সম্পাদকীয়
সিএলসি পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড নামের একটি ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সরকারের সঙ্গে জালিয়াতি করে ভাড়া বাবদ গত এক বছরে প্রাপ্য অর্থের চেয়ে ১১ কোটি টাকা বেশি আদায় করেছে। সরকারের সঙ্গে জালিয়াতি করা সহজ নয়, সবাই তা করতে পারে না। যারা পারে, তাদের নানা রকমের জোর থাকে: টাকার জোর, রাজনৈতিক ক্ষমতার জোর ইত্যাদি। দেখা যাচ্ছে, সিএলসি পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের মালিক ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাংসদ আসলামুল হক। ঢাকার কেরানীগঞ্জের বছিলায় অবস্থিত তাঁর এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি সেইসব বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের অন্যতম, যেগুলোতে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় সরকারের সরবরাহ করা তেল বা গ্যাস ব্যবহার করে। সরকার এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে তেল–গ্যাস সরবরাহ করে বিনা মূল্যে। অর্থাৎ এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের জ্বালানি বাবদ কোনো অর্থ ব্যয় করতে হয় না, তাঁরা বিদ্যুৎ উৎপাদন করেন নিখরচা। সেই বিদ্যুৎ সরকার তাঁদের কাছ থেকে কিনে নেয়। সরকার তাঁদের বিদ্যুতের দাম তো পরিশোধ করেই, উপরন্তু বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণের জন্যও অর্থ দেয়। শুধু তা–ই নয়, বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদনক্ষমতা অনুযায়ী ভাড়াও তাঁরা পেয়ে থাকেন, যেটাকে বলা হয় ক্যাপাসিটি পেমেন্ট।
সাংসদ আসলামুল হকের মালিকানাধীন সিএলসি পাওয়ার কোম্পানি সরকারের কাছ থেকে এই ক্যাপাসিটি পেমেন্ট আদায় করার ক্ষেত্রে অনৈতিক পন্থা অবলম্বন করেছে। এই অভিযোগ পাওয়া গেছে সরকারি সংস্থা পিডিবির সূত্র থেকে, যেটি বেসরকারি মালিকানাধীন রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট বা ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ গ্রাহকদের মধ্যে সরবরাহ করে। দাবি করা হয়, উল্লিখিত বিদ্যুৎকেন্দ্রটির উৎপাদনক্ষমতা ১০৮ মেগাওয়াট। কিন্তু পিডিবির সূত্র বলছে, এটি কখনোই ১০৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারেনি।
গত বছরের জানুয়ারি মাসে সর্বোচ্চ গড় দৈনিক উৎপাদন হয়েছে ২ তারিখে, পরিমাণ ছিল ৮১ দশমিক ৭২ মেগাওয়াট। আর ফেব্রুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সর্বোচ্চ গড় দৈনিক উৎপাদন ছিল ৯৮ দশমিক ১৮ মেগাওয়াট। ইউনিটভিত্তিক ক্যাপাসিটি পেমেন্টের হিসাবে গত বছর বিদ্যুৎকেন্দ্রটির পাওনা হয়েছিল ৮০ কোটি ৫০ লাখ টাকা। কিন্তু কেন্দ্রটি নিয়েছে ৯১ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রায় ১১ কোটি টাকা অতিরিক্ত নেওয়া হয়েছে অন্যায্যভাবে।
কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব হলো? গত শনিবার এ বিষয়ে প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেল, পিডিবির সচিব মিনা মাসুদ উজ্জামান গত বছরের ৯ মার্চ এই মর্মে ঘোষণাপত্র দিয়েছেন যে সিএলসি পাওয়ার কোম্পানির বিদ্যুৎকেন্দ্রটির উৎপাদনক্ষমতা ১০৮ মেগাওয়াট। কিন্তু তা যে সত্য নয়, তা তো পিডিবির হিসাবেই প্রমাণিত।
কিংবা বলা যেতে পারে, প্রকৃত উৎপাদনক্ষমতা যতই হোক না কেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বাস্তবে কখনোই ১০৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারেনি। মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে তাদের ১১ কোটি টাকা অতিরিক্ত নেওয়ার দায় অবশ্যই পিডিবির ওপরও বর্তায়। পিডিবির সচিব এই দায় চাপাতে চেয়েছেন সংস্থাটির কারিগরি টিমের ওপর। কিন্তু সে সুযোগ একদমই নেই। পিডিবির সংশ্লিষ্ট সবাইকে দায়িত্ব নিতে হবে, জবাবদিহি করতে হবে; অনৈতিকতার চর্চা হয়ে থাকলে তাঁদের শাস্তির পদক্ষেপ নিতে হবে। সর্বোপরি, বিদ্যুৎকেন্দ্রটিকে যে অতিরিক্ত ১১ কোটি টাকা ভাড়া বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে, তা ফেরত নিতে হবে।
সাংসদ আসলামুল হকের মালিকানাধীন আরও দুটি কোম্পানি দুটি ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি পেয়েছে যথাক্রমে ২০১১ ও ২০১২ সালে। এক বছরের মধ্যেই সেগুলোর নির্মাণকাজ শেষ করার বিধান ছিল, কিন্তু এই দীর্ঘ সাত–আট বছরে উভয় বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাত্র ৫ শতাংশ নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। বিধান অনুযায়ী সেগুলোর অনুমোদন বাতিল এবং কোম্পানি দুটির কাছ থেকে জরিমানা আদায় করা হোক।
- কার্টসিঃ প্রথম আলো/ নভেম্বর ২৭,২০১৮