ব্যাপারে দুই কমিশনারের প্রস্তাব নাকচ হয়ে যায়। এদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর দাবির প্রেক্ষিতে নির্বাচন পিছিয়ে জানুয়ারি মাসে ভোটগ্রহণ সম্ভব কিনা- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিলেন সিইসি। জবাবে তিনি বলেছিলেন, জানুয়ারি মাসটা অনেক ডিস্টার্বিং। এ সময় বিশ্ব ইজতেমাসহ অনেক বিষয় রয়েছে। যে কারণে জানুয়ারিতে ভোটগ্রহণ সম্ভব না। জানা গেছে, জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে ভোটগ্রহণের ব্যাপারে সরকারের তরফেও আপত্তি ছিল না। কিন্তু একটি বিয়ের কারণে এগিয়ে আনা হয় তফসিলসহ ভোটগ্রহণের দিনক্ষণ। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আগামী ৩রা জানুয়ারি নির্ধারিত রয়েছে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরীর মেয়ের বিয়ের দিনক্ষণ। এজন্য শাহাদাত হোসেন চৌধুরীর অনুরোধের প্রেক্ষিতে ডিসেম্বরে ভোটগ্রহণের পরিকল্পনা করে কমিশন। সে অনুযায়ী ২৩শে ডিসেম্বর ভোটগ্রহণের তারিখ চূড়ান্ত হয়।

এদিকে নির্বাচন একমাস পেছানোর দাবি জানিয়ে কমিশনে চিঠি দিয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। নির্বাচন এক সপ্তাহ পেছানোর দাবি জানিয়ে চিঠি দিয়েছে প্রফেসর ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টও। রোববার কমিশনে জমাকৃত এসব চিঠির ভিত্তিতে নির্বাচন পেছানো হবে কিনা এ ব্যাপারে আজ সিদ্ধান্ত নেবে কমিশন। নির্বাচন পেছানোর মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যখন কমিশন সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে তখন ব্যক্তিগত সফরে ভারতে অবস্থান করছেন নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী। তার এই বিদেশ সফর নিয়ে প্রধান হিসাবরক্ষক বরাবর একটি চিঠি পাঠিয়েছে ইসি সচিবালয়। ৩০শে অক্টোবর সিনিয়র সহকারী সচিব মো. শাহ আলম স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, আমি নির্দেশক্রমে জানাচ্ছি যে- নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী আগামী ১১ই নভেম্বর থেকে ১৪ই নভেম্বর পর্যন্ত ব্যক্তিগত সফরে ভারতে থাকবেন। চিঠিতে বলা হয়, এ সফরে শাহাদাত হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে তার স্ত্রী সারওয়াত চৌধুরী, মেয়ে চৌধুরী সায়মা তাবাসসুম ও ছেলে সাফায়াত হোসেন চৌধুরী সফরসঙ্গী হবেন। 

সফরের সকল খরচ নির্বাচন কমিশনার নিজেই বহন করবেন। এই সফর একটি ব্যক্তিগত সফর বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, বেসামরিক বিমান ও পর্যটন সচিব, অতিরিক্ত আইজিপি, ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার, ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনারসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে এই চিঠির ২৫টি অনুলিপি পাঠানো হয়। এদিকে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরীর একান্ত সচিব তকদির আহমেদ জানান, শাহাদাত হোসেন চৌধুরী সপরিবারে রোববার ভারত সফরে গেছেন। সেখানে তিনদিন অবস্থান করবেন তিনি। তকদির আহমেদ আরো জানান, শাহাদাত হোসেন চৌধুরী এখন ব্যস্ত রয়েছেন। কারণ আগামী ৩রা জানুয়ারি তার মেয়ে চৌধুরী সায়মা তাবাসসুমের বিয়ের অনুষ্ঠানের দিনক্ষণ চূড়ান্ত রয়েছে। 

  • কার্টসিঃ মানবজমিন/ নভেম্বর ১২,২০১৮ 

পরীক্ষা না দিয়েই ৩৫৩তম!


বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা তিনি দেননি। তবু প্রকাশিত ফলাফলে তাঁর মেধাস্থান ৩৫৩তম। ভর্তি হতে এসেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। প্রথমে তিনি বিষয়টি অস্বীকার করেন। প্রক্টর বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণ দেখালে একপর্যায়ে স্বীকার করেন। পরে পুলিশে সোপর্দ করা হয় রাসিক মারজান নামের ওই শিক্ষার্থীকে।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ভর্তি পরীক্ষা না দিলেও রাসিক মারজান ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় মেধাতালিকায় ৩৫৩তম হন। বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও জানত না। জালিয়াতি করে ওই শিক্ষার্থী ভর্তির মেধাতালিকায় স্থান করে নেওয়ার বিষয়টি প্রথম গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে জানতে পারেন প্রক্টর জহীর উদ্দিন আহমেদ। রোববার মেধাতালিকায় ১ থেকে ৬০০তম অবস্থানে থাকা শিক্ষার্থীদের ‘বি’ ইউনিটে (প্রকৌশল বিষয়গুলোতে) ভর্তির সাক্ষাৎকারের দিন নির্ধারিত ছিল। বিকেলে ৩৫৩তম মেধাস্থানের ক্রমিক এলে ভর্তির জন্য আসেন রাসিক মারজান। তবে তিনি এইচএসসির মূল সনদ নিয়ে আসেননি। নকল সনদ নিয়ে আসেন। প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও ভর্তি পরীক্ষা কমিটির সদস্যসচিব জহীর উদ্দিন আহমেদ জালিয়াতি করে ভর্তির হওয়ার বিষয়ে রাসিককে প্রশ্ন করলে তিনি অস্বীকার করেন। পরে প্রক্টর তাঁর মূল সনদের কপি দেখালে সেটি তাঁর বলে স্বীকার করেন। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে স্বীকার করেন, তিনি ভর্তি পরীক্ষা দেননি। পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে তিন লাখ টাকা দিয়ে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে জালিয়াতি করে এ মেধাস্থান অর্জন করেন। পরে প্রক্টর তাঁকে সিলেট নগর পুলিশের জালালাবাদ থানা–পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেন।

রাসিক মারজান রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার পীরগঞ্জ গ্রামের বাসিন্দা। তিনি রংপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে চলতি বছর এইচএসসি পাস করেন।

প্রক্টর জহীর উদ্দিন আহমেদ বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ওই শিক্ষার্থী জালিয়াতির বিষয়টি স্বীকার করলে তাঁকে পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পুলিশে সোপর্দ করা হয়।

মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে জালালাবাদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহ মো. হারুনুর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আটক করে ওই শিক্ষার্থীকে আমাদের হেফাজতে দিয়েছে। পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটে রাসিকের নামে মামলা আছে। সাইবার ক্রাইম ইউনিটের সদস্যরা ঢাকা থেকে আসছেন। তাঁদের হাতে তাঁকে তুলে দেওয়া হবে।’

  • কার্টসিঃ প্রথম আলো/ নভেম্বর ১২,২০১৮ 

গাড়ির চেয়ে সাইকেলের গতি বেশি!

  • পিক আওয়ারে সাইকেলের গতি থাকে ঘণ্টায় সাড়ে ১০ কিলোমিটার।
  • একই সময় গাড়ির গতি থাকে ৭ কিলোমিটারের কম।
  • সাইকেলের মাধ্যমে বছরে জনপ্রতি গড়ে সাশ্রয় ২৪ হাজার টাকা।



দুর্বিষহ হয়ে উঠছে ঢাকার যানজট। অবস্থা এমন হয়েছে যে বাইসাইকেলও চলে গাড়ির আগে। যে কারণে নগরবাসীর অনেকে এখন সাইকেলে ঝুঁকছেন। সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থীদের করা এক গবেষণা ও বিশ্বব্যাংকের গত বছরের এক প্রতিবেদন থেকে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ঢাকায় যানবাহনের গড় গতিবেগ ঘণ্টায় সাত কিলোমিটারেরও কম। যানজট নিরসনের উদ্যোগ না নেওয়া হলে সাত বছর পর মানুষও হাঁটবে গাড়ির আগে। আর বুয়েটের শিক্ষার্থীদের গবেষণা অনুযায়ী, ঢাকায় সাইকেলের গড় গতিবেগ ঘণ্টায় ১০ দশমিক ৬৪ কিলোমিটার। ঢাকার ছয়টি প্রধান বাণিজ্যিক এলাকায় অফিসগামী ৩০০ সাইকেল আরোহীর ওপর জরিপ করে এই গতিবেগ পাওয়া গেছে। সাইকেলচালকদের ৩৬ শতাংশ বলছেন, দ্রুত যাওয়া যায় বলে তাঁরা অফিস যাতায়াতে সাইকেল ব্যবহার করছেন। এ ছাড়া আর্থিক, স্বাস্থ্যগত, বাসের অপ্রতুলতা ও নিরাপত্তাও রয়েছে সাইকেল ব্যবহারের পেছনে। গবেষণাটি করেছেন বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষার্থী আহমেদ ইলদেরীম তকী ও শেফা আরাবায়ি শিয়োমা।

ছয় মাস ধরে ঢাকায় সাইকেল চালান ফখরুল ইসলাম। কারওয়ান বাজারে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন তিনি, থাকেন মিরপুরে। ফখরুল বলেন, প্রতিদিন সকালে বাসের জন্য ১৫-২০ মিনিট অপেক্ষা করতে হতো। ঠাসাঠাসি করে বাসে উঠতে ও মিরপুর থেকে কারওয়ান বাজারে আসতে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা সময় লাগত। সন্ধ্যায় ফেরার সময়ও একই অবস্থা হতো। দ্রুত যাতায়াতের জন্য তিনি সাইকেল ব্যবহার শুরু করলেন। এখন ৩০ থেকে ৪৫ মিনিটে তিনি যাতায়াত করতে পারেন।

বুয়েটের গবেষক আহমেদ ইলদেরীম তকী প্রথম আলোকে বলেন, গবেষণায় সাইকেলের গড় গতিবেগ নির্ধারণ করা হয়েছে পিক আওয়ারে (অফিস যাতায়াতের সময়)। এ সময় গাড়ির চেয়েও গতি বেশি থাকে সাইকেলে। তিনি বলেন, গবেষণায় অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে উচ্চ বেতনে চাকরি করেন এমন সাইকেলচালকও ছিলেন। তাঁরা মূলত সময় বাঁচাতে ও স্বাস্থ্যগত কারণে সাইকেল চালান। আর নিম্ন আয়ের লোকজন সাইকেল চালান টাকা বাঁচাতে।

গবেষণায় বলা হয়েছে, অন্য যানবাহনের তুলনায় অফিস যাতায়াতে সাইকেল ব্যবহার করলে বছরে জনপ্রতি গড়ে প্রায় ২৪ হাজার টাকা সাশ্রয় হয়। যাঁরা বেশি আয় করেন ও যাতায়াতের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করেন, তাঁদের ক্ষেত্রে সাশ্রয় আরও বেশি হবে।

গবেষণায় বাইসাইকেল পার্কিংয়ের সমস্যাটি উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, মিরপুর, কারওয়ান বাজার, গুলশান, বনানী, মতিঝিল, মিরপুর, পুরান ঢাকা ও মহাখালী এলাকায় গড়ে মাত্র ২৮ শতাংশ অফিসে সাইকেল পার্কিংয়ের সুবিধা আছে।

ইলদেরীম তকী নিজেও ঢাকায় পাঁচ-ছয় বছর ধরে সাইকেল চালান। তিনি বলেন, পার্কিং সমস্যাটিই প্রধান সমস্যা। তা ছাড়া এ ব্যাপারে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিও খারাপ। তিনি বলেন, কেউ সাইকেল ব্যবহার করলে তাঁকে অনেকেই নিম্নবিত্তের মনে করেন। ফলে পার্কিংয়ের সময় দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা অনেক সময় খারাপ ব্যবহার করেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে।

পার্কিং ছাড়াও সাইকেলের জন্য পৃথক লেন না থাকা, অনিরাপদ সড়ক, মোটরযানের মাধ্যমে বায়ু ও শব্দদূষণসহ আরও কিছু সমস্যার কথা জানিয়েছেন সাইকেল ব্যবহারকারীরা।

নগরবাসীর অনেকে এখন সাইকেলে ঝুঁকছেন। তবে পৃথক লেন ও পার্কিংয়ের ব্যবস্থা থাকলে সাইকেলের ব্যবহার বাড়বে।

নগর পরিকল্পনাবিদেরা বলছেন, উন্নত দেশগুলোতে হাঁটাপথ (ফুটপাত), সাইকেল লেন ও গণপরিবহন চলার মূল রাস্তা—তিনটিই সমান গুরুত্ব পায়। কিন্তু আমাদের দেশে পরিবেশবান্ধব ও স্বাস্থ্যসম্মত বাহন সাইকেলের বিষয়টি মাথায় না রেখেই সব রাস্তা বানানো হয়েছে। পরিকল্পিতভাবে এই অবস্থার পরিবর্তন করতে হবে। নতুন যেসব রাস্তা করা হচ্ছে, সেসব রাস্তায় অবশ্যই সাইকেলের জন্য পৃথক লেন রাখতে হবে।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, উত্তর সিটি করপোরেশন গুলশান, বনানী ও মিরপুরের জিল্লুর রহমান ফ্লাইওভার (মিরপুর-এয়ারপোর্ট রোড) থেকে ডিওএইচএস পর্যন্ত সাইকেল লেন করার উদ্যোগ নিয়েছে। উত্তরার একটি পার্কে সাইকেল লেন বানানো হয়েছে, আরও তিনটি পার্কে লেন তৈরির কাজ চলছে। তবে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে এমন কোনো উদ্যোগ নেই।

গবেষক আহমেদ ইলদেরীম তকী বলেন, ২০০৮-০৯ সাল থেকে সাইকেলের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। গবেষণায় তাঁরা পার্কিং সমস্যার সমাধান, পৃথক লেনসহ কিছু সুপারিশ করেছেন। এগুলো বাস্তবায়ন হলে সাইকেলের ব্যবহার আরও বাড়বে।

  • কার্টসিঃ প্রথম আলো/ ১২ নভেম্বর ২০১৮