এবারের নির্বাচনে ‘মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মের ব্যবহার’ নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনকে মতামত জানিয়েছেন দেশের তিন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব লেখক-গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ, মানবাধিকারকর্মী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামাল এবং অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।
বিশিষ্ট লেখক, গবেষক ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘এখন তো নির্বাচনকালীন পরিবেশ, এখন মানুষ চায় ভিন্ন কিছু। উচ্চশিক্ষিত তরুণদের কাছে ভবিষ্যৎ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে যখন বড় কোনো লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থাকে না, তখন তারা এ বিষয়গুলোকে পুঁজি করে।’
‘আসলে মানুষ তার নিজের ভবিষ্যৎ নিয়েই সবচেয়ে বেশি সচেতন। জাতির অগ্রগতি ও মর্যাদা বাড়ানোর যে বিষয়, এখন সেগুলো তো কোনো অর্থ বহন করছে না। ধর্ম হলো অনন্তকালের বিষয়। এর কোনো নতুন ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। আর মুক্তিযুদ্ধ একটি গৌরবজনক বিষয়। একটা স্বাধীন জাতি যে নতুন সভ্যতায় গড়ে উঠবে, একটা গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা হলে সেখানে সবকিছুই সুষ্ঠুভাবে থাকে। ধর্মেরও স্বাধীনতা থাকে, মুক্তিযুদ্ধেরও চেতনা থাকে,’বলেন সৈয়দ আবুল মকসুদ।
‘নির্বাচনের সময় এই দুটি বিষয়ের ব্যবহার আমার কাছে অর্থহীন মনে হয়। এগুলো প্রতি মুহূর্তের ব্যাপার। নির্বাচন আসলে এর ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার মানেই হচ্ছে এটি উদ্দেশ্য প্রণোদিত। নির্বাচনের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্কই নেই। ধর্ম এবং মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করে ভোট চাওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই।’
এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বলেন, ‘আগে একপক্ষ ধর্মকে ব্যবহার করতো আর একপক্ষ মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করতো। এখন বোধহয় উভয়পক্ষই রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে দুটোই ব্যবহার করছে। নির্বাচনের সময় ধর্ম ও মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহারের প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি একবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত।’
তার মতে, ‘রাজনৈতিক দলগুলো দেউলিয়া হয়ে গেছে। তারা নিজেদের আদর্শ নিয়ে কোনো কথা বলে না, ইশতেহারের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে কী করবে তা বলা হয় না। তারা শুধু বলে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করব। কিন্তু, সেটা আসলে কী? এই চেতনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আবার তারা যা বলে এবং করে, তাও কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়ায়।’
‘তার মানে, দলগুলো নিজেরা ভীষণ হতবিহ্বল অবস্থার মধ্যে বাস করছে এবং জাতিকেও ঘোল খাওয়াচ্ছে। আমার মতে, জনগণের সঙ্গে এই অবিচার অপরাধের শামিল। তারা জনগণকে কোনো সুস্পষ্ট ধারণা দিতে পারছে না। ফলে জনগণও নির্বাচনে নিজেদের পছন্দের রায় দিতে পারে না। খালি বুথে গিয়ে ভোট দিতে পারলেই তো আর নির্বাচন সুষ্ঠু হয়ে যায় না। নির্বাচনের পলিসি, লক্ষ্য ও ভিশন থাকে, যা রাজনৈতিক দলগুলো ঘোলাটে করে দেয়। এই কাজের মাধ্যমেই তারা ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে চায় কিংবা ক্ষমতায় যেতে চায়। এটাই তাদের চতুর কৌশল, যেখানে কোনো স্বচ্ছতার বালাই থাকে না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘নির্বাচনকালীন সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ধর্ম এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ব্যবহার করার বিষয়টি একাকার হয়ে যায়নি। বিএনপির মৌলিক দর্শন পরিবর্তন হয়নি ঠিকই তবে আমার কাছে অবাক লাগছে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অনেকেই প্রকাশ্যে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেক সুন্দর সুন্দর কথা বলেন। এবার ‘ধানের শীষ’ প্রতীক নিয়ে তারা কী বলেন সেটিই এখন দেখার বিষয়।’
তার মতে, ‘আওয়ামী লীগের যে একটা সেক্যুলার চিন্তা-ভাবনা ছিল, তারও পরিবর্তন হয়েছে এবং সেটি পরিস্থিতির কারণে। তারা বুঝতে পারছে, ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে সঙ্গে না নিলে জনমনে আশঙ্কা থেকেই যাবে যে, আওয়ামী লীগ ধর্মবিরোধী দল।’
‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা ধর্ম নিয়ে এখন বড় কোনো বিতর্ক হচ্ছে না, তার তিনটি কারণ হচ্ছে, গত ১০ বছরে বিএনপির ভেতরেও একটি চিন্তা ভাবনা এসেছে। বিএনপি বুঝতে পারছে এখন তারা পুরনো রাজনীতিতে আর থাকতে পারবে না। তাদের কৌশল পরিবর্তন করতে হবে। আর এখন যদি বলা হয় যে, আওয়ামী লীগ ধর্মবিরোধী দল, তাহলে তা আর হালে পানি পাবে না। হেফাজত ইসলাম জনসভা করে প্রধানমন্ত্রীকে যেভাবে সংবর্ধনা দিল তাতে প্রমাণিত হয় যে আওয়ামী লীগকে নিয়ে তাদের মনেও কোনো ভয় নেই।’
তিনি মনে করেন, ‘এটি আওয়ামী লীগের জন্য ক্ষতিকর, যে তারা আদর্শের বিরুদ্ধে যাচ্ছে। কিন্তু, ভোটের যুদ্ধে এটি কাজে দিতে পারে। আমি এটিকে আদর্শগত পরিবর্তন বলছি না, এর মাধ্যমে রাজনৈতিক কৌশলের পরিবর্তন হয়েছে। আবার এটিও হতে পারে যে, আওয়ামী লীগের তরুণ প্রজন্মও এখন এই বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবেই নিচ্ছে।’
‘অপরদিকে, আওয়ামী লীগের পক্ষেও এখন বলা সম্ভব হবে না যে, বিএনপি একেবারে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দল। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে এক জোটে নির্বাচন করায় তাদের কিছুটা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে। তারা বঙ্গবন্ধুকে স্বীকার করছে এবং পরবর্তীতেও করবে বলে মনে হচ্ছে। জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল হয়েছে, এটা বিএনপির জন্য সাপে বর হয়েছে। এখন তারা জামায়াতের সঙ্গে ঐক্য করছে না। তারা ঐক্য করছে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তির সঙ্গে।’
‘তিন নম্বর কারণ হচ্ছে, বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিএনপি বুঝতে পারছে, একটা অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি পশ্চিমের দেশগুলো চায়। পশ্চিমে যেহেতু জঙ্গিবিরোধী মনোভাব প্রবল, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি পশ্চিমের জন্য অন্তত গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না। ফলে, বিএনপিকেও তাদের অতীত অবস্থান পরিবর্তন করতে হবে। ওরা আর ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করতে পারবে না,’ যোগ করেন সৈয়দ মনজুর।
তিনি মনে করেন, ‘প্রায় আড়াই কোটির মতো তরুণ ভোটার, এরা একেবারেই ভিন্ন প্রজন্মের মানুষ। এরা অতীত নিয়ে ঘাটাঘাটি, বিভিন্ন চেতনা নিয়ে চিৎকার, বঙ্গবন্ধুকে অসম্মান করা ও মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে নেতিবাচক কথা বলা একেবারেই পছন্দ করে না। এটা তো অস্বীকার করতে পারবে না বিএনপি। যার ফলে তারা এই বাস্তবতা মেনে নিয়েছে। এটাও কৌশল। কিন্তু, এই কৌশলটাও যদি ভালোভাবে প্রয়োগ করা যায়, একসময় সেটাও আদর্শে পরিণত হতে পারে।’
- Courtesy: The Daily Star/ Bangla online/ Nov 26, 2018