সম্পাদকীয়
অর্থ পাচার, শুল্ক ফাঁকিসহ নানা অসদুদ্দেশ্যে বিল অব লেডিং, এয়ারওয়ে বিল, ট্রাক রিসিপ্টের মতো জরুরি নথি বা দলিল জালিয়াতির আশ্রয় নিচ্ছেন একশ্রেণীর ব্যবসায়ী। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ব্যাংকে জমা দেয়া পরিবহন-সংক্রান্ত নথির ২৫ শতাংশের ক্ষেত্রেই মূল কপি ও অনুলিপির মধ্যে অমিল পাওয়া যায়। কার্গো ক্যারিয়ার বা পণ্য পরিবহন সংস্থার পরিচিতি নিয়ে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয় ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে। ৮০ শতাংশ বিল অব লেডিংয়ের যথার্থতা নিয়ে চ্যালেঞ্জের সামনে পড়তে হয় ব্যাংকারদের। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বেড়ে ওঠার পাশাপাশি নানা ধরনের জালিয়াতির ঘটনাও বেড়ে উঠছে। এসব রোধে বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড নানা উদ্যোগ নিলেও জালিয়াতির ধরনে পরিবর্তন আসায় এক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত সুফল মিলছে না। অনেক সময় ব্যাংকারও সেসব জালিয়াতি সম্পর্কে অবগত না হওয়ায় প্রতিষ্ঠানও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। রাষ্ট্র বঞ্চিত হচ্ছে প্রত্যাশিত রাজস্ব আহরণ থেকে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে পণ্য পরিবহন ব্যবস্থায় বিশ্বব্যাপী চ্যালেঞ্জ বেড়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকারদের আরো সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। বিশেষ করে বিল অব লেডিং, এয়ারওয়ে বিল, ট্রাক রিসিপ্টের ক্ষেত্রে সতর্ক হতে হবে। বৈদেশিক বাণিজ্যে জালজালিয়াতি প্রতিরোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, শুল্ক বিভাগ, ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার, শিপিং লাইন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে কমিটি গঠনের পক্ষে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। সেটিও আমলে নিতে পারে কর্তৃপক্ষ। বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্রেডিট রিপোর্টের জন্য একটি সেন্ট্রাল তথ্যভাণ্ডার (ডাটাবেজ) তৈরি করতে পারলে ঝুঁকি ও খরচ অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। সেন্ট্রাল ডাটাবেজ থাকলে কোনো ভুয়া ক্রেডিট রিপোর্ট সরবরাহের সুযোগ থাকবে না। এতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ব্যাংক খাতের ঝুঁকি অনেকাংশে কমে আসবে; কমবে অনিয়ম ও জালিয়াতির ঘটনাও।
বৈদেশিক বাণিজ্য ঘিরে জালিয়াতি ও অর্থ পাচারের প্রবণতা বেড়ে উঠছে দেশে। গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী অর্থ পাচারের ৮৩ শতাংশ হয় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে। ব্যাংক সতর্ক থাকলে কোনো অনিয়ম ঘটার সুযোগ নেই। বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার কতটা বেড়েছে, তা আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট। রেকর্ড বাণিজ্য ঘাটতির পেছনেও অর্থ পাচার দায়ী বলে মনে করা হচ্ছে। অর্থ পাচারের সম্ভাব্য পথ অনুসন্ধান এবং তা বন্ধে সরকারের আরো সতর্ক হওয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগগুলো প্রত্যাশিত ফল লাভে সফল হয়নি। এর পেছনে অবশ্য নীতিমালার যথাযথ প্রয়োগের অভাবই দায়ী। ব্যাংকগুলোর উচিত বৈদেশিক বাণিজ্যের যাবতীয় নথি পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাই করে দেখা। অধিকাংশ ব্যাংক ক্লায়েন্ট বেজড তথ্য যাচাই-বাছাই করে। ফলে অনেক ব্যবসায়ী মিথ্যা বা ভুয়া তথ্যের আশ্রয় নিয়ে অর্থ পাচার ও শুল্ক ফাঁকি দিচ্ছেন। এমন প্রবণতা বন্ধে ব্যাংকগুলোকে আরো সতর্ক হতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত কেস টু কেস বা পর্যায়ক্রমিকভাবে ব্যাংকের বৈদেশিক বাণিজ্যের নথি পর্যালোচনার প্রতিবেদন খতিয়ে দেখা, কোথাও গরমিল দেখা গেলে অধিক যাচাইয়ের মাধ্যমে ব্যাংকের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশ ব্যাংক বা ব্যাংকের একার পক্ষে বৈদেশিক বাণিজ্যের নথি ঘিরে জালিয়াতি ও অর্থ পাচার বন্ধ করা সম্ভব নয়। এজন্য সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। বৈদেশিক বাণিজ্যে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার সুযোগও নিয়ে থাকেন একশ্রেণীর ব্যবসায়ী। এক্ষেত্রে বৈদেশিক বাণিজ্যকে আরো মসৃণ করতে প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি ও তদারকি জোরদার করা জরুরি। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো কীভাবে বৈদেশিক বাণিজ্যকে আরো গতিশীল ও স্বচ্ছ করেছে, তা অনুসরণ করতে পারে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআরসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা যেতে পারে। যাদের কাজ হবে বৈদেশিক বাণিজ্যের জালিয়াতির ফাঁকফোকর খুঁজে বের করে তা বন্ধে সুপারিশ করা। তবে এসবের আগে প্রয়োজন সুশাসন নিশ্চিত করা। বৈদেশিক বাণিজ্যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা গেলে এ ধরনের অপরাধপ্রবণতাও কমে আসবে বৈকি।
- কার্টসিঃ বণিক বার্তা/ ০৪ ডিসেম্বর ২০১৮