Search

Tuesday, December 4, 2018

ক্ষমতায় থাকলে সম্পদ বাড়ে

সম্পাদকীয়


উচ্চ আদালতের নির্দেশে যেকোনো নির্বাচনে প্রার্থীদের হলফনামায় সম্পদের বিবরণীসহ আটটি তথ্য দেওয়া বাধ্যতামূলক। এই তথ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা, তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত কি না, অতীতে কোনো মামলা ছিল কি না; সেই সঙ্গে পেশা ও আয়ের উৎস, ব্যাংকে বা ব্যক্তিগত পর্যায়ে দায়দেনা আছে কি না, সেসবও প্রার্থীকে জানাতে হয়। সেদিক থেকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীরা যে হলফনামা দিয়েছেন, তা নতুন কিছু নয়।

প্রার্থীদের হলফনামায় এ কথাও লিখতে হয়ে যে ‘আমি শপথপূর্বক বলিতেছি যে এই হলফনামায় প্রদত্ত তথ্য এতৎসঙ্গে দাখিলকৃত সকল দলিল-দস্তাবেজ আমার জ্ঞান ও বিশ্বাসমতে সম্পূর্ণ সত্য ও নির্ভুল।’ তবে সেই নির্ভুল হলফনামা কতটা নির্ভুল, সে বিষয়েও সন্দেহমুক্ত হওয়া যাচ্ছে না। দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন, যাঁরা হলফনামায় ভুল তথ্য দেবেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের আগে প্রার্থীদের হলফনামা পরীক্ষা-নিরীক্ষার কোনো ব্যবস্থা এই প্রতিষ্ঠানের আছে কি না, সেই প্রশ্নও আছে। কোনো কোনো সম্পদের যে দাম উল্লেখ করেছেন, তা অবিশ্বাস্যভাবে কম। তারপরও প্রার্থীদের সম্পদ ও আয়–বৃদ্ধির হারে পাঁচ-দশ গুণ হওয়া স্বাভাবিক বলা যাবে না।

হলফনামার সাধারণ ধারা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সরকারি দলের প্রার্থীদের সম্পদের পরিমাণ অনেক গুণ বেড়ে যায়, আর বিরোধী দলে থাকলে মামলার সংখ্যা। কোনো কোনো প্রার্থীর সম্পদ পাঁচ বছরে পাঁচ গুণ বা দশ গুণ হওয়া মোটেই স্বাভাবিক নয়। এই ঘটনা শুধু বর্তমান সরকারের আমলে ঘটেছে তা-ই নয়, বিএনপির আমলেও এর এন্তার নজির রয়েছে। আবার বিরোধী দলে থাকতে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা, রাজনৈতিক মামলা দায়ের করার অভিযোগ এনে থাকে, ক্ষমতায় গিয়ে তারাও একই কাজ করে। ক্ষমতায় এসে তাদের প্রথম কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় রাজনৈতিক মামলা পর্যালোচনার নামে একটি কমিটি করে দলীয় নেতা-কর্মীদের মামলাগুলো দ্রুত তুলে নেওয়া। আওয়ামী লীগ সরকার একটানা ১০ বছর ক্ষমতায় আছে। এ কারণে বিরোধী দলের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যাও বহু গুণে বেড়ে গেছে। উদাহরণ হিসেবে বিএনপির চেয়ারপারসনের বিরুদ্ধে ৩০টি ও মহাসচিবের বিরুদ্ধে ৪৬টি মামলার কথা উল্লেখ করা যায়।

আমাদের জনপ্রতিনিধিদের সম্পদ যখন জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে, তখন সাধারণ মানুষের আয় কতটা ও কী হারে বাড়ছে, সেটাও পরখ করে দেখা প্রয়োজন। সম্প্রতি তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের জন্য যে নতুন মজুরি ঘোষণা করা হয়েছে, তাতে দেখা যায় পাঁচ বছরে তাঁদের মজুরি বেড়েছে মাত্র ৪৩ শতাংশ। বছর হিসাবে ৯ শতাংশেরও কম। মূল্যস্ফীতির হার বিবেচনায় নিলে শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি এক পয়সাও বাড়েনি। অথচ যাঁরা তাঁদের জনপ্রতিনিধি হবেন, তাঁদের সম্পদ ও আয় বেড়েছে বহু গুণ।

এবারের হলফনামায় আরও যে তথ্য বেরিয়ে এসেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে বিরোধী দলে থেকেও কোনো কোনো সাংসদ শতকোটি টাকারও বেশি সম্পদ করেছেন। উদাহরণ হিসেবে দশম জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ ও তাঁর স্বামী হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের কথা উল্লেখ করা যায়। আরও মজার বিষয় হলো, এরশাদের চেয়ে রওশনের সম্পদের পরিমাণ বেশি। এটি আরও অনেক ভিভিআইপি প্রার্থীর ক্ষেত্রে ঘটেছে। 

সম্প্রতি এক সেমিনারে বক্তারা যে রাজনীতিকে বড় লাভজনক ব্যবসা বলে অভিহিত করেছেন, এটি যেন তারই বাস্তব রূপ। জনপ্রতিনিধিরা না খেয়ে জনগণের সেবা করবেন, সেটি কেউ আশা করেন না। কিন্তু তাঁদের আয়-উন্নতি সাধারণ মানুষের আয়ের ধারার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। 

  • কার্টসিঃ প্রথম আলো/ ০৪ ডিসেম্বর ২০১৮ 

No comments:

Post a Comment